পালরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিল। কাজেই ছাড়া পেয়ে এক সময় আবার গ্রামে
ফিরে আসে, কিন্তু মন্দির তালাবন্ধই পড়ে থাকে।
ইতিহাস এইটুকুই। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মূর্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা গেল।
দুই–এক ঘর নিম্নবর্ণের হিন্দু যারা ছিল, তারা বিশেষ কিছু বলতে পারে না। হরিশ মণ্ডল বলল, ‘বাবু, আমরা কেউ ঐ দিকে যাই না। ঐ মন্দিরে গেলে নির্বংশ হতে হয়, কে যাবে বলেন?”
‘আপনি তাে শিক্ষিত লােক, এইসব বিশ্বাস করেন?
করি না, কিন্তু যাইও না।‘ মূর্তিটা আপনি দেখেছেন? আমি দেখি নাই, তবে আমার জ্যাঠা দেখেছে। তিনি কি নির্বংশ হয়েছেন?” না, তার তিন ছেলে। এক ছেলে নান্দিনা হাইস্কুলের হেড মাস্টার। ‘মূর্তিটা কেমন ছিল বলতে পারেন? ‘শ্বেতপাথরের মূর্তি। কৃষ্ণনগরের কারিগরের তৈরি। একটা হাত ভাঙা ছিল।‘ ‘মূর্তি নাকি হঠাৎ উধাও হয়েছে?
‘কেউ চুরিটুরি করে নিয়ে বিক্রি করে ফেলেছে। গ্রামে চোরের তাে অভাব নাই। এ রকম একটা মূর্তিতে হাজারখানিক টাকা হেসেখেলে আসবে। সাহেবরা নগদ দাম দিয়ে কিনবে।‘
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
“আচ্ছা, একটা বাচ্চা মেয়েকে যে বলি দেয়া হয়েছিল, সে নাকি অমাবস্যার রাত্রে ঘুরে বেড়ায়?”
বলে তাে সবাই। চিৎকার করে কাঁদে। আমি শুনি নাই। অনেকে শুনেছে।
অমাবস্যার জন্যে মিসির আলিকে তিন দিন অপেক্ষা করতে হলাে। তিনি অমাবস্যার রাত্রে একটা পাঁচ–ব্যাটারির টর্চ আর একটা মােটা বাঁশের লাঠি নিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে রইলেন। তিনি কিছুই শুনলেন না। শেয়ালের ডাক শােনা গেল অবশ্যি। শেষ রাত্রের দিকে প্রচণ্ড বাতাস বইতে লাগল। বাতাসে শিষ দেবার। মতাে শব্দ হলাে। সে সব নিতান্তই লৌকিক শব্দ। অন্য জগতের কিছু নয়। রাত শেষ হবার আগে–আগে বর্ষণ শুরু হলাে। ছাতা নিয়ে যান নি। মন্দিরের ছাদ ভাঙা। আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। মিসির আলি কাকভেজা হয়ে গেলেন।
ঢাকায় ফিরলেন প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে। ডাক্তার পরীক্ষা করে শুকনাে মুখে বললেন, মনে হচ্ছে নিউমােনিয়া। একটা লাংস এফেকটেড, ভােগাবে।‘
মিসির আলিকে সত্যি–সত্যি ভােগাল। তিনি দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন।
বইপাড়াতে এ সময় লােকজন তেমন থাকে না। আজ যেন আরাে নির্জন। নীলু একা–একা কিছুক্ষণ হাঁটল। তার খুব ঘাম হচ্ছে। বারবার সবুজ রুমালটি বের করতে হচ্ছে। চারটা দশ বাজে। চিঠিতে লিখেছে সে চারটার মধ্যেই আসবে, কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নীলু অবশ্যি কারাে মুখের দিকে তাকাতেও পারছে না। কাউকে তাকাতে দেখলেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠছে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
নীলু একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। গল্পের বই তার তেমন ভালাে লাগে না। ভালাে লাগে বিলুর। বিলুর জন্যে একটা কিছু কিনলে হয়, কিন্তু কী কিনবে? সবই হয়তাে ওর পড়া। ঐ দিন শীর্ষেন্দুর কী–একটা বইয়ের কথা বলছিল । নামটা মনে নেই।
‘আচ্ছা, আপনাদের কাছে শীর্ষেন্দুর কোনাে বই আছে?” ‘জ্বি-না। আমরা বিদেশি বই রাখি না।
নীলু অন্য একটা ঘরে ঢুকল। শুধু–শুধু দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে একটা কবিতার বই কিনে ফেলল। অপরিচিত কবি, তবে প্রচ্ছদটি সুন্দর । একটি মেয়ের ছবি। সুন্দর ছবি। নামটি সুন্দর প্রেম নেই। কেমন অদ্ভুত নাম। প্রেম নেই’ আবার কী? প্রেম থাকবে না কেন?
দাড়িঅলা এক জন রোগা ভদ্রলােক তখন থেকেই তার দিকে তাকাচ্ছে। লােকটির কাঁধে একটি ব্যাগ । এই কি সে! নীলুর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। নীলু বইয়ের দাম দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল। তার পেছনে ফেরারও সাহস নেই। পেছনে ফিরলেই সে হয়তাে দেখবে বুড়াে দাড়িঅলা গুটিগুটি আসছে।
না, লােকটি আসছে না। নীলুর মনে হলাে, ভয়ানক মােটা এবং বেঁটে একজন। কে যেন তাকে অনুসরণ করছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না, কিন্তু আসছে তার পিছু পিছু। নীলুর তৃষ্ণা পেয়ে গেল। বড় টেনশান। বাড়ি ফিরে গেলে কেমন হয়? কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। নীলু ঘড়ি দেখল, পাঁচটা পাঁচ। তার মানে কি
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
যে সে আসবে না? কথা ছিল নীলু থাকবে ঠিক এক ঘণ্টা। সে ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ভালােই হয়েছে। দেখা না–হওয়াটাই বােধহয় ভালাে। দেখা হবার মধ্যে একটা আশাভঙ্গের ব্যাপার আছে। না–দেখার রহস্যময়তাটাই না হয় থাকুক। নীলু ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল।
নীলু।‘ নীলু দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘একটু দেরি হয়ে গেল। তুমি ভালাে আছ নীলু?” চকচকে লাল টাই–পরা যে ছেলেটি হাসছে, সে কে? লম্বা স্বাস্থ্যবান একটি
তরুণ। ঝলমল করছে। তার লাল টাই উড়ছে। বাতাসে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। সেন্টের গন্ধ। পুরুষ মানুষের গা থেকে আসা সেন্টের গন্ধ নীলুর পছন্দ নয়, কিন্তু আজ এত ভালাে লাগছে কেন?
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বল।‘ ‘আপনি বলেছিলেন আপনি বুড়াে।
আমরা সবাই কিছু-কিছু মিথ্যা বলি। আমাকে নীলু নামের একটি মেয়ে লিখেছিল, সে দেখতে কুৎসিত।‘
লােকটি হাসছে হা হা করে । এত সুন্দর করেও মানুষ হাসতে পারে! নীলুর এক ধরনের কষ্ট হতে লাগল। মনে হতে লাগল সমস্তটাই একটা সুন্দর স্বপ্ন, খুবই ক্ষণস্থায়ী। যেন এক্ষুণি স্বপ্ন ভেঙে যাবে। নীলু দেখবে সে জেগে উঠেছে, পাশের বিছানায় বিলু ঘুমাচ্ছে মশারি না–ফেলে, কিন্তু সে রকম কিছু হলাে না। ছেলেটি হাসিমুখে বলল, কোথাও বসে এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? খাবে?
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
নীলু মাথা নাড়ল—সে খাবে।
তুমি কিন্তু সবুজ রুমালটি ব্যাগে ভরে ফেলছ। আমি যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি ।‘
নীলু অস্বাভাবিক ব্যস্ত হয়ে রুমাল বের করতে গেল । একটা লিপস্টিক, একটা ছােট চিরুনি, কিছু খুচরাে পয়সা গড়িয়ে পড়ল নিচে। ছেলেটি হাসিমুখে সেগুলাে কুড়ােচ্ছে। নীলু মনে–মনে বলল—যেন এটা স্বপ্ন না হয়। আর স্বপ্ন হলেও যেন স্বপ্নটা অনেকক্ষণ থাকে। নীলুর খুব কান্না পেতে লাগল।
নিউ মার্কেটের ভেতর চা খাওয়ার তেমন ভালাে জায়গা নেই। ওরা বলাকা বিডিংয়ের দোতলায় গেল। চমত্তার জায়গা! অন্ধকার–অন্ধকার চারদিক।
পরিচ্ছন্ন টেবিল। সুন্দর একটি মিউজিক হচ্ছে।
‘চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে নীলু?
নাহ্।
‘এরা ভালাে সমুচা করে। সমুচা দিতে বলি? আমার খিদে পেয়েছে। কি, বলব?”
বলুন।
ছেলেটি হাসল। নীলুর খুব ইচ্ছা করছিল, জিজ্ঞেস করে হাসছ কেন তুমি? আমি কি হাস্যকর কিছু করেছি? কিন্তু নীলু কিছু বলল না। ছেলেটি হাসতে–হাসতে বলল, আসলে আমি বিজ্ঞাপনটা মজা করবার জন্যে দিয়েছিলাম, কেউ জবাব। দেবে ভাবি নি।।
‘আমি ছাড়া কেউ কি লিখেছিল?
তা লিখেছে। মনে হচ্ছে এ দেশের মেয়েদের কাজকর্ম বিশেষ নেই। সুযােগ পেলেই ওরা চিঠি লেখে। এই কথা বললাম বলে তুমি আবার রাগ করলে না
তাে?”
নাহ্।