রানুরা উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি ভারি গলায় বললেন, ‘আবার দেখা হবে। রানু কিছু বলল না। আনিস বলল, আমরা তাহলে যাই?
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।
মিসির আলি ওদের রিকশা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। ওরা রিকশায় উঠবার সময় তিনি হঠাৎ বললেন, রানু, যে তােমার পা জড়িয়ে ধরেছিল, ওর নাম কী?
‘ওর নাম জালালউদ্দিন। “কি করে জানলে, ওর নাম জালালউদ্দিন?‘
রানু তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। মিসির আলি সাহেব বললেন, ঠিক আছে, পরে কথা হবে।
রিকশায় ওরা দুই জনে কোনাে কথা বলল না। আনিসের এক বার মনে হলাে, রানু কাঁদছে। সে সিগারেট ধরিয়ে সহজ স্বরে বলল, ‘দ্রলােককে তােমার কেমন লাগল রানু?’
ভালাে। বেশ ভালাে লােক। উনি আসলে কী করেন? “উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পার্ট–টাইম টীচার। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি পড়ান। খুব জ্ঞানী লোেক।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
ইউনিভার্সিটির টীচাররা এমন রােগা হয়, তা তাে জানতাম না। আমার ধারণা ছিল তারা খুব মােটাসােটা হন।‘
রানু শব্দ করে হাসল। আনিস বলল, “আজ বাইরে খাওয়া–দাওয়া করলে কেমন হয়?”
‘শুধু–শুধু টাকা খরচ। ‘তােমার গিয়ে রান্না চড়াতে হবে না। চল না, কিছু পয়সা খরচ হােক। ‘কোথায় খাবে?” ‘আছে আমার একটা চেনা জায়গা। নানরুটি আর কাবাব । কি বল?”
মিসির আলি সাহেব দেখলেন তার ঘরের সামনে চারটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনাে টিউটোরিয়েল ক্লাস আছে নাকি? আজ বুধবার, টিউটোরিয়েল ক্লাস থাকার কথা নয়। তবে কে জানে হয়তাে নতুন রুটিন দিয়েছে। তিনি এখনাে নােটিস পান নি।
‘এই, তােমাদের কী ব্যাপার?” মেয়েগুলাে জড়সড় হয়ে গেল। ‘কি, তােমাদের সঙ্গে কোনাে ক্লাস আছে? “জ্বি–না স্যার।
তাহলে কি? কিছু বলবে?
স্যার, নােটিস–বাের্ডে আপনি একটা নােটিস দিয়েছিলেন, সেই জন্যে এসেছি।‘
‘কিসের নােটিস? তিনি ভুরু কোঁচকালেন। মেয়েগুলাে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
কী নােটিস দিয়েছিলাম?” “স্যার, আপনি লিখেছেন—কারাে এক্সট্রাসেন্সরি পারসেপশনের ক্ষমতা আছে কি না আপনি পরীক্ষা করে বলে দেবেন।‘
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মিসির আলি সাহেবের সমস্ত ব্যাপারটা মনে পড়ল। মাস দুয়েক আগে এ রকম একটা নােটিস দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এই প্রথম চার জনকে পাওয়া গেল, যারা উৎসাহী এবং সব কটি মেয়ে। মেয়েগুলাে রােগা। তার মানে কি অকল্টের ব্যাপারে রােগা মেয়েরাই বেশি উৎসাহী? তিনি মনে–মনে একটা নােট তৈরি করলেন এবং তৎক্ষণাৎ তার মনে হলাে বিষয়টি ইন্টারেস্টিং। একটা সার্ভে করা যেতে পারে।
‘এস তােমরা। ঘরে এস। তােমরা তাহলে জানতে চাও তােমাদের ইএসপি আছে কি না?‘
মেয়েগুলাে কথা বলল না । যেন একটু ভয় পাচ্ছে। মুখ সবারই শুকনাে । ‘বস তােমরা। চেয়ারে আরাম করে বস।‘
ওরা বসল। মিসির আলি সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। নিচু গলায় বললেন, ‘সব মানুষের মধ্যেই ইএসপি কিছু পরিমাণ থাকে। টেলিপ্যাথির কথাই ধর। তােমাদের নিজেদেরই হয়তাে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। সহজ উদাহরণ হচ্ছে, ধর, এক দিন তােমাদের কারাে মনে হলাে আজ অমুকের সাথে দেখা হবে। যার সঙ্গে দেখা হবার কথা মনে হচ্ছে, সে কিন্তু এখানে থাকে না। থাকে চিটাগাং। কিন্তু সত্যি–সত্যি দেখা হয়ে গেল। কি, হয় না এ রকম?”
মেয়েগুলাে কথা বলল না। এর মধ্যে এক জন রুমাল দিয়ে কপাল মুছতে লাগল। মেয়েটি ঘামছে। নার্ভাস হয়ে পড়ছে মনে হয়। নিশ্চয়ই ব্লাডপ্রেশার বেড়ে গেছে। মিসির আলি বিস্মিত হলেন। নার্ভাস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এই বিষয়ে চর্চা এখনাে বিজ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে না। বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই অনুমানের ওপর। তবে আমেরিকায় একটি ইউনিভার্সিটি আছে ডিউক ইউনিভার্সিটি। ওরা কিছু–কিছু এক্সপেরিমেন্টাল কাজ শুরু করেছে। মুশকিল হচ্ছে, ফলাফল সবসময় রিপ্রডিউসিল নয়।’
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মিসির আলি সাহেব ড্রয়ার খুলে দশটি চৌকো কার্ড টেবিলে বিছালেন। হাসিমুখে বললেন, পরীক্ষাটি খুব সহজ। এই কার্ডগুলােতে বিভিন্ন রকম চিহ্ন আছে। যেমন ধর ক্রস, স্কয়ার, ত্রিভুজ, বিন্দু। কোনটিতে কী আছে সেটা অনুমান করতে চেষ্টা করবে। দুই এক বার কাকতালীয়ভাবে মিলে যাবে। তবে ফলাফল যদি স্ট্যাটিসটিক্যালি সিগনিফিকেন্ট হয়, তাহলে বুঝতে হবে তােমাদের ইএসপি আছে। এখন এস দেখি, কে প্রথম বলবে? তােমার কী নাম?
নীলুফার।‘ ‘হা নীলুফার, তুমিই প্রথম চেষ্টা কর। যা মনে আসে তা-ই বল।‘
আমার কিছু মনে আসছে না।
‘তাহলে অনুমান করে বল।
মেয়েটি ঠিকমতাে বলতে পারল না। তার সঙ্গীরাও না। মিসির আলি হাসতে–হাসতে বললেন, নাহ্, তােমাদের কারাে কোনাে ইএসপি নেই ।ওরা যেন তাতে খুশিই হলাে। মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, না থাকাই ভালাে। আধুনিক মানুষদের এ সব থাকতে নেই। এতে অনেক রকম জটিলতা হয়।
কী জটিলতা?‘ ‘আছে, আছে।‘ বলুন না স্যার।
মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, নীলুফার নামের মেয়েটিই কথা বলছে। স্পষ্ট সতেজ গলা।
‘অন্য আরেক দিন বলব। আজ তােমরা যাও।‘ নীলুফার বলল, এমন কিছু কি স্যার আছে, যা করলে ইএসপি হয়?
“লােকজন বলে, প্রেমে পড়লেও এই ক্ষমতাটা অসম্ভব বেড়ে যায়। আমি ঠিক জানি না। তােমরা যদি কেউ কখনাে প্রেমে পড়, তাহলে এস, পরীক্ষা করে দেখব।‘
কথাটা বলেই মিসির আলি অপ্রস্তুত বােধ করলেন। ছাত্রীদের এটা বলা ঠিক হয় নি। কথাবার্তায় তার আরাে সাবধান হওয়া উচিত। এ রকম হালকা ভঙ্গিতে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।
দেবী উপন্যাস -পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
‘স্যার, আমরা যাই? “আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা হবে।‘
মিসির আলি নিচের টীচার্স লাউঞ্জে চা খেতে এলেন। বেলা প্রায় তিনটা। লাউঞ্জে লােকজন নেই। পলিটিক্যাল সায়েন্সের রশিদ সাহেব এক কোণায় বসেছিলেন। তিনি অস্পষ্ট স্বরে ডাকলেন, “এই যে মিসির সাহেব, অনেক দিন পর মনে হয় এলেন এদিকে । চা খাবেন?‘
কে যেন বলছিল, আপনি নাকি ভূতে–ধরা সারাতে পারেন। ঠিক নাকি?‘ ‘জ্বি–না। আমি ওঝা নই।‘ রাগ করলেন নাকি? আমি কথার কথা বললাম। ‘না, রাগ করব কেন?
আচ্ছা মিসির আলি সাহেব, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?