দেয়াল(পর্ব-৮)- হুমায়ূন আহমেদ

একসময় আমাদের অঞ্চলে মিলিটারি চলে এল। খাতিমনগরে মিলিটারির গানবােট ভিড়ল। দাদাজানের বাড়ি থেকে খাতিমনগর বাজার দু’মাইল দূরে। খবর শােনামাত্র দাদাজান আমাকে নিয়ে তাঁর পীর সাহেবের হুজরাখানায় উপস্থিত হলেন। 

দেয়ালবিশাল এলাকাজুড়ে পীর সাহেবের হুজরাখানা। চারদিকে দেয়াল, দেয়ালের ওপর কাটাতার । দুর্গের মতাে ব্যাপার । হুজরাখানার ভেতরে দুটি মাদ্রাসা আছে। একটি ছেলেদের, একটি মেয়েদের। দুটিই হাফেজি মাদ্রাসা। কোরানশরিফ মুখস্থ। করানাে হয়। হুজরাখানার পেছনে পীর সাহেবের দোতলা বাড়ি। একতলায় থাকেন পীর সাহেবের প্রথম স্ত্রী। তাঁর কোনাে সন্তানাদি নেই। দোতলায় থাকেন পীর সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী।

তার নাম জুলেখা। এই স্ত্রীর গর্ভে একটি সন্তান আছে। তার নাম জাহাঙ্গীর। তিনি কোরানে হাফেজ। রূপবান এক যুবক। স্র এবং দ্র। মেয়েদের মতাে চোখে গাঢ় করে কাজল দেন। তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার দেখা হয়েছে। তিনি কখনাে মাথা তুলে তাকান নি। হুজরাখানার পুরুষদের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানাের নিয়ম নেই। 

আমি পীর সাহেবের সামনে বসে আছি। আমার পাশে দাদাজান। পীর সাহেব নামাজের ভঙ্গিতে বসেছেন। তার বয়স অনেক, তবে তিনি শারীরিকভাবে মােটেই অশক্ত না। পীর সাহেবের ডানহাতে তসবি। তসবির দানাগুলি নীল রঙের, অনেক বড় বড়। তিনি একমনে তসবি টেনে যাচ্ছেন। ঘরে আরও কয়েকজন ছিল, তাদের হাতেও তসবি। পীর সাহেবের নির্দেশে তারা বেরিয়ে গেল। একজন এসে ফরসি হুক্কা দিয়ে গেল। পীর সাহেব হুক্কায় টান দিতে দিতে বললেন, সরফরাজ! তােমার এই নাতনির মা বিদেশিনী, সেটা জানলাম। তার ধর্ম কী ? 

দেয়াল(পর্ব-৮)- হুমায়ূন আহমেদ

খ্রিষ্টান। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। 

পীর সাহেব বললেন, মুসলমান ছেলে খ্রিষ্টান বিবাহ করতে পারে। নবিজি মরিয়ম নামের এক খ্রিষ্টান কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁর গর্ভে এক পুত্রসন্তানও হয়েছিল। সন্তানের নাম ইব্রাহিম। এখন আমার প্রশ্ন, তােমার পুত্রের সঙ্গে খ্রিষ্টান মেয়ের বিবাহ কি ইসলাম ধর্মমতে হয়েছে ? 

জি হুজুর । 

আলহামদুলিল্লাহ। এটা একটা সুসংবাদ। তুমি তােমার নাতনিকে আমার এখানে রাখতে চাও? 

জি জনাব। মেয়ের বাবা কোথায় ? 

মেয়ের বাবা কোথায় আমি জানি না। আমার ছেলে তিন বছর বয়সের মেয়েকে এনে আমার কাছে রেখে স্পেনে চলে যায়। এরপর আর তার খোজ জানি 

সে কি জীবিত আছে ? 

তাও জানি না। 

পীর সাহেব বললেন, জ্বিনের মাধ্যমে তােমার পুত্রের সংবাদ আমি এনে দিতে পারি। সেটা পরে দেখা যাবে। এই মেয়ের নাম কী ? 

অবন্তি । এটা কেমন নাম ? তার বাবা রেখেছে। 

সন্তানের সুন্দর ইসলামি নাম রাখা মুসলমানের কর্তব্য। আমি এই মেয়ের নাম রাখলাম, মায়মুনা। মায়মুনা নামের অর্থ ভাগ্যবতী । 

দাদাজান চুপ করে রইলেন। 

পীর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি কোরানমজিদ পাঠ করতে পারাে ? 

আমি বললাম, পারি। কে শিখিয়েছে ? তােমার খ্রিষ্টান মা ? 

আমার দাদাজান আমার জন্যে একজন হুজুর রেখে দিয়েছিলেন। হুজুরের নাম বলব ? 

পীর সাহেব বললেন, নাম বলতে হবে না। তুমি কথা বেশি বলাে। কথা কম বলবে। তােমার অজু আছে ? 

জি-না। 

যাও, অজু করে এসে আমাকে কোরানমজিদ পাঠ করে শােনাও। সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে।। 

আমি সূরা ইয়াসিন পড়লাম। পীর সাহেব বললেন, পাঠ ঠিক আছে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। সরফরাজ, তােমার নাতনি মায়মুনাকে আমি জুলেখার হাতে হাওলা করে দিব । সে নিরাপদে থাকবে। তবে তাকে কঠিন পর্দার ভেতর থাকতে হবে। আমার এখানে তা-ই নিয়ম ।। 

দাদাজান বললেন, আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই সে থাকবে। 

পীর সাহেবের কাছে থাকার সময়ই খবর পেলাম, দাদাজানের বাড়িতে মিলিটারি এসে উঠেছে। মিলিটারি ক্যাপ্টেন ঘাঁটি হিসেবে বাড়ি পছন্দ করেছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্যে বাড়ির চারদিকের সব গাছপালা কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধীরেন কাকা ও তার স্ত্রীকে যে মিলিটারিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। এই খবর তখনাে আসে নি। 

দেয়াল(পর্ব-৮)- হুমায়ূন আহমেদ

দাদাজান আমাকে রেখে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমার হাতে এক শ’ টাকার নােটে দুই হাজার টাকা দিলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার ব্যক্তিগত পিস্তলটা তােকে দিয়ে যাচ্ছি। ভালাে করে দেখে নে। বারাে রাউন্ড গুলি ভরা আছে। সেফটি ক্যাচ লাগানাে অবস্থায় ট্রিগার চাপলে গুলি হবে না। সেফটি ক্যাচ কীভাবে খুলতে হয় দেখ। এইভাবে। 

আমি বললাম, সেফটি ক্যাচ খােলার কায়দা জেনে আমি কী করব? কাকে আমি গুলি করে মারব ? 

দাদাজান বললেন, কাউকে মারবি না। জিনিসটা জানা থাকল। 

আমি বললাম, তুমি কোথায় যাবে ? 

দাদাজান বললেন, জানি না কোথায় যাব। ঢাকায় যেতে পারি। মিলিটারিরা তােমার বাড়ি দখল করে বসে আছে। তাদের কিছু বলবে না ? 

পীর সাহেবের এই বাড়িতে আমি কত দিন থাকব ? 

মলিটারির গুষ্টি বিদায় না হওয়া পর্যন্ত থাকবি । আমি মাঝে মধ্যে এসে খোঁজ নিব। পিস্তলটা লুকিয়ে রাখবি। পিস্তলের বিষয়টা কেউ যেন না জানে। 

কেউ জানবে না। 

পীর সাহেবের বাড়িতে আমার জীবন শুরু হলাে। খুব যে কষ্টকর জীবন তা না। দোতলার সর্বউত্তরের একটা ছােট্ট ঘর আমাকে দেওয়া হলাে। ঘরে একটাই জানালা। এই জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। জানালার সামনেই বটগাছের সাইজের এক কড়ইগাছ। ঘরে আমি একা থাকি। শুধু রাত্রে সালমা নামের মধ্যবয়স্ক এক দাসী মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমায়। তার চেহারা কদাকার। মুখে বসন্তের দাগ, একটা চোখ নষ্ট। মানুষ হিসেবে সে অসাধারণ, মানসিক সৌন্দর্যের কাছে তার শারীরিক ত্রুটি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল। প্রথম রাতেই সে আমাকে বলল, আম্মাজি, আপনি ভয় খাইয়েন না। আমি আছি। 

আমি বললাম, ভয় পাব কী জন্যে ? 

দেয়াল(পর্ব-৮)- হুমায়ূন আহমেদ

সালমা বলল, আপনের বয়স অল্প। আপনে হুরের মতাে সুন্দর। কিংবা কে বলবে, হুরের চেয়েও সুন্দর। আমি তাে আর হুর দেখি নাই। আপনের মতাে মেয়েছেলের কাইকে কাঁইকে (কদমে কদমে) বিপদ। আপনে সাবধানে চলবেন । আমার একটাই নয়ন। এই নয়ন আপনের উপর রাখলাম। 

আমি বললাম, একটা নয়ন আমার উপর রেখে দিলে কাজকর্ম করবেন কীভাবে ? তারচেয়েও বড় কথা, নয়ন আপনি আমার উপর রাখছেন কী জন্যে ? 

সালমা বলল, ছােট মা’র হুকুম।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *