ক্যাফিন তােমার নার্ভগুলােকে অ্যাকটিভ রাখবে।‘
রানু চায়ের পেয়ালা নিল, কিন্তু চুমুক দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বলতে লাগলেন, ‘রানু, তােমাকে নিয়ে এই গল্পটি আমি তৈরি করেছি। তুমি মন দিয়ে শােন।
তুমি যখন বেশ ছােট নয়, দশ বা এগার। বছর বয়স, তখন এক জন বয়স্ক লােক তােমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নির্জন কোনাে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল । তােমাদের গ্রামে এ রকম একটা নির্জন জায়গার খোঁজে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে জঙ্গলের কাছে একটা ভাঙা বিষ্ণুমন্দির দেখেছি। মনে হয় ঐ জায়গাটাই হবে। কারণ সাপের ভয়ে ওখানে কেউ যেত না। রানু, তুমি কি আমার কথা শুনছ?”
‘শুনছি। তারপর সেই বয়স্ক মানুষটি মন্দিরে তােমাকে নিয়ে গেল।
‘আমাকে কেউ নিয়ে যায় নি। আমি নিজেই গিয়েছিলাম। ঐ মন্দিরে খুব সুন্দর একটি দেবীমূর্তি আছে। আমি ঐ মূর্তি দেখার জন্যে যেতাম।
তারপর কী হয়েছে, বল।‘ রানু তীক্ষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তীব্র স্বরে বলল, আমি বলব না, আপনি বলুন।
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ঐ লােকটি তখন টেনে তােমার পায়জামা খুলে ফেলল।
রানুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। “ঐ লােকটির নাম ছিল জালালউদ্দিন।
রানু কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, তােমার অসুখ শুরু হলাে সেদিন থেকে। তােমার মনের মধ্যে ব্যাপারটি গেঁথে গেল, পরবর্তী সময়ে গােসলের সময় যখন মরা মানুষটি তােমার পায়ে লেগে গেল, তখন তােমার মনে পড়ল মন্দিরের দৃশ্য। বুঝতে পারছ?” রানু জবাব দিল না।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
অসুখের মূল কারণটি আলােয় নিয়ে এলেই অসুখ সেরে যায়; এ জন্যেই আমি এটা তােমাকে বললাম। তুমি নিজেও এখন গােড়া থেকে সমস্ত ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করবে। তােমার অসুখ সেরে যাবে।
রানু মৃদু স্বরে বলল, আপনি কি ঐ লােকটির সঙ্গে কথা বলেছেন?”
বলেছি।‘ ‘ও কী বলেছে?” ‘তেমন কিছু বলে নি।
‘না, বলেছে, আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন না। এতটা যখন বলেছেন, তখন বাকিটাও বলুন। | রানু তীব্র চোখে তাকাল । মিসির আলি বললেন, “দেখ রানু, আমি খুবই যুক্তিবাদী মানুষ। অলৌকিক কোনাে কিছুতে বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি সব কিছুরই একটি ব্যাখ্যা আছে। জালালউদ্দিন যা বলেছে, তাও নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করা যায়।
ব্যাখ্যা পরে করবেন। আগে বলুন, সে কী বলেছে?
সে বলেছে, হঠাৎ সে দেখে মূর্তিটি ছুটে এসে তােমার মধ্যে মিলিয়ে গেছে। তােমার গা থেকে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। জালালউদ্দিন তখন ছুটে পালিয়ে যায়।
‘আপনি জালালউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন না?”
না। ওর মনে পাপবােধ ছিল। মন্দিরটন্দির নিয়ে মুখ মানুষদের মনে অনেক রকম ভয়–ভীতি আছে। তা থেকেই সে একটা হেলুসিনেশন দেখেছে। তুমি নিজে
তাে কিছু দেখ নি।
‘তাহলেই হলাে। জালালউদ্দিন কী দেখেছে না–দেখেছে, সেটা তার প্রবলেম, তােমার নয়।‘
রানু তীক্ষ কণ্ঠে বলল, “কিন্তু একটা জিনিস কি জানেন? ঐ ঘটনার পর থেকে আমি অসম্ভব সুন্দর হয়ে গেলাম।‘ | মিসির আলি শব্দ করে হাসলেন। হাসতে–হাসতে বললেন, ‘সুন্দর তুমি সব সময়ই ছিলে। ঘটনাটি ঘটেছে তােমার বয়ঃসন্ধিতে। বয়ঃসন্ধির পর মেয়েদের রূপ খুলতে শুরু করে। এখানেও তাই হয়েছে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
‘কিন্তু ঐ দেবীমূর্তিটিকে এর পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। | তুমি কিন্তু খুব ছেলেমানুষের মতাে কথা বলছ রানু। মূর্তিটি চুরি গেছে, কেউ নিয়ে পালিয়ে গেছে, ব্যস।
‘মূর্তিটি চুরি যায় নি।
তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর না—একটা পাথরের মূর্তি তােমার মধ্যে ঢুকে আছে? কি, কর?
রানু তীব্র কণ্ঠে বলল, “আমার দিকে ভালাে করে তাকিয়ে বলুন, আমাকে কি অনেকটা মূর্তির মতাে দেখায় না?”
না রানু, মূর্তির মতাে দেখাবে কেন? অসম্ভব রূপবতী একটি তরুণী—এর বেশি কিছু না। তােমার মতাে রূপবতী মেয়ে এ দেশেই আছে এবং তারা সবাই রক্ত–মাংসের মানুষ।
রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি বললেন, চলে যাচ্ছ রানু?” ‘হ্যা। ‘অসুখ সারলে তােমাদের ওখানে একবার যাব।‘ ‘না, আপনি আসবেন না। আপনার আসার কোনাে দরকার নেই।
রানু ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিসির আলি ক্ষীণস্বরে বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং। তার স্ত্রী কুঞ্চিত হলাে। তিনি ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারছেন না। যতটা সহজ মনে হয়েছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে না। তিনি মৃত্যু–বিষয়ক বইটি আবার পড়তে শুরু করলেন। সাবজেক্টটি তাঁকে বেশ আকর্ষণ করেছে। ফ্যাসিনেটিং টপিক।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
গভীর রাতে আনিস জেগে উঠল । শুনশান নীরবতা চারদিকে। রানু হাত–পা। ছড়িয়ে বাচ্চা মেয়ের মতাে ঘুমােচ্ছে। জানালার আলাে এসে পড়েছে তার মুখে। অদ্ভুত সুন্দর একটি মুখ। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। আনিস ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। বাথরুমে যেতে হবে ।
বাথরুমে পানি জমে আছে। পাইপ জ্যাম হয়ে গেছে। বাড়িঅলাকে বলতে হবে। আনিস নােংরা পানি বাঁচিয়ে সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই শুনল ঝুমঝুম করে শব্দ হচ্ছে। নূপুর বাজছে যেন। এর মানে কী? মনের ভুল কি? মনের ভুল হবার কথা নয়। বেশ বােঝা যাচ্ছে নূপুর পায়ে দিয়ে ঝমঝম করতে–করতে কেউ–একজন এঘর–ওঘর করছে। শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছে। মনের ভুল। হবার কথা নয়।
বাথরুমের দরজা খুলতেই শব্দটা চট করে থেমে গেল । শুধু একটা তীব্র ফুলের গন্ধ আনিসকে অভিভূত করে ফেলল। একটু আগেও তাে এ রকম সৌরভ ছিল না। আনিসের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল । বিস্ময়ের ঘাের অবশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলাে না। আনিসের মনে পড়ল একতলার বাগানে হাস্নাহেনার প্রকাণ্ড একটা ঝাড় আছে। বাতাসের ঝাপটায় ফুলের গন্ধই উড়ে এসেছে বারান্দায়। আনিস কিছুক্ষণ। একা–একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল—নূপুরের শব্দ আবার যদি পাওয়া যায় ।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
দোতলার একটা বাচ্চা ছেলে শুধু কাঁদছে। তার মা তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। একটা রিকশী গেল টুনটুন করে । ব্যস, আর কিছু শােনা গেল না।
শােবার ঘরে রানু ঘুমােচ্ছে। মড়ার মতাে। জানালা খােলা। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরে। আনিস জানালা বন্ধ করতে গিয়ে শুনল, রান্নাঘর থেকে জিতু মিয়া সাড়াশব্দ দিচ্ছে। কান্না চাপার আওয়াজ।
জিতু মিয়া।
জিতু ফুপিয়ে উঠল। আনিস রান্নাঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল। জিতু মশারির ভেতর জবুথবু হয়ে বসে আছে।
‘জিতু, কি হয়েছে রে?” কিছু হয় নাই।
বসে আছিস কেন?” ‘ঘুম আহে না।
স্বপ্ন দেখেছিস?”