দেয়াল(পর্ব-৬)- হুমায়ূন আহমেদ

অবন্তি তার দাদাজানের পাশে এসে দাঁড়াল। সরফরাজ খান ছবি নামিয়ে রাখলেন। অবন্তি বলল, টাসকি খেয়েছ দাদাজান ? 

দেয়ালটাসকি আবার কী ? 

টাসকি হচ্ছে কোনাে-একটা জিনিস দেখে ঘাবড়ে যাওয়া। তুমি কি ছবি দেখে টাসকি খেয়েছ? 

টাসকি খাওয়ার মতাে কোনাে ছবি না। দাদাজান, তুমি হিংসা করছ। আমি হিংসা   করছি ? গরুর নাদিকে আমি হিংসা করব ? গরুর নাদি বলছ কেন? 

যে যা আমি তাকে তা-ই বলি। আমার স্যার গরুর নাদি? ইয়েস। চিন্তাভাবনা করে বলছ, নাকি আমাকে রাগানাের জন্যে বলছ ? চিন্তাভাবনা করেই বলছি। দাদাজান শােননা। আমি তােমার সঙ্গে বাস করব না। কোথায় যাবে? আমি আমার স্বামীর কাছে চলে যাব। কার কাছে চলে যাবি? স্বামীর কাছে। To my beloved husband, 

সরফরাজ খান কঠিন চোখে অবন্তির দিকে তাকিয়ে আছেন। অবন্তিও তাকিয়ে আছে, তবে অবন্তির মুখ হাসি হাসি। 

সরফরাজ উঠে দাঁড়ালেন। অবন্তি বলল, কোথায় যাচ্ছ? সরফরাজ বললেন, ঘুমাতে যাচ্ছি। আর কোথায় যাব! 

আমার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ কেন? ছবি রেখে যাও। এই ছবি আমি বাধিয়ে আমার শােবার ঘরে রেখে দেব। 

সরফরাজ খান বিরক্ত গলায় বললেন, বাড়াবাড়ি করিস না। কোনােকিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করা ঠিক না। 

অবন্তি বলল, এই কথা তােমার জন্যেও প্রযােজ্য। তুমিও কোনােকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। 

তারপরেও বই শেষ 

দেয়াল(পর্ব-৬)- হুমায়ূন আহমেদ

সরফরাজ বিছানায় শুয়েছেন। তাঁর হাতে ইছামতি বই। বইটা পড়ে কোনাে আরামই পাচ্ছেন না। জটিল ভাষা। অর্থহীন কথাবার্তা। তারপরেও বই শেষ করতে হবে। নিশ্চয়ই বইয়ের কোথাও-না-কোথাও বদ মাস্টার কোনাে ইশারা দিয়েছে। পেন্সিল দিয়ে আন্ডারলাইন করেছে। 

সরফরাজ ইছামতি পড়ছেন— 

রাজারামের ভগ্নি তিনটির বয়স যথাক্রমে ত্রিশ, সাতাশ ও পঁচিশ। তিলুর বয়স সবচেয়ে বেশি বটে, কিন্তু তিন ভগ্নির মধ্যে সেই সবচেয়ে দেখতে ভালাে, এমনকি তাকে সুন্দরী শ্ৰেণীর মধ্যে সহজেই ফেলা যায়। তিলুর মধ্যে পাকা সবরি কলার মতাে একটু লালচে ছােপ থাকায় উনুনের তাতে কিংবা গরম রৌদ্রে মুখ রাঙা হয়ে উঠলে বড় সুন্দর দেখায় ওকে। 

বড় চোখ, চমৎকার হাসি। তিলুর দিকে একবার চাইলে হঠাৎ চোখ ফেরানাে যায় না। সরফরাজ বই বন্ধ করলেন। মাস্টারের ব্যাপারটা এখন বােঝা যাচ্ছে। অবন্তি হচ্ছে তার তিলু। আরও কিছুদূর এগুলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। দেখা যাবে তিলু প্রেমে পড়েছে তার গৃহশিক্ষকের। এই গৃহশিক্ষক আবার পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে পারে। সরফরাজ মনে মনে বললেন, হারামজাদা! ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখাে নি। তুমি আমাকে চেনাে না। আমি সরফরাজ খান। দাড়াও, তােমার শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা করছি, বইটা আগে শেষ করি।

দেয়াল(পর্ব-৬)- হুমায়ূন আহমেদ

সরফরাজ পাঠে মন দিলেন— 

তবে তিলু শান্ত পল্লীবালিকা, ওর চোখে যৌবন চঞ্চল কটাক্ষ নেই, বিয়ে হলে এতদিন ছেলেমেয়ের মা ত্রিশ বছরের অর্ধপ্রৌঢ়া গিন্নি হয়ে যেত তিলু। বিয়ে না হওয়ার দরুণ ওদের তিন বােনই মনেপ্রাণে এখনাে সরলা বালিকা। আদরে আবদারে, কথাবার্তায়, ধরন ধারণে সব রকমেই। দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। হাতের বই নামিয়ে সরফরাজ বললেন, কে ? 

অবন্তি বলল, তােমার জন্যে পান আর চা নিয়ে এসেছি। সরফরাজ বললেন, ফরগেট ইট! 

অবন্তি বলল, দরজাটা খােলাে। তােমার টেবিলে রেখে যাই, তারপর তুমি ফরগেট ইট’ করে ফেলবে। 

সরফরাজ দরজা খুললেন। অবন্তি পান আর চা নামিয়ে রেখে মিষ্টি করে হাসল। সরফরাজ বিরক্ত মুখে বললেন, হাসছিস কেন? হাসি বন্ধ। 

অবন্তি বলল, তােমার হাসতে ইচ্ছা না করলে হাসবে না। তবে আমার এই হেসে যাওয়াতেই আনন্দ। 

কী বললি ? বললাম, আমার হেসে যাওয়াতেই আনন্দ। এর মানে কী? 

অবন্তি বলল, খুব সহজ মানে দাদাজান। কেউ হেসে আনন্দ পায়। কেউ কেঁদে আনন্দ পায়। আনন্দটাই প্রধান। হাসা বা কাঁদাটা কোনাে ব্যাপার না।

দেয়াল(পর্ব-৬)- হুমায়ূন আহমেদ 

সরফরাজ বললেন, সারাক্ষণ এমন উদ্ভট কথা কেন বলিস? অবন্তি বলল, আমার এই উদ্ভট কথাতেই আনন্দ। 

রাগ করতে গিয়েও সরফরাজ খান রাগ করতে পারলেন না। হেসে ফেললেন। 

অবন্তি বলল, দাদাজান, তুমি যখন হাসাে তখন তােমাকে কী সুন্দর যে লাগে! অথচ তুমি সারাক্ষণ মুখটাকে রামগরুড়ের ছানা করে রাখাে। 

রামগরুড়ের ছানা আবার কী ? 

অবন্তি বলল, যাদের হাসতে মানা, তারাই রামগরুড়ের ছানা। দাদাজান, গুড নাইট স্লিপ টাইট। 

অবন্তির লেখা আমার দাদাজান সরফরাজ খান পুলিশের এসপি হয়ে রিটায়ার করেছিলেন। আমি আমার জীবনে তার মতাে ভীতু মানুষ দেখি নি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলাে, তিনি অসীম সাহসিকতার জন্য পিপিএম’ পেয়েছিলেন। পিপিএম হলাে পাকিস্তান পুলিশ মেডেল। পুলিশ সার্ভিসে সাহসিকতার সর্বোচ্চ পুরস্কার। 

আমি দাদাজানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী জন্যে এত বড় পুরস্কার তিনি। পেয়েছিলেন ? দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট! এই বাক্যটি তার খুব প্রিয়। কারণে-অকারণে তিনি বলেন, ফরগেট ইট! যেসব প্রশ্নের উত্তরে ফরগেট ইট’ কিছুতেই বলা যায় না, সেখানেও তিনি এই বাক্য বলেন। উদাহরণ দেইআমি একদিন বললাম, দাদাজান, বাজার থেকে মাগুর মাছ এনেছে। মটরশুটি দিয়ে রান্না করবে, নাকি আলু দিয়ে ? 

দেয়াল(পর্ব-৬)- হুমায়ূন আহমেদ

দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট! আমি বললাম, কী ফরগেট করব ? মাছ রান্না ? তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমাকে বিরক্ত করবি না।। রান্না তুচ্ছ বিষয়? স্টপ আইং। 

তুচ্ছ বিষয় নিয়ে দাদাজান কথা বলতে পছন্দ করেন না, এই তথ্য পুরােপুরি মিথ্যা। তার আগ্রহ তুচ্ছ বিষয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন। 

১৯৭১ সালের মে মাসে দাদাজান আমার জন্যে গােলাপি রঙের বােরকা কিনে আনলেন। কঠিন বােরকা। বাইরে থেকে চোখও দেখা যায় না এমন। চোখের 

ওপর মশারির মতাে জাল। এখানেই শেষ না, বােরকার সঙ্গে কালাে হাতমােজা। পায়ের মােজা । দাদাজান আমাকে বললেন, নাে আমেন্ট, নাে তর্ক, নাে ডিলে। বােরকা পর। আমি বােরকা পরলাম। দাদাজান বললেন, এখন চল। 

আমি বললাম, কোথায় যাব ? 

সােহাগী যাব । ঢাকা শহরে থাকা যাবে না। মিলিটারি মেরে ফেলবে। এখনই রওনা হব। 

সঙ্গে আর কিছু নেব না ? দাদাজান বললেন, ফরগেট ইট! আমি বললাম, দাঁত মাজার ব্রাশও নেব না ? 

দাদাজান বললেন, বেঁচে থাকলে দাঁত মাজার অনেক সুযােগ পাবি। বেঁচে থাকবি কি না এটাই এখন প্রশ্ন। 

ঢাকা শহর আমরা পার হলাম রিকশায় এবং পায়ে হেঁটে। কিছু কিছু বাস ঢাকা থেকে যাচ্ছিল। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া বাসগুলিতে মিলিটারিরা ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছিল। মিলিটারি তল্লাশি মানে কয়েকজনের মৃত্যু। রূপবতী মেয়েদের ধরে আড়ালে নিয়ে যাওয়া তখনাে শুরু হয় নি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *