দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

ভূমিকা 

হুমায়ুন আহমেদের অবর্তমানে তার উপন্যাস দেয়াল প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। প্রকাশকের ইচ্ছায় আমি তার ভূমিকা লিখছি। বইটির যে কোনাে ভূমিকার প্রয়ােজন ছিল, আমার তা মনে হয় না।দেয়াল

গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই দেয়াল নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাইকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী লেখক উপন্যাসটির প্রথম প্রকাশিত রূপের পরিবর্তন সাধন করেছেন। গ্রন্থাকারে সেই পরিবর্তিত রূপই প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। তারপরও, আমার মনে হয়, দেয়াল বিতর্কিত থেকে যাবে। 

বইটিতে দুটি আখ্যান সমান্তরালে চলেছে। প্রথমটি অবন্তি নামে এক চপলমতি ও প্রচলনবিরােধী মেয়ের কাহিনি। তার বাবা নিরুদ্দিষ্ট। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে মা ইসাবেলা স্বদেশ স্পেনে চলে গেছেন। এই দম্পতির কেউ যে সাধারণ বিচারে স্বাভাবিক, তা মনে হয় না। অবস্তি ঢাকায় বাস করে পিতামহ সরফরাজ খানের সঙ্গে তিনি রক্ষণশীল এবং খেয়ালি—অবন্তিকে লেখা তার মায়ের চিঠি আগে গােপনে খুলে পড়েন, অবন্তির শিক্ষক শফিকের ওপর নজরদারি করেন এবং আরও অনেক কিছু করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরাপত্তার খোঁজে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যান, সেখানেও টিকতে না পেরে আশ্রয় নেন এক পীরের বাড়িতে। এক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা অবন্তিকে দেখে ফেলে বিয়ে করতে চায়। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পীর নিজের ছেলের সঙ্গে অবন্তির বিয়ে দিয়ে দেন। অবন্তি এ-বিয়ে মেনে নেয় না বটে, কিন্তু হাফেজ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যােগাযােগও ছিন্ন করে না। তা নিয়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়। 

দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

সরফরাজ খানের পুত্রের বন্ধুদের একজন মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ। এ-বাড়িতে তার আসা-যাওয়া আছে। তার সূত্রে কর্নেল তাহেরও এখানে এসেছেন। এভাবেই প্রথম আখ্যানের সঙ্গে দ্বিতীয় আখ্যানের যোেগ সাধিত হয়। 

দ্বিতীয় আখ্যানটি সূচিত হয় মেজর ফারুকের বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে। এই পরিকল্পনায় ফারুক ও মেজর রশীদ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ওসমানীকে জড়িত করে। পরিকল্পনার সাফল্য, খন্দকার মােশতাকের ক্ষমতালাভ, খালেদ মােশাররফের অভ্যুত্থান, কারাগারে চার নেতা হত্যা, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতার বিপ্লব, জিয়াউর রহমানের মুক্তিলাভ ও ক্ষমতাগ্রহণ, 

খালেদ মােশাররফ ও কর্নেল হুদার হত্যা এবং তাহেরের ফাঁসিতে উপাখ্যানের সমাপ্তি। তারপরও লেখক দ্রুত ঘটনা বলে গেছেন, উপন্যাসের সমাপ্তি হয়েছে জিয়ার হত্যাকাণ্ডে। 

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এসব শােকাবহ পর্বের বর্ণনায় যে-পরিসর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়ােজন ছিল, বইতে তা দেওয়া হয় নি। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে অন্নবস্ত্রের অভাব এবং রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার ও তাদের প্রতি সর্বসাধারণের ক্ষোভ ও ঘৃণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শেখ মুজিবকে বঙ্গপিতা, মহামানব ও বঙ্গবন্ধু বলা হলেও মৃত্যুতে তিনি লেখকের অতটা সহানুভূতি লাভ করেননি যতটা পেয়েছেন তার পরিবারের শিশু ও নারীরা। বঙ্গবন্ধু-হত্যায় মানুষের মধ্য থেকে যে প্রবল প্রতিবাদ হলাে না, বরঞ্চ কোথাও কোথাও আনন্দ-মিছিল হলাে, এতে লেখক বিস্মিত (কাদের সিদ্দিকীর প্রতিবাদ সম্পর্কে হুমায়ুনের মন্তব্য “ভারতে তিনি কাদেরিয়া বাহিনী তৈরি করে সীমান্তে বাংলাদেশের থানা আক্রমণ করে নিরীহ পুলিশ মারতে লাগলেন।

পুলিশ বেচারারা কোনাে অর্থেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত না, বরং সবার আগে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্যে তারা প্রাণ দিয়েছে।”)। অবন্তির গৃহশিক্ষক শফিক—যে নিজেকে খুবই ভীতু বলে পরিচয় দেয়, সে কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিব হত্যার বিচার চাই’ বলে স্লোগান দেয়, গ্রেপ্তার হয় এবং নিপীড়ন সহ্য করে। খন্দকার মােশতাককে এ-বইতে আমরা পাই কমিক চরিত্ররূপে। অসীম সাহসী মুক্তিযােদ্ধা বীর উত্তম খালেদ মােশাররফ এবং মহাবীর কর্নেল তাহেরের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে এবং উপন্যাসে কর্নেল তাহেরকেও দেখি খালেদ মােশাররফের সাহসিকতা ও চরিত্রগুণের প্রশংসা করতে।

দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

জিয়াউর রহমানের আর্থিক সততার প্রশংসা আছে, জনগণের শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছিলেন, তা বলা হয়েছে, সেইসঙ্গে তার ক্ষমতালােভের কথা বলা হয়েছে এবং সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে জানানাে হয়েছে যে, ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত তার গঠিত সামরিক আদালতের বিচারে ১১৪৩ জন সৈনিক ও অফিসারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। হুমায়ুনের মতে, এদের দীর্ঘনিশ্বাস জমা হয় চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজেসেখানে জিয়া প্রাণ হারান তার এক সময়ের সাথী জেনারেল মঞ্জরের পাঠানাে ঘাতক বাহিনীর হাতে। এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে বইতে কোনাে তথ্য নেই, বরঞ্চ এই হত্যাকাণ্ডের পশ্চাতে মনজুরের রূপবতী স্ত্রীর প্রলয়ংকরী স্ত্রীবুদ্ধি কাজ করে থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র যে বলেছিলেন, উপন্যাস উপন্যাস—উপন্যাস ইতিহাস নহে’, সে-কথা যথার্থ । তবে ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাসে ইতিহাসের সারসত্য অবিকৃত থাকবে বলে আশা করা হয় এবং কল্পনাপ্রসূত আখ্যানেও কার্যকারণ সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত। 

দেয়াল উপন্যাসের প্রথমদিকে হুমায়ন আহমেদ নিজের উল্লেখ করেছে প্রথম পুরুষে, শেষদিকে এসে উত্তমপুরুষে নিজের কথা সে বলে গেছে। আমরা জানতে পারি—অনেকেরই তা অজানা নয় যে—-শহীদ-পরিবার হিসেবে ঢাকা শহরে হুমায়ুনদের সরকারিভাবে যে-বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়, রক্ষী বাহিনীর এক কর্মকর্তা 

তা দখল করে তাদেরকে নির্মমভাবে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে পথে নামিয়ে দেন; হুমায়ুনের মা এবং ভাইবােনেরা শুধু চরম অপমানের শিকার হন, তা নয়, নিরাপত্তার সম্পূর্ণ অভাবে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক হুমায়ুনকে বাকশালে যােগ দিতে চাপ দেওয়া হয় এবং চাপের কাছে নতিস্বীকার করে রসায়ন বিভাগে, রেজিস্ট্রারের অফিসে এবং উপাচার্যের দপ্তরে ছােটাছুটি করেও শেষ পর্যন্ত সময় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে তার প্রয়াস নিষ্ফল হয়, বাকশালে যােগদান থেকে সে বেঁচেই যায় বলতে হবে। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধুর সরকার সম্পর্কে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অন্যপক্ষে কর্নেল তাহেরের ভাই আনােয়ার হােসেনের সূত্রে তাহেরের সঙ্গে সে পরিচিত হয়, তার মাকে নিজের মায়ের মতাে দেখতে অভ্যস্ত হয়। তাহেরের জীবনাবসান তার মনে গভীর দাগ ফেলে যায়—এতটাই যে ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণের পরিকল্পনাকে ‘সাহসী’ বলে উপন্যাসে প্রশংসা করা হয়েছে। আমার ধারণা, হুমায়ুনের এই ব্যক্তিগত পটভূমি এই উপন্যাসের চরিত্র ও ঘটনার উপস্থাপনে তাকে প্রভাবান্বিত করেছে। 

দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

 প্রথম আখ্যানেই আমরা পরিচিত হুমায়ুন আহমেদকে পাই। চরিত্রের খেয়ালিপনা, সংলাপের সংঘাত, ঘটনার আকস্মিকতা ও কার্যকারণহীনতা আমাদের সবসময়ে রহস্যময়তার দিকে আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় আখ্যানের ঐতিহাসিকতা প্রমাণের জন্যে হুমায়ুন বইপত্র এবং মামলার কাগজপত্রের শরণাপন্ন হয়েছে। তবে তারপরও তথ্যগত ক্রটি রয়ে গেছে। কাহিনি বলা থামিয়ে লেখক কখনাে তারিখ দিয়ে মােটা দাগে ঘটনার বিবরণ লিখে গেছে। শেষে এক লাফে ছ বছর সময় 

পেরিয়ে উপসংহারে পৌঁছেছে। 

এরই মধ্যে ছড়িয়ে আছে হুমায়ুনের স্বভাবসিদ্ধ এপিগ্রাম। সামান্য নমুনা দিই : 

মানুষ এবং পশু শুধু যে বন্ধু খোজে তা না, তারা প্রভুও খোঁজে। 

এই পৃথিবীতে মূল্যবান শুধু মানুষের জীবন, আর সবই মূল্যহীন। কিছু বিদ্যা মানুষের ভেতর থাকে। সে নিজেও তা জানে না। 

যে লাঠি দিয়ে অন্ধ মানুষ পথ চলে, সেই লাঠি দিয়ে মানুষও খুন করা 

যায়। মানবজাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে 

নিরাপদ মনে করে। সমালােচক যা-ই বলুক না কেন, আমি জানি, হুমায়ুন আহমেদের অন্য বইয়ের মতাে দেয়ালও পাঠকের সমাদর লাভ করবে। 

বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

আনিসুজ্জামান।

দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ভাদ্র মাসের সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ আছে। লালচে রঙের মেঘ। যে মেঘে বৃষ্টি হয়। 

তবে দেখায় অপূর্ব। এই গাঢ় লাল, এই হালকা হলুদ, আবার চোখের নিমিষে লালের সঙ্গে খয়েরি মিশে সম্পূর্ণ অন্য রঙ। রঙের খেলা যিনি খেলছেন মনে হয় তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। 

শফিক চা খেতে খেতে আকাশের রঙের খেলা দেখছে। সে চা খাচ্ছে ধানমণ্ডি দশ নম্বর রােডের মাঝখানে একটা চায়ের দোকানে। অস্থায়ী দোকান ছিল, এখন মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে। হালকা-পাতলা শিরিষ গাছের পাশে দোকান। শিরিষ গাছের মধ্যে তেজিভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সে আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা নিয়ে বড় 

হচ্ছে। 

শফিক চা শেষ করে পকেটে হাত দিয়ে দেখে মানিব্যাগ আনে নি । এরকম ভুল তার সচরাচর হয় না। তার আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। শফিক মনস্থির করতে পারছে না। সঙ্গে মানিব্যাগ নেই—এই তথ্য দোকানিকে আগে দেবে, নাকি চা-সিগারেট খেয়ে তারপর দেবে! 

শফিকের হাতে বিভূতিভূষণের একটা উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ইছামতিবইটির দ্বিতীয় পাতায় শফিক লিখেছে-‘অবন্তিকে শুভ জন্মদিন’। বইটা নিয়ে শফিক বিবৃত অবস্থায় আছে। বইটা অবন্তিকে সে দিবে, নাকি ফেরত নিয়ে যাবে ? এখন কেন জানি মনে হচ্ছে ফেরত নেওয়াই ভালাে। 

অবন্তির বয়স মােল। সে ভিকারুননিসা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। শফিক তাকে বাসায় অংক শেখায় । আজ অবন্তির জন্মদিন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শফিককে বলা হয় নি। অবন্তি শুধু বলেছে, তের তারিখ আপনি আসবেন না। ওইদিন আমাদের বাসায় ঘরােয়া একটা উৎসব আছে। আমার জন্মদিন। 

শফিক বলেছে, ও আচ্ছা! 

দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

অবন্তি বলেছে, জন্মদিনে আমি আমার কোনাে বন্ধুবান্ধবকে ডাকি না। দাদাজান তাঁর বন্ধুবান্ধবকে খেতে বলেন। 

শফিক আবারও বলেছে, ও আচ্ছা। 

অবন্তি বলেছে, আপনাকে জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করা হয় নি, এই নিয়ে মন খারাপ করবেন না। 

শফিক তৃতীয়বারের মতাে বলল, ও আচ্ছা। শেষবারে ‘ও আচ্ছা’ না বলে বলা উচিত ছিল মন খারাপ করব না। | যে উৎসবে শফিকের নিমন্ত্রণ হয় নি, সেই উৎসব উপলক্ষে উপহার কিনে নিয়ে যাওয়া অস্বস্তির ব্যাপার। শফিক ঠিক করে রেখেছে বইটা অবন্তিদের বাড়ির দারােয়ানের হাতে দিয়ে আসবে। সমস্যা একটাই—দারােয়ান সবদিন থাকে না। গেট থাকে ফাকা। তবে আজ যেহেতু বাড়িতে একটা উৎসব, দারােয়ানের থাকার কথা। 

শফিক দোকানির দিকে তাকিয়ে বলল, মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি। আপনার টাকাটা আগামীকাল ঠিক এই সময় দিয়ে দিব। চলবে ? 

দোকানি কোনাে জবাব দিল না। সে গরম পানি দিয়ে কাপ ধুচ্ছে। তার চেহারার সঙ্গে একজন বিখ্যাত মানুষের চেহারার সাদৃশ্য আছে। মানুষটা কে। মনে পড়ছে না। দোকানির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তাে মনে পড়বে। শফিক অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমাকে আরেক কাপ চা খাওয়ান, আর একটা ক্যাপস্টান সিগারেট। আগামীকাল ঠিক এই সময় আপনার সব টাকা দিয়ে দেব।

দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ 

দোকানি কাপ ধােয়া বন্ধ রেখে শফিকের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় সে 

সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। দোকানির চোখের চাউনি দেখে শফিক নিশ্চিত হলাে, তার চেহারা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতাে। আব্রাহাম লিংকন লম্বা, আর এ বেঁটে। বেঁটে আব্রাহাম লিংকন। উইলিয়াম বুথ এই আব্রাহাম লিংকনকে গুলি করলে গুলি লাগত না। মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত। 

দোকানি বলল, আমার হাত ভিজা, আপনে বৈয়ম খুইলা ছিরগেট নেন। 

ভাদ্র মাসের লাল মেঘে বৃষ্টি পড়ার কথা না, কিন্তু বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। ফোঁটা ঘন হয়ে পড়ছে। আশ্চর্যের কথা, ব্যাঙ ডাকছে। আশপাশে ডােবা নেই যে ব্যাঙ থাকবে। ধানমণ্ডি লেকের কোনাে ব্যাঙ কি রাস্তায় নেমে এসেছে ? বর্ষায় কই মাছ পাড়া বেড়াতে বের হয়, ব্যাঙরা কি বের হয় ? 

শফিক ইছামতি বইটা সিগারেটের বৈয়মের ওপর রেখে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়েছে।

 দোকানি বলল, আপনে ভিজতেছেন কী জন্যে? চালার নিচে খাড়ান। ভাদ্র মাসের বৃষ্টি আসে আর যায়। এক্ষণ বৃষ্টি থামব। আসমানে তারা ফুটব। 

 শফিক দোকানির পাশে বসেছে। সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোনাে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চায়ের দোকানের সামনে কালাে রঙের একটা কুকুর এসে দাঁড়িয়েছে। কুকুরটা প্রকাণ্ড। দেশি কুকুর এত বড় হয় না। 

দোকানি বলল, কুত্তার শইলটা দেখছেন ? হালা ভােম্বা জোয়ান। শফিক বলল, “। বিরাট। 

বড়লােকের কুত্তার সাথে দেশি কুত্তি সেক্স করছে বইলা এই জিনিসের পয়দা হইছে। দেখলে ভয় লাগে। 

দোকানি বৈয়াম খুলে একটা টোস্ট বিস্কুট ছুড়ে দিল। কুকুর বিস্কুট কামড়ে ধরে চলে গেল । সে মনে হয় টোস্ট বিস্কুটের বিষয়ে আগ্রহী না। কিংবা ক্ষুধা নেই। ক্ষুধার্ত কুকুর এইখানেই কচকচ করে বিস্কুট খেত, আড়ালে চলে যেত না। | দোকানি বলল, প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় এই ডােম্বা কুত্তা আহে। এরে একটা বিস্কুট দেই, মুখে নিয়া চইল্যা যায়। ঠিক করছি কুত্তাটারে ভালােমতাে একদিন খানা দিব। গােস্-ভাত। 

দেয়াল(পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

শফিক বলল, আপনার চেহারার সঙ্গে অতি বিখ্যাত একজন মানুষের চেহারার মিল আছে। নাম আব্রাহাম লিংকন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। 

দোকানি বলল, গরিবের আবার চেহারা কী ? আপনার নাম কী ? 

রিবের নামও থাকে না। বাপ-মা কাদের বইল্যা ডাকে। আমার নাম কাদের মােল্লা। নামের শেষে ‘মােল্লা’ কেন লাগাইছে আমি জানি না। নামাজের ধারেকাছে নাই। মাকুন্দা মানুষ। থুতনিতে একগাছা দড়িও নাই, নাম হইছে মােল্লা! 

ছাতা মাথায় কে যেন এগিয়ে আসছে। অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে গেছে। লােকটা পানিতে ছপ ছপ শব্দ করতে করতে আসছে। শফিক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু পুরােপুরি চেনা যাচ্ছে না। আজকাল শফিকের এই সমস্যা হচ্ছে, প্রথম দর্শনেই কাউকে সে চিনতে পারছে না। 

মাস্টার সাব, এইখানে কী করেন

অবন্তিদের বাড়ির দারােয়ান কালাম ছাতা মাথায় দোকানের সামনে এসে দাড়িয়েছে। মনে হয় বিড়ি কিনতে এসেছে। শফিক বিব্রত গলায় বলল, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি। 

কালাম বলল, ঘরে আসেন। ঘরে আইসা বসেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *