দেয়াল(পর্ব-১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

ঠাট্টা ঠাট্টা গলায় কথা বলছ কেন দাদাজান? পুলিশের এসপি হয়ে তুমি যেমন কর্মীপুরুষ, রাস্তার মােড়ে যে প্রৌঢ়া সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একমনে ইট ভাঙে সেও কমীমহিলা।

দেয়ালদরজায় কড়া নড়ছে। সরফরাজ নিজেই দরজা খুলতে গেলেন। এই সময় পিয়ন আসে। পিয়নের হাত থেকে চিঠি সংগ্রহ করা তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন । চিঠি পড়ার পর যার যার চিঠি তিনি তাকে দেন। চিঠি Edit-ও করা 

হয়। অপছন্দের কিছু লাইন কেটে দেওয়া হয়। সব চিঠি যে প্রাপকের কাছে দেওয়া হয় তাও না। নষ্ট করে ফেলা হয়। খাম খােলার যাবতীয় সরঞ্জাম তার কাছে আছে। 

চিঠি এসেছে দুটা। এটা পাঠিয়েছেন অবন্তির মা ইসাবেলা। হঠাৎ করে চিঠি আসার অর্থ কী তিনি বুঝতে পারছেন না। এই বদ মহিলা বছরে দু’টা, খুব বেশি হলে তিনটা, চিঠি পাঠায়। সরফরাজ খান ভুরু কুঁচকে চিঠি সরিয়ে রাখলেন। সময় নিয়ে খুলতে হবে, সময় নিয়ে পড়তে হবে। তাড়াহুডোের কিছু নেই। 

দ্বিতীয় চিঠি দেখে সরফরাজ খানের ভুরু কুঁচকালাে এবং তাঁর ঘাড় ব্যথা করতে লাগল। হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে তার ঘাড় ব্যথা করে। চিঠি লিখেছে গদিনসীন পীর হাফেজ জাহাঙ্গীর। অবন্তিকে লেখা চিঠি। বদমাইশ এখনাে অবন্তিকে তার স্ত্রী মনে করছে। বদমাইশটাকে জুতাপেটা করা দরকার। 

দেয়াল(পর্ব-১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

সরফরাজ খান চিঠি নিয়ে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। 

চিঠি খুললেন। এই চিঠি খুলতে সাবধানতার কিছু নেই। চিঠি অবন্তির কাছে দেওয়া হবে না। ছিড়ে ফেলে দেওয়া হবে। এতে দোষের কিছু নেই। পরিবার হলাে রাষ্ট্রের মতাে। রাষ্ট্রের গােয়েন্দা বিভাগ থাকে। তারা রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করে। পরিবারেও গােয়েন্দা বিভাগ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই গােয়েন্দা বিভাগ পরিবারের কল্যাণে কাজ করবে। 

চিঠি হুবহু তুলে দেওয়া হলাে— 

আমার প্রাণপ্রিয় পত্নী মায়মুনা 

ওরফে অবতি! সরফরাজ মনে মনে বিড়বিড় করলেন, বদমাইশ! নামটাও জানে না। বলে অবতি। এদিকে প্রাণপ্রিয় পত্নী। তােকে যদি নেংটা করে চক্কর না দেওয়াই আমার নাম সফরাজ খান না। 

পরসমাচার এই যে, আল্লাহপাকের অসীম মেহেরবানিতে আমি ভালাে আছি। সােবাহানাল্লাহ। সােবাহানাল্লাহ। সােবাহানাল্লাহ। 

তােমার স্বাস্থ্যও নিশ্চয় ভালাে আছে। আমি প্রতি বৃহস্পতিবার আছরের ওয়াক্তে তােমার জন্য খাস দিলে দোয়া করিতেছি । 

প্রতি মাসের প্রথম শনিবারে জ্বিনসহ যে দোয়া করা হয় তাহাতেও তােমার নাম উল্লেখ করি। গত বুধবার তিন ঘটিকায় তােমার পত্র পাইয়া আমি যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি। বলিলে বিশ্বাস হইবে না, আমার দুই চোখেই পানি আসিয়াছে। গদিনশীন পীর হিসাবে আমি কী করি এবং তােমার শ্বশুরের মৃত্যুর পর হুজরাখানা কেমন চলিতেছে তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছ। আলহামদুলিল্লাহ, সােবাহানাল্লাহ। 

শ্রাবণ মাসের ৭ তারিখ বাদ-আছর হুজরাখানায় আমার পিতার মৃত্যুদিবসে ওরস উদযাপন হইবে। ইনশাল্লাহ। 

এই উপলক্ষে তুমি চলিয়া আসসা। তােমার দাদাজান মনে হয় তােমাকে পাঠাইতে রাজি হইবেন না। এমতাবস্থায় তােমাকে নেওয়ার জন্য বিশ্বস্ত কাউকে পাঠাইতে পারি। কিংবা আমি নিজেও আসিতে পারি। 

তােমার ভরণপােষণের টাকা আমি নিয়মিত পাঠাই। ইহাতে রাগ করিও না। স্বামী হিসাবে আমার ইহা কর্তব্য। 

দেয়াল(পর্ব-১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

জ্বিন কর্তৃক জানিয়াছি, সামনে তােমার বড় ফাড়া আছে। আমি তােমাকে একটা তাবিজ পাঠাইলাম। তাবিজটি পঞ্চধাতুর কবজে ভরিয়া তােমার শােবার ঘরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে ঝুলাইয়া রাখিবে। 

তাবিজ ঝুলাইবার পর পর ঘরে বিড়ালের উপদ্রব হইতে পারে। ভয় পাইও না এবং অবশ্যই বিড়ালগুলিকে কোনাে খাবার দিবে না। তাহাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করারও প্রয়ােজন নাই। 

ইতি 

জাহাঙ্গীর খতিবি 

গদিনসীন পীর, খতিবনগর হুজরাখানা সরফরাজ খান সঙ্গে সঙ্গে চিঠি টুকরা টুকরা করে ডাস্টবিনে ফেললেন। তারপরই চিঠির টুকরা ডাস্টবিন থেকে তুলে আলাদা করলেন। আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। একটা টুকরাও যেন অবন্তির হাতে না যায়। কোনাে কাজে দেরি করতে নেই। সরফরাজ খান দিয়াশলাই জ্বালিয়ে চিঠির টুকরা পােড়ালেন। 

মুসলমান মাতার গর্ভে এবং মুসলমান পিতার ঔরসে জন্ম নেওয়ার কারণেই হয়তাে তাবিজটা পােড়াতে পারলেন না ।

তিনি এই তাবিজ পঞ্চধাতুর কবচে ভর্তি করে গােপনে অবন্তির শােবার ঘরের দক্ষিণের দেয়ালে ঝুলাবার ব্যবস্থাও করলেন। নানান ঝামেলায় তার সারা দিন গেল বলে অবন্তির মা ইসাবেলার চিঠি পড়ার সুযােগ হলাে না। তিনি ঠিক করলেন, এই চিঠি রাতে ঘুমুবার সময় ঠান্ডা মাথায় পড়বেন। এখন মাথা কিঞ্চিৎ গরম হয়ে আছে। 

অবন্তি দাদাজানকে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেছে। আজ রান্না হয়েছে পাখির মাংস। খালেদ মােশাররফ চাচু ছয়টা ঘুঘু পাখি দিয়ে গেছেন। ছয়টাই রান্না হয়েছে। সরফরাজ খান আনন্দ নিয়ে খাচ্ছেন। অবন্তি খাচ্ছে ডিমভাজা দিয়ে। সরফরাজ খান বললেন, পাখি খাচ্ছিস না? 

অবন্তি বলল, আমি পাখি খাই না। বিশেষ করে ঘুঘু খাওয়া তাে অসম্ভব। হেমন্তের ওই গানটা মনে করাে-ছায়া ঢাকা, ঘুঘু ডাকা গ্রামখানি ওই…’ 

অবন্তিকে থামিয়ে সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, মােরগ, হাঁস এইসব তাে। খাস ? 

দেয়াল(পর্ব-১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

ওরা পাখি না? ওরা সুন্দর না ? | না। মােরগ কু কু করে ডাকে, আর হাঁস প্যাক প্যাক করে। অসহ্য! এই দুই পাখি আবার মানুষের বিষ্টা খায় ।। 

সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, তাের সঙ্গে আগুমেন্টে যাওয়া আর একটা কাতল মাছের সঙ্গে আগুমেন্টে যাওয়া একই। আমরা দুইজন দুই জগতের বাসিন্দা। 

অবন্তি বলল, ঠিকই বলেছ। ভেরি রাইট। তুমি স্থলচর আমি জলচর। এখন বললা, জলচর প্রাণীর কাছে জনৈক স্থলচর প্রাণীর চিঠিটা কি নষ্ট করে ফেলেছ ? 

তার মানে ? 

অবন্তির খাওয়া শেষ হয়েছে। সে হাত ধুতে ধুতে বলল, দুপুরে আমি তােমার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কাগজ পােড়ার গন্ধ পেলাম। তােমার ঘরের দরজা কখনাে বন্ধ থাকে না। মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে তুমি নিষিদ্ধ কিছু কাজ করাে বলে আমার ধারণা। 

সরফরাজ খান বললেন, কাগজ পােড়ার গন্ধ থেকে তুই বুঝে ফেললি আমি তাের চিঠি পােড়াচ্ছি ? 

 হঁ্যা। কারণ আমি জলচর প্রাণী হলেও আমার বুদ্ধি স্থলচরদের চেয়েও বেশি। ভালাে কথা, দাদাজান, আমি দু’দিনের জন্যে এক জায়গায় বেড়াতে যাব। কোথায় যাব জিজ্ঞেস করবে না। কারণ আমি বলব না। 

একা যাবি? একা যাব না। সঙ্গে চড়নদার আছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *