দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

 ক্যাফিন তােমার নার্ভগুলােকে অ্যাকটিভ রাখবে‘ 

রানু চায়ের পেয়ালা নিল, কিন্তু চুমুক দিল নামাথা নিচু করে বসে রইলমিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বলতে লাগলেন, রানু, তােমাকে নিয়ে এই গল্পটি আমি তৈরি করেছিতুমি মন দিয়ে শােন

তুমি যখন বেশ ছােট নয়, দশ বা এগারবছর বয়স, তখন এক জন বয়স্ক লােক তােমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নির্জন কোনাে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল তােমাদের গ্রামে রকম একটা নির্জন জায়গার খোঁজে আমি গিয়েছিলামসেখানে জঙ্গলের কাছে একটা ভাঙা বিষ্ণুমন্দির দেখেছিমনে হয় জায়গাটাই হবেকারণ সাপের ভয়ে ওখানে কেউ যেত নারানু, তুমি কি আমার কথা শুনছ?” 

শুনছিতারপর সেই বয়স্ক মানুষটি মন্দিরে তােমাকে নিয়ে গেল। 

আমাকে কেউ নিয়ে যায় নিআমি নিজেই গিয়েছিলামমন্দিরে খুব সুন্দর একটি দেবীমূর্তি আছেআমি মূর্তি দেখার জন্যে যেতাম। 

তারপর কী হয়েছে, বলরানু তীক্ষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তীব্র স্বরে বলল, আমি বলব না, আপনি বলুন। 

মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, লােকটি তখন টেনে তােমার পায়জামা খুলে ফেলল। 

রানুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগললােকটির নাম ছিল জালালউদ্দিন। 

রানু কিছু বলল নামিসির আলি বললেন, তােমার অসুখ শুরু হলাে সেদিন থেকেতােমার মনের মধ্যে ব্যাপারটি গেঁথে গেল, পরবর্তী সময়ে গােসলের সময় যখন মরা মানুষটি তােমার পায়ে লেগে গেল, তখন তােমার মনে পড়ল মন্দিরের দৃশ্যবুঝতে পারছ?রানু জবাব দিল না। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

অসুখের মূল কারণটি আলােয় নিয়ে এলেই অসুখ সেরে যায়; এ জন্যেই আমি এটা তােমাকে বললামতুমি নিজেও এখন গােড়া থেকে সমস্ত ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করবেতােমার অসুখ সেরে যাবে। 

রানু মৃদু স্বরে বলল, আপনি কি ঐ লােকটির সঙ্গে কথা বলেছেন?” 

বলেছিকী বলেছে?তেমন কিছু বলে নি। 

না, বলেছে, আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন নাএতটা যখন বলেছেন, তখন বাকিটাও বলুন| রানু তীব্র চোখে তাকাল মিসির আলি বললেন, দেখ রানু, আমি খুবই যুক্তিবাদী মানুষঅলৌকিক কোনাে কিছুতে বিশ্বাস করি নাআমি বিশ্বাস করি সব কিছুরই একটি ব্যাখ্যা আছেজালালউদ্দিন যা বলেছে, তাও নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করা যায়। 

ব্যাখ্যা পরে করবেনআগে বলুন, সে কী বলেছে

সে বলেছে, হঠাৎ সে দেখে মূর্তিটি ছুটে এসে তােমার মধ্যে মিলিয়ে গেছেতােমার গা থেকে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছেজালালউদ্দিন তখন ছুটে পালিয়ে যায়। 

আপনি জালালউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন না?” 

নাওর মনে পাপবােধ ছিলমন্দিরটন্দির নিয়ে মুখ মানুষদের মনে অনেক রকম ভয়ভীতি আছেতা থেকেই সে একটা হেলুসিনেশন দেখেছেতুমি নিজে 

তাে কিছু দেখ নি। 

তাহলেই হলােজালালউদ্দিন কী দেখেছে নাদেখেছে, সেটা তার প্রবলেম, তােমার নয়‘ 

রানু তীক্ষ কণ্ঠে বলল, কিন্তু একটা জিনিস কি জানেন? ঘটনার পর থেকে আমি অসম্ভব সুন্দর হয়ে গেলাম| মিসির আলি শব্দ করে হাসলেনহাসতেহাসতে বললেন, সুন্দর তুমি সব সময়ই ছিলেঘটনাটি ঘটেছে তােমার বয়ঃসন্ধিতেবয়ঃসন্ধির পর মেয়েদের রূপ খুলতে শুরু করেএখানেও তাই হয়েছে

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

কিন্তু দেবীমূর্তিটিকে এর পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি| তুমি কিন্তু খুব ছেলেমানুষের মতাে কথা বলছ রানুমূর্তিটি চুরি গেছে, কেউ নিয়ে পালিয়ে গেছে, ব্যস। 

মূর্তিটি চুরি যায় নি। 

তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর নাএকটা পাথরের মূর্তি তােমার মধ্যে ঢুকে আছে? কি, কর

রানু তীব্র কণ্ঠে বলল, আমার দিকে ভালাে করে তাকিয়ে বলুন, আমাকে কি অনেকটা মূর্তির মতাে দেখায় না?” 

না রানু, মূর্তির মতাে দেখাবে কেন? অসম্ভব রূপবতী একটি তরুণীএর বেশি কিছু নাতােমার মতাে রূপবতী মেয়ে দেশেই আছে এবং তারা সবাই রক্তমাংসের মানুষ। 

রানু উঠে দাঁড়ালমিসির আলি বললেন, চলে যাচ্ছ রানু?হ্যাঅসুখ সারলে তােমাদের ওখানে একবার যাবনা, আপনি আসবেন নাআপনার আসার কোনাে দরকার নেই। 

রানু ঘর ছেড়ে চলে গেলমিসির আলি ক্ষীণস্বরে বললেন, ভেরি ইন্টারেস্টিংতার স্ত্রী কুঞ্চিত হলােতিনি ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারছেন নাযতটা সহজ মনে হয়েছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে নাতিনি মৃত্যুবিষয়ক বইটি আবার পড়তে শুরু করলেনসাবজেক্টটি তাঁকে বেশ আকর্ষণ করেছেফ্যাসিনেটিং টপিক

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

গভীর রাতে আনিস জেগে উঠল শুনশান নীরবতা চারদিকেরানু হাতপাছড়িয়ে বাচ্চা মেয়ের মতাে ঘুমােচ্ছেজানালার আলাে এসে পড়েছে তার মুখেঅদ্ভুত সুন্দর একটি মুখশুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়আনিস ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। বাথরুমে যেতে হবে । 

বাথরুমে পানি জমে আছেপাইপ জ্যাম হয়ে গেছেবাড়িঅলাকে বলতে হবেআনিস নােংরা পানি বাঁচিয়ে সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই শুনল ঝুমঝুম করে শব্দ হচ্ছেনূপুর বাজছে যেনএর মানে কী? মনের ভুল কি? মনের ভুল হবার কথা নয়বেশ বােঝা যাচ্ছে নূপুর পায়ে দিয়ে ঝমঝম করতেকরতে কেউএকজন এঘরওঘর করছেশব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছেমনের ভুলহবার কথা নয়। 

বাথরুমের দরজা খুলতেই শব্দটা চট করে থেমে গেল শুধু একটা তীব্র ফুলের গন্ধ আনিসকে অভিভূত করে ফেললএকটু আগেও তাে রকম সৌরভ ছিল নাআনিসের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল বিস্ময়ের ঘাের অবশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলাে নাআনিসের মনে পড়ল একতলার বাগানে হাস্নাহেনার প্রকাণ্ড একটা ঝাড় আছেবাতাসের ঝাপটায় ফুলের গন্ধই উড়ে এসেছে বারান্দায়আনিস কিছুক্ষণএকাএকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলনূপুরের শব্দ আবার যদি পাওয়া যায়

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

দোতলার একটা বাচ্চা ছেলে শুধু কাঁদছেতার মা তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছেএকটা রিকশী গেল টুনটুন করে ব্যস, আর কিছু শােনা গেল না। 

শােবার ঘরে রানু ঘুমােচ্ছেমড়ার মতােজানালা খােলা। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরেআনিস জানালা বন্ধ করতে গিয়ে শুনল, রান্নাঘর থেকে জিতু মিয়া সাড়াশব্দ দিচ্ছেকান্না চাপার আওয়াজ। 

জিতু মিয়া। 

জিতু ফুপিয়ে উঠলআনিস রান্নাঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালজিতু মশারির ভেতর জবুথবু হয়ে বসে আছে। 

জিতু, কি হয়েছে রে?কিছু হয় নাই। 

বসে আছিস কেন?ঘুম আহে না। 

স্বপ্ন দেখেছিস?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *