দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

আনিস আর কিছু বলল নাচা শেষ করে ঘুমুতে গেলশীতশীত করছিলরানু পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতাে শুয়েছেএকটি হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে আনিসকেতার ভারি নিঃশ্বাস পড়ছেঘুমিয়ে পড়েছে বােধহয়জানালায় নারকেল গাছের ছায়া পড়েছেমানুষের মতােই লাগছে ছায়াটাকে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছেমনে হচ্ছে মানুষটি হাত নাড়ছেঘরের ভেতর মিষ্টি একটা গন্ধমিষ্টি, কিন্তু অচেনা

দেবী উপন্যাস

আনিস রানুকে কাছে টেনে আনলরানুর মুখে আলাে এসে পড়েছেকী যে মায়াবতী লাগছে! আনিস ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র মাসআনিস এখনাে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনিপ্রতি রাতেই রানুর মুখ তার কাছে অচেনা লাগেঅপরূপ রূপবতী একটি বালিকার মুখ, যাকে কখনাে পুরােপুরি চেনা যায় নাআনিস ডাকল, রানু, রানুকোনাে জবাব পাওয়া গেল নাগাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন রানুআনিসের ঘুম এল নাশুয়েশুয়ে ঠিক করে ফেলল, রানুকে ভালাে এক জন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবেঅফিসের কর্মলেন্দুবাবুএক ভদ্রলােকের কথা প্রায়ই বলেন, খুব নাকি গুণী লােকমিসির সাহেবদেখালে হয় এক বার মিসির সাহেবকে| রানু ঘুমের ঘােরে খিলখিল করে হেসে উঠলঅপ্রকৃতিস্থ মানুষের হাসি শুনতে ভালাে লাগে না, গা ছমছম করে। 

ভদ্রলােকের বাড়ি খুঁজে বের করতে অনেক দেরি হলােকাঁঠালবাগানের এক গলির ভেতর পুরােনাে ধাঁচের বাড়িঅনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর অসম্ভব রােগা এক ভদ্রলােক বেরিয়ে এলেনবিরক্ত মুখে বললেন, কাকে চান

মিসির সাহেবকে খুঁজছিতাকে কী জন্যে দরকার? জি, আছে একটা দরকারআপনি কি মিসির সাহেব?” 

হাবলেন, দরকারটা বলেনরাস্তায় দাঁড়িয়ে সমস্যার কথা বলতে হবে নাকি? আনিস অস্বস্তি বােধ করতে লাগলকিন্তু ভদ্রলােকের ভাবভঙ্গি রকম যে, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, ভেতরে ঢুকতে দেবেন নাআনিস বলল, ভেতরে এসে বলি

ভেতরে আসবেন? ঠিক আছে, আসুন। 

মিসির সাহেব যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেনঘন অন্ধকারতিনচারটা বেতের চেয়ার ছাড়া আসবাবপত্র কিছু নেই। 

বসুন আপনি। 

আনিস বসলদ্রলােক বললেন, আজ আমার শরীর ভালাে নাআলসার আছেব্যথা হচ্ছে এখনতাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন। 

আমার স্ত্রীর একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছিআপনার নাম শুনেই এসেছি‘ 

আমার নাম শুনে এসেছেন?জি।‘ 

আমার এত নামডাক আছে, তা তাে জানতাম না! স্পেসিফিক্যালি বলুন তাে কার কাছে শুনেছেন

আনিস আমতাআমতা করতে লাগলভদ্রলােক অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, বলুন, কে বলল?” 

আমাদের অফিসের এক ভদ্রলােককমলেন্দুবাবুআপনি নাকি তাঁর বােনের চিকিৎসা করেছিলেন। 

আচ্ছা, চিনেছি, কমলেন্দুশােনেন, আমি কিন্তু ডাক্তার না, জানেন তাে? জ্বি স্যার, জানি। 

আচ্ছা, আগে এক কাপ চা খান, তারপর কথা বলবরুগীটি কে বললেন? আপনার স্ত্রী

বয়স কত? ষােলসতেরবলেন কী! আপনার বয়স তাে মনে হয় চল্লিশের মতাে, ঠিক না?আনিস শুকনাে গলায় বলল, আমার সাঁইত্রিশরকম অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করেছেন কেন?” 

এটা আবার কেমন প্রশ্নআনিসের মনে হলাে, কমলেন্দুবাবুর কথা শুনে এখানে আসাটা ঠিক হয় নিভদ্রলােকের নিজেরই মনে হয় মাথার ঠিক নেইএক জন অপরিচিত মানুষকে কেউ রকম কথা জিজ্ঞেস করে

বলুন বলুন, রকম অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করলেন কেন?” 

হয়ে গেছে আর কি। 

বলতে চান না বোঝা যাচ্ছেঠিক আছে, বলতে হবে নাচাকথা বলে আসিচা খেয়ে তারপর শুরু করব‘ 

ভদ্রলােক আনিসকে বাইরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেনতারপর আর আসার নামগন্ধ নেইআটবছরের একটি বাচ্চা মেয়ে এক কাপ দারুণ মিষ্টি সরভাষা চা দিয়ে চলে গেলতারপর আর কোনাে সাড়াশব্দ নেইদেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায়আনিস বেশ কয়েক বার কাশলদুই বার গলা উঁচিয়ে ডাকল, বাসায় কেউ আছেন?কোনাে সাড়া নেইকী ঝামেলা

কমলেন্দুবাবু অবশ্য বারবার বলে দিয়েছেনএই লােকের কথাবার্তার ঠিকঠিকানা নেইতবে লােকটা অসাধারণআনিসের কাছে অসাধারণ কিছু মনে হয় নিতবে চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণএইটি অবশ্য প্রথমেই চোখে পড়েআর দ্বিতীয় যে জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হচ্ছে তার আঙুলঅস্বাভাবিক লম্বালম্বা 

সব কটা আঙুল। 

এই যে, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। 

না, ঠিক আছেঠিক থাকবে কেন? ঠিক না‘ 

লােকটি এই প্রথম বার হাসলথেমেথেমে বলল, আলসার আছে তাে, ব্যথায় কাহিল হয়ে শুয়েছিলামঅমনি ঘুম এসে গেল। 

আমি তাহলে অন্য এক দিন আসি?” 

না, এসেছেন যখন বসুনচা দিয়েছিল

বেশ, এখন বলুন কী বলবেন

আনিস চুপ করে রইলএটা এমন একটা ব্যাপার, যা চট করে অপরিচিত কাউকে বলা যায় নাভদ্রলােক শান্ত স্বরে বললেন, আপনার স্ত্রীর মাথার ঠিক নেই, তাই তাে?‘ 

জ্বিনা স্যার, মাথা ঠিক আছে। পাগল নন? জ্বিনা‘ 

তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?মাঝেমাঝে সে অস্বাভাবিক আচরণ করে। 

কী রকম অস্বাভাবিক? ভয় পায়মাঝেমাঝেই রকম হয়। 

ভয় পায়? তার মানে কী?

কিসের ভয়? ভূতের ভয়ঠিক জানেন, ভয়টা ভূতের? জ্বিনা, ঠিক জানি নামনে হয় রকম। 

ভদ্রলােক একটি চুরুট ধরিয়ে খকখক করে কাশতেকাশতে বললেন, বর্মা থেকে আমার এক বন্ধু এনেছে, অতি বাজে জিনিসআনিস কিছু বলল নাতবে এই ভদ্রলােকের স্টাইলটি তার পছন্দ হলােভদ্রলােক অবলীলায় অন্য একটি প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেনএবং এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আগের কথাবার্তা তাঁর কিছুই মনে নেই। 

“এ রকম চুরুট চারপাঁচটা খেলে যক্ষ্মা হয়ে যাবেআপনাকে দেব একটা?জ্বিনা। 

ফেলে দিলে মায়া লাগে বলে খাইখাওয়ার জিনিস নাঅখাদ্যতবে হাভানা চুরুটগুলি ভালােহাভানা চুরুট খেয়েছেন কখনাে

জ্বিনাখুব ভালােমাঝেমাঝে আমার এক বন্ধু আমাকে দিয়ে যায়‘ 

ভদ্রলােক চুরুটে টান দিয়ে আবার ঘর কাঁপিয়ে কাশতে লাগলেনকাশি থামতেই বললেন, এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবযথাযথ জবাব দেবেন। 

জ্বি আচ্ছাপ্রথম প্রশ্ন, আপনার স্ত্রী কি সুন্দরী?‘ 

বেশ সুন্দরী?” 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *