দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি সাজগােজ করব। 

এখনই? চারটা বাজতে তাে দেরি আছেতােমার মতাে সুন্দরী তাে আমি নাআমাকে সময় নিয়ে সাজতে হবেরানু উঠে পড়লনীলু সত্যি সাজতে বসল

কিন্তু কী যে হয়েছে তার, চোখে পানি এসে কাজল ধুয়ে যাচ্ছেআইল্যাশ পরার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু একাএকা পরা সম্ভব নয়অনেক বেছেটেছে একটা শাড়ি পছন্দ করলসাদার ওপর নীলের একটা প্রিন্ট আগে সে কখনাে পরে নি। 

নীলু মা, কোথাও যাচ্ছ নাকি? নীলু তাকিয়ে দেখলবাবাকোথায় যাচ্ছ গাে মা? এক জন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেতােমার কি চা লাগবে

হলে ভালাে হতথাক, তুই ব্যস্তচা বানাতে আর কয় মিনিট লাগবে! তুমি বস, আমি বানিয়ে আনছিনীলুর বাবা চেয়ার টেনে নীলুর ঘরেই বসলেন। 

চা কি চিনি ছাড়া আনব বাবা?না, এক চামচ চিনি দিসএকটুআধটু চিনি খেলে কিছু হবে না। 

নীলু চা নিয়ে এসে দেখে বাবা ঝিমুচ্ছেনঝিমুনিরও বেশি, প্রায় ঘুমাচ্ছেন বলা চলেবাবা যেন বড় বেশি দ্রুত বুড়াে হয়ে যাচ্ছেনবড় মায়া লাগল নীলুর । 

বাবা, তােমার চাকোন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিস মা?নীলু খানিক ইতস্তত করে বলল, তােমাকে আমি পরে বলব বাবা। 

সন্ধ্যার আগেই আসবি তাে?হ্যা, বাবাগাড়ি নিয়ে যাবি?” 

না, গাড়ি নেব নানিয়ে যা না ড্রাইভার তাে দিনরাত বসেবসেই মায়না খায়‘ 

বাবা, আমি গাড়ি নেব না‘ 

নীলুর সাজ শেষ হলাে ঠিক সাড়ে তিনটায়আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে তার পছন্দই হলােযে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে, সে বেশ রূপসীতার মায়াকাড়া দুটি চমৎকার চোখ আছেকিশােরীদের মতাে ছােট একটি চিবুকভালােই তাে! রকম একটি মেয়েকে পুরুষরা কি ভালােবাসে না? নাকের কাছে মুক্তোর মতাে কিছু ঘামের বিন্দুনীলু তার সবুজ রুমাল দিয়ে সাবধানে ঘাম মুছে ফেলল । 

তারপর উঠে এল তিনতলায় । 

রানু, রানুরানু যেন তৈরি হয়েইছিলসে বেরিয়ে এল সঙ্গেসঙ্গে। 

তুমি যাবে বলেছিলে আমার সঙ্গেচল‘  

রানু তালা লাগালনীলু মৃদু স্বরে বলল, তুমি জানতে আমি আসব?হ্যা, জানতাম‘ 

সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করলকারাে দেখা পাওয়া গেল নাএক সময় নীলু বলল, এখন চলে যেতে চাও রানু

আরাে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকিতােমার তাে এখনাে যেতে ইচ্ছা করছে 

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে চল হাঁটি। 

তারা বেশ কয়েক বার নিউ মার্কেট চক্কর দিয়ে ফেললকেউ এগিয়ে এসে বলল না, তােমাদের মধ্যে নীলু কে?‘ 

রানু, তােমার কি হাঁটতে টায়ার্ড লাগছে?” 

রানু, তুমি তাে অনেক কিছু বুঝতে পার, তাই না

মাঝেমাঝে পারিলােকটি এসেছে কি না বুঝতে পারছ না

নীলু, পারছি নাআমি সব সময় পারি নারানু লক্ষ্য করল, নীলুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছেসে তার সবুজ রুমাল দিয়ে চোখ চেপে ধরল। রানু গাঢ় স্বরে বলল, কাদে না নীলু। 

কান্না এলে কী করব?মনটা শক্ত কর ভাইপৃথিবীটা খুব ভালাে জায়গা নয়‘ 

লােকজন তাকাচ্ছে ওদের দিকেরানু নীলুর হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলবেশ অস্বস্তিকর অবস্থা। 

তার প্রায় চার দিন পর নীলু একটি চিঠি পেলপ্রিয় নীলু

ঐদিন তােমাকে দেখলামতুমি তাে ভারি মিথুক! কেন বললে তুমি দেখতে সুন্দর নও? তােমাকে বর্ষার জলভারে নত আকাশের তাে লাগছিআমি ছুটে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তােমার বান্ধবীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিকথা ছিল একা আসবেতানয় কি

শুধু আমরা দুই জন থাকবআমাকে দেখে দি তােমার কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে কোনাে একটি রেস্টুরেন্টে বসে দুই জনে চা খেতেখেতে গল্প করব। 

আর যদি তােমার আমাকে পছন্দ নাহয়, তাহলে তুমি তােমার সবুজ রুমালটি তােমার হ্যান্ডব্যাগে লুকিয়ে ফেলবে। 

তােমাকে কিছুই বলতে হবে নাআমি খারাপ করব ঠিকই, কিন্তু বিদায় নেব হাসিমুখে, এবং আর কোনাে দিনই তুমি আমাকে দেখবে নাতবে নীলু, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমাকে তুমি পছন্দ রবে নারকম মনে করার কোনােই কারণ নেই, তবু মনে হচ্ছেখুব সম্ভব উইশফুল থিংকিংনা মেয়ে 

নীলু চিঠিটি সমস্ত দিনে প্রায় একশবার পড়ল এবং প্রতি বারই তার কাছে নতুন মনে হলােরাতে সে অদ্ভুত সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখল যেন পুরােনাে আমলের একটি পালতােলা জাহাজে সে বসে আছেজাহাজের পালটি গাঢ় সবুজ রঙেরপ্রচণ্ড বাতাস দিচ্ছেবাতাসে জাহাজ ছুটে চলেছে বিদ্যুৎগতিতেনীলুর একটু ভয়ভয় লাগছে, কারণ জাহাজে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে নানীলু এক সময় বলল, আমার ভয় লাগছে এই জাহাজেআর কেউ কি আছে?’ সঙ্গেসঙ্গে একটি ভারি পুরুষালি গলা শােনা গেল, ভয় নেই নীলুআমি আছিস্বপ্ন এত সুন্দর হয়। 

নীলুর ঘুম ভেঙে গেলবাকি রাত সে আর ঘুমােতে পারল নাবালিশে মুখ খুঁজে ফুপিয়েফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল বিলু জেগে উঠে বলল, কী হয়েছে রে আপা?” 

নীলু ভেজা গলায় বলল, পেট ব্যথা করছেএখন একটু কমতুই ঘুমাে৷ 

১০ অনুফার কাছ থেকে নতুন কিছু জানা গেল নাসেও খুব জোর দিয়ে বলল, রানুর পরনে পায়জামা ছিল এবং মৃত লােকটির পরনেও কাপড় ছিল। 

আপনি লােকটিকে দেখেছেন?” 

হ্যাকিন্তু আপনি করে বলছেন কেন? মুরুব্বি মানুষ আপনিআমি আপনার মেয়ের বয়েসী। 

লােকটিকে কেমন দেখলে বল তাে!‘ 

চাচা, আমার কিছু মনে নেইসেই সময় আমি ঘােরের মধ্যে ছিলামপরদিন আমার বিয়ে। 

হ্যা, তা আমি জানিলােকটিকে নদীর পারে পুঁতে রাখা হয়, তাই না?জ্বিতারপর অনেক দিন কেউ ওদিকে যেত নাসবাই বলাবলি করত

রাতে কী জানি দেখতে পায়। 

কী দেখতে পায়? ছায়াছায়া কী নাকি দেখেতবে এইসব সত্যি না চাচাসব মনগড়াতাই নাকি?জ্বিভূতপ্রেত বলে কিছু নেইমিসির আলি বড়ই অবাক হলেনগ্রামের কোনাে মেয়ে এইভাবে চিন্তা করে এতটা মুক্তচিন্তা তাদের থাকার কথা নয়মিসির আলি বললেন, তুমি পড়াশােনা কত দূর করেছ?” 

চাচা, আমি আই.. পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়তারপর আর পড়াশােনা হয় নি। গ্রামে বিয়ে হয়েছে তাে! পড়াশােনা করার আমার খুব শখ ছিল। 

মানুষের সব শখ মেটা উচিত নয়একটা কোনাে ডিসস্যাটিসফেকশন থাকাদরকার। 

কেন?” 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *