দেবী উপন্যাস -পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

মাঝরাতের দিকে রানুর ঘুম ভেঙে গেল । 

তার মনে হলাে ছাদে কে যেন হাঁটছেসাধারণ মানুষের হাঁটা নয়, পা টেনেটেনে হাঁটাসে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, এই, এইআনিসের ঘুম ভাঙল না দেবী

বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছেঅল্পঅল্প বাতাসবাতাসে জামগাছের পাতায়অদ্ভুত এক রকমের শব্দ উঠছেরানু আবার ডাকল, এই, একটু ওঠ নাএই। 

কী হয়েছে?কে যেন ছাদে হাঁটছে।‘ 

কী যে বল! কে আবার ছাদে হাঁটবে? ঘুমাও তােপ্লীজ, একটু উঠে বসআমার বড় ভয় লাগছে। 

আনিস উঠে বসলপ্রবল বর্ষণ শুরু হলাে এই সময়ঝমঝম করে বৃষ্টিজানালার পর্দা বাতাসে পতপত করে উড়তে লাগলরানু হঠাৎ দেখল, জানালার শিক ধরে খালিগায়ে একটি রােগামতাে মানুষ দাঁড়িয়ে আছেমানুষটির দুটি হাতই অসম্ভব লম্বারানু ফিসফিস করে বলল, ওখানে কে?‘ 

কোথায় কে

যে জানালায়আহ্, কী যে ঝামেলা কর! নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে। 

একটু বাতিটা জ্বালাও নারানু, তুমি ঘুমােও তাে‘ 

আনিস শােবার উপক্রম করতেই ছাদে বেশ কয়েক বার থপথপ শব্দ হলােযেন কেউএক জন ছাদে লাফাচ্ছে। 

রানু চমকে উঠে বলল, কিসের শব্দ হচ্ছে?‘ 

বানরজায়গায় বানর আছেকালই তাে দেখলে ছাদে লাফালাফি করছিল‘ 

আমার বড় ভয় করছেএকটু উঠে গিয়ে বাতি জ্বালাও নাপায়ে পড়ি তােমার| আনিস বাতি জ্বালালঘড়িতে বাজে দেড়টাছাদে আর কোনাে শব্দ শােনা যাচ্ছে নাতবু রানুর ভয় কমল নাসে কেঁপেকেঁপে উঠতে লাগলআনিস 

বিরক্ত স্বরে বলল, রকম করছ কেন?” 

কেন জানি অন্য রকম লাগছে আমারএকটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি‘ 

কী স্বপ্ন?দেখলাম আমি যেন...। 

কথার মাঝখানে হঠাৎ রানু থেমে গেলকে যেন হাসছেভারি গলায় হাসছেরানু কাপা স্বরে বলল, হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছ? কে যেন হাসছে‘ 

কে আবার হাসবে! বানরের শব্দকিংবা কেউ হয়তাে জেগে উঠেছেদোতলায়। 

আনিস লক্ষ্য করল, রানু খুব ঘামছেচোখমুখ রক্তশূন্যবালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলদেশলাই জ্বালাতেজ্বালাতে বলল, কী স্বপ্ন দেখছিলে?” 

দিনের বেলা বলব‘ 

কী যে সব কুসংস্কার তােমাদের! এখনাে ভয় লাগছে? হ্যাভয়টা কিসের? চোরডাকাতের, না ভূতের? বুঝতে পারছি না। 

ঠিক আছে, বাতি জ্বালানােই থাকবাতি জ্বালিয়েই ঘুমাব আজকেএখন বল দেখি, কী স্বপ্ন দেখলে?” 

দিনের বেলা বলবআহ্ বল না! বললেই ভয় কেটে যাবে‘ 

রানু আনিসের বাঁ হাত শক্ত করে চেপে ধরলথেমেথেমে বলল, দেখলাম, একটা ঘরে আমি শুয়ে আছিএকটা বেঁটে লােক এসে ঢুকলতারপর দেখলাম, সে আমার শাড়ি টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। 

আনিস শব্দ করে হাসল রানু বলল, হাসছ কেন?হাসব না? এটা কি একটা ভয় পাওয়ার স্বপ্ন?” 

তুমি তাে সবটা শােন নি। 

সবটা শুনতে হবে নাপরে কী হবে তা আমার জানাতুমি যা দেখেছ তা হচ্ছে একটা সেক্সয়াল ফ্যান্টাসিযুবকযুবতীরা রকম স্বপ্ন প্রায়ই দেখে। 

আমি দেখি নাতুমিও দেখমনে থাকে না তােমারআমি স্বপ্ন খুব কম দেখি। যা দেখি তা সব সময় সত্যি হয়তােমাকে তাে 

 

বলেছি অনেক বার । 

আনিস চুপ করে রইলরানু এই কথাটি প্রায়ই বলেবিয়ের রাতে প্রথম বার বলেছিলআনিস সেবারও হেসেছেরানু অবাক হয়ে বলেছে, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, না?‘ 

নাহআমি আপনার গা ছুঁয়ে বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা। 

রানু এমনভাবে বলল, যেন আনিসের বিশ্বাসের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছেআনিস শেষ পর্যন্ত হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম, এখন দয়া করে আপনিআপনি করবে নারানু ফিসফিস করে বলল, আপনার সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে, সেটাও আমি জানতাম। 

এটাও স্বপ্নে দেখেছিলে?” 

হুদেখলাম, একটি লােক খালিগায়ে দাঁড়িয়ে আছেতার পেটের কাছে একটা মস্ত কাটা দাগ লােকটিকে দেখেই মনে হলাে, এর সঙ্গে আমার বিয়ে হবেআমি তাকে বললাম, কেটেছে কীভাবে? আপনি বললেন, সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। 

আনিস সে রাতে দীর্ঘক্ষণ কোনাে কথা বলতে পারে নিতার পেটে একটা কাটা দাগ সত্যিসত্যি আছে, এই মেয়েটির সেটা জানার কথা নয়তবে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে কাটে নিজামগাছ থেকে পিছলে পড়ে কেটেছেব্যাপারটা কাকতালীয়, বলাই বাহুল্যমাঝেমাঝে এমন দুইএকটা জিনিস খুব মিলে যায়তবুও কোথায় যেন একটা ক্ষীণ অস্বস্তি থাকে। 

বাইরে বৃষ্টি খুব বাড়ছেঝড়টড় হবে বােধহয়। শোঁশোঁ আওয়াজ হচ্ছে জানালায়একটি কাচ ভাঙাপ্রচুর পানি আসছে ভাঙা জানালা দিয়ে, শীতশীত করছে। 

রানু, চল ঘুমিয়ে পড়িসিগারেট শেষ হয়েছে? । 

বিছানায় ওঠামাত্র প্রবল শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল। বাতি চলে গেল সঙ্গেসঙ্গেশুধু অঞ্চল নয়, সমস্ত ঢাকাই বােধ করি অন্ধকার হয়ে গেলআনিস বলল, ভয় লাগছে রানু

হ্যাআচ্ছা, হাসির গল্পটল্প কর। এতে ভয় কমে যায়বল একটা গল্প‘ 

তুমি বল । 

আনিস দীর্ঘ সময় নিয়ে এক জন পাদ্রী তিনটি ইহুদি তিনটি মেয়ের গল্প বলল গল্পের এক পর্যায়ে শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করতে হয়পাদ্রী তখন কী বলল? এর উত্তরটি হচ্ছে পাঞ্চ লাইন, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না রানুসে কি শুনছে ?

আনিস ডাকল, এই রানু, এই!’ রানু কথা বলল নাবাতাসের ঝাপটায় সশব্দে জানালার একটি পাল্লা খুলে গেলআনিস বন্ধ করবার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই রানু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল, তুমি যেও নাখবরদার, যেও না

কী আশ্চর্য, কেন?একটাকিছু জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে‘ 

কী যে বল!প্লীজ, প্লীজরানু কেঁদে ফেললফোপাতেফোঁপাতে বলল, তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?“কিসের গন্ধ?কপূরের গন্ধের মতাে গন্ধ। 

এটা কি মনের ভুল? সূক্ষ্ম একটা গন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে ঘরে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *