‘এই বাসাটাও ভালাে।
রানু খুব খুশি মনে নতুন বাসা সাজাল। নিজেই পরদা কিনে আনল, সারা রাত জেগে সেলাই করল। তার উৎসাহের সীমা নেই।
‘বুঝলে রানু, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। অন্যদের বাসায় যাবে–টাবে। একা–একা থাকার অভ্যেসটা ভালাে না। যাবে তাে?”
যাব।‘
‘একা থাকলেই মানুষের মধ্যে নানান রকম প্রবলেম দেখা যায়, বুঝলে? সব ভাড়াটেদের সঙ্গে খাতির রাখবে।
ভাড়াটে তাে মাত্র এক জন। ‘ঐ ওনার বাসাতেই যাবে। বাড়িঅলার বাসায়ও যাবে। ‘আচ্ছা, যাব।’
রানু অবশ্যি যায় নি কোথাও। তার ভালাে লাগে না। অন্যদের মতাে সে কারাে সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে না। অন্যদের সামনে কেমন যেন আড়ষ্ট লাগে। বারান্দার বেতের চেয়ারটাতে বসে থাকতেই বেশি ভালাে লাগে। দুপুরটাই যা কষ্টের। দুপুরটা কেটে গেলেই অন্যরকম একটা শান্তি লাগে ।
কিন্তু আজকের দুপুরটা দীর্ঘ। কিছুতেই আর কাটছে না। বারান্দায় বসে থাকতেও ভালাে লাগছে না। মেয়েদের স্কুলটাও কী কারণে যেন বন্ধ । চারদিকে চুপচাপ। বডড ফঁাকা। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে কেমন হয়?
ঘরের ভেতরটা কেমন যেন অন্যরকম। রানু ভেতরে ঢুকে জানালার পর্দা ফেলে দিল। অনেকখানি অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকার ও চুপচাপ। আর তখন স্পষ্ট গলায় কেউ ডাকল, রানু, রানু। কয়েক মুহুর্ত রানু নড়ল না। অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু যে ডেকে উঠেছে, সে দ্বিতীয় বার আর ডাকল না।
রাণুর এ রকম চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে এক জন অশরীরী কেউ ডেকে ওঠে। অসংখ্যবার শুনেছে এই ডাক। কে সে! কোথেকে আসে সে! রানু ফিসফিস করে বলল, “কে?‘ কোনাে জবাব পাওয়া গেল না।
“কে তুমি?
জানালার পরদাটা শুধু কাঁপছে। বিকেল হয়ে আসছে। রানু ছােট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের বাগানে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি হাঁটছে। নীলু বােধহয় ওর নাম। এই মেয়েটি তার বােনের মতাে নয়। গম্ভীর। কথাবার্তা প্রায় বলেই না। তবুও ওকে দেখলেই রানুর মনে হয়—মেয়েটি বড় ভালাে। মায়াবতী মেয়ে।
রানু দেখল বিষন্ন ভঙ্গিতে মেয়েটি একা–একা বসে আছে। তার ইচ্ছা হল নিচে নেমে ওর সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু সে গেল না।
নীলু দুই বার বিজ্ঞাপনটা পড়ল। বেশ একটা মজার বিজ্ঞাপন।
কেউ কি আসবেন? আমি একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা জীবন যাপন করছি। সময় আর কাটে না। আমার দীর্ঘ দিবস ও দীর্ঘ
রজনীর নিঃসঙ্গতা কাটাতে কেউ আমাকে দুই লাইন লিখবেন?
জিপিও বক্স নাম্বার ৭৩ দৈনিক পত্রিকায় এ রকম বিজ্ঞাপন দেবার মানে কী? সাপ্তাহিক কাগজগুলিতে এই সব থাকে; ছেলেছােকরাদের কাণ্ড। এই লােকটি নিশ্চয় ছেলেছােকরা নয়। বুড়াে–হাবড়াদের একজন।
বাবা, এটা পড়েছ?‘ নীলু জাহিদ সাহেবের হাতে কাগজটা খুঁজে দিল। বাবা, এই বিজ্ঞাপনটি পড় তাে!’
জাহিদ সাহেব নিজেও কুঞ্চিত করে দুই বার পড়লেন। তাঁর মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল বেশ বিরক্ত হয়েছেন।
পড়েছ?” ‘, পড়লাম। কী মনে হয় বাবা?
কী আবার মনে হবে? কিছুই মনে হয় না। দেশটা রসাতলে যাচ্ছে। খবরের কাগজঅলারা এইসব ছাপে কীভাবে!
নীলু হাসিমুখে বলল, “ছাপাবে না কেন?”
“দেশটা বিলাত–আমেরিকা নয়, বুঝলি? আর ভালাে করে পড়লেই বােঝা যায়, লােকটার একটা বদ মতলব আছে।
কই, আমি তাে বদ মতলব কিছু বুঝছি না।’ জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দেখিস, তুই আবার চিঠি লিখে বসবি ।‘
নীলু মুখ নিচু করে হাসল ।। হাসছিস কেন?” ‘এমনি হাঁসছি।‘ “চিঠি লিখবার কথা ভাবছিস না তাে মনে–মনে?”
নীলু মুখে উঁহু বললেও মনে–মনে ঠিক করে ফেলল, গুছিয়ে একটা চিঠি লিখবে। দেখা যাক না কী হয়। কী লেখে লােকটি।
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সে সত্যি একটা চিঠি লিখে ফেলল । মােটামুটি বেশ দীর্ঘ চিঠি।
জনাব, আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। লিখলাম কয়েক লাইন। এতে
কি আপনার নিঃসঙ্গতা কাটবে? আমার বয়স আঠার। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমরা দু‘বােন। আমার ছােট বােনটির নাম বিলু। সে হলিক্রস কলেজে পড়ে। আমরা দু’বােনই খুব সুন্দরী। এই যা, এটা আপনাকে লেখা ঠিক হল ।
তাই না ? নাকি সুন্দরী মেয়েদের চিঠি পেলে আপনার নিঃসঙ্গতা আরাে দ্রুত কাটবে ?
নীলু। চিঠিটি লিখেই তার মনে হলাে যে, এ রকম লেখাটা ঠিক হচ্ছে না। চিঠির মধ্যে একটা বড় মিথ্যা আছে। সে সুন্দরী নয়। বিলুর জন্যে কথাটা ঠিক, তার জন্যে নয়। নীলু ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখল।
আমার নাম নীলু। আমার বয়স কুড়ি। আপনার নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে আপনাকে লিখছি। কিন্তু চিঠিতে কি কারাে নিঃসঙ্গতা কাটে? আপনার বয়স কত, এটা দয়া করে জানাবেন।
নীলু দ্বিতীয় চিঠিটিও তার পছন্দ হলাে না। তার মনে হলাে, সে যেন কিছুতেই গুছিয়ে আসল জিনিসটি লিখতে পারছে না। রাতে শুয়ে–শুয়ে তার মনে হলাে, হঠাৎ করে সে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন? চিঠি লেখারই–বা কী দরকার? সে। নিজেও কি খুব নিঃসঙ্গ? হয়তাে–বা। এ বাড়িতে আর দুটি মাত্র প্রাণী। বিলু আর বাবা। বাবা দিন–রাত নিজের ঘরেই থাকেন। মাসের প্রথম দিকের কয়েকটা দিন বাড়িভাড়ার টাকা আদায়ের জন্যে অল্প যা নড়াচড়া করেন। তারপর আবার নিজের ঘরেই বন্দি। আর বিলু তাে আছে তার অসংখ্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে। শুধু মেয়েবন্ধু নয়, তার আবার অনেক ছেলেবন্ধুও আছে।
মহানন্দে আছে বিলু। তবে সে একটু বাড়াবাড়ি করছে। কাল তার কাছে একটি ছেলে এসেছিল, সে রাত আটটা পর্যন্ত ছিল। এ সব ভালাে নয়। নীলু উঁকি দিয়ে দেখেছে, ছেলেটি ফরফর করে সিগারেট টানছে। হাত নেড়ে–নেড়ে কথা বলছে। আর বীলু হাসতে–হাসতে ভেঙে পড়ছে। ভাত খাওয়ার সময় নীলু কিছু বলবে না বলবে না করেও বলল, ছেলেটা কে রে?”
‘কোন ছেলে?” ‘ঐ যে রাত আটটা পর্যন্ত গল্প করলি?
‘ও, সে তাে রুবির ভাই! মহা চালবাজ। নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবে, আসলে মহা গাধা।
বলতে–বলতে খিলখিল করে হাসে বিলু।
মহা গাধা হলে এতক্ষণ বসিয়ে রাখলি কেন? ‘যেতে চাচ্ছিল না তাে কী করব?
বলতে বলতে বিলু আবার হাসল।