দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

রাধানাথ বললেন, একটা জাতীয় দৈনিকে ভালাে কোনাে খবর ছাপা হবে না তা হয় না। ভালােমতাে খুঁজে দেখাে, নিশ্চয়ই কিছু-না-কিছু আছে।দেয়ালরিকশাওয়ালার সততা, মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়ে ফেরত দিয়েছে টাইপ কিছু থাকার 

কথা। 

শফিক বলল, একটা পেয়েছি। লবণের দাম কিছু কমেছে। আগে ছিল ষাট টাকা কেজি, এখন হয়েছে পঞ্চাশ টাকা কেজি। সরকার স্থলপথে ইন্ডিয়া থেকে লবণ আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন। 

 রাধানাথ বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি তাে খুবই খারাপ একটা খবর পড়লে। কক্সবাজার ভর্তি সামুদ্রিক লবণ। অথচ লবণ আনতে হচ্ছে ইন্ডিয়া থেকে। হােয়াট এ শেম! এখন ভালাে খবরটা পড়াে। 

শফিক বলল, দুটা এক শ টাকার নােটের ছবি পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। নােট দুটার নম্বর এক খবরে বলেছে, বাংলাদেশের কারেন্সি ইন্ডিয়া ছেপে দেয় । ধারণা করা হচ্ছে, তারা দুই সেট কারেন্সি ছাপে। এক সেট বাংলাদেশকে দেয়, অন্য সেট তারা বাংলাদেশি পণ্য নেওয়ার জন্য ব্যবহার করে । 

দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

রাধানাথ বললেন, এটা তাে খুবই ভালাে খবর। ভালাে খবর ? 

অবশ্যই ভালাে খবর। বাংলাদেশ সরকার গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। ইন্ডিয়ার প্রতি নির্ভরতা কমাবে। 

শফিক বলল, আপনার যুক্তি অদ্ভুত, কিন্তু ভালাে। 

রাধানাথ বললেন, যুক্তিবিদ্যা অতি দুর্বল বিদ্যা, সবদিকে এই বিদ্যা খাটানাে যায়। যাই হােক, তুমি চলে যাও, আজ আমি ডিকটেশন দেব না। 

আপনার কি শরীর খারাপ? “। চোখের যন্ত্রণা বাড়ছে। মনে হয় অন্ধ হওয়ার পথে এগুচ্ছি। এটা ভালাে। কীভাবে ভালাে? 

জগতের রূপ দেখতে হয় চোখ বন্ধ করে। হাছন রাজা তাই বলেছেন, “আঁখি। মুঞ্জিয়া দেখাে রূপ রে।” জগতের রূপ দেখার জন্য তৈরি হচ্ছি, খারাপ কী ? ড্রয়ারটা খােললা । 

শফিক ড্রয়ার খুলল। 

রাধানাথ ক্লান্ত গলায় বলল, তােমার চল্লিশ টাকা পাওনা হয়েছে। পঞ্চাশ টাকার নােটটা নিয়ে যাও। দশ টাকা পরে ফেরত দিয়াে। টিসিবির একটা রসিদ আছে দেখাে। রসিদে হয় শার্টের জন্য আড়াই গজ কাপড় দিবে, নয়তাে প্যান্টপিস দেবে। রসিদ দেখিয়ে তােমার যেটা প্রয়ােজন নিয়ে নিয়ে। এখন বলাে, মানুষের সবচেয়ে কঠিন অভাব কোনটা? 

খাদ্যের অভাব। 

হয় নাই। বস্ত্রের অভাব। ক্ষুধার্ত অবস্থায় তুমি পথে বের হতে পারবে। ভিক্ষা চাইতে পারবে। নগ্ন অবস্থায় সেটা পারবে না। তােমাকে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হবে। 

শফিক বলল, আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। রাধানাথ বললেন, দেখে কি মনে হচ্ছে না গভীর দুঃখে আমি কাঁদছি ? মনে হচ্ছে। 

রাধানাথ আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ধর্মপাশার একজন সাধুর নাম ‘অশ্রুবাবা’। তিনি ভক্তদের দেখলেই চোখের জল ফেলতেন। অশ্রুবাবার নামডাক শুনে একবার তাঁকে দেখতে গেলাম। তিনি দু’হাতে আমার ডানহাত জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। আমি আবিষ্কার করলাম, তার  চোখের কোনাে সমস্যার কারণে তিনি অশ্রুবর্ষণ করেন। ভক্তের দুঃখে আপুত হয়ে বা তার প্রতি মমতাবশত অশ্রুবর্ষণ করেন না। তার হাতটা আমার দেখার শখ ছিল। আমি বললাম, বাবা, আপনার হাতটা একটু দেখি। আমি একজন শখের হস্তরেখাবিদ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত মুঠো করে চোখমুখ শক্ত করে ফেললেন। অশ্রুবাবা এরকম কেন করলেন জানাে ? 

দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

 তিনি নিশ্চয়ই বড় কোনাে পাপ করেছেন। তার ধারণা হয়েছিল আমি হাত দেখে সেটা ধরে ফেলব। 

শফিক বলল, আপনি আমার হাতটা একদিন দেখে দেবেন না। 

রাধানাথ বললেন, না। হাতের রেখায় মানুষের ভাগ্য থাকে না। মানুষের ভাগ্য থাকে কর্মে। তােমার কর্ম তাে আমি দেখছি। 

শফিক বলল, হাতের রেখা বিশ্বাস করেন না, তাহলে হাত দেখেন কেন ? 

রাধানাথ বললেন, পাঁচ হাজার বছর ধরে মানুষ ভুলের পেছনে কেন ছুটছে, কেন এই বিদ্যার চর্চা এখনাে হচ্ছে, তা জানার জন্যে। এখন তুমি বিদায় হও। আজ একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আজকের কথা বলার কোটা শেষ। আজ আর কথা বলব না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব। 

‘অতিভুক্তিরতী বােক্রিঃ 

সদ্যঃপ্রাণাপহারিণী এর অর্থ—অতিরিক্ত ভােজন এবং অতিরিক্ত বাচালতা সদ্য প্রাণনাশক। 

রাধানাথ বাবু দরজা-জানালা বন্ধ করে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। তিনি চিলেকোঠায় মেঝেতে পাতা শীতলপাটিতে ঘুমান। এই ঘরে কখনাে না। এটা অতিথি-অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার ঘর। দেয়ালে যামিনী রায়ের দুটি দুর্লভ ছবি আছে। দুই ছবির মাঝখানে রামকিংকর বেইজের ড্রয়িং। ছবিগুলি যত্নে আছে তা 

যামিনী রায়ের হুক খুলে গেছে বলে তিনি ফাস নেওয়ার মতাে দেয়ালে ঝুলছেন। 

রাধানাথ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমালেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন, তাঁকে একটা প্রকাণ্ড কাঁঠালগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। গাছভর্তি বিষপিপড়া। অর্ধেকটা লাল অর্ধেকটা কালাে। বিষপিপড়ারা তাঁকে কামড়াচ্ছে। হাত-পা বাঁধা বলে তিনি গা থেকে পিপড়া তাড়াতে পারছেন না। আশপাশে কেউ নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে ডাকবেন। 

এই স্বপ্নটা তিনি এর আগেও কয়েকবার দেখেছেন। প্রতিবার স্বপ্নেই কিছু পার্থক্য থাকে, কিন্তু মূল বিষয় এক। তিনি গাছের সঙ্গে বাঁধা। পিপড়া তাঁকে কামড়াচ্ছে। এই স্বপ্নের কোনাে ব্যাখ্যা কি আছে ? কেউ তাকে কোনাে বিষয়ে সাবধান করে দিতে চাচ্ছে ? সেই কেউটা কে ? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি পিতা ? সেই আদি পিতাকে কে সৃষ্টি করেছে ? তিনি স্বয়ম্ভ। নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। সেটা কী করে সম্ভব! 

দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

রাধানাথ ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন। আজ আর চিলেকোঠার প্রার্থনাঘরে যাওয়া হবে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ে সন্দেহজনক কোনাে চিন্তা মাথায় এলে তিনি অস্থির বােধ করেন। সেদিন আর তার প্রার্থনাঘরে যাওয়া হয় না। এক-দু’দিন সময় লাগে মন ঠিক করতে। মন ঠিক হওয়ার পর জীবনযাপন স্বাভাবিক হয়ে আসে। 

দরজা খুলে প্রেসের পিয়ন মাথা বের করল। তার চোখে ভয়। সাধুবাবার সঙ্গে কথা বলার প্রয়ােজন পড়লে সে কোনাে কারণ ছাড়াই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। 

কিছু বলবি ফণি ? বাবু, চা দিব ? 

 আপনার কি শরীর খারাপ? 

 আপনার কাছে একজন দ্রলােক আসছে। এক ঘণ্টার উপরে হইল বইসা আছেন। আপনার সঙ্গে নাকি বিশেষ প্রয়ােজন। আমি কী বলব, আপনি ঘুমে আছেন? 

আমি তাে ঘুমাচ্ছি না। মিথ্যা বলবি কেন ? ঘরে বাতি জ্বালা। ভদ্রলােককে এখানে নিয়ে আয়। 

বাবু, আপনাকে কি লেবুর শরবত বানায়ে দিব ? আচ্ছা দে। 

দ্রলােকের পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল। অত্যন্ত সুপুরুষ। এই সন্ধ্যাবেলাতেও তার চোখে কালাে চশমা। রাধানাথের বিছানার কাছে রাখা কাঠের চেয়ারে তিনি মােটামুটি শক্ত হয়ে বসে আছেন। চেয়ারের হাতলে হাত রাখা, সেই হাতও শক্ত। রাধানাথ বললেন, আমার কাছে কী প্রয়ােজন ? 

দ্রলােক ইতস্তত করে বললেন, শুনেছি আপনি খুব ভালাে হাত দেখেন। আমি আপনাকে হাত দেখাতে এসেছি। 

রাধানাথ বললেন, আমি নিজের শখে মাঝে মধ্যে হাত দেখি। অন্যের শখে দেখি না। 

ভদ্রলােক ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। রাধানাথ বললেন, হাত দেখার এই অপবিজ্ঞানে আমার কোনাে আস্থা নেই। দুর্বল মানুষ এর পেছনে ছছাটে। আপনি দুর্বল হবেন কেন ? 

দ্রলােক বললেন, আমি আপনার জন্যে সামান্য কিছু উপহার এনেছি। দার্জিলিংয়ের চায়ের দুটা প্যাকেট। আপনি উপহার গ্রহণ করলে আমি খুশি হব। | রাধানাথ বললেন, আমি উপহার গ্রহণ করলাম, কিন্তু আপনার হাত দেখব । প্রেসে ফণি বলে এক কর্মচারী আছে, তার কাছে চায়ের প্যাকেট দিয়ে যান। 

দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

ভদ্রলােক উঠে দাঁড়ালেন। বিনীত গলায় বললেন, স্যার, তাহলে যাই। আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে লজ্জিত। 

রাধানাথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, বসুন। দু’হাত মেলুন। তার আগে আমার টেবিলের ড্রয়ারে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস আছে, সেটা আমাকে দিন। সন্ধ্যাবেলা কেউ আমার কাছ থেকে মন খারাপ করে চলে যাবে তা হবে না। সন্ধ্যা হলাে বিশ্বপিতার মাহেন্দ্রক্ষণ। 

স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ। 

ছাদ থেকে ঝুলন্ত চল্লিশ ওয়াট বাল্বের আলাে রাধানাথের জন্যে যথেষ্ট না । রাধানাথ ম্যাগনিফাইং গ্লাস হাতে ঝুঁকে আছেন। তাঁর চোখও সমস্যা করছে। রুমালে বারবার চোখ মুছতে হচ্ছে । 

আপনার নাম কী ? 

দ্রলােক নড়েচড়ে বসলেন। জবাব দিলেন না। রাধানাথ বললেন, নাম বলতে কি সমস্যা আছে ? সমস্যা থাকলে বলতে হবে না। নামে কিছু আসে যায় । আসে যায় কর্মে। যিশুখ্রিষ্টকে বিশুব্রিষ্ট ডাকলেও তাঁর যিশুত্ব কিছুমাত্র কমবে 

আমার নাম ফরিদ। 

রাধানাথ ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আসল নাম গােপন করলেন, তাই না? ফরিদ নামেও চলবে। আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন ? আপনার হাভভাব, চোখের কালাে চশমায় এরকম মনে হচ্ছে। আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন এমন তথ্য হাতে লেখা নেই। অনুমানে বললাম। 

আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম, এখন নেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। 

হুঁ। 

খেতাবধারী ? 

কতক্ষণ আর হুঁ হুঁ করবেন ? দু’-একটা কথা বলুন শুনি। কী খেতাব পেয়েছেন? হাদেখে মনে হচ্ছে বড় খেতাব। বীরউত্তম নাকি ? 

আপনার অপঘাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল। ফাঁসিতে মৃত্যু। বিশেষ আর কিছু জানতে চাইলে কুষ্ঠি তৈরি করতে হবে। চা খাবেন? 

আপনি সাহসী, একরােখা, জেদি এবং নির্বোধ। আপনার সুবিধা হচ্ছে, নিজের নির্বুদ্ধিতার বিষয়ে আপনি জানেন, অন্যরা জানে না। যদি সম্ভব হয় একটা রত্ন ধারণ করবেন। রত্নের নাম গােমেদ, ইংরেজিতে বলে গার্নেট। দশ রতির মতাে হলেই চলবে। 

আপনার এখানে পাওয়া যায় ? না। আমি রত্নব্যবসা করি না। রত্ন কোথায় পাওয়া যাবে ? ঢাকায় পাবেন না। কলকাতা থেকে সংগ্রহ করলে ভালাে হয়। 

দেয়াল(পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

রাধানাথের চোখের যন্ত্রণা হঠাৎ অনেকখানি বাড়ল। তিনি রুমালে চোখ ঢাকতে ঢাকতে বললেন, আপনি কি বিশেষ কিছু জানতে চান ? 

যুবক ইতস্তত করে বললেন, মানুষের ভাগ্য কি পূর্বনির্ধারিত। 

রাধানাথ বললেন, এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আপনাদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে পূর্বনির্ধারিত। সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলছেন, আমি তােমাদের ভাগ্য তােমাদের গলায় নেকলেসের মতাে ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব। 

আপনি কোরানশরিফ পড়েছেন ? অনুবাদ পড়েছি। 

আগন্তুক বলল, আপনার দেয়ালে অতি মূল্যবান কিছু ছবি দেখতে পাচ্ছি । 

রাধানাথ বললেন, এই পৃথিবীতে মূল্যবান শুধু মানুষের জীবন, আর সবই মূল্যহীন। 

আগন্তুক দার্শনিক কথাবার্তার দিকে না গিয়ে বলল, ছবিগুলি অযত্নে আছে। ধুলা মাকড়শার ঝুল। আমি কি আপনার প্রেসের ছেলে ফণিকে বলে ঠিক করে দিয়ে যাব ? 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *