‘গুড়। আমি কিন্তু শুধু তােমার চিঠির জবাব দিয়েছি। অন্য কারাের চিঠির জবাব দিই নি। আমার কথা বিশ্বাস করছ তাে?‘
করছি।‘
বেয়ারা চায়ের পট দিয়ে গেল। ছেলেটি বলল, ‘দাও, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি। ঘরে বানাবে মেয়েরা, কিন্তু বাইরে পুরুষেরা—এ–ই নিয়ম।
নীলু লক্ষ্য করল, ছেলেটি তার কাপে তিন চামচ চিনি দিয়েছে। নীলু এক বার লিখেছে সে চায়ে তিন চামচ চিনি খায়। ছেলেটি সেটা মনে রেখেছে। কী আশ্চর্য!
চায়ে এত চিনি খাওয়া কিন্তু ভালাে না।‘
নীলু কিছু বলল না।
এর পর থেকে চিনি কম খাবে। নীলু ঘাড় নাড়ল। তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইল। নীলু একবার বলল, ‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, উঠি?”
ছেলেটি বলল, আরেকটু বস, আমি বাসায় পৌছে দেব, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। নীলু আর কিছু বলল না।
একটু দেরি হলে তােমাকে আবার বাসায় বকবে না তাে?‘ নাহ্, বকবে না। আমি মাঝে–মাঝে অনেক রাত করে বাসায় ফিরি। ‘সেটা ঠিক না নীলু। শহর বড় হচ্ছে, ক্রাইম বাড়ছে। ঠিক না?”
হ্যা, ঠিক।‘ ‘ঐ দিন কী হলাে জান আমার পরিচিত এক মহিলার কান থেকে টেনে দুল নিয়ে গেছে, রক্তারক্তি কাণ্ড!
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আমি বাইরে গেলে গয়নাটয়না পরি না।‘
–পরাই উচিত। আচ্ছা নীলু, তুমি কি আজ তােমার বাবার সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে?
‘আপনি যদি চান, দেব।‘ ‘আমি নিশ্চয়ই চাই। তুমি কি চাও?‘
‘চাই‘ বলতে গিয়ে নীলুর চোখ ভিজে উঠল। ছেলেটিকে এখন কত–না পরিচিত মনে হচ্ছে! সে যদি এখন হাত বাড়িয়ে নীলুর হাত স্পর্শ করে, তাহলে
কেমন লাগবে নীলুর? ভালােই লাগবে। কিন্তু ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র। সে এমন কিছুই করবে না।
নীলু, আমি তােমার জন্যে একটা উপহার এনেছিলাম। কিন্তু তার আগে বল, তুমি কী এনেছ? তুমি বলেছিলে লাল টাই আনবে। ভুলে গেছ, না?‘
ভুলব কেন? ‘আমি তােমার জন্যেই লাল টাই পরে এসেছি। যদিও লাল রং আমার পছন্দ নয়। আমার পছন্দ হচ্ছে নীল।
‘নীল আমারও পছন্দ।
তবে হালকা নীল, কড়া নীল নয়।
নীলু এই প্রথম অল্প হাসল। হাল্কা নীল তার নিজেরও পছন্দ। ছেলেটি হাসতে–হাসতে বলল, আমার সবচে’ অপছন্দ হচ্ছে সবুজ রং। কিন্তু দেখ, আজ
সবুজ রংটাও খারাপ লাগছে না।
তারা উঠে দাঁড়াল সাড়ে আটটার দিকে। হেঁটে–হেঁটে এল নিউমার্কেটের গেটে। ছােট্ট একটা হােন্ডা সিভিক সেখানে পার্ক করা। ছেলেটি ঘড়ি দেখে বলল, রাত কি বেশি হয়ে গেল নীলু?”
না, বেশি হয় নি। ‘তােমার বাবা দুশ্চিন্তা না–করলে হয়। আমি চাই না আমার জন্যে কেউ বকা খাক। অবশ্যি এক–আধ দিন বকা খেলে কিছু যায়–আসে না, কি বল?‘
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
নীলু হাসল। ছেলেটিও হাসল। মার্জিত হাসি।
‘সরাসরি বাসায় যাবে, নাকি যাবার আগে আইসক্রীম খাবে? ধানমণ্ডিতে একটা ভালাে আইসক্রীমের দোকান দিয়েছে।‘
‘আজ আর যাব না। “ঠিক আছে, চল বাসায় পৌঁছে দিই।‘
ছেলেটি নীলুকে তাদের গেটের কাছে নামিয়ে দিল। নীলুর খুব ইচ্ছে করছিল তাকে বসতে বলে, কিন্তু তার বড় লজ্জা করল। বিলু নানান প্রশ্ন শুরু করবে।
‘স্যার, ভেতরে আসব?‘
“এস। কী ব্যাপার?‘
মিসির আলি মেয়েটিকে ঠিক চিনতে পারলেন না। তিনি কখনাে তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের চিনতে পারেন না।
স্যার, আমার নাম নীলু, নীলুফার।
“ও, আচ্ছা।
মিসির আলি পরিচিত ভঙ্গিতে হাসলেন কিন্তু নামটি তার কাছে অপরিচিত লাগছে। এও এক সমস্যা। কারাে নাম তিনি মনে রাখতে পারেন না। তার জ্ব কুঞ্চিত হলাে। নাম মনে না করতে পারার একটিই কারণ—মানুষের প্রতি তাঁর আগ্রহ নেই। আগ্রহ থাকলে নাম মনে থাকত।
স্যার, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি সেকেন্ড ইয়ারের। এক দিন এসেছিলাম আমরা চার বন্ধু।
‘ও হঁ্যা। এসেছিলে তােমরা। মনে পড়েছে। আজ কী ব্যাপার?‘ ‘মেয়েটি ইতস্তত করতে লাগল। তার মানে কী? কমবয়েসী মেয়েদের তিনি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেন। তরলমতি মেয়েরা মাঝে–মাঝে অনেক অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে বসে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
“তােমার কী ব্যাপার, বল। ‘স্যার, আমি ঐ ইএসপির টেস্টটা আবার দিতে চাই।‘ ‘এক বার তাে দিয়েছ। আবার কেন?‘ মিসির আলি বিস্মিত হলেন। এই মেয়েটির মতিগতি তিনি বুঝতে পারছেন ।
‘স্যার, আমার মনে হয়, এবার পরীক্ষা করলে দেখা যাবে—আমার ইএসপি আছে।
‘এ রকম মনে হবার কারণ কী?
মেয়েটি উত্তর না–দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। লক্ষণ ভালাে নয়। মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, এখন আমি একটু ব্যস্ত আছি। অন্য এক দিন এস।
মেয়েটি তবুও কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল।
তুমি কি অন্য কিছু বলতে চাও? ‘জ্বি–না স্যার। আমি যাই । স্নামালিকুম। মিসির আলি গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। এ মেয়েটিকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে । এরা সহজেই একটা ঝামেলা বাধিয়ে দিতে পারে। এ রকম সুযােগ দেয়া ঠিক।
বারটায় একটা ক্লাস ছিল। মিসির আলি গিয়ে দেখলেন কোনাে ছাত্র–ছাত্রী নেই। কোনাে স্ট্রাইক হচ্ছে কি? এ রকম কিছু শােনেন নি। সামনে হয়তাে টার্ম পরীক্ষা আছে। টার্ম পরীক্ষা থাকলে ছাত্ররা দল বেঁধে আসা বন্ধ করে দেয়। মিসির আলি কুঁচকে খালি ক্লাসে মিনিট পাঁচেক বসে রইলেন। গত রাতে অসুস্থ শরীরে এই ক্লাসটির জন্যে পড়াশােনা করেছেন। এ অবস্থা হবে জানলে সকাল
সকাল শুয়ে পড়তে পারতেন। ছাত্ৰশূন্য একটি ক্লাসে তিনি খাতাপত্র নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন হাস্যকর দৃশ্য। অনেকেই করিডাের দিয়ে হাঁটবার সময় তাকে কৌতুহলী হয়ে দেখল। পাগলটাগল ভাবছে বােধহয়। মিসির আলি উঠে পড়লেন। | আজকের দিনটিই শুরু হয়েছে খারাপভাবে। একটি কাজও ঠিকমতাে হচ্ছে না। মিসির আলি ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। তার কপালের মাঝখানে ব্যথা শুরু হলাে। এই উপসর্গটি নতুন। ব্লাড–প্রেশারট্রেশার হয়েছে বােধহয়। ডাক্তার দেখাতে হবে।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
তিনি বাড়ি ফিরলেন তিনটার দিকে। এই অসময়েও বসার ঘরে কে যেন বসে আছে। সমস্ত দিনটিই যে খারাপ যাবে, এটা হচ্ছে তার প্রমাণ। গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা–পয়সা চাইতে কেউ এসেছে নির্ঘাত।
‘কে?‘ “জ্বি, আমি আনিস।
আনিস সাহেব, আপনি এই সময়ে! অফিস নেই?” ছুটি নিয়ে এলাম। ব্যাপার কী? রানুর শরীরটা বেশি খারাপ। ভাবলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। ‘ভালােই করেছেন। বসেন, চা–টা দিয়েছে? “জ্বি, চা খেয়েছি। আপনার ভাই ছিলেন এতক্ষণ।
বসুন, আমি কাপড় ছেড়ে আসি।‘