দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

আপনার স্ত্রী কখন ভয় পানরাতে না দিনে?সাধারণত রাতেতবে এক বার দুপুরে ভয় পেয়েছিলভয়টা কী রকম সেটা বলেনমনে হয় কিছুএকটা দেখেসব বার একই জিনিস দেখেন, না একেক বার একেক রকম?এটা আমি ঠিক বলতে পারছি না‘ 

এই সময় কি তিনি কোনাে রকম গন্ধ পান? আমি ঠিক বলতে পারছি নাযখন সুস্থ হয়ে ওঠেন, তখন কি তঁার ভয়ের কথা মনে থাকে

বেশির ভাগ সময়ই থাকে না, তবে মাঝেমাঝে থাকেআপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই খারাপদেবী উপন্যাস  

উনি প্রথম কখন ভয় পেয়েছিলেন, বলতে পারেন? জ্বিনাতবে খুব ছােটবেলায়প্রথম ভয়ের ঘটনাটা আমাকে বলুনআমি সেটা ঠিক জানি না। 

আপনি অনেক কিছুই জানেন না মনে হচ্ছেআপনার স্ত্রীকে একদিন নিয়ে আসুন। 

আনিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি তাকে আনতে চাই নাকেন চান না

সে খুব সেনসিটিভসে যদি টের পায় যে, তার এই অস্বাভাবিকতা নিয়ে আমি লােকজনের সাথে আলাপ করছি, তাহলে খুব মনখারাপ করবে। 

| দেখুন ভাই, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে কিছুই করা যাবে নাআপনার স্ত্রী অসুস্থ এবং আমার মনে হচ্ছে এই অসুখ দ্রুত বেড়ে যাবেআপনি তাঁকে নিয়ে আসবেন। 

আনিস উঠে দাঁড়ালক্ষীণ স্বরে বলল, আপনাকে কত দেব

ভদ্রলােক বিস্মিত হয়ে বললেন, কমলেন্দুবাবু কি আপনাকে বলেন নি আমি ফিস নিই না? এই কাজটি আমি শখের খাতিরে করি, বুঝতে পারছেন

জ্বি পারছি। 

তবে আপনি যদি ভালাে গােলাপের চারা পান, তাহলে আমাকে দিতে পারেনআমার গােলাপের খুব শখসব মিলিয়ে ত্রিশটি ডিফারেন্ট ভেরাইটির চারা আমার কাছে আছেএকটা আছে দারুণ ইন্টারেস্টিং, ঘাসফুলের মতাে ছােট সাইজের গােলাপ। 

তাই নাকি? জ্বিওরা বলে মাইক্রো রােজহল্যাণ্ডের গােলাপকড়া গন্ধদেখবেন?” 

আরেক দিন দেখবআজ দেরি হয়ে গেছে, আমার স্ত্রী একা থাকে।, তাই নাকি? শােনেন, একা তাকে রাখবেন নাকখনাে যেন মেয়েটি একা থাকেএটা খুবই জরুরি‘ 

রাস্তায় নেমে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেলখামােকা সময় নষ্টলােকটি তেমন কিছু জানে নাকমলেন্দুবাবু যে সব আধ্যাত্মিক শক্তিটক্তির কথা বলেছেন, সে সব মনে হয় নেহায়েতই গালগল্পতবে লােকটির কথাবার্তা বেশ ফোর্সফুল। 

রানুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এক বার এনে দেখালে হয়ক্ষতি তাে কিছু নেই। 

তা ছাড়া ভদ্রলােক খুব সম্ভব ফ্যালনাও ননক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির টীচার একেবারে কিছু নাজেনে তাে কেউ মাষ্টারি করে নাকিছু নিশ্চয়ই জানেনমানুষের চেহারা দেখে কিছু অনুমান করাটাও ঠিক না। 

আনিস অফিসে চলে গেলে রানুর খুব একলা লাগেকিছুই করার থাকে নাগোছানাে আলনা আবার নতুন করে গােছায়বসার ঘরের বেতের সােফা ঝাড়ন দিয়ে ঝাড়েশােবার মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতেমুছতে চকচকে করে ফেলে, তবু সময় কাটে নাএক সময় তেতলার বারান্দায় গিয়ে বসেবাড়ির ছােট বারান্দাটি তার খুব পছন্দগ্রিল দেওয়া বারান্দাটি গােলাকারএখানে বসে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়সামনেই একটা মেয়েদের স্কুলটিফিন টাইমে মেয়েগুলাের কাণ্ডকারখানা দেখতে এমন মজা লাগে! রানু প্রায় সারা দুপুর বারান্দাতেই বসে থাকেএকাএকা ঘরে বসে থাকতে ভালাে লাগে নাকেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসেএকটু যেন ভয়ভয়ও লাগে। 

অবশ্য যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে থাকে, তখন ভয়ভয় ভাবটা কমে যায়বিকেলবেলা বাড়িঅলার মেয়ে দুটি তাদের ভেতরের দিকের বাগানে বসে মজা করে চা খায়চা খেতেখেতে দুইজনেই খুব হাসাহাসি করেএকেক দিন ওদের বাবাও সঙ্গে বসেন, রানুর দেখতে বেশ লাগে। 

ছােট মেয়েটির সঙ্গে রানুর কিছু দিন আগে আলাপ হয়েছিলবেশ মেয়েটি! খুব স্মার্টদেখতেও সুন্দরএক দিন দুপুরে রানু বারান্দায় এসে বসেছে, মেয়েটি এসে উপস্থিতমুখে চাপা হাসিহাতে কীএকটা বইএসেই বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি। 

কি কথা?” ‘আপনি সারা দিন বারান্দায় বসে থাকেন কেন

সারা দিন কোথায়? দুপুরবেলায় বসিকিছু করার নেই তাে, একাএকা লাগে‘ 

‘তা ঠিকবসব আপনার এখানে? আজ আমি কলেজে যাই নিবােটানি প্র্যাকটিক্যাল ছিল আজকে‘ 

মেয়েটি খুব সহজভাবে বসলঘণ্টাখানেকের মধ্যে একগাদা কথা বললতারপর যাবার সময় হঠাৎ বলল, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করব

আপনি এত সুন্দর কেন? যে আমার চেয়েও সুন্দরী, তাকে আমার ভালাে লাগে না। 

রানু কী বলবে ভেবে পেল নামেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি ধারণা, জানেন? তাদের ধারণা, আমি হচ্ছি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাওদের এক দিন এনে আপনাকে দেখিয়ে দেব। 

ঠিক আছে, দিওআরেকটু বস চা খাবে?” 

না, চা আমি বেশি খাই নাবেশি চা খেলে গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যায়। 

মেয়েটি যেমন হুট করে এসেছিল, তেমনি হুট করে নিচে নেমে গেল। বেশ লাগল রানুর নতুন বাসাটা তার ভালােই লাগছেপুরােনাে ঢাকায় হলেও বেশনিরিবিলিমালিবাগের বাসাটার মতাে নয়নিঃশ্বাস নেবার জায়গা ছিল নাসেখানেপাশ দিয়ে রাতদিন রিকশা যাচ্ছে, গাড়ি যাচ্ছেজঘন্য! এই বাসাটা ভেতরের দিকেবাড়িঅলা দ্রলােকও বেশ ভালােমানুষপ্রথম দিনেই আনিসকে বলেছেন, আমার বাড়ি ভাড়া দেবার দরকার নেইটাকার জন্যেই তাে বাড়ি ভাড়াটাকা যথেষ্ট আছেতবু দুই ঘর ভাড়াটে রাখিকারণ এত বড় বাড়িতে মানুষ নাথাকলে ভালাে লাগে নাকবরখানাকবরখানা ভাব চলে আসেতবে সবাইকে আমি বাড়ি ভাড়া দিই নাআপনাকে দিচ্ছি, কারণ আপনাকে পছন্দ হয়েছে। 

| ভাড়াও খুব কমমাত্র ছয় টাকাতিনরুমের এত বড় একটা বাড়ি ছয় টাকায় পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপাররানু এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেতার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে বাথরুমবড় ঝকঝকে একটা বাথরুমবাসাটা রানুর খুব পছন্দ হয়েছিলআনিস যখন বলল, কি, নেব? পছন্দ হয়

হয়

ভালাে করে ভেবে বল নেব কি নাদুই দিন পর যদি বল পছন্দ না, তাহলে মুশকিলে পড়বমালিবাগের বাসাটা ভালো ছিলশুধুশুধু বদলালাম

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *