জিতু মাথা নাড়ল।
কী স্বপ্ন?’ ‘এক জন মাইয়া মানুষ পাকের ঘরে হাঁটতে আছিল। ‘এই দেখেছিস স্বপ্নে?’ ‘স্বপ্নে দেখি নাই। নিজের চোখে দেখলাম। ‘দূর ব্যাটা, অন্ধকারে তুই মানুষ দেখলি কীভাবে? যা, ঘুমাে।‘ জিতু শুয়ে পড়ল।
আনিস বলল, ভয়ের কিছু নেই, আমি জেগে আছি, ঘুমাে
‘আচ্ছা।
আর শােন, রান্নাঘরে বাতি জ্বালানাে থাকুক। “আচ্ছা।‘
জিতু শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। আনিস একটি সিগারেট ধরাল। ঘুম চটে গেছে। তাকে এখন দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে হবে। এক পেয়ালা চা খেতে পারলে মন্দ হত না। রাত তাে বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা। বাকি রাতটা তার জেগেই কাটবে মনে হয়। সিগারেট টানতে ভালাে লাগছে না। পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে।
ঘুমের মধ্যে রানু শব্দ করে হাসল । আনিস মৃদু স্বরে ডাকল, ‘এই রানু। রানু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “কি?
‘জেগে আছ নাকি?”
‘হ্যা।
কী আশ্চর্য, কখন জাগলে? ‘অনেকক্ষণ। তুমি বাথরুমে গেলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে। ‘আমাকে ডাকলে না কেন? ‘শুধু–শুধু ডাকব কেন?”
আনিস সিগারেট টানতে লাগল। রানু বলল, ‘বড় গরম লাগছে। জানালা বন্ধ করলে কেন?”
‘গরম কোথায়? বেশ ঠাণ্ডা তাে! ‘আমার গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড় না। ‘এই ঠাণ্ডার মধ্যে ফ্যান ছাড়ব কি, কী যে বল!
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
রানু ছােট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যখন বাথরুমে ছিলে তখন কি নূপুরের শব্দ শুনেছ?”
আনিস ঠাণ্ডা স্বরে বলল, না তাে, কেন?
এমনি। আমি শুয়ে–শুয়ে শুনছিলাম। ঘুমাও রানু। আমার ঘুম আসছে না।‘ ঘুম না এলে উঠে বস, গল্প করি। চা খাওয়া যেতে পারে, কি বল?”
রানু উঠে বসল, কিন্তু জবাব দিল না। আনিস দেখল রানু কোন ফাঁকে গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে। ক্লান্ত স্বরে বলল, বড্ড গরম লাগছে। তুমি আমার দিকে। তাকিও না, প্লীজ!’
‘এইসব কী রানু? ঘরে একটা বাচ্চা ছেলে আছে।
‘কী করব, বড় গরম লাগছে। তুমি বরং রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে সব অন্ধকার করে দাও।
বাতি জ্বালানাে থাক।‘ আনিস দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। রানু বলল, আমাদের গ্রামে একটা মন্দির আছে, তার গল্প এখন শুনবে না?‘
‘আহু, মন্দির–ফন্দিরের গল্প এখন শুনব না।
‘আহ্, শোন না! আমার বলতে ইচ্ছে করছে। আমি যখন খুব ছােট, তখন একা–একা যেতাম সেখানে।
‘কি মন্দির? কালীমন্দির?”।
নাহ্, বিষ্ণুমন্দির বলত ওরা। তবে কোনাে বিষ্ণুমূর্তি ছিল না। একটি দেবী ছিল। হিন্দুরা বলত রুকমিনী দেবী।
তুমি মন্দিরে যেতে কী জন্যে? ‘এমনি যেতাম। ছােট বাচ্চা পুতুল খেলে না?”
কী করতে সেখানে?‘ ‘দেবীমূর্তির সাথে গল্পগুজব করতাম। ছেলেমানুষি খেলা আর কি!
বলতে–বলতে রানু খিলখিল করে হেসে উঠল। আনিস স্পষ্ট শুনল সঙ্গে–সঙ্গে ঝমঝম করে কোথাও নূপুর বাজছে। রানু তীক্ষ কণ্ঠে বলল, “শুনতে পাচ্ছ?”
কী শুনব?‘ নূপুরের শব্দ শুনছ না?” আনিস দৃঢ় স্বরে বলল, না। তুমি ঘুমাও রানু। ‘আমার ঘুম আসছে না।‘ “শুয়ে থাক। তুমি অসুস্থ।‘ রানু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, হ্যা, আমি অসুস্থ। তােমাকে খুব বড় ডাক্তার দেখাব আমি। ‘আচ্ছা। ‘এখন শুয়ে থাক। রানু মৃদু স্বরে বলল, “আমি ঐ দেবীকে গান গেয়ে শােনাতাম।‘ ‘ঐ সব অন্য দিন শুনব।‘ ‘আজ রাতে আমার বলতে ইচ্ছে করছে।‘
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
আনিস এসে রানুর হাত ধরল । গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আনিস অবাক হয়ে বলল, “তােমার গা তাে পুড়ে যাচ্ছে!
হুঁ, বড় গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড়বে?” আনিস উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিল। ঘর ভর্তি হয়ে গেল ফুলের গন্ধে। আর তখনি রানু অত্যন্ত নিচু গলায় গুনগুন করে কী যেন গাইতে লাগল। অদ্ভুত অপার্থিব কোনাে–একটা সুর—যা এ জগতের কিছু নয়। অন্য কোনাে ভুবনের। রান্নাঘর থেকে জিতু ডাকতে লাগল, ‘ও ভাইজান, ভাইজান।‘
আনিস রানুকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে গায়ের চাদর টেনে দিল । জিতুকে বলল, এ ঘরে যেন না আসে। তারপর নেমে গেল নিচে, বাড়িঅলার মেয়েটিকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে।
নীলু এল সঙ্গে সঙ্গে। আনিস দেখল রানু শিশুর মতাে ঘুমাচ্ছে। জিতু মিয়া শুধু জেগে আছে। কাঁদছে ব্যাকুল হয়ে। নীলুর সঙ্গে তার বাবাও আসছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘হয়েছেটা কি?” আনিস ভাঙা গলায় বলল, বুঝতে পারছি
, কেমন যেন করছে।
কী করছে?”
আনিস জবাব দিল না। নীলু বলল, ‘বাবা, তুমি শুয়ে থাক গিয়ে, আমি এখানে থাকি। রাত তাে বেশি নেই। ভদ্রলােক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিচে নেমে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, হাসপাতালে নিতে হলে বলবেন, ড্রাইভারকে ডেকে তুলব।‘
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
‘জ্বি আচ্ছা। রানু বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল। একবারও জাগল না। নীলু সারাক্ষণ তার পাশে রইল । আনিসের সঙ্গে তার কথাবার্তা কিছু হলাে না। আনিস বসার ঘরের সােফায় বসে ঝিমুতে লাগল।
মিসির আলি লােকটির ধৈর্য প্রায় সীমাহীন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি দ্বিতীয় দফায় রানুদের গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক ভদ্রলােক, জয়নাল সাহেব। উদ্দেশ্য রুমিনী দেবীর মন্দির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।
জয়নাল সাহেব মন্দির দেখে বিশেষ উল্লসিত হলেন না। তিন শ বৎসরের বেশি এর বয়স হবে না। এ রকম ভগ্নস্তুপ এ দেশে অসংখ্য আছে। মিসির আলি বললেন, তেমন পুরােনাে নয় বলছেন?”
“না রে ভাই। ইটের সাইজ দেখলেই বুঝবেন। ভেঙে টেঙে কী অবস্থা হয়েছে দেখেন!‘
‘যত্ন হয় নি। মন্দির যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি হয়তাে মারা গেছেন কিংবা তার উৎসাহ মিইয়ে গেছে।‘
গ্রামের লােকজনের কাছ থেকে অল্প কিছু তথ্য পাওয়া গেল—পালবাবুদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির। পালরা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরপরই তাদের ভাগ্য–বিপর্যয় শুরু হয়। তিন–চার বছরের মধ্যে পালরা নির্বংশ হয়ে পড়ে। দেবীকে তুষ্ট করার জন্যে তখন এক রাতে কুমারী বলির আয়ােজন করা হয়। বার বছরের একটা কুমারীকন্যাকে অমাবস্যার রাত্রিতে মন্দিরের সামনে বলি দেয়া হয়। দেবীর তুষ্টি হয় না তাতেও। পাথরের মূর্তি এত সহজে বােধহয় তুষ্ট হয়।
তবে গ্রামের মানুষেরা নাকি বলি দেয়া মেয়েটিকে এর পর থেকে গ্রামময় ছুটোছুটি করতে দেখে। ময়মনসিংহ থেকে ইংরেজ পুলিশ সুপার এসে মন্দির তালাবন্ধ করে পালদের দুই ভাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান।