ঝন্ঝন্ করে আরেকটা কাচ ভাঙল। রানু বলল, “ঐ জিনিসটা হাসছে। শুনতে পাচ্ছ না?‘ বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আনিস কিছু শুনতে পেল না।
তুমি বস তাে। আমি হারিকেন জ্বালাচ্ছি।‘
না, তুমি আমাকে ধরে বসে থাক।
আনিস অস্বস্তির সঙ্গে বলল, তুমি ঐ জানালাটার দিকে আর তাকিও না তাে!‘ আনিস লক্ষ্য করল, রানু থরথর করে কাঁপছে, ওর গায়ের উত্তাপও বাড়ছে। রানুকে সাহস দেবার জন্যে সে বলল, “কোনাে দোয়া–টোয়া পড়লে লাভ হবে? আয়াতুল কুর্সি জানি আমি । আয়াতুল কুর্সি পড়ব?’
রানু জবাব দিল না। তার চোখ বড়–বড় হয়ে উঠেছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে নাকি? শ্বাস ফেলছে টেনে–টেনে।
‘এই রানু, এই।
কোনােই সাড়া নেই। আনিস হারিকেন জ্বালাল। রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। ইদুর, এতে সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি ভালাে লাগছে না। আনিস বারান্দায় এসে ডাকল, রহমান সাহেব, ও রহমান সাহেব। রহমান সাহেব বােধহয় জেগেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন।
কী ব্যাপার? ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
কী হয়েছে? ‘বুঝতে পারছি না।‘
হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?” বুঝতে পারছি না।‘ ‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।
আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে হলাে সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানােমাত্র কেউ–এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রােগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, রানু। রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, ‘কি?‘
ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, এখন কেমন অবস্থা?” রানু অবাক হয়ে বলল, “কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?
রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, তােমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?
ভালাে।‘ রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, এখন আমি ভালাে।
রহমান সাহেব তবুও মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, “আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?
সে তাে রােজই শুনি। বাঁদরের উৎপাত। ‘আমিও তাই ভাবছিলাম।’ ‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে–দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।‘
তাই নাকি?”
‘জ্বি। নতুন এসেছেন তাে! কয়েক দিন যাক, টের পাবেন। বাড়িঅলাকে বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।‘
‘জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন নাকি এক কাপ?”
“আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই । কোনাে অসুবিধা দেখলে ডাকবেন।
ভদ্রলােক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, এই রাত–দুপুরে ভদ্রলােককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!
‘তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই ভদ্রলােককে ডাকলাম।
কী করেছিলাম আমি? অনেক কাণ্ড করেছ। এখন তুমি কেমন, সেটা বল। ‘ভালাে।‘
কী রকম ভালাে?” ‘বেশ ভালাে।‘
ভয় লাগছে না আর?” নাহ।‘
রানু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। সে বেশ সহজ ও স্বাভাবিক। ভয়ের কোনাে চিহ্নও নেই চোখে–মুখে। শাড়ি কোমরে জড়িয়ে ঘরের পানি সরাবার ব্যবস্থা করছে।
সকালে যা করবার করবে। এখন এসব রাখ তাে।‘ ‘ইস্, কী অবস্থা হয়েছে দেখ না! ‘হােক, এস তাে এদিকে। রানু হাসি–হাসি মুখে এগিয়ে এল। ‘এখন আর তােমার ভয় লাগছে না?” ‘না।‘
জানালার পাশে কে যেন দাঁড়িয়েছিল বলেছিলে?‘ ‘এখন কেউ নেই। আর থাকলেও কিছু যায় আসে না।
আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। হালকা গলায় বলল, ‘এক কাপ চা করতে পারবে?‘
‘চা, এত রাতে!‘ ‘এখন আর ঘুম আসবে না, কর দেখি এক কাপ।‘
রানু চা বানাতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ফোটার শব্দ হলাে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। রানু একা–একা রান্নাঘরে। কে বলবে এই মেয়েটিই অল্প কিছুক্ষণ আগে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল! ছাদে আবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বানর এসেছে নাকি? আনিস উঠে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিল। হালকা গলায় বলল, “ছাদে বড় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে?” রানু জবাব দিল না।
আনিস বলল, এই বাড়িটা ছেড়ে দেব।‘ ‘সস্তায় এ রকম বাড়ি আর পাবে না।‘ ‘দেখি পাই কি না।‘
চায়ে চিনি হয়েছে তােমার?” হয়েছে। তুমি নিলে না?”
নাহ্, রাত–দুপুরে চা খেলে আমার আর ঘুম হবে না। রানু হাই তুলল। আনিস বলল, “এখন বল তাে তােমার স্বপ্ন–বৃত্তান্ত।‘ ‘কোন স্বপ্নের কথা?‘ ‘ঐ যে স্বপ্ন দেখলে! একটা বেঁটে লােক।।
কখন আবার এই স্বপ্ন দেখলাম? কী যে তুমি বল!