তা পারবেন। ‘বেশ, তাহলে আপনি আমাকে ঠিকানা দিন। ‘দেব। বাড়িতে চলেন, খাওয়াদাওয়া করেন। ‘আমি হােটেল থেকে খেয়েদেয়ে এসেছি।‘ তা কি হয়, অতিথি–মানুষ! আসুন আসুন।
দ্রলােক বাড়িতে নিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু বড়ই গম্ভীর হয়ে রইলেন। মাথার ওপর হঠাৎ এসে পড়া উপদ্রবে তাকে যথেষ্ট বিরক্ত মনে হলাে। ভালাে করে কোনাে কথাই বললেন না। অকারণে বাড়ির এক জন কামলার ওপর প্রচণ্ড হম্বিতম্বি শুরু করলেন।
কিন্তু অনুফার বাড়িতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ঘটল। মেয়েটি আদর–যত্নের একটি মেলা বাধিয়ে ফেলল। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটির স্বামী সন্ধ্যাবেলাতেই জাল নিয়ে পুকুরে নেমে গেছে। অনুফা পরিচিত মানুষের মতাে আদুরে গলায় বলল, রাতে ফিরবেন কি—কাল সকালে যাবেন। লােকজন মিসির আলিকে দেখতে এল। এরা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ। মেয়েটিও মনে হয় বেশ ক্ষমতা নিয়ে আছে। সবাই তার কথা শুনছে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁকে গােসলের জন্যে গরম পানি করে দেয়া হলাে। একটা বাটিতে নতুন একটা গায়ে মাখার সাবান। মােড়কটি পর্যন্ত হেঁড়া হয় নি। বাংলাঘরে নতুন চাদর বিছিয়ে বিছানা করা হলাে। মেয়েটির বৃদ্ধ শ্বশুর একটি ফর্সী হুক্কাও এনে দিলেন এবং বারবার বলতে লাগলেন, খবর না–দিয়ে আসার জন্যে ঠিকমতাে খাতির–যত্ন করতে না পেরে তিনি বড়ই শরমিন্দা। তবে যদি কালকের দিনটা থাকেন, তবে তিনি হরিণঘাটার বিখ্যাত মাগুর মাছ খাওয়াবেন। খাওয়াতে না–পারলে তিনি বাপের ব্যাটা না ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিসির আলির বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি সত্যি–সত্যি এক দিন থেকে গেলেন। মিসির আলি সাহেব এ রকম কখনাে করেন না।
রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘ভেতরে আসব?”
‘এস রানু, এস।‘ ‘গল্প করতে এলাম।‘ ‘খুব ভালাে করেছ।‘
নীলু উঠে গিয়ে রানুর হাত ধরল। রানু বলল, তুমি কাঁদছিলে নাকি, চোখ ভেজা! নীলু কিছু বলল না। রানু বলল, “এত কিসের দুঃখ তােমার যে দুপুরবেলায় কাঁদতে হয়?
‘তােমার বুঝি কোনাে দুঃখটুঃখ নেই? “উহু। আমি খুব সুখী।
রানু হাসতে লাগল। নীলু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি বলেছিলে, একটা খুব অদ্ভুত কথা আমাকে বলবে।‘
বলেছিলাম নাকি?‘
হা। আজ সেটা বলতে হবে। তারপর আমি আমার একটা অদ্ভুত কথা বলব।‘
রানু হাসতে লাগল। ‘হাসছ কেন রানু? ‘তােমার অদ্ভুত কথাটা আমি জানি, এই জন্যে হাসছি।”
কী আবােলতাবােল বলচ! তুমি জানবে কী? ‘জানি কিন্তু। নীলু গম্ভীর হয়ে বলল, জানলে বল তাে।‘ “তােমার এক জন প্রিয় মানুষ তােমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছে। ঠিক ?‘
নীলু দীর্ঘ সময় কোন কথাবার্তা বলল না। রানু বলল, কি ভাই, বলতে পারলাম তাে?”
হ্যা, পেরেছ। ‘ও কি বাসায় আসবে?
“বলব তােমাকে। তার আগে তুমি বল, তুমি কী করে জানলে? বিলু তােমাকে বলেছে? কিন্তু বিলু তাে কিছু জানে না!‘
‘আমাকে কেউ কিছু বলে নি। ‘তাহলে তুমি জানলে কী করে? ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি?‘
স্বপ্ন দেখেছি মানে?
নীলু, মাঝে–মাঝে আমি স্বপ্ন দেখি। সেগুলাে ঠিক স্বপ্নও নয়। তবে অনেকটা স্বপ্নের মতাে। সেগুলাে সব সত্যি। গত রাতে স্বপ্নে দেখলাম, তুমি একটি চিঠি পেয়ে খুব খুশি। সেই চিঠিতে একটি লাইন লেখা আছে, যার মানে হচ্ছে তােমার সঙ্গে আমার দেখা হবে বা এই রকম কিছু।
‘এসব কি তুমি সত্যি–সত্যি বলছ রানু?
কবে তার সঙ্গে তােমার দেখা হবে? ‘আজ বিকেলে। আমি নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে একটা সবুজ রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকব। তিনি আমাকে খুঁজে বের করবেন।
বাহ, খুব মজার ব্যাপার তাে!
রানু হাসতে লাগল। এক সময় হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘শুধু গল্প উপন্যাসেই এসব হয়। বাস্তবে এই প্রথম দেখছি। তােমার ভয় করছে না?‘
ভয় করবে কেন? ‘তােমার কিন্তু নীলু ভয় করছে। আমি বুঝতে পারছি। বেশ ভয় করছে। করছে না?
নাহ্।
রানু ইতস্তত করে বলল, ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পার । আমি দূরে থাকব।‘
“থাক, দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।
মনে হলাে নীলু রানুর কথাবার্তা সহজভাবে নিতে পারছে না। তার চোখ–মুখ গম্ভীর। রানু বলল, “কি, নেবে?
আমার একা যাবার কথা, একাই যাব।‘ ‘আর যদি গিয়ে দেখ, খুব বাজে ধরনের একটা লােক। তখন কী করবে? বাজে ধরনের লােক মানে? অর্থাৎ যদি গিয়ে দেখ দাঁত পড়া, চুল পাকা এক বুড়াে? ‘তােমার কি সে রকম মনে হচ্ছে?
রানু মাথা দুলিয়ে হাসল, কিছু বলল না। নীলুকে দেখে মনে হলাে রানুর ব্যবহারে সে বেশ বিরক্ত হচ্ছে। দুটো বাজতেই সে বলল, এবার তুমি যাও, আমি সাজগােজ করব।
‘এখনই? চারটা বাজতে তাে দেরি আছে। ‘তােমার মতাে সুন্দরী তাে আমি না। আমাকে সময় নিয়ে সাজতে হবে। রানু উঠে পড়ল। নীলু সত্যি সাজতে বসল। কিন্তু কী যে হয়েছে তার, চোখে
পানি এসে কাজল ধুয়ে যাচ্ছে। আইল্যাশ পরার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু একা–একা পরা সম্ভব নয়। অনেক বেছেটেছে একটা শাড়ি পছন্দ করল। সাদার ওপর নীলের একটা প্রিন্ট । আগে সে কখনাে পরে নি।
নীলু মা, কোথাও যাচ্ছ নাকি? নীলু তাকিয়ে দেখলবাবা। ‘কোথায় যাচ্ছ গাে মা? ‘এক জন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তােমার কি চা লাগবে?
হলে ভালাে হত। থাক, তুই ব্যস্ত। চা বানাতে আর কয় মিনিট লাগবে! তুমি বস, আমি বানিয়ে আনছি।‘ নীলুর বাবা চেয়ার টেনে নীলুর ঘরেই বসলেন।
চা কি চিনি ছাড়া আনব বাবা?” না, এক চামচ চিনি দিস। একটু–আধটু চিনি খেলে কিছু হবে না।
নীলু চা নিয়ে এসে দেখে বাবা ঝিমুচ্ছেন। ঝিমুনিরও বেশি, প্রায় ঘুমাচ্ছেন বলা চলে। বাবা যেন বড় বেশি দ্রুত বুড়াে হয়ে যাচ্ছেন। বড় মায়া লাগল নীলুর ।
বাবা, তােমার চা। ‘কোন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিস মা?” নীলু খানিক ইতস্তত করে বলল, “তােমাকে আমি পরে বলব বাবা।
সন্ধ্যার আগেই আসবি তাে?‘ হ্যা, বাবা।‘ ‘গাড়ি নিয়ে যাবি?”