নীলুর বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই তার কথা হয়েছে। ভদ্রলােক জিজ্ঞেস করেছেন, “কি, এত দেরি
যে?‘ যার মেয়ের এত বড় বিপদ, সে এ রকম স্বাভাবিক থাকবে কী করে?
আনিস বলল, ‘ওরা তাে কিছু বলল না!‘ ‘ওরা কিছু জানে না। আমি জানি, বিশ্বাস কর—আমি জানি। ‘আমাকে কী করতে বল? ‘আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ‘জিনিসটা কি তুমি স্বপ্নে দেখেছ?‘
না। কিন্তু আমি দেখেছি।
কী দেখেছ?” ‘আমি সেটা তােমাকে বলতে পারব না।
তুমি যদি চাও আমি নিচে গিয়ে ওদের বলতে পারি, কিন্তু ওরা বিশ্বাস করবে । রানু চোখ বড়–বড় করে তাকিয়ে রইল। ওর শরীর অল্প–অল্প করে কাঁপছে। আনিস বলল, নাকি মিসির আলি সাহেবের কাছে যাবে? উনি কোনাে–একটা বুদ্ধি দিতে পারেন। যাবে?‘
রানু কাঁপা গলায় বলল, তুমি নিজে কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?”
তঁা, করছি।
একতলার বারান্দায় বিলু বসেছিল। ওদের নামতে দেখেই বিলু বলল, ভাবী, নীলু আপা এখনাে ফিরছে না। বাবা খুব দুশ্চিন্তা করছেন।
রানু কিছু বলল না। ‘তােমরা কোথায় যাচ্ছ ভাবী?
রানু তারও কোনাে জবাব দিল না। রিকশায় উঠেই সে বলল, আমাকে ধরে রাখ, খুব ভালাে লাগছে।‘
আনিস তার কোমর জড়িয়ে বসে রইল। রানুর গা শীতল । রানু খুব ঘামছে। জ্বর নেমে গেছে।
রানু চোখ বড়–বড় করে বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তাই না?”
মিসির আলি চুপ করে রইলেন।। ‘আগে আপনি বলুন—আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?”
‘বিশ্বাসও করছি না, আবার অবিশ্বাসও করছি না। তুমি নিজে যা সত্যি বলে মনে করছ, তা–ই বলছ। তবে আমি এত সহজে কোনাে কিছু বিশ্বাস করি না।‘
কিন্তু যদি সত্যি হয়, তখন?‘ মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে কাশতে লাগলেন। বলুন, যদি আমার কথা সত্যি হয়—যদি মেয়েটা মারা যায়?
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ঠিক এই মুহূর্তে কী করা যায়, তা তাে বুঝতে পারছি না। মেয়েটি কোথায় আছে, তা তাে তুমি জান না। নাকি জান?
না, জানি না।‘ ‘ছেলেটির নামধামও জান না?”
‘ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর । আমার এ রকম মনে হচ্ছে। ‘এই শহরে খুব কম করে হলেও দশ হাজার সুন্দর ছেলে আছে। ‘আমরা কিছুই করব না?”
‘পুলিশের কাছে গিয়ে বলতে পারি একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে এবং আশঙ্কা করা যাচ্ছে দুষ্ট লােকের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু তাতেও একটা মুশকিল আছে, ২৪ ঘণ্টা পার না হলে পুলিশ কাউকে মিসিং পারসন হিসেবে গণ্য করে না।
রানু আবার বলল, “কিছুই করা যাবে না?”।
মিসির আলি গম্ভীর মুখে সিগারেট টানতে লাগলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন রানুর চোখ–মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। সে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।
রানু, তুমি যদি ঐ লােকটির কোনাে ঠিকানা কোনােভাবে এনে দিতে পার, তাহলে একটা চেষ্টা চালানাে যেতে পারে।‘
‘ঠিকানা কোথায় পাব?”
‘তা তাে রানু আমি জানি না। যেভাবে খবরটি পেয়েছ, সেইভাবেই যদি পাও।
রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি সাহেব বললেন, যাচ্ছ নাকি?” ‘হ্যা, বসে থেকে কী করব?
নীলুদের সব ক‘টি ঘরে আলাে জ্বলছে। রাত প্রায় এগারটা বাজে। নীলুর বাবা পাথরের মূর্তির মতাে বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। রানুদের ঢুকতে দেখে এগিয়ে এলেন কিন্তু কিছু বললেন না। রানু মাথা নিচু করে তিনতলায় উঠে গেল । নীলুদের ঘরে ঘনঘন টেলিফোন বাজছে। দুটি গাড়ি এসে থামল। মনে হয় ওঁরা খুঁজতে শুরু করেছেন। পুলিশের কাছে নিশ্চয়ই লােক গিয়েছে। নীলুর বাবা অস্থির ভঙ্গিতে বাগানে হাঁটছেন।
ছােট্ট একটি ঘর। কিন্তু দু শ পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলছে ঘরে। চারদিক ঝলমল করছে। লােকটি একটি চেয়ারে বসে আছে । নীলু লােকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কারণ লােকটি বসে আছে তার পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাবার কোনাে উপায় নেই নীলুর । নাইলনের চিকন দড়ি তার গা কেটে বসে গেছে। চারদিকে কোনাে সাড়াশব্দ নেই। মাঝে–মাঝে দূরের রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নীলু থেমে–থেমে বলল, আপনি কি আমাকে মেরে ফেলবেন?”
কেউ কোনাে জবাব দিল না।