তার আগেই জাহাঙ্গীর সােফায় এলিয়ে
পড়লেন। জ্বরে তাঁর গা পুড়ে যাচ্ছিল।
এই মানুষটি গুনে গুনে তিন সপ্তাহ প্রবল জ্বরে ভুগল। তাঁকে রাখা হলাে একতলার একটা ঘরে।
বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতাে আমি আমার স্বামীর সেবা–যত করলাম তা যেন কেউ মনে না করেন। মাঝে মাঝে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছি। এই পর্যন্তই। | তাঁর নিউমােনিয়া হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার জবাব দিয়ে দেওয়ার পর দাদাজান তাকে হাসপাতালে পাঠানাের ব্যবস্থা করলেন। কঠিন গলায় বললেন, হাসপাতালে গিয়ে মরুক, আমার এখানে না।
ন্যাশনাল হাসপাতালের সঙ্গে ব্যবস্থা করা হলাে। তারা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রােগী নিতে এল।
রােগী সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, আমাকে হাসপাতালে নিতে হবে
আমার রােগ সেরে গেছে। আমার বাপজানের মৃত্যু হয়েছে। আমি এখন গদিনশীন পীর।
দাদাজান বললেন, তােমাকে কে বলেছে ? জ্বিনের বাদশা এসে বলে গেছে ?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহপাক যখন কাউকে বিপদ দেন তখন পরপর তিনবার দেন। তােমার জীবনে আরও দুইবার মহাবিপদ আসবে। তখন একমনে দোয়া গাঞ্জল আরশ পাঠ করবে। আরেকটা কথা, কুকুর থেকে সাবধান। একটা পাগলা কুকুর তােমাকে কামড়াবে। | দাদাজান বললেন, চুপ থাক বুরবাক! ফকির সাব চলে এসেছেন। পেটে পাড়া দিলে নাক-মুখ দিয়ে ফকিরি বের হয়ে যাবে।
দেয়াল(পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
হাফেজ জাহাঙ্গীর দাদাজানের কথা শুনে মনে হয় মজা পেয়েছেন। তাঁর মুখভর্তি হাসি।।
দাদাজান বললেন, তুই হাসছিস কেন?
আপনার অকারণ রাগ দেখে হাসছি। আপনি চাইলে আপনাকে একটা তাবিজ দেব। তাবিজ ধারণ করলে রাগ কমবে।
আর একটা কথাও না। কথা বললেই থাপ্পড় খাবি ।
ন্যাশনাল হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে তাকে রেলস্টেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। আমরা তার ভাড়া দিতে ভুলে গেলাম। তিনিও চাইলেন না।
মার্চ মাস।
সে বছর মার্চ মাসে অস্বাভাবিক গরম পড়েছিল। আকাশ থেকে রােদের বদলে আগুন ঝরছে। গাছের কোনাে পাতাই নড়ছে না। আসন্ন দুর্যোগে ঝিঝিপােকা দিনেরবেলা ডাকে। এখন তা-ই ডাকছে।
প্রচণ্ড গরমে কালাে পােশাক পরা আর্টিলারির প্রধান মেজর ফারুক খুব। ঘামছেন। গায়ের কালাে শার্ট ভিজে উঠেছে। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ মেঘে ঢাকা। গত কয়েকদিন ধরেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। মেঘের কারণেই গরম বাড়ছে। গ্রীন হাউস ইফেক্ট! একসময় নাকি পৃথিবীর গরম বাড়তে বাড়তে এমন হবে যে, মানুষ ও পশুপাখির বাসের অযােগ্য হবে। ফারুকের মনে হচ্ছে সেই দিন বেশিদূর না।।
মেজর ফারুক দলবল নিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জঙ্গলে। তাঁর। শীতকালীন রেঞ্জ ফায়ারিংয়ের শিডিউল। মার্চ মাসে শীত নেই। চামড়া পােড়ানাে গরম পড়েছে। সকালবেলা মাঝারি পাল্লার কামানে কয়েক দফা গুলি চালানাে হয়েছে। জোয়ানরা তাঁর মতােই ক্লান্ত। তিনি সুবেদার মেজর ইশতিয়াককে ডেকে বললেন, আজকের মতাে ফায়ারিং বন্ধ।
ইশতিয়াক বলল, স্যারের কি শরীর খারাপ করেছে ? ফারুক বললেন, আই অ্যাম ফাইন। গেট মি এ গ্লাস অব ওয়াটার।
দেয়াল(পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
তার জন্যে তৎক্ষণাৎ পানি আনা হলাে। পানির গ্লাসে বরফের কুঁচি ভাসছে। ফারুক গ্লাস হাতে নিয়েও ফেরত পাঠালেন।
ইশতিয়াক বলল, স্যার, পানি খাবেন না ?
ফারুক বললেন, না। একজন সৈনিক সর্ব অবস্থার জন্যে তৈরি থাকবে। সামান্য গরমে কাতর হয়ে বরফ দেওয়া পানি খাবে না ।
বরফ ছাড়া পানি দেই ? না। মুক্তিযুদ্ধের সময় একনাগাড়ে দু’দিন পানি না-খেয়ে ছিলাম।
ইশতিয়াক বলল, পানি ছাড়া কেন ছিলেন স্যার? বাংলাদেশে তাে পানির অভাব নেই।
যেখানে ছিলাম সেখানে সুপেয় পানির অভাব ছিল । সবই পাট পচা নােংরা পানি। ভাগ্যিস পানি খাই নি। যারা খেয়েছিল তারা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেবার আমাদের হাতে অল্পবয়সী একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ধরা পড়েছিল। তার সঙ্গে ছিল বােতলভর্তি পানি। দাঁড়াও, তার নামটা মনে করি। এস দিয়ে নাম। ইদানীং কেন যেন পুরনাে দিনের কারাের নামই মনে পড়ে না। যাক, মনে পড়েছে। সামস। রাজপুত্রের মতাে চেহারা। মাইকেল এঞ্জেলাের ডেভিড়ে খুঁত থাকলেও তার কোনাে খুঁত ছিল না। খাড়া নাক, পাতলা ঠোট, মাথার চুল কোঁকড়ানাে, আবু লাহাবের মতাে গায়ের রঙ।
স্যার, আবু লাহাব কে ?
আমাদের প্রফেটের চাচা। ওই সূরা নিশ্চয়ই পড়েছ—আবু লাহাবের দুই হস্ত ধ্বংস হােক এবং সে নিজেও ধ্বংস হােক।
পড়েছি স্যার। সূরা লাহাব।
লাহাব শব্দের অর্থ আগুন। আবু লাহাব’-এর অর্থ আগুনের পিতা। লাহাবের গাত্রবর্ণ ছিল আগুনের মতাে। ক্যাপ্টেন সামসের গায়ের বর্ণও তা-ই। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে তার একটা ছবি তুলে রাখতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে যে জিনিসটার অভাব অনুভব করেছি তা হলাে একটা ভালাে ক্যামেরা। ছবি তােলার মতাে অপূর্ব সব সাবজেক্ট পেয়েছি। সমস্যা হচ্ছে, সৈনিকের হাতে রাইফেল মানায়। ক্যামেরা মানায় না। এখন অবশ্যি আমার সঙ্গে ক্যামেরা আছে। লাইকা নাম। জার্মানির ক্যামেরা। কিন্তু ছবি তােলার সাবজেক্ট পাচ্ছি না।
দেয়াল(পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
সুবেদার মেজর ইশতিয়াক বিনীত গলায় বলল, স্যার, এক গ্লাস পানি খান। বরফ ছাড়া এক গ্লাস পানি দিতে বলি ?
না। ক্যাপ্টেন সামসের গল্পটা শােননা। আমি তার পানির বােতলের সবটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। তাকে বললাম, থ্যাংক অ্যা। ইউ সেভড মাই লাইফ। পানির বদলে তুমি কিছু চাও?
6976157, Yes! I also want to save my life. আমি বললাম, এটা সম্ভব না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তােমাকে হত্যা করা হবে।
সে কিছুক্ষণ শিশুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। শিশুর দৃষ্টি’র অর্থ হচ্ছে, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝিয়ে বলাে।
সে বলল, আমার হাতে কতক্ষণ সময় আছে? আমি বললাম, আধ ঘণ্টা ম্যাক্সিমাম। সে বলল, এক কাপ কফির সঙ্গে একটা সিগারেট খেতে চাই। চা-কফি নেই। তােমাকে সিগারেট দিতে পারব।
আমি কে-টু সিগারেটের প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তাকে বললাম, মৃত্যুর জন্যে তৈরি হওয়ামাত্র আমাকে বলবে।
সামস বলল, একজন সৈনিক সবসময় মৃত্যুর জন্যে তৈরি।
পাকিস্তানি ওই ক্যাপ্টেনের কথা আমার মনে ধরেছিল। এখনাে সুযােগ পেলেই আমি বলি, একজন খাটি সৈনিক সবসময় মৃত্যুর জন্যে তৈরি। একজন। খাটি সৈনিক যুদ্ধ ছাড়াও সারা জীবন রণক্ষেত্রে কাটায়।
পাকিস্তানি ওই ক্যাপ্টেনের মৃত্যুর জন্যে কি আপনার কোনাে অনুশােচনা আছে ?
ফারুক বললেন, অনুশােচনা নেই। তাকে আমি নিজের হাতে গুলি করি। ওই ক্যাপ্টেন আমাদের অনেক মেয়েকে রেপ করেছে। তার অভ্যাস ছিল রেপ করার পর পর সে কামড়ে মেয়েদের স্তনের বোঁটা ছিড়ে নিত। এটা ছিল তার ফান পার্ট।
দেয়াল(পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
ইশতিয়াক বলল, কী বলেন স্যার!
যুদ্ধ ভয়াবহ জিনিস ইশতিয়াক। যুদ্ধে ফান পার্ট লাগে। যাই হােক, এখন এক গ্লাস পানি খাব। বরফ দিয়েই খাব। একটা জিপ রেডি করতে বলাে। আমি হালিশহর যাব। একজনের সঙ্গে দেখা করব। তবে রাতেই ফিরব।
স্যার, আমি কি সঙ্গে যাব ? যেতে পারাে। হালিশহরে কার কাছে যাবেন ?
একজন পীর সাহেবের কাছে যাব। তিনি জন্মান্ধ । বিহারি । কোরানে হাফেজ বলে অনেকেই তাকে ‘আন্ধা হাফেজ’ও ডাকে। তুমি কি তার বিষয়ে কিছু জানাে ?
জি-না স্যার।
আমার জানামতে তিনি একমাত্র মানুষ যিনি ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখেন। আল্লাহপাক অল্প কিছু মানুষকে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পাঠান। তিনি তাঁদের একজন।