দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

পালরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিলকাজেই ছাড়া পেয়ে এক সময় আবার গ্রামে 

ফিরে আসে, কিন্তু মন্দির তালাবন্ধই পড়ে থাকে। 

ইতিহাস এইটুকুইমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মূর্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা গেল

দুইএক ঘর নিম্নবর্ণের হিন্দু যারা ছিল, তারা বিশেষ কিছু বলতে পারে নাহরিশ মণ্ডল বলল, বাবু, আমরা কেউ দিকে যাই নামন্দিরে গেলে নির্বংশ হতে হয়, কে যাবে বলেন?” 

আপনি তাে শিক্ষিত লােক, এইসব বিশ্বাস করেন

করি না, কিন্তু যাইও নামূর্তিটা আপনি দেখেছেন? আমি দেখি নাই, তবে আমার জ্যাঠা দেখেছেতিনি কি নির্বংশ হয়েছেন?না, তার তিন ছেলেএক ছেলে নান্দিনা হাইস্কুলের হেড মাস্টারমূর্তিটা কেমন ছিল বলতে পারেন? শ্বেতপাথরের মূর্তিকৃষ্ণনগরের কারিগরের তৈরিএকটা হাত ভাঙা ছিলমূর্তি নাকি হঠাৎ উধাও হয়েছে

কেউ চুরিটুরি করে নিয়ে বিক্রি করে ফেলেছেগ্রামে চোরের তাে অভাব নাইরকম একটা মূর্তিতে হাজারখানিক টাকা হেসেখেলে আসবেসাহেবরা নগদ দাম দিয়ে কিনবে‘ 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

আচ্ছা, একটা বাচ্চা মেয়েকে যে বলি দেয়া হয়েছিল, সে নাকি অমাবস্যার রাত্রে ঘুরে বেড়ায়?” 

বলে তাে সবাইচিৎকার করে কাঁদেআমি শুনি নাইঅনেকে শুনেছে। 

অমাবস্যার জন্যে মিসির আলিকে তিন দিন অপেক্ষা করতে হলােতিনি অমাবস্যার রাত্রে একটা পাঁচব্যাটারির টর্চ আর একটা মােটা বাঁশের লাঠি নিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে রইলেনতিনি কিছুই শুনলেন নাশেয়ালের ডাক শােনা গেল অবশ্যিশেষ রাত্রের দিকে প্রচণ্ড বাতাস বইতে লাগলবাতাসে শিষ দেবারমতাে শব্দ হলাে। সে সব নিতান্তই লৌকিক শব্দঅন্য জগতের কিছু নয়রাত শেষ হবার আগেআগে বর্ষণ শুরু হলােছাতা নিয়ে যান নিমন্দিরের ছাদ ভাঙাআশ্রয় নেবার জায়গা নেইমিসির আলি কাকভেজা হয়ে গেলেন। 

ঢাকায় ফিরলেন প্রচণ্ড জ্বর নিয়েডাক্তার পরীক্ষা করে শুকনাে মুখে বললেন, মনে হচ্ছে নিউমােনিয়াএকটা লাংস এফেকটেড, ভােগাবে‘ 

মিসির আলিকে সত্যিসত্যি ভােগালতিনি দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন। 

বইপাড়াতে সময় লােকজন তেমন থাকে নাআজ যেন আরাে নির্জননীলু একাএকা কিছুক্ষণ হাঁটলতার খুব ঘাম হচ্ছেবারবার সবুজ রুমালটি বের করতে হচ্ছেচারটা দশ বাজেচিঠিতে লিখেছে সে চারটার মধ্যেই আসবে, কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে নানীলু অবশ্যি কারাে মুখের দিকে তাকাতেও পারছে নাকাউকে তাকাতে দেখলেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠছে। 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

নীলু একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়লগল্পের বই তার তেমন ভালাে লাগে নাভালাে লাগে বিলুরবিলুর জন্যে একটা কিছু কিনলে হয়, কিন্তু কী কিনবে? সবই হয়তাে ওর পড়াদিন শীর্ষেন্দুর কীএকটা বইয়ের কথা বলছিল নামটা মনে নেই। 

আচ্ছা, আপনাদের কাছে শীর্ষেন্দুর কোনাে বই আছে?জ্বি-নাআমরা বিদেশি বই রাখি না। 

নীলু অন্য একটা ঘরে ঢুকলশুধুশুধু দাঁড়িয়ে থাকা যায় নাসে একটা কবিতার বই কিনে ফেললঅপরিচিত কবি, তবে প্রচ্ছদটি সুন্দর একটি মেয়ের ছবিসুন্দর ছবিনামটি সুন্দর প্রেম নেইকেমন অদ্ভুত নামপ্রেম নেইআবার কী? প্রেম থাকবে না কেন

দাড়িঅলা এক জন রোগা ভদ্রলােক তখন থেকেই তার দিকে তাকাচ্ছেলােকটির কাঁধে একটি ব্যাগ এই কি সে! নীলুর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেলনীলু বইয়ের দাম দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলতার পেছনে ফেরারও সাহস নেইপেছনে ফিরলেই সে হয়তাে দেখবে বুড়াে দাড়িঅলা গুটিগুটি আসছে

না, লােকটি আসছে নানীলুর মনে হলাে, ভয়ানক মােটা এবং বেঁটে একজনকে যেন তাকে অনুসরণ করছেতার দিকে তাকাচ্ছে না, কিন্তু আসছে তার পিছু পিছুনীলুর তৃষ্ণা পেয়ে গেলবড় টেনশানবাড়ি ফিরে গেলে কেমন হয়? কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে নানীলু ঘড়ি দেখল, পাঁচটা পাঁচতার মানে কি 

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

যে সে আসবে না? কথা ছিল নীলু থাকবে ঠিক এক ঘণ্টাসে ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললভালােই হয়েছেদেখা নাহওয়াটাই বােধহয় ভালােদেখা হবার মধ্যে একটা আশাভঙ্গের ব্যাপার আছেনাদেখার রহস্যময়তাটাই না হয় থাকুকনীলু ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল। 

নীলুনীলু দাঁড়িয়ে পড়লএকটু দেরি হয়ে গেলতুমি ভালাে আছ নীলু?চকচকে লাল টাইপরা যে ছেলেটি হাসছে, সে কে? লম্বা স্বাস্থ্যবান একটি 

তরুণঝলমল করছেতার লাল টাই উড়ছেবাতাসে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছেসেন্টের গন্ধপুরুষ মানুষের গা থেকে আসা সেন্টের গন্ধ নীলুর পছন্দ নয়, কিন্তু আজ এত ভালাে লাগছে কেন

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলআপনি বলেছিলেন আপনি বুড়াে। 

আমরা সবাই কিছু-কিছু মিথ্যা বলিআমাকে নীলু নামের একটি মেয়ে লিখেছিল, সে দেখতে কুৎসিত‘ 

লােকটি হাসছে হা হা করে এত সুন্দর করেও মানুষ হাসতে পারে! নীলুর এক ধরনের কষ্ট হতে লাগলমনে হতে লাগল সমস্তটাই একটা সুন্দর স্বপ্ন, খুবই ক্ষণস্থায়ীযেন এক্ষুণি স্বপ্ন ভেঙে যাবেনীলু দেখবে সে জেগে উঠেছে, পাশের বিছানায় বিলু ঘুমাচ্ছে মশারি নাফেলে, কিন্তু সে রকম কিছু হলাে নাছেলেটি হাসিমুখে বলল, কোথাও বসে এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? খাবে

দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

নীলু মাথা নাড়লসে খাবে। 

তুমি কিন্তু সবুজ রুমালটি ব্যাগে ভরে ফেলছ। আমি যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি ‘ 

নীলু অস্বাভাবিক ব্যস্ত হয়ে রুমাল বের করতে গেল একটা লিপস্টিক, একটা ছােট চিরুনি, কিছু খুচরাে পয়সা গড়িয়ে পড়ল নিচেছেলেটি হাসিমুখে সেগুলাে কুড়ােচ্ছেনীলু মনেমনে বললযেন এটা স্বপ্ন না হয়আর স্বপ্ন হলেও যেন স্বপ্নটা অনেকক্ষণ থাকেনীলুর খুব কান্না পেতে লাগল। 

নিউ মার্কেটের ভেতর চা খাওয়ার তেমন ভালাে জায়গা নেইওরা বলাকা বিডিংয়ের দোতলায় গেলচমত্তার জায়গা! অন্ধকারঅন্ধকার চারদিক। 

পরিচ্ছন্ন টেবিলসুন্দর একটি মিউজিক হচ্ছে। 

চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে নীলু

নাহ্। 

এরা ভালাে সমুচা করেসমুচা দিতে বলি? আমার খিদে পেয়েছেকি, বলব?” 

বলুন। 

ছেলেটি হাসলনীলুর খুব ইচ্ছা করছিল, জিজ্ঞেস করে হাসছ কেন তুমি? আমি কি হাস্যকর কিছু করেছি? কিন্তু নীলু কিছু বলল না। ছেলেটি হাসতেহাসতে বলল, আসলে আমি বিজ্ঞাপনটা মজা করবার জন্যে দিয়েছিলাম, কেউ জবাবদেবে ভাবি নি। 

আমি ছাড়া কেউ কি লিখেছিল

তা লিখেছেমনে হচ্ছে দেশের মেয়েদের কাজকর্ম বিশেষ নেইসুযােগ পেলেই ওরা চিঠি লেখেএই কথা বললাম বলে তুমি আবার রাগ করলে না 

তাে?” 

নাহ্। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *