স্বামী : আনিস আহমেদ। দি জেনিথ ইন্টারন্যাশনালের ডিউটি অফিসার। বয়স ৩৭। স্বাস্থ্য ভালাে।
তৃতীয় পাতার হেডিংটি হচ্ছে—‘অডিটরি হেলুসিনেশন‘। এর নিচে লাল কালি দিয়ে একটা বড় প্রশ্নবােধক চিহ্ন আঁকা। এই পাতায় অনেক কিছুই লেখা হয়েছে, আবার কাটাকুটি করা হয়েছে। যেন মিসির আলি সাহেব মনস্থির করতে পারছেন না কী লিখবেন। দুটি লাইন শুধু পড়া যায়। লাইন দুটির নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয়া।
‘মেয়েটি অডিটরি হেলুসিনেশন হচ্ছে : সে একা থাকাকালীন শুনতে পায় কেউ যেন তাকে ডাকছে।
পরের কয়েকটি পাতায় রানুর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয় লেখা। এ পাতাগুলাে পড়লেই বােঝা যায়, মিসির আলি নামের এই লােকটির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। অতি তুচ্ছ ব্যাপারগুলােও লেখা আছে। যেমন, এক জায়গায় লেখা—মেয়েটি বেশ কয়েক বার শাড়ির আঁচল টেনেছে। দুই বার শব্দ করে আঙুল ফুটিয়েছে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি লক্ষ্য করলাম মেয়েটি পানি খেল মাথা নিচু করে। বেশ খানিকটা নিচু করে । যেন পানি পান করার ব্যাপারটি সে আড়াল করতে চায়। | নদীতে গােসলের গল্পটি লেখা আছে। গল্পের শেষে বেশ কিছু প্রশ্ন করা আছে। যেমন— এক জন মৃত মানুষ পানিতে ভেসে থাকবে। ডুবে থাকবে না। গল্পে মৃত মানুষটির ডুবে–ডুবে চলার কথা আছে। এ রকম থাকার কথা নয়।
পাজামা খুলে ফেলার কথা আছে। কিশােরীরা সাধারণত শক্ত গিট দিয়ে পাজামা পরে। গিট খুলতে হলে ফিতা টানতে হবে। ঐ মানুষটি কি ফিতা টেনেছিল, না পাজামাটাই টেনে নামিয়েছে?
মৃত লােকটির কি কোনাে পােস্ট মর্টেম হয়েছিল? * তার আনুমানিক বয়স কত ছিল?
প্রথম অসুস্থতার সময় কি মেয়েটি ঘুমের মধ্যে কোনাে কথাবার্তা বলত? কী বলত?
মেয়েটি বলল, লােকটির নাম জালালউদ্দিন। কীভাবে বলল? লােকটির নাম তাে জানার কথা নয়। নাকি পরে শুনেছে? | * জালালউদ্দিন–জাতীয় নামের কারাে সঙ্গে কি এই মেয়েটির পূর্বপরিচয় ছিল?
প্রশ্নের শেষে তিনটি মন্তব্য লেখা আছে। মন্তব্যগুলাে সংক্ষিপ্ত। প্রথম মন্তব্য মেয়েটি যে ঘটনার কথা বলেছে, তা বিশ্বাসযােগ্য নয়। দ্বিতীয় মন্তব্য– এই ঘটনা। অন্য যেসব ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেছে তাদের সঙ্গে প্রথমে আলাপ করতে হবে। দ্বিতীয় মন্তব্যটি লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা ও পাশে লেখা অত্যন্ত
জরুরি। তৃতীয় মন্তব্য—মেয়েটির অবশ্যই কিছু পরিমাণ এক্সট্রাসেন্সরি। পারসেপশন আছে। সে কার্ডের সব কটি চিহ্ন সঠিকভাবে বলতে পেরেছে। আমি এ রকম আগে কখনাে দেখি নি। এই বিষয়ে আমার ধারণা হচ্ছে, মানসিকভাবে অসুস্থ রুগীদের এই দিকটি উন্নত হয়ে থাকে। আমি এর আগেও যে ক’টি অসুস্থ মানুষ দেখেছি, তাদের সবার মধ্যেই এই ক্ষমতাটি কিছু পরিমাণে লক্ষ্য করেছি। দি জার্নাল অব প্যারাসাইকোলজির তৃতীয় ভলুমে (১৯৭৩) এই প্রসঙ্গে রিভিউ পেপার আছে। অথর জন নান এবং এফ টলম্যান।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
সােহাগী হাইস্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব দারুণ অবাক হলেন। রানুর ব্যাপারে খোজখবর করার জন্যে এক ভদ্রলােক এসেছেন—এর মানে কী? অতত দিন আগে কী হয়েছিল, না–হয়েছিল, তা কি এখন আর কারাে মনে আছে? আর মনে থাকলেও এইসব ব্যাপার নিয়ে এখন ঘাটাঘাটি করাটা বােধহয় ঠিক নয়। কিন্তু যে ভদ্রলােক এসেছেন, তাঁকে মুখের ওপর না বলতেও বাধছে। দ্রলােক হাজার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক। মানী লােক। তা ছাড়া এত দূর এসেছেন, নিশ্চয়ই কোনাে কারণ আছে। মুখে বলছেন রানু অসুস্থ এবং তিনি রানুর এক জন চিকিৎসক, কিন্তু এটা ঠিক বিশ্বাসযােগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ মাসখানেক আগেই রানুকে তিনি দেখে এসেছেন। কিছুমাত্র অসুস্থ মনে হয় নি। আজ হঠাৎ এমন কী হয়েছে যে ঢাকা থেকে এই ভদ্রলােককে আসতে হলাে?
রানুর কী হয়েছে বললেন?” মানসিকভাবে অসুস্থ। ‘আমি তাে সেদিনই তাকে দেখে এলাম।‘ যখন দেখেছেন তখন হয়তাে সুস্থই ছিল।
কী জানতে চান আপনি, বলেন।
নদীতে গােসলের সময় কী ঘটেছিল, সেটা বলেন। ‘সে সব কি আর এখন মনে আছে?”
‘ঘটনাটা বেশ সিরিয়াস এবং নিশ্চয়ই আপনাদের মধ্যে বহু বার আলােচিত হয়েছে, কাজেই মনে থাকার কথা। আপনার যা মনে আসে তাই বলেন।
হেডমাস্টার গভীর স্বরে ঘটনাটা বললেন। রানুর গল্পের সঙ্গে তার গল্পের কোনাে অমিল লক্ষ্য করা গেল না। শুধু দ্রলােক বললেন, মেয়েরা গােসল করতে গিয়েছিল দুপুরে, সন্ধ্যায় নয়।‘
পায়জামা খােলার ব্যাপারটি বলেন। পায়জামাটা কি পাওয়া গিয়েছিল?” ‘আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।‘
‘রানু বলছিল, নদীতে গােসল করবার সময় সেই মরা মানুষটি তার পায়জামা খুলে ফেলে।
“আরে না না, কী বলেন! ‘ওর পরনে পায়জামা ছিল?
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
হ্যা, থাকবে না কেন? আপনার ঠিক মনে আছে তাে?”
মনে থাকবে না কেন? পরিষ্কার মনে আছে। আপনি অন্য সবাইকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
‘ঐ মরা মানুষটি সম্পর্কে কী জানেন?
‘কিছুই জানি না রে ভাই। থানায় খবর দিয়েছিলাম। থানা হচ্ছে এখান থেকে দশ মাইল। সেই সময় যােগাযােগব্যবস্থা ভালাে ছিল না। থানাঅলারা আসে দুই দিন পরে। লাশ তখন পচে–গলে গিয়েছে। শিয়াল–কুকুর কামড়াকামড়ি করছে। থানাঅলারা এসে আমাদের লাশ পুঁতে ফেলতে বলে। আমরা নদীর ধারেই গর্ত করে পুঁতে ফেলি।‘
‘আচ্ছা, ঐ লাশটি তাে উলঙ্গ ছিল, ঠিক না?” “জ্বি–না, ঠিক না। হলুদ রঙের একটা প্যান্ট ছিল আর গায়ে গেঞ্জি ছিল।‘ মিসির সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত হলাে। ‘আপনার ঠিক মনে আছে তাে ভাই?”
আরে, এটা মনে না–থাকার কোনাে কারণ আছে? পরিষ্কার মনে আছে।‘ ‘লাশটি কি বুড়াে মানুষের ছিল?‘ “জ্বি–না, জোয়ান মানুষের লাশ।
আর কিছু মনে পড়ে?‘ ‘আর কিছু তাে নেই মনে পড়ার।‘
আপনার ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই, অনুফা যার নাম। শুনেছি ওর শ্বশুরবাড়ি কাছেই।
হরিণঘাটায়। আপনি যেতে চান হরিণঘাটা?’ ‘জি।
কখন যাবেন?‘ ‘আজকেই যেতে পারি। কত দূর এখান থেকে?‘ ‘পনের মাইল। বেবিট্যাক্সি করে যেতে পারেন।
রাতে ফিরে আসতে পারব?‘