আনিস আর কিছু বলল না। চা শেষ করে ঘুমুতে গেল। শীত–শীত করছিল। রানু পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতাে শুয়েছে। একটি হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে আনিসকে। তার ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বােধহয়। জানালায় নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে। মানুষের মতােই লাগছে ছায়াটাকে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। মনে হচ্ছে মানুষটি হাত নাড়ছে। ঘরের ভেতর মিষ্টি একটা গন্ধ। মিষ্টি, কিন্তু অচেনা।
আনিস রানুকে কাছে টেনে আনল। রানুর মুখে আলাে এসে পড়েছে। কী যে মায়াবতী লাগছে! আনিস ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ‘ মাস। আনিস এখনাে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। প্রতি রাতেই রানুর মুখ তার কাছে অচেনা লাগে। অপরূপ রূপবতী একটি বালিকার মুখ, যাকে কখনাে পুরােপুরি চেনা যায় না। আনিস ডাকল, রানু, রানু। কোনাে জবাব পাওয়া গেল না। গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন রানু। আনিসের ঘুম এল না। শুয়ে–শুয়ে ঠিক করে ফেলল, রানুকে ভালাে এক জন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অফিসের কর্মলেন্দুবাবু। এক ভদ্রলােকের কথা প্রায়ই বলেন, খুব নাকি গুণী লােক। মিসির সাহেব। দেখালে হয় এক বার মিসির সাহেবকে। | রানু ঘুমের ঘােরে খিলখিল করে হেসে উঠল। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের হাসি শুনতে ভালাে লাগে না, গা ছমছম করে।
ভদ্রলােকের বাড়ি খুঁজে বের করতে অনেক দেরি হলাে। কাঁঠালবাগানের এক গলির ভেতর পুরােনাে ধাঁচের বাড়ি। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর অসম্ভব রােগা এক ভদ্রলােক বেরিয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, কাকে চান?
‘মিসির সাহেবকে খুঁজছি।‘ তাকে কী জন্যে দরকার? ‘জি, আছে একটা দরকার। আপনি কি মিসির সাহেব?”
হা। বলেন, দরকারটা বলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সমস্যার কথা বলতে হবে নাকি? আনিস অস্বস্তি বােধ করতে লাগল। কিন্তু ভদ্রলােকের ভাবভঙ্গি এ রকম যে, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। আনিস বলল, ‘ভেতরে এসে বলি?
‘ভেতরে আসবেন? ঠিক আছে, আসুন।
মিসির সাহেব যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ঘন অন্ধকার। তিন–চারটা বেতের চেয়ার ছাড়া আসবাবপত্র কিছু নেই।
বসুন আপনি।
আনিস বসল। দ্রলােক বললেন, “আজ আমার শরীর ভালাে না। আলসার আছে। ব্যথা হচ্ছে এখন। তাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন।
‘আমার স্ত্রীর একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি। আপনার নাম শুনেই এসেছি।‘
‘আমার নাম শুনে এসেছেন?‘ ‘জি।‘
‘আমার এত নামডাক আছে, তা তাে জানতাম না! স্পেসিফিক্যালি বলুন তাে কার কাছে শুনেছেন?
আনিস আমতা–আমতা করতে লাগল। ভদ্রলােক অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, ‘বলুন, কে বলল?”
‘আমাদের অফিসের এক ভদ্রলােক। কমলেন্দুবাবু। আপনি নাকি তাঁর বােনের চিকিৎসা করেছিলেন।
“ও আচ্ছা, চিনেছি, কমলেন্দু। শােনেন, আমি কিন্তু ডাক্তার না, জানেন তাে? “জ্বি স্যার, জানি।
“আচ্ছা, আগে এক কাপ চা খান, তারপর কথা বলব। রুগীটি কে বললেন? আপনার স্ত্রী?
‘বয়স কত? ‘ষােল–সতের। ‘বলেন কী! আপনার বয়স তাে মনে হয় চল্লিশের মতাে, ঠিক না?” আনিস শুকনাে গলায় বলল, আমার সাঁইত্রিশ। ‘এ রকম অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করেছেন কেন?”
এটা আবার কেমন প্রশ্ন। আনিসের মনে হলাে, কমলেন্দুবাবুর কথা শুনে এখানে আসাটা ঠিক হয় নি। ভদ্রলােকের নিজেরই মনে হয় মাথার ঠিক নেই। এক জন অপরিচিত মানুষকে কেউ এ রকম কথা জিজ্ঞেস করে?
‘বলুন বলুন, এ রকম অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করলেন কেন?”
হয়ে গেছে আর কি।
বলতে চান না বোঝা যাচ্ছে। ঠিক আছে, বলতে হবে না। চা‘র কথা বলে আসি। চা খেয়ে তারপর শুরু করব।‘
ভদ্রলােক আনিসকে বাইরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। তারপর আর আসার নামগন্ধ নেই। আট–ন‘ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে এক কাপ দারুণ মিষ্টি সর–ভাষা চা দিয়ে চলে গেল। তারপর আর কোনাে সাড়াশব্দ নেই। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আনিস বেশ কয়েক বার কাশল। দুই বার গলা উঁচিয়ে ডাকল, বাসায় কেউ আছেন?’ কোনাে সাড়া নেই। কী ঝামেলা!
কমলেন্দুবাবু অবশ্য বারবার বলে দিয়েছেন—এই লােকের কথাবার্তার ঠিকঠিকানা নেই। তবে লােকটা অসাধারণ। আনিসের কাছে অসাধারণ কিছু মনে হয় নি। তবে চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। এইটি অবশ্য প্রথমেই চোখে পড়ে। আর দ্বিতীয় যে জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হচ্ছে তার আঙুল। অস্বাভাবিক লম্বা–লম্বা
সব কটা আঙুল।
‘এই যে, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।
না, ঠিক আছে।‘ ‘ঠিক থাকবে কেন? ঠিক না।‘
লােকটি এই প্রথম বার হাসল। থেমে–থেমে বলল, আলসার আছে তাে, ব্যথায় কাহিল হয়ে শুয়েছিলাম। অমনি ঘুম এসে গেল।
‘আমি তাহলে অন্য এক দিন আসি?”
না, এসেছেন যখন বসুন। চা দিয়েছিল?
‘বেশ, এখন বলুন কী বলবেন?
আনিস চুপ করে রইল। এটা এমন একটা ব্যাপার, যা চট করে অপরিচিত কাউকে বলা যায় না। ভদ্রলােক শান্ত স্বরে বললেন, আপনার স্ত্রীর মাথার ঠিক নেই, তাই তাে?‘
‘জ্বি–না স্যার, মাথা ঠিক আছে। ‘পাগল নন? ‘জ্বি–না।‘
তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?” মাঝে–মাঝে সে অস্বাভাবিক আচরণ করে।
কী রকম অস্বাভাবিক? ভয় পায়। মাঝে–মাঝেই এ রকম হয়।
ভয় পায়? তার মানে কী?
কিসের ভয়? ভূতের ভয়। “ঠিক জানেন, ভয়টা ভূতের? ‘জ্বি–না, ঠিক জানি না। মনে হয় এ রকম।।
ভদ্রলােক একটি চুরুট ধরিয়ে খকখক করে কাশতে–কাশতে বললেন, বর্মা থেকে আমার এক বন্ধু এনেছে, অতি বাজে জিনিস।‘ আনিস কিছু বলল না। তবে এই ভদ্রলােকের স্টাইলটি তার পছন্দ হলাে। ভদ্রলােক অবলীলায় অন্য একটি প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। এবং এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আগের কথাবার্তা তাঁর কিছুই মনে নেই।
“এ রকম চুরুট চার–পাঁচটা খেলে যক্ষ্মা হয়ে যাবে। আপনাকে দেব একটা?” “জ্বি–না।
‘ফেলে দিলে মায়া লাগে বলে খাই। খাওয়ার জিনিস না। অখাদ্য। তবে হাভানা চুরুটগুলি ভালাে। হাভানা চুরুট খেয়েছেন কখনাে?
“জ্বি–না। “খুব ভালাে। মাঝে–মাঝে আমার এক বন্ধু আমাকে দিয়ে যায়।‘
ভদ্রলােক চুরুটে টান দিয়ে আবার ঘর কাঁপিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামতেই বললেন, এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। যথাযথ জবাব দেবেন।
“জ্বি আচ্ছা। ‘প্রথম প্রশ্ন, আপনার স্ত্রী কি সুন্দরী?‘
‘বেশ সুন্দরী?”