আমি সাজগােজ করব।
‘এখনই? চারটা বাজতে তাে দেরি আছে। ‘তােমার মতাে সুন্দরী তাে আমি না। আমাকে সময় নিয়ে সাজতে হবে। রানু উঠে পড়ল। নীলু সত্যি সাজতে বসল।
কিন্তু কী যে হয়েছে তার, চোখে পানি এসে কাজল ধুয়ে যাচ্ছে। আইল্যাশ পরার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু একা–একা পরা সম্ভব নয়। অনেক বেছেটেছে একটা শাড়ি পছন্দ করল। সাদার ওপর নীলের একটা প্রিন্ট । আগে সে কখনাে পরে নি।
নীলু মা, কোথাও যাচ্ছ নাকি? নীলু তাকিয়ে দেখলবাবা। ‘কোথায় যাচ্ছ গাে মা? ‘এক জন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তােমার কি চা লাগবে?
হলে ভালাে হত। থাক, তুই ব্যস্ত। চা বানাতে আর কয় মিনিট লাগবে! তুমি বস, আমি বানিয়ে আনছি।‘ নীলুর বাবা চেয়ার টেনে নীলুর ঘরেই বসলেন।
চা কি চিনি ছাড়া আনব বাবা?” না, এক চামচ চিনি দিস। একটু–আধটু চিনি খেলে কিছু হবে না।
নীলু চা নিয়ে এসে দেখে বাবা ঝিমুচ্ছেন। ঝিমুনিরও বেশি, প্রায় ঘুমাচ্ছেন বলা চলে। বাবা যেন বড় বেশি দ্রুত বুড়াে হয়ে যাচ্ছেন। বড় মায়া লাগল নীলুর ।
বাবা, তােমার চা। ‘কোন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিস মা?” নীলু খানিক ইতস্তত করে বলল, “তােমাকে আমি পরে বলব বাবা।
সন্ধ্যার আগেই আসবি তাে?‘ হ্যা, বাবা।‘ ‘গাড়ি নিয়ে যাবি?”
না, গাড়ি নেব না।‘ ‘নিয়ে যা না । ড্রাইভার তাে দিনরাত বসে–বসেই মায়না খায়।‘
বাবা, আমি গাড়ি নেব না।‘
নীলুর সাজ শেষ হলাে ঠিক সাড়ে তিনটায়। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে তার পছন্দই হলাে। যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে, সে বেশ রূপসী। তার মায়া–কাড়া দুটি চমৎকার চোখ আছে। কিশােরীদের মতাে ছােট একটি চিবুক। ভালােই তাে! এ রকম একটি মেয়েকে পুরুষরা কি ভালােবাসে না? নাকের কাছে মুক্তোর মতাে কিছু ঘামের বিন্দু। নীলু তার সবুজ রুমাল দিয়ে সাবধানে ঘাম মুছে ফেলল ।
তারপর উঠে এল তিনতলায় ।
রানু, রানু।‘ রানু যেন তৈরি হয়েইছিল। সে বেরিয়ে এল সঙ্গে–সঙ্গে।
তুমি যাবে বলেছিলে আমার সঙ্গে। চল।‘
রানু তালা লাগাল। নীলু মৃদু স্বরে বলল, তুমি জানতে আমি আসব?‘ “হ্যা, জানতাম।‘
সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করল। কারাে দেখা পাওয়া গেল না। এক সময় নীলু বলল, “এখন চলে যেতে চাও রানু?
আরাে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। তােমার তাে এখনাে যেতে ইচ্ছা করছে
‘এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে চল হাঁটি।
তারা বেশ কয়েক বার নিউ মার্কেট চক্কর দিয়ে ফেলল। কেউ এগিয়ে এসে বলল না, তােমাদের মধ্যে নীলু কে?‘
রানু, তােমার কি হাঁটতে টায়ার্ড লাগছে?”
‘রানু, তুমি তাে অনেক কিছু বুঝতে পার, তাই না?
মাঝে–মাঝে পারি।‘ ‘লােকটি এসেছে কি না বুঝতে পারছ না?
নীলু, পারছি না। আমি সব সময় পারি না।‘ রানু লক্ষ্য করল, নীলুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে তার সবুজ রুমাল দিয়ে চোখ চেপে ধরল। রানু গাঢ় স্বরে বলল, কাদে না নীলু।
কান্না এলে কী করব?” মনটা শক্ত কর ভাই। পৃথিবীটা খুব ভালাে জায়গা নয়।‘
লােকজন তাকাচ্ছে ওদের দিকে। রানু নীলুর হাত ধরে বাইরে নিয়ে এল। বেশ অস্বস্তিকর অবস্থা।
তার প্রায় চার দিন পর নীলু একটি চিঠি পেল। প্রিয় নীলু,
ঐদিন তােমাকে দেখলাম। তুমি তাে ভারি মিথুক! কেন বললে তুমি দেখতে সুন্দর নও? তােমাকে বর্ষার জলভারে নত আকাশের মতাে লাগছিল। আমি ছুটে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তােমার বান্ধবীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছি। কথা ছিল একা আসবে। তাই নয় কি?
শুধু আমরা দুই জন থাকব। আমাকে দেখে যদি তােমার কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে কোনাে একটি রেস্টুরেন্টে বসে দুই জনে চা খেতে–খেতে গল্প করব।
আর যদি তােমার আমাকে পছন্দ না–হয়, তাহলে তুমি তােমার সবুজ রুমালটি তােমার হ্যান্ডব্যাগে লুকিয়ে ফেলবে।
তােমাকে কিছুই বলতে হবে না। আমি মন–খারাপ করব ঠিকই, কিন্তু বিদায় নেব হাসিমুখে, এবং আর কোনাে দিনই তুমি আমাকে দেখবে না। তবে নীলু, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমাকে তুমি অপছন্দ করবে না। এ রকম মনে করার কোনােই কারণ নেই, তবু মনে হচ্ছে। খুব সম্ভব উইশফুল থিংকিং। না মেয়ে
নীলু চিঠিটি সমস্ত দিনে প্রায় একশ‘ বার পড়ল এবং প্রতি বারই তার কাছে নতুন মনে হলাে। রাতে সে অদ্ভুত সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখল যেন পুরােনাে আমলের একটি পালতােলা জাহাজে সে বসে আছে। জাহাজের পালটি গাঢ় সবুজ রঙের। প্রচণ্ড বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে জাহাজ ছুটে চলেছে বিদ্যুৎগতিতে। নীলুর একটু ভয়ভয় লাগছে, কারণ জাহাজে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নীলু এক সময় বলল, ‘আমার ভয় লাগছে এই জাহাজে। আর কেউ কি আছে?’ সঙ্গে–সঙ্গে একটি ভারি পুরুষালি গলা শােনা গেল, ভয় নেই নীলু। আমি আছি।‘ স্বপ্ন এত সুন্দর হয়।
নীলুর ঘুম ভেঙে গেল। বাকি রাত সে আর ঘুমােতে পারল না। বালিশে মুখ খুঁজে ফুপিয়ে–ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল । বিলু জেগে উঠে বলল, কী হয়েছে রে আপা?”
নীলু ভেজা গলায় বলল, ‘পেট ব্যথা করছে। এখন একটু কম। তুই ঘুমাে৷
১০ অনুফার কাছ থেকে নতুন কিছু জানা গেল না। সেও খুব জোর দিয়ে বলল, রানুর পরনে পায়জামা ছিল এবং মৃত লােকটির পরনেও কাপড় ছিল।
‘আপনি লােকটিকে দেখেছেন?”
‘হ্যা। কিন্তু আপনি করে বলছেন কেন? মুরুব্বি মানুষ আপনি। আমি আপনার মেয়ের বয়েসী।
‘লােকটিকে কেমন দেখলে বল তাে!‘
‘চাচা, আমার কিছু মনে নেই। সেই সময় আমি ঘােরের মধ্যে ছিলাম। পরদিন আমার বিয়ে।
‘হ্যা, তা আমি জানি। লােকটিকে নদীর পারে পুঁতে রাখা হয়, তাই না?” ‘জ্বি। তারপর অনেক দিন কেউ ওদিকে যেত না। সবাই বলাবলি করত,
রাতে কী জানি দেখতে পায়।
কী দেখতে পায়? ছায়া–ছায়া কী নাকি দেখে। তবে এইসব সত্যি না চাচা। সব মনগড়া। “তাই নাকি?” ‘জ্বি। ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই।‘ মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। গ্রামের কোনাে মেয়ে এইভাবে চিন্তা করে । এতটা মুক্তচিন্তা তাদের থাকার কথা নয়। মিসির আলি বললেন, তুমি পড়াশােনা কত দূর করেছ?”
‘চাচা, আমি আই.এ. পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়। তারপর আর পড়াশােনা হয় নি। গ্রামে বিয়ে হয়েছে তাে! পড়াশােনা করার আমার খুব শখ ছিল।
মানুষের সব শখ মেটা উচিত নয়। একটা কোনাে ডিসস্যাটিসফেকশন থাকা। দরকার।
“কেন?”