দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

তাহলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করেসব শখ মিটে গেলে বেঁচে থাকার প্রেরণা নষ্ট হয়ে যায়যে সব মানুষের শখ মিটে গেছে, তারা খুব অসুখী মানুষ। 

অনুফা চুপ করে রইলমিসির আলি মৃদু স্বরে বললেন, এবার রানুর কথা বলকী কথা জানতে চান? সব কথাখুব অদ্ভুত মেয়েমানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারে‘ 

কীভাবে বলে? তা জানি না, তবে বলতে পারেএকবার কী হয়েছে, শােনেনআমি আর গল্প করছি, সে হঠাৎ গল্প থামিয়ে বললকিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের বাড়িতে শ্রীপুরের খালারা বেড়াতে আসবেন। আর সত্যিসত্যি তাঁরা এলেন। 

এটা তাে এমনিতেও হতে পারেমানুষ বেড়াতে আসে না?” 

তা আসে। কিন্তু শ্রীপুরের খালা পাঁচ বছর পর প্রথম এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের কীএকটা ঝগড়া চলছিল। 

, তাই নাকি?’ 

জিআরেক গল্প বলি শােনেন, তখন আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রানুদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিনা, এটা আপনাকে বলা যাবে না‘ 

বলা যাবে না কেন?গল্পটা ভালাে নাথাক, তাহলে অন্য গল্প বল। 

অনুফার স্বামীকেও মিসির আলি সাহেবের বেশ লাগলগোঁয়ারগগাবিন্দ ধরনের লােকস্ত্রীর খুবই অনুগতসে মিসির আলিকে নিয়ে প্রচুর ঘুরল লােকটির যথেষ্ট প্রভাবপ্রতিপত্তিও দেখা গেলমধুপুর থানার ওসি সাহেব ওরকথাতেই পুরােনাে ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখালেন যে, একটি মরা লাশ পাওয়ার খবরে এফআইআর করা হয়েছিলতখন ওসি ছিলেন ব্রজগােপাল হালদার, তাঁর নােটে লেখা 

একটি কলেরায় মৃত মানুষের লাশ (৩০/) ধুপুরের নিমশাসা গ্রামে পাওয়া যায়লাশটির পচন ধরিয়া গিয়াছিলপ্রাথমিক রীক্ষাপর আমি লাশটি পুঁতিয়া ফেলিবার নির্দেশ দেইলাশটির কোনাে পরিচয় জানা যায় নাইমিসির আলি বললেন, কলেরায় মৃত, এটা বােঝা গেল কী করে?” 

ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, সেটা আমি কী করে বলব? রিপাের্ট তাে আমার লেখা নাব্রজগােপাল বাবুকে জিজ্ঞেস করেনতিনি জানবেন। 

তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?পুলিশ ডাইরেক্টরেটে খোজ করেনতবে এই সব খোজাখুঁজির কোনাে অর্থ নেইদশ বৎসর আগের ঘটনা মনে করে বসে আছেন নাকি? পুলিশকে আপনারা কী মনে করেন বলেন তাে?” 

ঘটনাটা অস্বাভাবিকসে জন্যই হয়তাে তার মনে থাকবে‘ 

একটা ডেড বডি পাওয়া গেছে পানিতে, এর মধ্যে আপনি অস্বাভাবিক কী দেখলেন? বাংলাদেশে প্রতি দিন কয়টা ডেড বডি পাওয়া যায় জানেন

‘জ্বিনা, জানি নাপুলিশের লাইনে ডেড বডি পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা, বুঝলেন?” 

মিসির আলি মধুপুরে আরাে এক দিন থাকলেনদেখে এলেন, যে জায়গায় লােকটিকে পোঁতা হয়েছিল সেই জায়গাদেখার মতাে কিছু নয়ঘন কাঁটাবন হয়েছে, যার মনে হচ্ছে এই জায়গাটিকে বেশ কিছু দিন লােকজন ভয়ের চোখে দেখেছেনহাঁটাচলা বন্ধ করে দিয়েছে নিশ্চয়ই। 

মিসির আলি অনেকের সঙ্গেই কথা বললেনযদি নতুন কিছু পাওয়া যায় নতুন কোনাে তথ্য, যা কাজে লাগবে, কিন্তু কিছুই জানা গেল নাদশ বৎসর দীর্ঘ সময়এই সময়ে মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়। 

মধুপুর থেকে তিনি গেলেন রানুদের আদি বাড়িতেসেখানে যাবার তারএকটি উদ্দেশ্য, খুঁজে দেখাজালালউদ্দিন নামে কাউকে পাওয়া যায় কি নাএই লােকটিকে পাওয়া খুবই প্রয়ােজন। 

আনিস লক্ষ্য করল, রানু ইদানীং বেশ স্বাভাবিকএর প্রধান কারণ বােধহয় বাড়িঅলার দুটি মেয়েওদের সঙ্গে সে বেশ মিলেমিশে আছেগল্পের বই আনছেভালােমন্দ কিছু রান্না হলেই আগ্রহ করে নিচে নিয়ে যাচ্ছেবাড়িঅলাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা আনিসের পছন্দ নয়বাড়িঅলাদের সে সব সময় শত্রুপক্ষ বলেই মনে করেকয়েক বার ভেবেছিল বলবে মেলামেশাটা কমাতে না বলে ভালােই হয়েছে, এতে যদি অসুখটা চাপা পড়ে তাে ভালােই। 

কাজের একটি ছেলে পাওয়া গেছেজিতু মিয়াএই ছেলেটিও রানুকে বেশ ব্যস্ত রাখছেছেলেটির বয়স দশএগার, তবে মহাবােকাকোনাে কাজই করতে পারে নাকরার আগ্রহও নেই রানু ক্রমাগত বকাঝকা করেও কিছু করতে পারে

তবে তার সময় বেশ কেটে যায়। 

সন্ধ্যাবেলা সে আবার জিতু মিয়াকে নিয়ে পড়াতে বসেজিতু ঘুমঘুম চোখে পড়ে স্বরে স্বরে এই পড়াটি গত এক সপ্তাহ ধরে চলছেজিতু মিয়া কিছুই মনে রাখতে পারছে না, কিন্তু তাতে রানুর উৎসাহে ভাটা পড়ছে না। 

আনিস এক দিন ঠাট্টা করে বলেছে, তুমি দেখি একে বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলছ! রানু তাতে বেশ রাগ করেছেগম্ভীর হয়ে বলেছে, ঠাট্টা করছ কেন? বিদ্যাসাগর তাে এক দিন হতেও পারে। 

অবশ্য অদূরভবিষ্যতে তেমন কোনাে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে নাভবিষ্যৎ বিদ্যাসাগর রােজ রাতেই পড়তেপড়তে ঘুমিয়ে পড়ছে এবং রানু প্লেটে খাবার বেড়ে প্রতি রাতেই প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেএতটা বাড়াবাড়ি আনিসের ভালাে লাগে না, কিন্তু সে কিছু বলে নাথাকুক একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত। 

এর মধ্যে এক দিন আনিস গিয়েছিল মিসির আলি সাহেবের কাছেদ্রলােক বেশ কিছু দিন ঢাকায় ছিলেন নাসবে ফিরেছেনতাঁর চোখ হলুদ, গা হলুদআনিস অবাক হয়ে বলেছে, হয়েছে কী আপনার

জন্ডিসজন্ডিস বাধিয়ে বসেছি‘ 

বলেন কী!‘ 

ইনফেকটাস হেপাটাইটিস। লিভারের অবস্থা কাহিল রে ভাই! আপনার স্ত্রী কেমন আছেন

ভালােআর ভয়টয় পাচ্ছেন না?জ্বিনাখুব ভালাে খবরআমি একটু সুস্থ হলেই যাব আপনার বাসায়জি আচ্ছা‘ 

আমি কিছু খোজখবর পেয়েছিমনে হয় আপনার স্ত্রীর সমস্যাটি ধরতে পেরেছি‘ 

তাই নাকি?হ্যা, একটু ভালাে হলেই নিয়ে কথা বলব‘ 

রানু মিসির আলি সাহেবের জন্ডিসের খবরে খুবই মনখারাপ করলআহা, বেচারা একাএকা কষ্ট করছেচল এক দিন দেখে আসিযাবে? ঠিক আছে, যাব একদিনকবে যাবে? কাল যাবে?এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? জন্ডিস যখন হয়েছে, তখন বেশ কিছু দিন থাকবেএক দিন দেখে এলেই হবে‘ 

আমি এই অসুখের ভালাে অষুধ জানিঅড়হড়ের পাতার রসসকালবেলা এক গ্লাস করে খেলে তিন দিনে অসুখ সেরে যাবে। 

তাই নাকি?‘ 

হাআমার দাদা এই অষুধটা দিতেনতুমি কিছু অড়হড়ের পাতা লােকটিকে দিয়ে এস না। 

ঢাকা শহরে আমি অড়হড়ের পাতা কোথায় পাব? কী যে বল!খুঁজলেই পাবেজংলা গাছ সব জায়গায় হয়‘ 

আনিস যথেষ্ট বিরক্ত হলােরানুর এই একটা প্রবলেমকোনােএকটা জিনিস মাথায় ঢুকলে ওটা নিয়েই থাকবেআনিস বলল, আচ্ছা, দেখি। 

দেখাদেখি না, তুমি খুঁজবেআর শােন, কাল তাে তােমার অফিস নেই, চল ওনাকে দেখে আসি‘ 

এত ব্যস্ত কেন? ভদ্রলােক তাে আর পালিয়ে যাচ্ছেন নারানু থেমেথেমে বলল, আমি অন্য একটা কারণে যেতে চাইকি কারণ?” 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *