ফারুক আনন্দে অভিভূত হলেন। কারণ, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। ঝুম বৃষ্টি। তাঁর ইচ্ছা করছে জিপ থামিয়ে কিছুক্ষণ রাস্তায় নেমে বৃষ্টিতে ভিজেন। তিনি বৃষ্টিবিষয়ক একটি বিখ্যাত কবিতা মনে করার চেষ্টা করছেন। কিছুতেই মনে পড়ছে । শুধু একটা লাইন মনে আসছে-বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।
খন্দকার মােশতাকের আগামসি লেনের বাড়ির দোতলায় মেজর রশীদ বসে আছেন। তাঁর গায়ে সামরিক পােশাক না। তিনি আজ নকশিদার পাঞ্জাবি পরেছেন। মাথায় কিস্তি টুপি পরেছেন। তাকে দেখে মনে হবে কিছুক্ষণ আগে তিনি একবার নামাজ শেষ করে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন।
মেজর রশীদ বললেন, দেশের মহাবিপদ যদি কখনাে হয় আমরা কি আপনাকে পাব?
খন্দকার মােশতাক জবাব দিলেন না। ফরসি হুক্কা টানতে লাগলেন। অতিরিক্ত গরমের কারণে খন্দকার মােশতাকের গায়ে পাতলা স্যান্ডােগেঞ্জি। মাথায় নেহেরু টুপি। তার আশা ছিল এই টুপি দেশে জনপ্রিয় হবে। তা হয় নি। মুজিবকোট জনপ্রিয় হয়েছে। কালাে রঙের এই কোট পরলে নিজেকে পেঙ্গুইন পাখির মতাে লাগে । তারপরেও কপালের ফেরে পরতে হয়।
মেজর রশীদ বললেন, আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি জবাব দেন নি। প্রশ্নের জবাব জানা বিশেষ প্রয়ােজন। প্রশ্নটা আবার করছি। দেশের পরম সংকটে আমরা কি আপনাকে পাব ?
খন্দকার মােশতাক বললেন, আমরা মানে কারা ? সেনাবাহিনী।
খন্দকার মােশতাক মূল প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললেন, গরম কী পড়েছে দেখেছেন ? ফ্যানের বাতাসে লু হাওয়া।
দেয়াল(পর্ব-১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
রশীদ বললেন, লু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় দেশপ্রেমিকদের কর্তব্য কী ?
খন্দকার মােশতাক বললেন, খানা খান। খানা দিতে বলি।
খানা খাব না। আমি আপনার কাছে খানা খেতে আসি নি। গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার জন্যে এসেছি।
মােশতাক বললেন, বাড়িতে আজ মােরগপােলাও হয়েছে। খেয়ে দেখেন, মুখে অনেক দিন স্বাদ লেগে থাকবে। তা ছাড়া আপনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছেন। খেতে খেতে বলুন। আমি এখন হা-না কিছু বলব না। আমি শুধু শুনে যাব।
মেজর রশীদ বললেন, আপনার সম্পর্কে একটি বিশেষ গল্প প্রচলিত। গল্পটির সত্য-মিথ্যা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
খন্দকার মােশতাক শীতল গলায় বললেন, কী গল্প ?
একবার নাকি আপনি, পরিকল্পনা পরিষদ প্রধান ড. নুরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু নাশতা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, গত রাতে আমি অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি।
আপনি জানতে চাইলেন, কী স্বপ্ন ? | বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আল্লাহপাক আমাকে কোরবানির নির্দেশ দিলেন। তারপর ঘুম ভেঙে গেল। এখন আমি কোরবানি দিতে প্রস্তুত। কোরবানি দিতে হয় সবচেয়ে প্রিয়জনকে। এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে প্রিয়জন হলাে খন্দকার মােশতাক। ভাবছি তাকেই কোরবানি দিব।
মেজর রশীদ কথা শেষ করে তাকিয়ে রইলেন। খন্দকার মােশতাক বললেন, শেখ মুজিবের কোনাে রসবােধ নেই। ভুল সময়ে ভুল রসিকতা করে তিনি আনন্দ পান। আর আমরা পেঙ্গুইনরা তাঁকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকি। এটা আমাদের নিয়তি।
মেজর রশীদ বললেন, গল্পটায় কি সত্যতা আছে ?
বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে এসেছেন RAW (ভারতের সিক্রেট সার্ভিস)-এর রিসার্চ ও অ্যানালাইসিস উইংয়ের পরিচালক কাও। তিনি এসেছেন পানবিক্রেতার ছদ্মবেশে
শেখ মুজিবুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, আমি আপনাকে চিনি। অনেকেই আপনাকে চেনে। আপনার ছদ্মবেশ ধরার প্রয়ােজন পড়ল কেন ?
কাও বললেন, মাঝে মাঝে নিজেকে অন্যরকম ভাবতে ভালাে লাগে বলেই ছদ্মবেশ। আপনাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মেজর রশীদ, ফারুক, লে. কর্নেল ওসমানী এই নিয়ে আলােচনায় বসেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায়। এই বিষয়ে আপনাকে তথ্য দিতে এসেছি।
দেয়াল(পর্ব-১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
শেখ মুজিব বললেন, আপনারা অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ। পানবিক্রেতার ছদ্মবেশে যে আমার কাছে তথ্য দিতে আসে তার কথায় আমার বিশ্বাস নেই।
আপনার সামনে মহাবিপদ।
মহাবিপদ আমি পার করেছি। পাকিস্তানের কারাগারে যখন ছিলাম তখন বিপদ আমার ঘাড়ে বসে ছিল। এখন বিপদ ঘাড় থেকে নেমেছে।
ঘাড় থেকে নামে নি স্যার।শেখ মুজিব বললেন, যাদের কথা আপনি বলছেন তারা আমার সন্তানসম। আমি এই আলােচনা আর চালাব না। আমার শরীরটা ভালাে না । যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি ঘুমুতে যাব।
স্যার, আপনি ভুল করছেন। ভুল আমি করছি না। আপনারা করছেন।
আমার কথা আপনি আমলে নিচ্ছেন না—ভালাে কথা। পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার কথা কি আমলে নেবেন?
শেখ মুজিব উঠে দাঁড়ালেন। পানবিক্রেতার সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাওয়া তাঁর কাছে অর্থহীন মনে হলাে।
সরফরাজ খান দোতলায় জানালার পাশে বসে আছেন। জানালার কাঠের খড়খড়ি খানিকটা নামানাে। তিনি খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাড়ির বাইরের উঠান খানিকটা দেখতে পাচ্ছেন। সরফরাজ খানের অনেক বিচিত্র অভ্যাসের মধ্যে একটি হলাে জানালার পাশে বসে ঘন্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা। এই তাকিয়ে থাকা অর্থহীন। তাঁর বাড়িতে কেউ ঢােকে না, কেউ বেরও হয় না। বাড়ির দারােয়ান কালাম মাঝে মধ্যে পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। বিলাপের সুরে শব্দ করে। মনে হয় গান করে। কালামের গান শােনার আগ্রহে সরফরাজ খান অপেক্ষা করেন—এ রকম মনে করার কোনাে কারণ নেই।
দেয়াল(পর্ব-১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
সকাল এগারটা। গত রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া ঠান্ডা। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের মতাে হয়েছিল। প্রচুর পাতা পড়েছে। পাতা পরিষ্কার করা হয় নি। পাতার ওপর পা ছড়িয়ে কালাম বসে আছে। সাইকেলের ঘন্টার ক্রিং ক্রিং শব্দ হলাে। সরফরাজ জানালার খড়খড়ি আরও খানিকটা তুললেন। সাইকেল আরােহীকে যদি দেখা যায়।
আরােহীকে দেখা গেল। সরফরাজ ভেবেছিলেন পােস্টঅফিসের পিয়ন। পােস্টঅফিসের পিয়নরা লাল রঙের সাইকেলে করে চিঠি বিলি করে। তা না। মায়া মায়া চেহারার শ্যামলা একটি মেয়ে সাইকেলে চড়ে এসেছে। মেয়েটি ছেলেদের মতাে শার্ট-প্যান্ট পরেছে। শার্ট-প্যান্ট দু’টার রঙই কালাে। এই মেয়ে কে ? | কালাম হাসিমুখে এই মেয়েকে সালাম দিল। সদর দরজা খুলে দিল। মেয়েটি কালামের হাতে সাইকেল ধরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। এর একটাই অর্থ, মেয়েটি কালামের পূর্বপরিচিত।
সরফরাজ খানের ভ্রু কুঞ্চিত হলাে। তিনি প্রায় সারা দিন বাড়িতে থাকেন, তারপরেও এ বাড়িতে কিছু লােকজন আসে যাদের বিষয়ে তিনি জানেন না।
নিশ্চয়ই এই মেয়ে অবন্তির কাছে এসেছে। অবন্তি তাকে কিছু জানায় নি। অবন্তির অপরাধ ক্ষমা করা যায়। সে অনেক কিছুই গােপন করে। মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে গােপন করা। বয়ঃসন্ধিকালে তারা শরীর গােপন করতে শেখে। গােপন করার এই অভ্যাস তাদের মাথায় ঢুকে যায়। তখন তারা সবই গােপন করে।
কালাম হারামজাদা কেন গােপন করেছে ? পাছায় লাথি দিয়ে বদটাকে বিদায় করা দরকার। বদটা এখন ক্রি ক্রিং শব্দে সাইকেলের বেল বাজাচ্ছে। যেন হাতে খেলনা পেয়েছে। সরফরাজ জানালার পাট খানিকটা খুলে ডাকলেন, কালাম!
কালাম ওপরের দিকে তাকাল। সরফরাজ বললেন, ওপরে আসাে। বলেই জানালা বন্ধ করলেন। তবে তিনি এখনাে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে কালাম বদটাকে দেখতে পাচ্ছেন। বদটা যে ভয় পেয়েছে তা না। এখনাে সাইকেলের ঘন্টি বাজাচ্ছে। সরফরাজ খান মনে মনে বললেন, তােমার সুখের দিন আজই শেষ। পত্রপাঠে বিদায়।