তাহলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। সব শখ মিটে গেলে বেঁচে থাকার প্রেরণা নষ্ট হয়ে যায়। যে সব মানুষের শখ মিটে গেছে, তারা খুব অসুখী মানুষ।
অনুফা চুপ করে রইল। মিসির আলি মৃদু স্বরে বললেন, “এবার রানুর কথা বল। ‘কী কথা জানতে চান? ‘সব কথা। ‘ও খুব অদ্ভুত মেয়ে। ও মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারে।‘
কীভাবে বলে? ‘তা জানি না, তবে বলতে পারে। একবার কী হয়েছে, শােনেন। আমি আর ও গল্প করছি, সে হঠাৎ গল্প থামিয়ে বলল—কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের বাড়িতে শ্রীপুরের খালারা বেড়াতে আসবেন। আর সত্যি–সত্যি তাঁরা এলেন।
‘এটা তাে এমনিতেও হতে পারে। মানুষ বেড়াতে আসে না?”
‘তা আসে। কিন্তু শ্রীপুরের খালা পাঁচ বছর পর প্রথম এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের কী–একটা ঝগড়া চলছিল।
‘ও, তাই নাকি?’
‘জি। আরেক গল্প বলি শােনেন, তখন আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রানুদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছি—না, এটা আপনাকে বলা যাবে না।‘
বলা যাবে না কেন?” ‘গল্পটা ভালাে না।‘ “থাক, তাহলে অন্য গল্প বল।
অনুফার স্বামীকেও মিসির আলি সাহেবের বেশ লাগল। গোঁয়ারগগাবিন্দ ধরনের লােক। স্ত্রীর খুবই অনুগত। সে মিসির আলিকে নিয়ে প্রচুর ঘুরল । লােকটির যথেষ্ট প্রভাব–প্রতিপত্তিও দেখা গেল। মধুপুর থানার ওসি সাহেব ওর। কথাতেই পুরােনাে ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখালেন যে, একটি মরা লাশ পাওয়ার খবরে এফআইআর করা হয়েছিল। তখন ওসি ছিলেন ব্রজগােপাল হালদার, তাঁর নােটে লেখা
একটি কলেরায় মৃত মানুষের লাশ (৩০/৩৫) মধুপুরের নিমশাসা গ্রামে পাওয়া যায়। লাশটির পচন ধরিয়া গিয়াছিল। প্রাথমিক পরীক্ষার পর আমি লাশটি পুঁতিয়া ফেলিবার নির্দেশ দেই। লাশটির কোনাে পরিচয় জানা যায় নাই। মিসির আলি বললেন, কলেরায় মৃত, এটা বােঝা গেল কী করে?”
ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, সেটা আমি কী করে বলব? রিপাের্ট তাে আমার লেখা না। ব্রজগােপাল বাবুকে জিজ্ঞেস করেন। তিনি জানবেন।
তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?‘ ‘পুলিশ ডাইরেক্টরেটে খোজ করেন। তবে এই সব খোজাখুঁজির কোনাে অর্থ নেই। দশ বৎসর আগের ঘটনা মনে করে বসে আছেন নাকি? পুলিশকে আপনারা কী মনে করেন বলেন তাে?”
ঘটনাটা অস্বাভাবিক। সে জন্যই হয়তাে তার মনে থাকবে।‘
‘একটা ডেড বডি পাওয়া গেছে পানিতে, এর মধ্যে আপনি অস্বাভাবিক কী দেখলেন? বাংলাদেশে প্রতি দিন কয়টা ডেড বডি পাওয়া যায় জানেন?
‘জ্বি–না, জানি না।‘ ‘পুলিশের লাইনে ডেড বডি পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা, বুঝলেন?”
মিসির আলি মধুপুরে আরাে এক দিন থাকলেন। দেখে এলেন, যে জায়গায় লােকটিকে পোঁতা হয়েছিল সেই জায়গা। দেখার মতাে কিছু নয়। ঘন কাঁটাবন হয়েছে, যার মনে হচ্ছে এই জায়গাটিকে বেশ কিছু দিন লােকজন ভয়ের চোখে দেখেছেন। হাঁটাচলা বন্ধ করে দিয়েছে নিশ্চয়ই।
মিসির আলি অনেকের সঙ্গেই কথা বললেন—যদি নতুন কিছু পাওয়া যায় । নতুন কোনাে তথ্য, যা কাজে লাগবে, কিন্তু কিছুই জানা গেল না। দশ বৎসর দীর্ঘ সময়। এই সময়ে মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়।
মধুপুর থেকে তিনি গেলেন রানুদের আদি বাড়িতে। সেখানে যাবার তার। একটি উদ্দেশ্য, খুঁজে দেখা—জালালউদ্দিন নামে কাউকে পাওয়া যায় কি না। এই লােকটিকে পাওয়া খুবই প্রয়ােজন।
আনিস লক্ষ্য করল, রানু ইদানীং বেশ স্বাভাবিক। এর প্রধান কারণ বােধহয় বাড়িঅলার দুটি মেয়ে। ওদের সঙ্গে সে বেশ মিলেমিশে আছে। গল্পের বই আনছে। ভালােমন্দ কিছু রান্না হলেই আগ্রহ করে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঅলাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা আনিসের পছন্দ নয়। বাড়িঅলাদের সে সব সময় শত্রুপক্ষ বলেই মনে করে। কয়েক বার ভেবেছিল বলবে মেলামেশাটা কমাতে । না বলে ভালােই হয়েছে, এতে যদি অসুখটা চাপা পড়ে তাে ভালােই।
কাজের একটি ছেলে পাওয়া গেছে—জিতু মিয়া। এই ছেলেটিও রানুকে বেশ ব্যস্ত রাখছে। ছেলেটির বয়স দশ–এগার, তবে মহাবােকা। কোনাে কাজই করতে পারে না। করার আগ্রহও নেই । রানু ক্রমাগত বকাঝকা করেও কিছু করতে পারে।
তবে তার সময় বেশ কেটে যায়।
সন্ধ্যাবেলা সে আবার জিতু মিয়াকে নিয়ে পড়াতে বসে। জিতু ঘুমঘুম চোখে পড়ে ‘স্বরে অ স্বরে আ’ । এই পড়াটি গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে। জিতু মিয়া কিছুই মনে রাখতে পারছে না, কিন্তু তাতে রানুর উৎসাহে ভাটা পড়ছে না।
আনিস এক দিন ঠাট্টা করে বলেছে, তুমি দেখি একে বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলছ! রানু তাতে বেশ রাগ করেছে। গম্ভীর হয়ে বলেছে, ঠাট্টা করছ কেন? বিদ্যাসাগর তাে এক দিন হতেও পারে।
অবশ্য অদূর–ভবিষ্যতে তেমন কোনাে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যৎ বিদ্যাসাগর রােজ রাতেই পড়তে–পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছে এবং রানু প্লেটে খাবার বেড়ে প্রতি রাতেই প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। এতটা বাড়াবাড়ি আনিসের ভালাে লাগে না, কিন্তু সে কিছু বলে না। থাকুক একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত।
এর মধ্যে এক দিন আনিস গিয়েছিল মিসির আলি সাহেবের কাছে। দ্রলােক বেশ কিছু দিন ঢাকায় ছিলেন না। সবে ফিরেছেন। তাঁর চোখ হলুদ, গা হলুদ। আনিস অবাক হয়ে বলেছে, হয়েছে কী আপনার?
‘জন্ডিস। জন্ডিস বাধিয়ে বসেছি।‘
বলেন কী!‘
ইনফেকটাস হেপাটাইটিস। লিভারের অবস্থা কাহিল রে ভাই! আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?
ভালাে। ‘আর ভয়টয় পাচ্ছেন না?‘ ‘জ্বি–না।‘ “খুব ভালাে খবর। আমি একটু সুস্থ হলেই যাব আপনার বাসায়। ‘জি আচ্ছা।‘
‘আমি কিছু খোজখবর পেয়েছি। মনে হয় আপনার স্ত্রীর সমস্যাটি ধরতে পেরেছি।‘
“তাই নাকি?” “হ্যা, একটু ভালাে হলেই এ নিয়ে কথা বলব।‘
রানু মিসির আলি সাহেবের জন্ডিসের খবরে খুবই মন–খারাপ করল। ‘আহা, বেচারা একা–একা কষ্ট করছে। চল এক দিন দেখে আসি। যাবে? “ঠিক আছে, যাব একদিন। কবে যাবে? কাল যাবে?” ‘এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? জন্ডিস যখন হয়েছে, তখন বেশ কিছু দিন থাকবে। এক দিন দেখে এলেই হবে।‘
‘আমি এই অসুখের ভালাে অষুধ জানি। অড়হড়ের পাতার রস। সকালবেলা এক গ্লাস করে খেলে তিন দিনে অসুখ সেরে যাবে।
“তাই নাকি?‘
হা। আমার দাদা এই অষুধটা দিতেন। তুমি কিছু অড়হড়ের পাতা ঐ লােকটিকে দিয়ে এস না।
ঢাকা শহরে আমি অড়হড়ের পাতা কোথায় পাব? কী যে বল!‘ ‘খুঁজলেই পাবে। জংলা গাছ সব জায়গায় হয়।‘
আনিস যথেষ্ট বিরক্ত হলাে। রানুর এই একটা প্রবলেম—কোনাে–একটা জিনিস মাথায় ঢুকলে ওটা নিয়েই থাকবে। আনিস বলল, আচ্ছা, দেখি।
‘দেখাদেখি না, তুমি খুঁজবে। আর শােন, কাল তাে তােমার অফিস নেই, চল ওনাকে দেখে আসি।‘
এত ব্যস্ত কেন? ভদ্রলােক তাে আর পালিয়ে যাচ্ছেন না। রানু থেমে–থেমে বলল, আমি অন্য একটা কারণে যেতে চাই।‘ “কি কারণ?”