দেয়াল(পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ

আমাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হলাে। শুক্রবার বাদ জুম্মা দশ হাজার এক টাকা কাবিনে আমার বিয়ে হয়ে গেল। এত দিন জানতাম মেয়ে তিনবার কবুল না বলা পর্যন্ত কবুল হয় না।

দেয়ালসেদিন জানলাম লজ্জাবশত যেসব নারী কবুল বলতে চায় না, তারা রেহেলের ওপর রাখা কোরানশরিফ তিনবার স্পর্শ করলেই কবুল হয় । 

আমার হাত ধরে জোর করে তিনবার কোরানশরিফ ছুঁইয়ে দেওয়া হলাে। 

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে গেল, আর তখন শুরু হলাে নানান ঝামেলা। একদল মুক্তিযােদ্ধা হুজরাখানা লক্ষ্য করে এলােপাথাড়ি গুলি করা শুরু করল। মুক্তিযােদ্ধা নামে একটা দল যে তৈরি হয়েছে, তারা যুদ্ধ শুরু করেছে—এই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। 

মুক্তিযযাদ্ধারা কিছুক্ষণ গুলি করে চলে গেল। তাদের গুলিতে কারও কিছু হলাে না, শুধু ইরাজ মিয়া নামের একজনের হাতের কজি উড়ে গেল। সে বিকট চিৎকার শুরু করল, আম্মাজি, আমারে বাচান। আম্মাজি, আমারে বাঁচান । মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে কেউ তাকে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল

ক্যাপ্টেন সামস জিপে করে দলবল নিয়ে এলেন। মিলিটারিরা আকাশের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুড়ে চলে গেল। 

সে রাতে অমাবস্যা ছাড়াই জুলেখা বিবির ওপর জ্বিনের আছর হলাে। আজকের আছর অন্যদিনের চেয়েও ভয়াবহ। তিনি পুরুষের গলায় চেঁচাতে লাগলেন, শইল জুইল্যা যায়। বরফপানি দে। বরফপানি দে। 

দেয়াল(পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ

ঘরে বরফ নেই। দাসীরা তার গায়ে কলসি কলসি পানি ঢালতে লাগল। তাতে তার জ্বলুনি কমল না।। 

একতলার একটা বড় ঘরে পালংকের ওপর আমি বসে আছি। স্বামীর জন্যে অপেক্ষা। এই ঘরেই বাসর হবে । ঘরে আগরবাতি জ্বালানাে হয়েছে। বাসরের আয়ােজন বলতে এইটুকুই। 

আমার স্বামী হাফেজ মােহম্মদ জাহাঙ্গীর এলেন শেষরাত্রে। তাঁকে বিব্রত ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আগে তিনি যেমন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না, এখনাে তাকাচ্ছেন না। তিনি খাটে বসতে বসতে কয়েকবার হাই তুললেন। আমি সহজ। ভঙ্গিতে বললাম, ইরাজ মিয়ার চিৎকার শােনা যাচ্ছে না। সে কি মারা গেছে ? 

তিনি হা-সূচক মাথা নেড়ে বললেন, হুঁ । সবই আল্লাহর ইচ্ছা। উনার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। 

আমি বললাম, এখন আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। আপনি ভয় পাবেন । ভয়ের কিছু নাই। এই দেখুন, এটা একটা পিস্তল। এখানে বারাে রাউন্ড গুলি ভরা আছে। সেফটি ক্যাচ লাগানাে বলে ট্রিগার টিপলেও গুলি হবে না। এই দেখুন, আমি সেফটি ক্যাচ খুলে ফেললাম। এখন ট্রিগার টিপলেই গুলি হবে।। 

তিনি এতটাই হতভম্ব হলেন যে, তাঁর ঠোট নড়ল কিন্তু কোনাে শব্দ বের হলাে না। আমি বললাম, এখন আমি যদি গুলি করি তাহলে প্রচণ্ড শব্দ হবে, কিন্তু কেউ এখানে আসবে না। সবাই ভাববে মুক্তিবাহিনী আবার আক্রমণ করেছে। 

তুমি গুলি কবে ? 

আমি বললাম, ভাের হতে বেশি বাকি নেই। আপনি আমাকে যদি লুকিয়ে স্টেশনে নিয়ে ঢাকার ট্রেনে তুলে দেন তাহলে গুলি করব না। যদি রাজি না হন অবশ্যই গুলি করব। এতে মন খারাপ করবেন না। যা ঘটবে আল্লাহর হুকুমেই ঘটবে। আর আপনি যদি আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন সেটাও করবেন আল্লাহর হুকুমেই। 

তিনি মূর্তির মতাে বসে আছেন। তার দৃষ্টি আমার হাতে ধরে রাখা পিস্তলের দিকে। তিনি খুব ঘামছেন। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছছেন। 

ফজরের আজান হলাে। তিনি বললেন, চলাে তােমাকে নিয়ে শ্যামগঞ্জের দিকে রওনা হই। সকাল নয়টায় একটা ট্রেন ভৈরব হয়ে ঢাকায় যায় । 

দেয়াল(পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ

তিনি আমাকে শ্যামগঞ্জের ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে যেতে পারতেন। তা করলেন না, আমার সঙ্গে রওনা হলেন। একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যতটা যত্ন করে ততটাই করলেন। ট্রেনের কামরা ফাকা ছিল। তিনি আমাকে বেঞ্চে পা ছড়িয়ে শুয়ে ঘুমাতে বললেন। আমি তা-ই করলাম। পথে কোনাে মিলিটারি চেকিং হলাে না। কিংবা হয়তাে হয়েছে, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম বলে জানি না। 

ঢাকায় পৌছলাম বিকেলে। তখন ভারি বর্ষণ হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটুপানি। রিকশায় ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। আমার স্বামী বললেন, আমার কিন্তু ফিরে যাওয়ার ভাড়া নাই। 

আমি জবাব দিলাম না। 

আমাদের বাড়ির গেট খােলা। বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কানাের পর দাদাজান ভীতমুখে দরজা খুললেন। তিনি দাড়ি রেখেছেন। মুখভর্তি দাড়ির জঙ্গলে তাঁকে চেনা যাচ্ছে না। আমাকে দেখে তিনি ভূত দেখার 

মতাে চমকে উঠলেন। টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমার মনে পড়ল না একজন মানুষ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার ফিরে যাওয়ার ভাড়া নেই। 

দাদাজান স্তব্ধ হয়ে হুজরাখানার সব গল্প শুনলেন। ক্যাপ্টেন সামস-এর আগমন, আমার বিবাহ কিছুই বাদ গেল না। 

দাদাজান বললেন (মেঝের দিকে তাকিয়ে, আমার চোখে চোখ না রেখে). বিয়ের পর বদটার সঙ্গে শারীরিক কিছু কি হয়েছে ? 

আমি বললাম, না। 

দাদাজান হাঁপ ছেড়ে বললেন, তাহলে বিবাহ বৈধ হয় নাই। জাহাঙ্গীর হারামজাদাটাকে আমি লাথি দিয়ে বিদায় করছি। 

দাদাজান হয়তাে হাফেজ জাহাঙ্গীরকে লাথি দিয়ে বিদায় করতেই ঘর থেকে বের হলেন। ফিরলেন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি এতক্ষণ ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছিলেন। দাদাজান বললেন, তুমি আমার নাতনিকে কষ্ট করে পৌছে দিয়েছ এইজন্যে তােমাকে ধন্যবাদ। শুকনা কাপড় দিচ্ছি। কাপড় পরাে। খাবার দিচ্ছি, খাবার খেয়ে বিদায় হয়ে যাও। আমার নাতনি তােমাকে তালাক দিয়েছে, কাজেই এখন আর তুমি তার স্বামী না। 

দেয়াল(পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ

জাহাঙ্গীর হালকা গলায় বললেন, সে আমাকে তালাক দিতে পারবে না । কেন পারবে না? তাকে বিয়ের সময় সেই অধিকার দেওয়া হয় নাই । 

দাদাজান বললেন, তাহলে তুমি তালাক দিবে। আমি কাজী ডেকে আনছি। তুমি কাজীর সামনে তালাক দিয়ে বিদায় হবে। বুঝেছ ? 

জি। 

জাহাঙ্গীর ভেজা কাপড় বদলালেন না। খাবারও খেলেন না। কঠিন চোখমুখ করে সােফায় বসে রইলেন। 

দাদাজান বললেন, হারামজাদা! তুই আমাকে চিনিস না। আমি তাের চামড়া খুলে ফেলব। 

জাহাঙ্গীর বললেন, গালাগালি কেন করছেন? যা করা হয়েছে আপনার নাতনির মঙ্গলের জন্যে করা হয়েছে। 

দাদাজান বললেন, আবার ফরফর করে কথা বলে। আমি কাঁচি দিয়ে তাের জিভ কেটে ফেলব। দাড়া কাঁচি নিয়ে আসি। 

দাদাজান হঠাৎ কেন রেগে অস্থির হলেন বুঝলাম না। তিনি সত্যি সত্যি বিশাল এক কাঁচি নিয়ে ফিরলেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *