দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

শফিক বলল, ঘরে যাব না। তুমি অবন্তিকে এই বইটা দিয়ে। তার জন্মদিনের উপহার। বই দিতে এসে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি। বইটা সাবধানে নিয়াে, বৃষ্টিতে যেন ভিজে না। তােমার আপার হাতেই দিয়ে। দেয়ালকালাম গলা নামিয়ে বলল, বই আফার হাতেই দিব। আপনি টেনশান। কইরেন না । বলেই সে চোখ টিপ দেওয়ার ভান করল। শফিকের গা জুলে গেল। একবার ইচ্ছা করল বলে, ‘চোখ টিপ দিলে কেন ?’ শফিকের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে, শেষ পর্যন্ত বলা হয় না। 

কালাম বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাচ্ছে না। সে দুই শলা সিগারেট কিনতে এসেছে, মাস্টারের সামনে কিনতে পারছে না। শফিক উঠে দাঁড়াল। বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করা অর্থহীন, এই বৃষ্টি থামবে না । 

ভয়ঙ্কর কালাে কুকুরটা আবার উদয় হয়েছে। সে যাচ্ছে শফিকের পেছনে পেছনে। শফিক কয়েকবার বলল, এই, যা বললাম, যা! লাভ হলাে না। পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলে কুকুর পেছনে পেছনে আসছেই। হঠাৎ ছুটে এসে পা কামড়ে ধরবে না তাে ? শফিক হাটার গতি বাড়াল। কুকুরও তা-ই করল। ভালাে যন্ত্রণা তাে! 

দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

অবন্তির দাদা সরফরাজ খানের হাতে ইছামতি বই। দারােয়ান বইটা সরাসরি তার হাতে দিয়েছে। তিনি প্রথমে পাতা উল্টিয়ে দেখলেন, লুকানাে কোনাে চিঠি আছে কি না। বদ প্রাইভেট মাস্টারেরা বইয়ের ভেতর লুকিয়ে প্রেমপত্র পাঠায়। অতি পুরনাে টেকনিক। চিঠি পাওয়া গেল না। বইটা তিনি ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখলেন । আগে নিজে পড়ে দেখবেন। বইয়ের লেখায় কোনাে ইঙ্গিত কি আছে ? হয়তাে দেখা যাবে এক প্রাইভেট মাস্টারকে নিয়ে কাহিনি। বড়লােকের মেয়ের সঙ্গে তার প্রণয় হয়। বাড়ি থেকে পালিয়ে সেই মেয়ে মাস্টারকে বিয়ে করে। তাদের সুখের সংসার হয়। গল্প-উপন্যাস হলাে অল্পবয়েসী মেয়েদের মাথা খারাপের মন্ত্র । তার মতে, দেশে এমন আইন থাকা উচিত যেন বিয়ের আগে কোনাে মেয়ে আউট বই পড়তে না পারে। বিয়ের পরে যত ইচ্ছা পড়ুক। তখন মাথা খারাপ হলে সমস্যা নাই। মাথা খারাপ ঠিক করার লােক আছে। স্বামীর সঙ্গে আদর সােহাগে একটা রাত পার করলেই মাথা লাইনে চলে আসবে। 

সরফরাজ খান ইজিচেয়ারে আধশােয়া হয়ে আছেন। নাতনির জন্মদিনের নিমন্ত্রিত অতিথিরা এখনাে কেউ আসে নি। যেভাবে বৃষ্টি নামছে কেউ আসবে কি 

কে জানে! রাতেরবেলা এমনিতেই কেউ বের হতে চায় না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শােচনীয়।। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অস্ত্র মানুষের হাতে চলে গিয়েছিল তা সব উদ্ধার হয় নি। দিনদুপুরেই ডাকাতি-ছিনতাই হচ্ছে। যাদের হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা, তাদের কেউ কেউ ডাকাতি-ছিনতাইয়ে নেমেছে। সরফরাজ খানের মনে হলাে, ভারতের সেনাবাহিনীকে এত তাড়াতাড়ি বিদায় করা ভুল হয়েছে। এরা থাকত আরও কিছুদিন। 

দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

সরফরাজ গলা উঁচিয়ে এ বাড়ির একমাত্র কাজের মেয়ে রহিমাকে ডাকলেন। রহিমা পনের বছর ধরে এ বাড়িতে আছে। কর্তৃত্ব নিয়ে আছে। যতই দিন যাচ্ছে তার কর্তৃত্ব ততই বাড়ছে। এখন সে মুখে মুখে কথা বলে। 

রহিমা এসে দাঁড়াল, মাথায় ঘােমটা দিতে দিতে বলল, কী বলবেন ‘তাড়াতাড়ি বলেন। পাক বসাইছি। বুড়া গরুর মাংস আনছে, সিদ্ধ হওনের নাম নাই। 

সরফরাজ বললেন, এখন থেকে মাস্টার যতক্ষণ অবন্তিকে পড়াবে তুমি সামনে বসে থাকবে। 

এইটা কেমন কথা! আমার কাইজকাম কে করব ? | সরফরাজ কঠিন গলায় বললেন, এ বাড়িতে আমি আর অবন্তি এই দুজন। মানুষ। এত কাজকর্ম কোথায় দেখলে? শুধু বাড়তি কথা। 

রহিমা বলল, দুইজন মানুষ এইটা কী বললেন ? আমরারে মানুষের মধ্যে ধরেন না? আমি আছি, ডেরাইভার ভাই আছে, দারােয়ান আছে। সবের পাক এক চুলায় হয়। পাঁচজন মানুষ। আপনের কথা শেষ হইছে?  এখন যাব ? 

অবন্তি কোথায়? আফা ছাদে। বৃষ্টির মধ্যে সে ছাদে কী করে? 

এইটা আফারে জিগান। আমি ক্যামনে বলব! যে আসামি সে জবানবন্দি দিবে, আমি আসামি না। আমি বৃষ্টির মধ্যে ছাদে যাই নাই। 

কথাবার্তা হিসাব রেখে বলবে। এখন যাও, অবন্তিকে আমার কাছে পাঠাও। আর যে কথা প্রথম বললাম, অবন্তি যখন তার মাস্টারের কাছে পড়বে তুমি উপস্থিত থাকবে। প্রতিদিন থাকতে হবে না। মাঝে মাঝে আমি থাকব। 

তাদের মধ্যে কোনাে ঘটনা কি ঘটেছে ? 

জানি না। ঘটতে পারে। সাবধান থাকা ভালাে। তুমি টেবিলের নিচে তাদের পায়ের দিকে লক্ষ রাখবে। পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি দেখলেই বুঝবে ঘটনা ঘটেছে। এরকম কিছু চোখে পড়লে মাস্টারকে কানে ধরে বিদায় করব। বদ কোথাকার! 

অবন্তি ছাদে হাঁটছে, তবে বৃষ্টিতে ভিজছে না। তার গায়ে নীল রঙের রেইনকোট। এই রেইনকোট তার মা ইসাবেলা স্পেন থেকে গত বছর পাঠিয়েছিলেন। জন্মদিনের উপহার। এ বছরের জন্মদিনের উপহার এখনাে এসে পৌছায় নি। তবে জন্মদিন উপলক্ষে লেখা চিঠি এসে পৌছেছে। অবন্তি সেই চিঠি এখনাে পড়ে নি। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় পড়বে। ইসাবেলা তার মেয়েকে বছরে দুটা চিঠি পাঠান। একটা তার জন্মদিনে, আরেকটা খ্রিসমাসে। 

দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

অবন্তিদের ছাদ ঝোপঝাড়ে বােঝাই এক জংলি জায়গা। তার দাদি জীবিত থাকা অবস্থায় ছাদে বড় বড় টব তুলে নানান গাছপালা লাগিয়েছিলেন। তিনি নিয়মিত ছাদে আসতেন, গাছগুলির যত্ন নিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর অবন্তি ছাদে আসে। কিন্তু টবের গাছে পানি দেয় না। গাছগুলি নিজের মতাে বড় হয়েছে। কিছু মরে গেছে। কিছুটবে আগাছা জন্মেছে। একটা কামিনীগাছ হয়েছে বিশাল। বর্ষায় ফুল ফোটে। সেই গন্ধ তীব্র। আজ অবশ্যি কামিনী ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি হতে পারে কিছু বিশেষ দিনে কামিনী ফুল গন্ধ দেয় না! 

ছাদের রেলিংয়ের একটা অংশ ভাঙা। অবন্তি মাঝে মাঝেই রেলিংয়ের ভাঙা অংশে দাঁড়ায়। সে ঠিক করে রেখেছে, কোনাে-একদিন সে এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দেবে। ঝাঁপ দিয়ে যেখানে পড়বে সে জায়গাটা বাঁধানাে। কাজেই তার মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। আজ সে ঝাপ দেবে না বলেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে এল। রহিমা বলল, আপনেরে দাদা ডাকে। মনে হয় কোনাে জটিল কথা বলবে। 

অবন্তি তার দাদাজানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, দাদাজান, জটিল কথা কিছু বলবে ? 

সরফরাজ নাতনির দিকে তাকিয়ে প্রবল দুঃখবােধে আপুত হলেন। মেয়েটা পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে চলে এসেছে। অতি রূপবতীদের কপালে দুঃখ ছাড়া কিছু থাকে না। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপতে চাপতে বললেন, হুঁ, বলব। 

উপদেশমূলক কথা? জন্মদিনে উপদেশমূলক কথা শুনতে ভালাে লাগে না। 

কী ধরনের কথা শুনতে ভালাে লাগে? মজার কোনাে কথা। 

সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, আমি তাে মজার কোনাে কথা জানি না। অবন্তি বলল, আমি জানি। আমি বলি তুমি শােনাে 

আমার মা’র নাম স্পেনের রানি ইসাবেলার নামে। রানি ইসাবেলা সারা জীবনে দুবার মাত্র স্নান করেছেন। 

সরফরাজ বললেন, এটা তাে মজার গল্প না। নােংরা থাকার গল্প। 

দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

অবন্তি বলল, রানি ইসাবেলা যখন দরবারে যেতেন তখন পােশাক পরতেন। বাকি সময় নগ্ন ঘােরাফেরা করতেন। গায়ে কাপড় লাগলে গা কুটকুট করত এই জন্যে। 

সরফরাজ হতভম্ব গলায় বললেন, এই গল্প তােমাকে কে বলেছে ? মাস্টার। 

উনি এই গল্প কেন করবেন? মা চিঠিতে লিখেছেন। মা চিঠিতে মজার কথা লেখেন। 

সরফরাজ কঠিন গলায় বললেন, যে চিঠিতে এই গল্প আছে সেই চিঠি আমাকে পড়তে দিবে। 

কেন ? 

আমার ধারণা কোনাে চিঠিতে এমন কথা তােমার মা লিখে নাই। এই নােংরা গল্প অন্য কেউ তােমার সঙ্গে করেছে। বুঝেছ ? 

অবন্তি হাসল। 

সরফরাজ বললেন, হাসছ কেন? তােমার এই গল্প আমি সিরিয়াসলি নিয়েছি। 

অবন্তি বলল, তুমি সবকিছুই সিরিয়াসলি নাও। আমার বিষয়ে তােমাকে এত ভাবতে হবে না। 

তােমার বিষয়ে কে ভাববে? আমার বিষয়ে ভাবার লােক আছে। লােকটা কে? তােমাকে বলব না, তবে রানি ইসাবেলা সম্পর্কে আরেকটা কথা বলব। ওই নােংরা বেটির কোনাে কথা শুনব না। কথাটা শুনলে অবাক হবে। 

তােমার সঙ্গে থাকা মানেই ঘন্টায় ঘন্টায় অবাক হওয়া। আর অবাক হতে চাচ্ছি না। 

ঘনঘন অবাক হলে লিভারের ফাংশান ভালাে থাকে। তােমার লিভার ফাংশান ভালাে থাকা দরকার। 

সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, কী বলবে বলে ঝামেলা শেষ করাে। 

অবন্তি বলল, আমেরিকার প্রথম ডাকটিকিটে যে ছবি ছাপা হয়েছিল সেই ছবি রানি ইসাবেলার। 

সরফরাজ জবাব দেওয়ার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলাে। নিমন্ত্রিত অতিথিদের কেউ মনে হয় এসেছেন। অবন্তি গেল দরজা খুলতে।

দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ 

প্রথম অতিথির নাম খালেদ মােশাররফ। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ। অবন্তির বাবার বন্ধু। তারা স্কুলজীবনে একসঙ্গে দাড়িয়াবান্দা খেলতেন। খালেদ মােশাররফের ফুসফুসের জোর ছিল অসাধারণ। কুঁ ডাক দিয়ে তিন মিনিট ধরে থাকা সহজ ব্যাপার না । 

অবন্তি মা! কেমন আছ ? ভালাে আছি চাচ্ছ। আজ তােমাকে অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি সুন্দর লাগছে। এর কারণ কী মা ? চাচ্চু! আপনি যখনই আসেন এই কথা বলেন। 

খালেদ মােশাররফ বললেন, আমি মিলিটারি মানুষ। যা দেখি তা-ই বলি। আমি তাে বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারি না, অবন্তিকে আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু কম সুন্দর লাগছে। 

মিলিটারিরা কি সবসময় সত্যি কথা বলে ? 

রে মা। যখন যুদ্ধক্ষেত্রে থাকে তখন অবশ্যই বলে। যুদ্ধের সময় মিথ্যা বলার সুযােগ থাকে না। ভালাে কথা, তােমার বাবার কোনাে খবর কি পাওয়া গেছে

মানুষটা কি হারিয়েই গেল? আশ্চর্য! 

অবন্তি বলল, বাবার বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিছুদিন পর পর ডুব দেওয়া তার স্বভাব। 

সরফরাজ ভেতর থেকে বললেন, কে এসেছে ? খালেদ ? অবন্তি বলল, হ্যা দাদাজান। জন্মদিনের পার্টি এখন শুরু হলাে। খালেদ মােশাররফ বললেন, জন্মদিন নাকি ? কার জন্মদিন ? 

অবন্তি অবলীলায় বলল, দাদাজানের। আগে জানলে তাে কিছু একটা নিয়ে আসতাম । 

অবন্তি বলল, এখনাে সময় আছে। চট করে কিছু-একটা নিয়ে আসুন। শুধু ফুল আনবেন না। দাদাজান ফুল পছন্দ করেন না। 

দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

খালেদ মােশাররফ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরফরাজ বললেন, কে এসেছে? 

অবন্তি বলল, যে এসেছে সে চলেও গেছে। সরফরাজ বললেন, তার মানে ? ওই শােননা জিপ স্টার্ট দেওয়ার শব্দ। জিপ নিয়ে চলে যাচ্ছেন। 

সরফরাজ হতভম্ব গলায় বললেন, আমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি না। আশ্চর্য! 

শফিক তার ঝিগাতলার বাসার বারান্দায় কেরােসিনের চুলায় ভাত বসিয়েছে। দুপুরের ডাল রয়ে গেছে। রাতে ডালের সঙ্গে ডিম ভাজা করা হবে। ডাল থেকে টক গন্ধ আসছে। মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। গরমে নষ্ট হয়ে যাওয়ারই কথা। শফিক ঠিক করল এখন থেকে বাড়তি কিছু রানা হবে না। যতটুকু প্রয়ােজন ততটুকুই রাঁধবে। 

বাজারে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ একবেলা রুটি খাচ্ছে। শফিক রুটি খেতে পারে না। রুটি বানানােও ঝামেলা। আটা দিয়ে কাই বানাও, বেলুন দিয়ে রুটি বেলাে, তাওয়ায় সেঁকো। মেলা দিগদারি। 

সবচেয়ে ভালাে হয় রাধানাথ বাবুর মতাে একবেলা খাওয়ার অভ্যাস করলে। তিনি সূর্য ডােবার সামান্য আগে একবেলা খান। তাতে যদি তাঁর সমস্যা না হয় শফিকের কেন হবে! রাধানাথ বাবু এখন একটা বই লিখছেন—রবীন্দ্রনাথ এবং বৌদ্ধধর্ম। তার নানান রকম অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য দরকার হয়। শফিকের ওপর দায়িত্ব পড়ে তথ্য অনুসন্ধানের। শফিককে তিনি মাগনা খাটান না। প্রতিটি তথ্যের জন্যে কুড়ি টাকা করে দেন। রাধানাথ বাবুর কাছে শফিকের চল্লিশ টাকা পাওনা হয়েছে। রাধানাথ বাবু বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ কোনাে-এক জায়গায় জীবন এবং মৃত্যুকে রমণীর দুই স্তন হিসেবে ভেবেছেন। আমার কিছুই মনে পড়ছে না। তুমি খুঁজে বের করতে পারলে চল্লিশ টাকা দেব। রবীন্দ্র রচনাবলী প্রথম পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করাে। 

শফিক আজই খুঁজে পেয়েছে। কাল সকালে যাবে, টাকাটা নিয়ে আসবে। তার হাত একেবারেই খালি। হাত খালি থাকলে তার অস্থির লাগে। মনে হয় পায়ের নিচে মাটি নেই, চোরাবালি । চোরাবালিতে সে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। যাই হােক, কাল টাকা পাওয়া যাবে। চোরাবালি থেকে মুক্তি। 

দেয়াল(পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

রাধানাথ বাবুর কবিতার লাইন দুটি আছে নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে। কবিতার নাম মৃত্যু। 

স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে, 

মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে শুনান্তরে। ভাত হয়ে গেছে। ডিম ভাজা গেল না। একটাই ডিম ছিল, সেটা পচা বের হয়েছে। শফিক টকে যাওয়া ডাল দিয়ে খেতে বসল। কয়েক নলার বেশি খাওয়া গেল না। শরীর উল্টে আসছে। আজকের ডালমাখা ভাত অবশ্যি নষ্ট হবে না। বিশাল কুকুরটা তার পেছনে পেছনে এসে মেঝেতে থাবা গেড়ে বসে আছে। সে নিশ্চয় ক্ষুধার্ত। এত বড় শরীরের জন্যে প্রচুর খাদ্য দরকার। 

শফিক ডাল মাখানাে ভাত উঠানে ঢেলে দিল। কী আগ্রহ করেই না কুকুরটা খাচ্ছে! ঘরে একটা টিনের থালা থাকলে থালায় ভাত দেওয়া যেত। পশুপাখিরাও 

ততা কিছুটা সম্মান আশা করতে পারে। শফিক বলল, এই তাের নাম কী ? 

কুকুরটা মাথা তুলে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিল। 

শফিক বলল, আমি তাের নাম দিলাম কালাপাহাড়। ঐতিহাসিক চরিত্র। নাম পছন্দ হয়েছে ? 

কুকুর এইবার ঘেউ শব্দ করল। মনে হয় নাম পছন্দ হয়েছে। 

শফিক বলল, খাওয়াদাওয়া করে চলে যা। আমি খুবই গরিব মানুষ। ডালটা নষ্ট না হলে আমিই খেতাম। তােকে দিতাম না। আমার অবস্থান তাের চেয়ে খুব যে ওপরে তা কিন্তু না। 

কালাপাহাড় আরেকবার ঘেউ করে শুয়ে পড়ল। তার ডিনার শেষ হয়েছে। ঝড়বৃষ্টির রাতে সে আর বের হবে না। এখানেই থাকবে। একজন প্রভু পাওয়া গেছে, এই আনন্দেও সে মনে হয় খানিকটা আনন্দিত। মানুষ এবং পশু শুধু যে বন্ধু খোজে তা না, তারা প্রভুও খোঁজে। 

অবন্তি মায়ের চিঠি নিয়ে শুয়েছে। খাম খুলেই সে প্রথমে গন্ধ শুকল। তার মা চিঠিতে দু’ ফোটা পারফিউম দিয়ে খাম বন্ধ করেন। গন্ধের খানিকটা থেকে যায়। 

আজকের গন্ধটা অদ্ভুত। চা-পাতা চা-পাতা গন্ধ। মার কাছ থেকে এই পারফিউমের নাম জানতে হবে। অবন্তি চিঠি পড়তে শুরু করল 

শুভ জন্মদিন অবন্তি মা, | তুমি তােমার যে ছবি পাঠিয়েছ, এই মুহূর্তে তা আমার লেখার টেবিলে। আমি প্রবল ঈর্ষা নিয়ে ছবিটির দিকে 

তাকাতে তাকাতে তােমাকে লিখছি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *