সাবের খানিক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। এক সময় চোখ মেলে বলল, ওরা বলেছে ওরা অসম্ভব কষ্ট পাবে।
‘তাহলে ওদের আপনি বলুন না – আপনাকে মুক্তি দিতে। ওদের তাে ক্ষণস্থায়ী জীবন। সেই জীবন তাে ওরা ভােগ করল – আর কত।
‘বলব?” ‘হ্যা বলুন?” ‘এটা বলতে লজ্জা করছে।” ‘লজ্জার কিছু নেই, আপনি বলুন।
সাবের চোখ বন্ধ করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে বলল, ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে। ওরা চায় না আমার মৃত্যু হােক।
‘এখন তাহলে অষুধ খাবেন?
‘অষুধ খেতে হবে না। ওরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করবে। ওদের সে ক্ষমতা আছে। আচ্ছা আমি যেসব কথাবার্তা বলছি তা কি আপনি বিশ্বাস করছেন?”
করছি। অবশ্যই করছি। ভাই, আমি তাহলে যাই? ‘কোথায় যাবেন ? ‘জানি না। ‘আমার মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ুন আহমেদ
হতেও পারে, কিছুই বলা যায় না। এই জগৎ বড়ই রহস্যময় – ভাই, আমি যাই। সূর্য ওঠার আগে আমাকে বিদেয় হতে হবে।
মিস্টার আগস্ট ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র সাবের তার মাকে ডেকে তুলল। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, এক কাপ চা খাওয়াতে পার, মা।।
সুরমা ছেলের গায়ে হাত রাখলেন। জ্বর নেমে গেছে। সাবেরের মুখ হাসি–হাসি।
‘মা, কড়া করে চা বানাবে। নােন্ত বিকিট থাকলে চায়ের সঙ্গে নােন্তা বিসকিট দিও – প্রচণ্ড ক্ষিদে লেগেছে।
হরিপ্রসন্ন বাবু ঘুমিয়ে ছিলেন। মিস্টার আগস্ট তাকে ডেকে তুলে বলল, আপনার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি
– আমি কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হব। বেশ কয়েকদিন আপনার সঙ্গে একসঙ্গে কাটালাম। কথাবার্তা তেমন হয় নি। হলে ভাল লাগতাে।
হরিপ্রসন্ন বাবু বললেন, রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছেন? ‘আসতে হয় দিনে – যাবার জন্যে তাে রাতই ভাল। ‘আপনার কথা বুঝলাম না। ‘কথার কথা বলেছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সরি, ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ‘না, না, অসুবিধা নাই। ‘আচ্ছা ভাল কথা – আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে?
দুই দুয়ারী-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ুন আহমেদ
হরিপ্রসন্ন বাবু চমকে উঠে বললেন, আমি ! আমি কোথায় যাব? না, না, কি বলছেন আপনি?
‘আপনি রাজি থাকলে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। ‘আরে না। ‘আচ্ছা, ভাই, তাহলে ঘুমান। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। চাদরটা গায়ে দিয়ে নিন। মিস্টার আগস্ট দরজা ভেজিয়ে বারান্দায় এল।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে সে নেমে গেল নিঃশব্দে। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেত – দোতলার বারান্দা থেকে মতিন সাহেব তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
কুড়ি বছর পরের কথা।
আমেরিকার মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটি কফি শপে একজন বাংলাদেশী ছাত্রীকে বসে থাকতে দেখা
যাচ্ছে। তার হাতে কফির মগ। টেবিলে স্থানীয় পত্রিকা বিছানাে। মেয়েটি অলস ভঙ্গিতে পত্রিকার বিজ্ঞাপনগুলি দেখছে। মেয়েটির নাম মিতু। সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইভার অপটিকস–এ পােষ্ট ডক করছে। একা একা থাকে। বেশীর ভাগ সময়ই তাকে খুব বিষন্ন দেখা যায়। জীবন তার প্রতি খুব সুবিচার করেনি। আমেরিকায় পড়তে আসা তার এক ধরনের স্বেচ্ছা নির্বাসন।
মিতু বিজ্ঞাপন পড়তে পড়তে হঠাৎ চমকে উঠল। এতটা চমকাল যে হাতের কফির মগ থেকে গরম কফি ছিটকে পড়ল গায়ে। চব্বিশ–পঁচিশ বছরের একজন হাসিখুশী যুবকের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে লেখা – এই যুবকটি নিম্ন ঠিকানায় আছে। যুবকটি এক ধরনের এ্যামনেশিয়ায় ভুগছে। পুরােনাে স্মৃতি মনে নেই। তার কোন খোজ–খবর বের করা যাচ্ছে না। যদি কেউ এই যুবকটি সম্পর্কে কিছু জানেন তাহলে যােগাযােগ করতে অনুরােধ করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপন দিয়েছে স্টেট পুলিশ।
দুই দুয়ারী-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ুন আহমেদ
যুবকটির ছবির দিকে মিতু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।
মিতু তাকে চেনে – তার নাম মিস্টার আগস্ট। এ ব্যাপারে মিতুর মনে কোন সন্দেহ নেই । মিতু পত্রিকা হাতে উঠে দাঁড়াল। চোদ্দ নম্বর পুলিশ প্রিসিংক্ট–এ যুবকটি আছে। উনিশ ডাউন শ্রটি – নর্থ। এই হল ঠিকানা। কতক্ষণ লাগবে সেখানে যেতে? বড়জোর কুড়ি মিনিট। মিতুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।
যুবকটির মুখােমুখি দাঁড়িয়ে মিতু খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। নীল চোখ এবং সােনালী চুলের একজন আমেরিকান যুবক তার সামনে বসে আছে। যুবকটির চোখে মুখে চাপা হাসি। মিতু নিশ্চিত যে, সুদূর শৈশবে দেখা মিস্টার আগস্টের সঙ্গে এই যুবকের চেহারার অসম্ভব মিল — তবু এই আমেরিকান যুবক মিস্টার আগস্ট হতে পারে না। পুলিশের জনৈক কর্মকর্তা বললেন, মিস আপনি কি এই যুবককে চেনেন? . মিতু বলল, না।
সে ফিরেই আসছিল। হঠাৎ কি মনে করে যুবকের দিকে তাকিয়ে ইংরেজীতে বলল, এক সময় আমার নাম ছিল পাঁচ হাজার ছয় শত চুয়ান্ন। আজ আমার নাম বার হাজার তিনশ’ একুশ। তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?
দুই দুয়ারী-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ুন আহমেদ
যুবকটি মিতুর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইংরেজীতে বলল, কেমন আছ মিতু?
এঃ
মিতুর চোখে পানি এসে গেল।
পুলিশ অফিসার অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, মিস আপনি কি যুবকটিকে চিনতে পারছেন? তাকে কি আপনার পরিচিত মনে হচ্ছে?
মিতু তাকিয়ে আছে যুবকের দিকে। যুবক মাথা নীচু করে বসে আছে। পা নাচাচ্ছে। তার মুখ হাসিহাসি।
মিতু বলল, আমি চিনি না। আমি এই যুবককে চিনি না।