নীলু জবাব দিল না। “বল, ঠিক না?”
হ্যা।‘ তােমাকে প্রথম দিন দেখেই...‘
সে চুপ করে গেল। নীলুর চোখে জল এল।
নীলু, আজ যদি তােমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, তাহলে তােমার আপত্তি আছে?”
নীলু ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল । জবাব দিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে বসেছিল। সে তার চোখের জল তাকে দেখাতে চায় না।
বল নীলু, আপত্তি আছে?‘ ‘আমাকে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।‘ ‘আটটার আগেই আমরা বাড়ি ফিরব। এস উঠি।‘
সে নীলুর হাত ধরল। ভালবাসার স্পর্শ, যার জন্যে তরুণীরা সারা জীবন প্রতীক্ষা করে থাকে।
রানু আজ অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন দিন প্রায় শেষ। আকাশ লালচে হতে শুরু করেছে। সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের বারান্দায় বিলু হাঁটছে একা–একা। রানুর কেমন জানি অস্বস্তি বােধ হতে লাগল । যেন কোথাও কিছু–একটা অস্বাভাবিকতা আছে, সে ধরতে পারছে না। নিচে থেকে বিলু ডাকল, রানু ভাবী, চা খেলে নেমে এস, চা হচ্ছে।‘
‘চা খাব না।
আস না বাবা! ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার বলব। কুইক। রানু নেমে গেল। তার মাথায় সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছুই ভালাে লাগছে । বমিবমি ভাব হচ্ছে ।
বারান্দায় নীলুর বাবাও ছিলেন। ওপর থেকে তাঁকে দেখা যায় নি। তিনি নরম স্বরে বললেন, এখন তুমি কেমন আছ মা?
“জ্বি, ভালাে।
‘আমি আনিস সাহেবকে বলেছি বড় একজন ডাক্তার দেখাতে। পিজির একজন প্রফেসর আছেন, আমার আত্মীয়, তাঁকে আমি বলে দেখতে পারি। তুমি আলাপ করাে আনিসের সাথে, কেমন?
“জ্বি, করব।‘
বিলু বলল, বাবা, ঘরে গিয়ে তুমি চা খাও। তােমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমরা দুই জন বাগানে বসি।‘ ভদ্রলােকে চলে গেলেন সঙ্গে–সঙ্গে।
রানু বলল, নীলু কোথায়? ‘ওর এক বন্ধুর বাড়ি গেছে।‘
বন্ধুর বাড়ি যাওয়া এমন কোনাে ব্যাপার নয়, তবু কেন জানি রানুর বুকে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল। ভোতা এক ধরনের যন্ত্রণা হতে লাগল মাথায়। বিলু বলল, রানু ভাবী, তােমাকে একটা গােপন কথা বলছি। টপ সিক্রেট, কাউকে বলবে না।‘
, বলব না।‘ ‘ইভেন নীলু আপাকেও নয়। কারণ কথাটা তাকে নিয়েই। “ঠিক আছে, কাউকে বলব না।‘
নীলু আপা ডুবে–ডুবে জল খাচ্ছে। আজকে সকালে টের পেয়েছি।‘ ‘তাই নাকি?‘
‘হ্যা। নীলু আপার ট্রাঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি। জনৈক ভদ্রলােক দারুণ সব রােমান্টিক চিঠি লিখেছে নীলু আপাকে। খুব লদকালদকি।‘
বিলু হাসল। রানু কিছু বলল না। তার মাথার যন্ত্রণাটা ক্রমেই বাড়ছে।
‘দু একটা চিঠি পড়ে দেখতে চাও?‘ ‘না, না। অন্যের চিঠি।‘
‘আহ্, পড় না, কেউ তাে জানতে পারছে না। আমরা ব্যাপারটা টপ সিক্রেট রাখব, তাহলেই তাে হলাে।
না বিলু, আমি চিঠি পড়ব না।‘ ‘পড়ব না বললে হবে না। পড়তেই হবে। দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি। যে আলাে আছে তাতে দিব্যি পড়তে পারবে।‘
বিলু ঘর থেকে চিঠি নিয়ে এল। রানু চিঠিটি হাতে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিলু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
না, কিছু হয় নি। এ রকম করছ কেন?‘ মাথা ধরেছে। বড় মাথা ধরেছে।
‘প্যারাসিটামল এনে দেব? তুমি চিঠিটা পড়ে আমাকে বল ভদ্রলােক সম্পর্কে তােমার কী ধারণা।
রানু চিঠি পড়ল। বিলু বলল, বল, তােমার কী মনে হয়? রানু কিছু বলল না। এক হাতে মাথার চুল টেনে ধরল। “তােমার কী হয়েছে? বড় শরীর খারাপ লাগছে। আমি এখন যাই।‘
চা খাবে না?” না। বিলু, নীলু কখন ফিরবে বলে গেছে?
না। সন্ধ্যার আগে–আগেই ফিরবে বােধহয়। তােমার কি শরীর বেশি খারাপ লাগছে?‘
হ্যা।‘ ‘তা হলে যাও, শুয়ে থাক গিয়ে।‘
রানু উপরে উঠে এল। ঘর অন্ধকার । বাতি জ্বালাতে ইচ্ছে হলাে না। শুয়ে পড়ল বিছানায়। আনিস আজ ফিরতে দেরি করবে। তার অফিসে কী–সব নাকি ঝামেলা হচ্ছে। রানু ডাকল, ‘জিতু জিতু মিয়া।‘ কেউ সাড়া দিল না। জিতু কি বাসায় নেই? ‘জিতু—জিতু।‘ কোনাে উত্তর নেই। জিতু মিয়া ইদানীং বেশ লায়েক হয়েছে। রানু কিছু বলে না বলেই হয়তাে বিকেলে খেলতে গিয়ে সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফেরে। বকাঝকা তার গায়ে লাগে না।
রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছে। ইঁদুর। নিশ্চয়ই ইঁদুর। তবু রানু বলল, ‘কে?” খুটখুট শব্দ থেমে গেল। ইঁদুর ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু সেই গন্ধটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। কড়া ফুলের গন্ধ। রানুর ইচ্ছে হলাে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। রানু দুর্বল গলায় ডাকল, জিতু, জিতু মিয়া। আর ঠিক তখন কে–একজন ডাকল, রানুরানু। এই ডাক রানুর চেনা। এই জীবনে সে অনেক বার শুনেছে। তবে এটা কিছু নয়। প্রফেসর সাহেব বলছেন, অডিটরি হেলুসিনেশন‘। আসলেই তাই। এ ছাড়া আর কিছু নয়।
রানুরানু।‘ ‘কে? তুমি কে?‘
রানুর মনে হলাে কেউ–একজন যেন এগিয়ে আসছে। তার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ছােট্ট–ছােট্ট পা নিশ্চয়ই। হালকা শব্দ। পায়ে কি নূপুর আছে? নূপুর বাজছে?
রানু চোখ বন্ধ করে ফেলল। এ সব সত্যি নয়, চোখের ভুল। রানু দুর্বল গলায় বলল, তুমি কে?
‘আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?”
কিশােরীর গলায় মৃদু হাসি শােনা গেল। ‘তাকাও রানু। তাকালেই চিনবে।‘ ‘আমি চিনতে চাই না।‘
‘তােমার বন্ধু নীলুর খুব বিপদ, রানু। এক দিন তােমার যে বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল, তার চেয়েও অনেক বড় বিপদ।
দরজায় ধাক্কা পড়ছে। জিতু এসেছে বােধহয়। রানু তাকাল, কোথাও কেউ নেই। ফুলের গন্ধ কমে আসছে। জিতু মিয়া বাইরে থেকে ডাকল, আম্মা, আম্মা। রানু উঠে দরজা খুলল।
‘আপনের কী হইছে?
“কিছু হয় নি।
রানু এসে শুয়ে পড়ল। তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। সে বিছানায় ছটফট করতে লাগল। কখন আসবে আনিস? কখন আসবে?
‘নিচে গিয়ে দেখে আয় তাে নীলু ফিরেছে নাকি।‘