‘আপনার স্ত্রী কখন ভয় পান—রাতে না দিনে?’ ‘সাধারণত রাতে। তবে এক বার দুপুরে ভয় পেয়েছিল। ‘ভয়টা কী রকম সেটা বলেন। মনে হয় কিছু–একটা দেখে। ‘সব বার একই জিনিস দেখেন, না একেক বার একেক রকম?” ‘এটা আমি ঠিক বলতে পারছি না।‘
এই সময় কি তিনি কোনাে রকম গন্ধ পান? ‘আমি ঠিক বলতে পারছি না। ‘যখন সুস্থ হয়ে ওঠেন, তখন কি তঁার ভয়ের কথা মনে থাকে?
‘বেশির ভাগ সময়ই থাকে না, তবে মাঝে–মাঝে থাকে। ‘আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই খারাপ।
উনি প্রথম কখন ভয় পেয়েছিলেন, বলতে পারেন? “জ্বি–না। তবে খুব ছােটবেলায়। ‘প্রথম ভয়ের ঘটনাটা আমাকে বলুন। ‘আমি সেটা ঠিক জানি না।
‘আপনি অনেক কিছুই জানেন না মনে হচ্ছে। আপনার স্ত্রীকে একদিন নিয়ে আসুন।
আনিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি তাকে আনতে চাই না। ‘কেন চান না?
‘সে খুব সেনসিটিভ। সে যদি টের পায় যে, তার এই অস্বাভাবিকতা নিয়ে আমি লােকজনের সাথে আলাপ করছি, তাহলে খুব মন–খারাপ করবে।
| দেখুন ভাই, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে কিছুই করা যাবে না। আপনার স্ত্রী অসুস্থ এবং আমার মনে হচ্ছে এই অসুখ দ্রুত বেড়ে যাবে। আপনি তাঁকে নিয়ে আসবেন।
আনিস উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনাকে কত দেব?
ভদ্রলােক বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কমলেন্দুবাবু কি আপনাকে বলেন নি আমি ফিস নিই না? এই কাজটি আমি শখের খাতিরে করি, বুঝতে পারছেন?
জ্বি পারছি।
তবে আপনি যদি ভালাে গােলাপের চারা পান, তাহলে আমাকে দিতে পারেন। আমার গােলাপের খুব শখ। সব মিলিয়ে ত্রিশটি ডিফারেন্ট ভেরাইটির চারা আমার কাছে আছে। একটা আছে দারুণ ইন্টারেস্টিং, ঘাসফুলের মতাে ছােট সাইজের গােলাপ।
“তাই নাকি? ‘জ্বি। ওরা বলে মাইক্রো রােজ। হল্যাণ্ডের গােলাপ। কড়া গন্ধ। দেখবেন?”
আরেক দিন দেখব। আজ দেরি হয়ে গেছে, আমার স্ত্রী একা থাকে।‘ ‘ও, তাই নাকি? শােনেন, একা তাকে রাখবেন না। কখনাে যেন মেয়েটি একা থাকে। এটা খুবই জরুরি।‘
রাস্তায় নেমে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। খামােকা সময় নষ্ট। লােকটি তেমন কিছু জানে না। কমলেন্দুবাবু যে সব আধ্যাত্মিক শক্তিটক্তির কথা বলেছেন, সে সব মনে হয় নেহায়েতই গালগল্প। তবে লােকটির কথাবার্তা বেশ ফোর্সফুল।
রানুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এক বার এনে দেখালে হয়। ক্ষতি তাে কিছু নেই।
তা ছাড়া ভদ্রলােক খুব সম্ভব ফ্যালনাও নন। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির টীচার । একেবারে কিছু না–জেনে তাে কেউ মাষ্টারি করে না। কিছু নিশ্চয়ই জানেন। মানুষের চেহারা দেখে কিছু অনুমান করাটাও ঠিক না।
আনিস অফিসে চলে গেলে রানুর খুব একলা লাগে। কিছুই করার থাকে না। গোছানাে আলনা আবার নতুন করে গােছায়। বসার ঘরের বেতের সােফা ঝাড়ন দিয়ে ঝাড়ে। শােবার মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে–মুছতে চকচকে করে ফেলে, তবু সময় কাটে না। এক সময় তেতলার বারান্দায় গিয়ে বসে। এ–বাড়ির ছােট বারান্দাটি তার খুব পছন্দ। গ্রিল দেওয়া বারান্দাটি গােলাকার। এখানে বসে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনেই একটা মেয়েদের স্কুল। টিফিন টাইমে মেয়েগুলাের কাণ্ডকারখানা দেখতে এমন মজা লাগে! রানু প্রায় সারা দুপুর বারান্দাতেই বসে থাকে। একা–একা ঘরে বসে থাকতে ভালাে লাগে না। কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটু যেন ভয়ভয়ও লাগে।
অবশ্য যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে থাকে, তখন ভয়ভয় ভাবটা কমে যায়। বিকেলবেলা বাড়িঅলার মেয়ে দুটি তাদের ভেতরের দিকের বাগানে বসে মজা করে চা খায়। চা খেতে–খেতে দুইজনেই খুব হাসাহাসি করে। একেক দিন ওদের বাবাও সঙ্গে বসেন, রানুর দেখতে বেশ লাগে।
ছােট মেয়েটির সঙ্গে রানুর কিছু দিন আগে আলাপ হয়েছিল। বেশ মেয়েটি! খুব স্মার্ট। দেখতেও সুন্দর। এক দিন দুপুরে রানু বারান্দায় এসে বসেছে, মেয়েটি এসে উপস্থিত। মুখে চাপা হাসি। হাতে কী–একটা বই। এসেই বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।
“কি কথা?” ‘আপনি সারা দিন বারান্দায় বসে থাকেন কেন?
সারা দিন কোথায়? দুপুরবেলায় বসি। কিছু করার নেই তাে, একা–একা লাগে।‘
‘তা ঠিক। বসব আপনার এখানে? আজ আমি কলেজে যাই নি। বােটানি প্র্যাকটিক্যাল ছিল আজকে।‘
মেয়েটি খুব সহজভাবে বসল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একগাদা কথা বলল। তারপর যাবার সময় হঠাৎ বলল, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করব?
আপনি এত সুন্দর কেন? যে আমার চেয়েও সুন্দরী, তাকে আমার ভালাে লাগে না।
রানু কী বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, “আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি ধারণা, জানেন? তাদের ধারণা, আমি হচ্ছি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। ওদের এক দিন এনে আপনাকে দেখিয়ে দেব।
“ঠিক আছে, দিও। আরেকটু বস । চা খাবে?”
না, চা আমি বেশি খাই না। বেশি চা খেলে গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যায়।
মেয়েটি যেমন হুট করে এসেছিল, তেমনি হুট করে নিচে নেমে গেল। বেশ লাগল রানুর । নতুন বাসাটা তার ভালােই লাগছে। পুরােনাে ঢাকায় হলেও বেশ। নিরিবিলি। মালিবাগের বাসাটার মতাে নয়। নিঃশ্বাস নেবার জায়গা ছিল না। সেখানে। পাশ দিয়ে রাত–দিন রিকশা যাচ্ছে, গাড়ি যাচ্ছে। জঘন্য! এই বাসাটা ভেতরের দিকে। বাড়িঅলা দ্রলােকও বেশ ভালােমানুষ। প্রথম দিনেই আনিসকে বলেছেন, আমার বাড়ি ভাড়া দেবার দরকার নেই। টাকার জন্যেই তাে বাড়ি ভাড়া। টাকা যথেষ্ট আছে। তবু দুই ঘর ভাড়াটে রাখি। কারণ এত বড় বাড়িতে মানুষ না–থাকলে ভালাে লাগে না। কবরখানা–কবরখানা ভাব চলে আসে। তবে সবাইকে আমি বাড়ি ভাড়া দিই না। আপনাকে দিচ্ছি, কারণ আপনাকে পছন্দ হয়েছে।
| ভাড়াও খুব কম। মাত্র ছয় শ‘ টাকা। তিন–রুমের এত বড় একটা বাড়ি ছয় শ‘ টাকায় পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রানু এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে বাথরুম। বড় ঝকঝকে একটা বাথরুম। বাসাটা রানুর খুব পছন্দ হয়েছিল। আনিস যখন বলল, “কি, নেব? পছন্দ হয়?
হয়
ভালাে করে ভেবে বল নেব কি না। দুই দিন পর যদি বল পছন্দ না, তাহলে মুশকিলে পড়ব। মালিবাগের বাসাটা ভালো ছিল। শুধু–শুধু বদলালাম।