দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ

তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে পৃথিবীতে এসেছ। তােমার মতাে বয়সে সবাই আমাকে ডাকত ‘Flower’। তােমার নাম আমি দিলাম স্বর্গের পুষ্প’। একটাই ক্রটি তােমার চোখ আমার চোখের মতাে নীল হয় নি।দেয়ালতুমি তােমার বাবার কালাে চোখ পেয়েছ। ভালাে কথা, তােমার বাবার সঙ্গে কি তােমার কোনাে যােগাযােগ হয়েছে ? আশ্চর্যের ব্যাপার, মানুষটা কি শেষ পর্যন্ত হারিয়েই গেল? 

তুমি চিঠিতে তােমার এক গৃহশিক্ষকের কথা লিখেছ। তুমি কি এই যুবকের প্রেমে পড়েছ ? চট করে কারও প্রেমে পড়ে যাওয়া কোনাে কাজের কথা না। অতি রূপবতীদের কারও প্রেমে পড়তে নেই। অন্যেরা তাদের প্রেমে পড়বে, তা-ই নিয়ম। 

 এখন আমি তােমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি। তুমি কি আসবে আমার এখানে ? 

 যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি হতদরিদ্র দেশে পড়ে থাকার কোনাে মানে হয় না। তােমার বৃদ্ধ দাদাজানকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে দেশে পড়ে থাকতে হবে—এটা কোনাে কাজের কথা না। তােমার জীবন তােমার একারই। এক বৃদ্ধকে সেখানে জড়ানাের কিছু নেই। সে বরং একটা কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করুক। একজন বৃদ্ধের সঙ্গে তােমার বাস করাকেও আমি ভালাে চোখে দেখছি না। সেক্স-ডিপ্ৰাইভড় বৃদ্ধরা নানান কুকাণ্ড করে। আমি তােমাকে নিয়ে চিন্তায় আছি। 

দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ

লুইসের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমি একা বাস করছি। লুইসের কারণে আমি অনেক টাকার মালিক হয়েছি। ঠিক করেছি সমুদ্রের কাছে একটা ভিলা কিনে বাস করব। তুমি আমার সঙ্গে এসে থাকতে পারাে। মা-মেয়ে সুখে জীবন পার করে দেব। 

তােমার জন্মদিন উপলক্ষে পারফিউমের একটা সেট পাঠালাম। তােমার মােল বছর হয়েছে বলে যােলটা পারফিউম। এর মধ্যে তােমার কাছে সবচেয়ে ভালােটার নাম 

আমাকে লিখে পাঠাবে। যদি আমার পছন্দের সঙ্গে মিলে যায় তাহলে পুরস্কার আছে। | মা, তুমি ভালাে থেকো। প্রায়ই তােমাকে নিয়ে আমি 

ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি, আমার অস্থির লাগে। 

ইসাবেলা 

মেঘ কেটে আকাশে চাঁদ উঠেছে। ভাদ্র মাসে চাঁদের আলাে সবচেয়ে প্রবল হয়। চারদিকে পানি জমে থাকে বলে চাঁদের আলাে প্রতিফলিত হয়ে ভাদ্রের চন্দ্র-রাত আলােময় হয়। 

শফিক বারান্দায় কাঠের বেঞ্চে বসে আছে। বৃষ্টিভেজা উঠান চাদের আলােয় চিকচিক করছে। এই রূপ শফিককে স্পর্শ করছে এরকম মনে হচ্ছে না। সে ক্ষুধায় অস্থির। ক্ষুধার সময় দেবতা সামনে এসে দাঁড়ালে তাঁকেও নাকি খাদ্যদ্রব্য মনে হয়। 

কালাে কুকুরটা এখনাে আছে। শফিক বেঞ্চে বসামাত্র সে উঠে এসে বেঞ্চের নিচে ঢুকে পড়ল। একথালা টকে যাওয়া ডালমাখা ভাত খেয়ে সে কৃতজ্ঞতায় 

অস্থির হয়ে আছে। 

দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ

শফিক ডাকল, কালাপাহাড়! এই কালাপাহাড়! | কালাপাহাড় সাড়া দিল। বেঞ্চের নিচ থেকে মাথা বের করে তাকাল শফিকের দিকে। শফিক বলল, কুকুর হয়ে জন্মানাের একটা সুবিধা আছে। খুব ক্ষুধার্ত হলে ডাস্টবিন ঘাটাঘাটি করলে কিছু-না-কিছু পাওয়া যায়। মানুষের এই সুবিধা নেই। 

 কালাপাহাড় বিচিত্র শব্দ করল। শফিকের কেন জানি মনে হলাে কুকুরটা তার কথা বুঝতে পেরে জবাব দিয়েছে। শফিকের হঠাৎ করেই গায়ে কাঁটা দিল । 

শফিকের মা জোবেদা খানমের একটা পােষা কুকুর ছিল। জোবেদা খানম কুকুরটাকে কপালপােড়া’ বলে ডাকতেন। কেউ তার গায়ে গরম ভাতের মাড় ফেলে কপাল পুড়িয়ে দিয়েছিল। কুকুরটা জোবেদা খানমের সঙ্গে কথা বলত এবং ভদ্রমহিলার ধারণা তিনি কুকুরের সব কথা বুঝতে পারতেন। 

শফিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, আমার মা ফিজিওফ্রেনিয়ার রােগী ছিলেন। এইসব রােগীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে। 

আসলেই কি তাই? নাকি অন্যকিছু? জগৎ অতি রহস্যময়। হয়তাে তার মা সত্যি সত্যি পশুপাখির কথা বুঝতেন। 

এক শ্রাবণ মাসের কথা। গভীর রাত। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। জোবেদা শফিককে ডেকে তুলে বললেন, বাবা! হারিকেন আর ছাতি নিয়ে একটু আগা ততা। 

শফিক অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব ? 

ঈশ্বরগঞ্জ থেকে তাের বাবা আসছে। কাঠের পুলের কাছে এসে ভয় পাচ্ছে। তাের বাবাকে একটু কষ্ট করে নিয়ে আয়।

দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ 

শফিক বলল, বাবা এসেছেন—এই খবর তুমি কোথায় পেয়েছ? কপালপােড়া আমাকে বলেছে। কুকুরটা তােমাকে বাবার সংবাদ দিয়েছে ? 

শফিক শীতল গলায় বলল, এক কাজ করাে, কুকুরের গলায় হারিকেন ঝুলিয়ে দাও। সে বাবাকে পুল পার করে নিয়ে আসুক। 

জোবেদা খানম ক্ষীণ গলায় অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন, বাবা! যা-না। মায়ের অনুরােধটা রাখ। মার কথাটা শােন। 

শফিক বলল, মা, তােমার কথা আমি এক শ’বার শুনব। কুকুরের কথা শুনব । কুকুরের কথায় ঝড়-বৃষ্টির রাতে কাঠের ব্রিজের কাছে যাব না। 

জোবেদা বলল, মানুষটা ভূতের ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। কাঠের ব্রিজ পার হতে পারছে না। | ভূত বলে কিছু নেই মা। ভূত গ্রামের দুর্বল মানুষের কল্পনা। মাথা নেই একটা ভূত কাঠের পুলে বসে থাকে । নিশিরাতে কেউ পুল পার হতে গেলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এইসব হলাে গল্প । 

জোবেদা বললেন, বাবারে! কয়েকজন তাে মারা গেছে ।। 

কয়েকজন না, দুজন মারা গেছে। তারা পা পিছলে খালে পড়ে মরেছে। আমি নিশিরাতে অনেকবার পুল পার হয়েছি। আমি মাথাকাটা ভূত দেখি নাই। 

ভূত-প্রেত সবার কাছে যায় না। কারও কারও কাছে যায়। মা! ঘুমাও তাে। 

শফিক কাথার নিচে ঢুকে বাক্যালাপের ইতি করল । সেই রাতে তার ভালাে ঘুম হলাে । ঘুম ভাঙল লােকজনের হইচই চিকারের শব্দে। তার বাবার মৃতদেহ কাঠের পুলের নিচে পাওয়া গেছে। তাঁর হাতে চটের ব্যাগ। ব্যাগে একটা শাড়ি। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর জন্যে কেনা। আর একটা হারমােনিকা। | হারমােনিকা তিনি কেন কিনেছিলেন, কার জন্যে কিনেছিলেন, এই রহস্য ভেদ হয় নি। শফিকের বাবা হারমােনিকা কেনার মানুষ না। তিনি মাওলানা মানুষ। 

দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ

কিছু রহস্য মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। সেইসব রহস্যের কখনােই কোনাে কিনারা হয় না । 

 হারমােনিকা শফিকের কাছে আছে। কখনাে এই বাদ্যযন্ত্রে ফুঁ দেওয়া হয় নি। শফিক ঠিক করে রেখেছে তার জীবনে যদি কখনাে গাঢ় আনন্দের ব্যাপার ঘটে, তাহলে সে হারমােনিকায় ফুঁ দেবে। 

রাত অনেক হয়েছে। অবন্তি ঘুমাতে গেছে। রহিমা, অবন্তির ঘরে মেঝেতে বিছানা করেছে। অবন্তি একা ঘুমাতে চায়, সরফরাজ খানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। 

 রহিমার নানান সমস্যা আছে। সে ঘুমের মধ্যে কথা বলে, হঠাৎ হঠাৎ বিকট শব্দে তার নাক ডাকে। তারচেয়েও বড় সমস্যা হলাে, মাঝে মাঝে রহিমা জেগে বসে থাকে। তাকে দেখে তখন মনে হয় সে কাউকে চিনতে পারছে না। এই সময় 

সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। 

রহিমা বলল, পান খাইবেন আফা ? অবন্তি বলল, না। রহিমা বলল, জর্দা দিয়া পান খাইলে মেয়েছেলের শইলে সুঘ্রাণ হয়। 

দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ

অবন্তি বলল, জর্দা খেয়ে শরীরে সুঘ্রাণ করার কিছু নাই। গায়ে পারফিউম দিলেই হয়। 

রহিমা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি খােয়াবে একটা জিনিস পাইছি, বলব? 

কথা বলাবলি বন্ধ। এখন ঘুম। রহিমা বলল, খােয়বে পাইছি মাস্টার সাবের সাথে আপনার শাদি হবে।। অবন্তি কঠিন গলায় বলল, আমি আর একটা কথাও শুনব না। 

রহিমা বলল, আমি নিজের মনে কথা বলি। শুনলে শুনবেন, না শুনলে নাই। আপনার আর মাস্টার সাবের বিবাহ হবে গােপনে। আপনার দাদাজানের অমতে। মামলা মােকদ্দমা হবে। শেষমেষ মিটমাট হবে। আমি খােয়বে পাইছি। আমার খােয়ব বড়ই কঠিন। একবার কী হইছে শুনেন, খােয়বে পাইলাম… 

রহিমা কথা বলেই যাচ্ছে। 

অবন্তি দুই হাতে কান চেপে ধরে মনে মনে গান করছে-‘আমার এই হেসে যাওয়াতেই আনন্দ খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে সুমন্দ। 

মনে মনে গান করলে বাইরের কোনাে শব্দ কানে ঢােকে না। এই আবিষ্কার অবন্তির নিজের। 

রাধানাথ বাবুর বয়স পঁয়ষট্টি। তাঁর মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুলের দিকে তাকালেই শুধু বয়স বােঝা যায়। চুলে কলপ করা হলে বয়স ত্রিশের কোঠায় নেমে আসত। সবল সুঠাম বেঁটেখাটো মানুষ। চোখ বড় বড় বলে মনে হয় তিনি সারাক্ষণ বিস্মিত হয়ে আছেন। তাঁর গাত্রবর্ণ অস্বাভাবিক গৌর। তার মাসি বলতেন, আমার রাধুর গা থেকে আলাে বের হয়। রাতেরবেলা এই আলােতে তুলসি দাসের রামায়ণ পড়া যায়। | চিরকুমার এই মানুষটি নীলক্ষেতের একটা দোতলা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। একতলায় তাঁর প্রেস। প্রেসের নাম ‘আদর্শলিপি’। প্রেসের সঙ্গে জিংক ব্লকের একটা ছােট্ট কারখানাও আছে। প্রেসের লােকজন তাকে ডাকেন ‘সাধুবাবা’। সাধুবাবা ডাকার যৌক্তিক কারণ আছে। তাঁর আচার-আচরণ, জীবনযাপন সাধুসন্তদের মতাে।

দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ 

বাড়ির চিলেকোঠায় তার প্রার্থনার ব্যবস্থা। পশমের আসনে বসে চোখ বন্ধ করে তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রার্থনায় বসেন। তাঁর সামনে থাকে ভুষাকালির একটা বাঁধানাে পায়ের ছাপ। এই পায়ের ছাপে বুড়াে আঙুল নেই। এই ছাপটা কার পায়ের তা তিনি কাউকে এখনাে বলেন নি। প্রার্থনার সময় পায়ের ছাপের সামনে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে। ধূপ পােড়ানাে হয়। কোনাে কোনাে দিন প্রার্থনা দ্রুত শেষ হয়, আবার দীর্ঘসময় নিয়েও প্রার্থনা চলে । সারা রাত প্রার্থনা চলেছে এমন নজিরও আছে। 

সাধুবাবা রাধানাথ শুচিবায়ুগ্রস্ত । কিন্তু তিনি মানুষের স্পর্শ বাচিয়ে চলেন। তার পরিচিত সবাই বিষয়টি জানে ? খুব সাবধানে থাকে । দৈবাৎ কারও গায়ের সঙ্গে গা লেগে গেলে তিনি তৎক্ষণাৎ স্নান করেন। স্নানের পর ভেজা কাপড় বদলান না। ভেজা কাপড় গায়ে শুকান। 

তিনি নিরামিষাশি এবং একাহারি। সূর্য ডােবার আগে আগে খাবার খান, তবে সারা দিনই ঘনঘন চা খান, লেবুর শরবত খান। বেদানা তার প্রিয় ফল। পাথরের বাটিতে সব সময়ই দানা ছড়ানাে বেদানা থাকে। 

দেয়াল(পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ

রাধানাথ বাবুর সামনে দৈনিক ইত্তেফাক হাতে শফিক বসে আছে। সে এই বাড়িতে প্রতিদিন সকাল ন’টার মধ্যে এসে পড়ে। তার দুটি দায়িত্বের একটি রাধানাথ বাবুকে খবরের কাগজ পড়ে শােনানাে এবং অন্যটি হলাে তাঁর ডিকটেশন নেওয়া। কিছুদিন হলাে রাধানাথ বাবুর চোখের সমস্যা হচ্ছে। পড়তে গেলে বা লিখতে গেলে চোখ কড়কড় করে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তিনি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছে চোখের পাতায় খুশকি হয়েছে। চিরকাল তিনি জেনেছেন খুশকি মাথায় হয়। খুশকি যে চোখের পাতায়ও হয় তা তার জানা ছিল । জগতের কতকিছুই যে জানেন না তা ভেবে সেদিন তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। 

শফিক বলল, আগে কি হেডলাইনগুলি পড়ব ? 

রাধানাথ বললেন, পত্রিকায় সবচেয়ে ভালাে খবর আজ কী ছাপা হয়েছে সেটা পড়াে। এরপর পড়বে সবচেয়ে খারাপ খবর। ভালাে ও মন্দে কাটাকাটি হয়ে যাবে। 

শফিক বলল, ভালাে খবর তেমন কিছু পাচ্ছি না। |

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *