রশিদ সাহেব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। আত্মা, আত্মায় বিশ্বাস করেন?
‘না ভাই, আমি একজন নাস্তিক।
‘আত্মা নেই—এই জিনিসটা কি প্রমাণ করতে পারবেন? কী কী যুক্তি আছে। আপনার হাতে? মিসির আলি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। রশিদ সাহেব বললেন, ‘আত্মা যে আছে, এর পক্ষে বিজ্ঞানীদের কিছু চমৎকার যুক্তি আছে।
‘থাকলে তাে ভালােই। বিজ্ঞানীরা জড়জগৎ বাদ দিয়ে আত্মাটাত্মা নিয়ে উৎসাহী হলেই কিন্তু ঝামেলা। রশিদ সাহেব, আমার মাথা ধরেছে। এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। কিছু মনে করবেন না।‘
মিসির আলি চা না খেয়েই উঠে পড়লেন। তার সত্যি–সত্যি মাথা ধরেছে। প্রচণ্ড ব্যথা। বড় রকমের কোনাে অসুখের একটা পূর্বলক্ষণ।
নীলু ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে দেখে তার বিছানার উপর চমৎকার একটি প্যাকেট পড়ে আছে। ব্রাউন কাগজে মােড়া প্যাকেটে গােটা–গােটা করে তার নাম লেখা। নীলুর বুক কেঁপে উঠল, বিলুর চোখে পড়ে নি তাে? বিলুর খুব খারাপ অভ্যাস আছে, অন্যের চিঠি খুলে–খুলে পড়বে। হাসাহাসি করবে। নীলু দরজা বন্ধ করেই প্যাকেটটি খুলল। ছােট্ট চিঠি, কিন্তু, কী চমৎকার করেই না লেখা :
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
কল্যাণীয়াসু, ইচ্ছা করেই তােমাকে আমি কম লিখি। তােমার চিঠি পড়ে–পড়ে খুব মায়া জন্মে যায়। এ বয়সে আমার আর মায়া বাড়াতে ইচ্ছা করে না। মায়া বাড়ালেই কষ্ট পেতে হয়। আরেকটি সামান্য উপহার পাঠালাম। গ্রহণ করলে খুব খুশি হব ।
আহমেদ সাবেত উপহারটি বড় সুন্দর! নীল রঙের একটি ডায়েরি। অসম্ভব নরম প্রাস্টিকের কভার, যেখানে ছােট্ট একটি শিশুর ছবি । পাতাগুলাে হালকা গােলাপী। প্রতিটি পাতায় সুন্দর–সুন্দর দুই লাইনের কবিতা। ডায়েরিটির প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখা ?
‘I wish I could be eighteen again‘
A. S. পড়তে গিয়ে কেন জানি নীলুর চোখে জল এল। এক জন সম্পূর্ণ অজানা
অচেনা মানুষের জন্যে মন কেমন করতে লাগল। লােকটি দেখতে কেমন কে জানে? সুন্দর নয় নিশ্চয়ই। বয়স্ক মানুষ, হয়তাে চুলটুল পেকে গেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। মানুষের বয়স হচ্ছে তার মনে। মন যত দিন কাচা থাকে, তত দিন মানুষের বয়স বাড়ে না। এই লােকটির মন অসম্ভব নরম। শিশুর মতাে নরম। নীলুর মনে হলাে এই লােকটি স্বামী হিসেবে অসাধারণ ছিল। তার স্ত্রীকে সে নিশ্চয়ই সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালােবেসেছে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
নীলু রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল—আপনি এমন কেন? নিজের কথা তাে কিছুই লেখেন নি! অথচ আমি আমার সমস্ত কথা লিখে বসে আছি। তবু মনে হয় সব বুঝি লেখা হলাে না। অনেক কিছু বুঝি বাকি রয়ে গেল। আপনি আমাকে এত সুন্দর–সুন্দর উপহার দিয়েছেন, কিন্তু আমি তাে আপনাকে কিছুই দিই নি। আমার কিছু–একটা দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আমি তাে জানি না আপনি কী পছন্দ করেন। আচ্ছা, আপনি কি টাই পরেন? তাহলে লাল টকটকে একটা টাই আপনাকে দিতে পারি। জানেন, পুরুষমানুষের এই একটি জিনিসই আমি পছন্দ করি ।
কিন্তু হয়তাে আপনি টাই পরেন না, ঢিলেঢালা ধরনের মানুষদের মতাে চাদর গায়ে দেন। আপনার সম্পর্কে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। এক দিন আসুন না আমাদের বাসায়, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। জানেন, আমি খুব ভালাে চা বানাতে পারি। অন্য কেউ চা বানিয়ে দিলে আমার বাবা খেতে পারেন না। সব সময় আমাকে বানাতে হয়। গত রােববারে কী হলাে, জানেন? রাত তিনটেয় বাবা আমাকে ডেকে তুলে বললেন—মা, এক কাপ চা বানা তাে, বড় চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আপা, দরজা বন্ধ করে কী করছ?’ | নীলু অপ্রস্তুত হয়ে দরজা খুলল। বিলু দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহজনকভাবে তাকাচ্ছে।
কী করছিলে?” ‘কিছু করছিলাম না।
বিলু বিছানায় এসে বসল, আপা, তােমার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।‘
কী পরিবর্তন?” ‘অস্থির–অস্থির ভাব। লক্ষণ ভালাে না আপা। বল তাে কী হয়েছে?
কী আবার হবে? তাের শুধু উল্টোপাল্টা কথা। ‘কিছু–একটা হয়েছে আপা। আমি জানি।
কী যে বলিস!
‘আমার কাছে লুকোতে পারবে না আপা। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।
“যা ভাগ, পাকামাে করিস না। | বিলু গেল না। কাপড় ছাড়তে–ছাড়তে বলল, রানু আপাকেও আমি বললাম তােমার পরিবর্তনের কথা। তারও ধারণা, তুমি কারাে প্রেমে পড়েছ।‘
আমার তাে খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া প্রেমটা আমার সঙ্গে করবে কে? চেহারার এই তাে অবস্থা।
‘খারাপ অবস্থাটা কী? রঙটা একটু ময়লা। এ ছাড়া আর কি?” নীলু ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।
‘নিঃশ্বাস ফেলছ কেন আপা? নিজের চেহারা সম্পর্কে তােমার এমন খারাপ ধারণা থাকা উচিত না। সবাই তাে আর রানু আপার মতাে হয় না, হওয়া উচিত নয়।
উচিত নয় কেন?” সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম প্রবলেম থাকে।‘ কী প্রবলেম?‘ রানু আপার মাথা খারাপ—সেটা তুমি জান?‘
কী বলছিস এ সব! ‘ঠিকই বলছি। আকবরের মা একদিন দুপুরে কি জন্যে যেন গিয়েছিল, শােনে রানু আপা নিজের মনে হাসছে এবং কথা বলছে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
“তাই নাকি?”
হ্যা। কথাগুলাে বলছে আবার দুই রকম গলায়। আকবরের মা প্রথম ভেবেছিল কেউ বােধহয় বেড়াতে এসেছে। শেষে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ নেই।‘
সত্যি ?
‘হু। রহমান সাহেবের স্ত্রী বললেন, একদিন নাকি আনিস সাহেব গভীর রাতে রহমান সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার স্ত্রীর খুব অসুখ, এই কথা বলে। রহমান সাহেব গিয়ে দেখেন অসুখটসুখ কিছু নেই, দিব্যি ভালাে মানুষ।
নীলু মৃদু স্বরে বলল, রানুর মতাে সুন্দরী হলে আমি পাগল হতেও রাজি।‘ বিলু হেসে ফেলল । হাসতে–হাসতে বলল, কথাটা ঠিক বলেছ আপা।
রানু প্রসঙ্গে পাওয়া সব তথ্য লিখে রাখবার জন্যে মিসির আলি সাহেব মােটা একটা খাতা কিনে এনেছেন। খাতাটির প্রথম পাতায় লেখা
‘এক জন মানসিক রুগীর পর্যায়ক্রমিক মনােবিশ্লেষণ। দ্বিতীয় পাতায় কিছু
ব্যক্তিগত তথ্য । যেমন— নাম : রানু আহমেদ। বয়স : সতের বৎসর (রূপবতী)। বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিতা। (তের মাস আগে বিয়ে হয়)। স্বাস্থ্য : রুগ্ণা। ওজন : আশি পাউন্ড।