দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

রশিদ সাহেব উৎসাহিত হয়ে উঠলেনআত্মা, আত্মায় বিশ্বাস করেন 

না ভাই, আমি একজন নাস্তিক। 

আত্মা নেইএই জিনিসটা কি প্রমাণ করতে পারবেন? কী কী যুক্তি আছেআপনার হাতেমিসির আলি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেনরশিদ সাহেব বললেন, আত্মা যে আছে, এর পক্ষে বিজ্ঞানীদের কিছু চমৎকার যুক্তি আছে। 

থাকলে তাে ভালােইবিজ্ঞানীরা জড়জগৎ বাদ দিয়ে আত্মাটাত্মা নিয়ে উৎসাহী হলেই কিন্তু ঝামেলারশিদ সাহেব, আমার মাথা ধরেছেনিয়ে আর কথা বলতে চাই নাকিছু মনে করবেন না‘ 

মিসির আলি চা না খেয়েই উঠে পড়লেনতার সত্যিসত্যি মাথা ধরেছেপ্রচণ্ড ব্যথাবড় রকমের কোনাে অসুখের একটা পূর্বলক্ষণ। 

নীলু ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে দেখে তার বিছানার উপর চমৎকার একটি প্যাকেট পড়ে আছেব্রাউন কাগজে মােড়া প্যাকেটে গােটাগােটা করে তার নাম লেখানীলুর বুক কেঁপে উঠল, বিলুর চোখে পড়ে নি তাে? বিলুর খুব খারাপ অভ্যাস আছে, অন্যের চিঠি খুলেখুলে পড়বেহাসাহাসি করবেনীলু দরজা বন্ধ করেই প্যাকেটটি খুললছােট্ট চিঠি, কিন্তু, কী চমৎকার করেই না লেখা :

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

কল্যাণীয়াসু, ইচ্ছা করেই তােমাকে আমি কম লিখিতােমার চিঠি পড়েপড়ে খুব মায়া জন্মে যায়। এ বয়সে আমার আর মায়া বাড়াতে ইচ্ছা করে নামায়া বাড়ালেই কষ্ট পেতে হয়আরেকটি সামান্য উপহার পাঠালামগ্রহণ করলে খুব খুশি হব

আহমেদ সাবেত উপহারটি বড় সুন্দর! নীল রঙের একটি ডায়েরিঅসম্ভব নরম প্রাস্টিকের কভার, যেখানে ছােট্ট একটি শিশুর ছবি পাতাগুলাে হালকা গােলাপীপ্রতিটি পাতায় সুন্দরসুন্দর দুই লাইনের কবিতাডায়েরিটির প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখা

I wish I could be eighteen again‘ 

A. S. পড়তে গিয়ে কেন জানি নীলুর চোখে জল এলএক জন সম্পূর্ণ অজানা 

অচেনা মানুষের জন্যে মন কেমন করতে লাগললােকটি দেখতে কেমন কে জানে? সুন্দর নয় নিশ্চয়ইবয়স্ক মানুষ, হয়তাে চুলটুল পেকে গেছেতাতে কিছু যায় আসে নামানুষের বয়স হচ্ছে তার মনেমন যত দিন কাচা থাকে, তত দিন মানুষের বয়স বাড়ে নাএই লােকটির মন অসম্ভব নরমশিশুর মতাে নরমনীলুর মনে হলাে এই লােকটি স্বামী হিসেবে অসাধারণ ছিলতার স্ত্রীকে সে নিশ্চয়ই সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালােবেসেছে। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

নীলু রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখলআপনি এমন কেন? নিজের কথা তাে কিছুই লেখেন নি! অথচ আমি আমার সমস্ত কথা লিখে বসে আছিতবু মনে হয় সব বুঝি লেখা হলাে নাঅনেক কিছু বুঝি বাকি রয়ে গেলআপনি আমাকে এত সুন্দরসুন্দর উপহার দিয়েছেন, কিন্তু আমি তাে আপনাকে কিছুই দিই নিআমার কিছুএকটা দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আমি তাে জানি না আপনি কী পছন্দ করেনআচ্ছা, আপনি কি টাই পরেন? তাহলে লাল টকটকে একটা টাই আপনাকে দিতে পারিজানেন, পুরুষমানুষের এই একটি জিনিসই আমি পছন্দ করি

কিন্তু হয়তাে আপনি টাই পরেন না, ঢিলেঢালা ধরনের মানুষদের মতাে চাদর গায়ে দেনআপনার সম্পর্কে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করেএক দিন আসুন না আমাদের বাসায়, এক কাপ চা খেয়ে যাবেনজানেন, আমি খুব ভালাে চা বানাতে পারিঅন্য কেউ চা বানিয়ে দিলে আমার বাবা খেতে পারেন নাসব সময় আমাকে বানাতে হয়গত রােববারে কী হলাে, জানেন? রাত তিনটেয় বাবা আমাকে ডেকে তুলে বললেনমা, এক কাপ চা বানা তাে, বড় চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

আপা, দরজা বন্ধ করে কী করছ?’ | নীলু অপ্রস্তুত হয়ে দরজা খুললবিলু দাঁড়িয়ে আছেসন্দেহজনকভাবে তাকাচ্ছে। 

কী করছিলে?কিছু করছিলাম না। 

বিলু বিছানায় এসে বসল, আপা, তােমার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি‘ 

কী পরিবর্তন?অস্থিরঅস্থির ভাবলক্ষণ ভালাে না আপাবল তাে কী হয়েছে

কী আবার হবে? তাের শুধু উল্টোপাল্টা কথাকিছুএকটা হয়েছে আপাআমি জানি। 

কী যে বলিস

আমার কাছে লুকোতে পারবে না আপাআমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। 

যা ভাগ, পাকামাে করিস না| বিলু গেল নাকাপড় ছাড়তেছাড়তে বলল, রানু আপাকেও আমি বললাম তােমার পরিবর্তনের কথাতারও ধারণা, তুমি কারাে প্রেমে পড়েছ‘ 

আমার তাে খেয়েদেয়ে কাজ নেইতা ছাড়া প্রেমটা আমার সঙ্গে করবে কে? চেহারার এই তাে অবস্থা। 

খারাপ অবস্থাটা কী? রঙটা একটু ময়লাছাড়া আর কি?নীলু ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। 

নিঃশ্বাস ফেলছ কেন আপা? নিজের চেহারা সম্পর্কে তােমার এমন খারাপ ধারণা থাকা উচিত নাসবাই তাে আর রানু আপার মতাে হয় না, হওয়া উচিত নয়। 

উচিত নয় কেন?সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম প্রবলেম থাকেকী প্রবলেম?রানু আপার মাথা খারাপসেটা তুমি জান?‘ 

কী বলছিস সব! ঠিকই বলছিআকবরের মা একদিন দুপুরে কি জন্যে যেন গিয়েছিল, শােনে রানু আপা নিজের মনে হাসছে এবং কথা বলছে। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

তাই নাকি?” 

হ্যাকথাগুলাে বলছে আবার দুই রকম গলায়আকবরের মা প্রথম ভেবেছিল কেউ বােধহয় বেড়াতে এসেছেশেষে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ নেই‘ 

সত্যি

হুরহমান সাহেবের স্ত্রী বললেন, একদিন নাকি আনিস সাহেব গভীর রাতে রহমান সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার স্ত্রীর খুব অসুখ, এই কথা বলেরহমান সাহেব গিয়ে দেখেন অসুখটসুখ কিছু নেই, দিব্যি ভালাে মানুষ। 

নীলু মৃদু স্বরে বলল, রানুর মতাে সুন্দরী হলে আমি পাগল হতেও রাজিবিলু হেসে ফেলল হাসতেহাসতে বলল, কথাটা ঠিক বলেছ আপা। 

রানু প্রসঙ্গে পাওয়া সব তথ্য লিখে রাখবার জন্যে মিসির আলি সাহেব মােটা একটা খাতা কিনে এনেছেন। খাতাটির প্রথম পাতায় লেখা 

এক জন মানসিক রুগীর পর্যায়ক্রমিক মনােবিশ্লেষণদ্বিতীয় পাতায় কিছু  

ব্যক্তিগত তথ্য যেমননাম : রানু আহমেদবয়স : সতের বৎসর (রূপবতী)বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিতা(তের মাস আগে বিয়ে হয়)স্বাস্থ্য : রুগ্ণাওজন : আশি পাউন্ড

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *