নিজের সঙ্গে খেলা- সমরেশ মজুমদার

নিজের সঙ্গে খেলা- সমরেশ মজুমদার

কাল সারারাত ওরা বৃষ্টিতে ভিজেছে। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চিরুনির দাঁতের মতো হাওয়া বইছিল সন্ধে থেকে। বৃষ্টি শুরু হলে তার চেহারা গেল বদলে। জলো বাতাসের তীব্র শাসানি আর কনে বউ-এর সিঁদুর-টিপের মতো বৃষ্টির ফোঁটা মাথার ওপরে বড়-বড় গাছের পাতা গলে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। গঙ্গাচরণের বুকের ওপর লেপটে মোহিনী দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল।

দিনের বেলায় যা ছিল একরকম, সূর্যি ডুবলে তা হল আর এক। বিকেলে যখন ছায়া ঘনাল, মাথার ওপরে বড়-বড় শাল সেগুন গাছে অজস্র পাখি আর বাঁদরেরা যখন বিচিত্র শব্দের আওয়াজ তুলছিল তখনও চোখের সামনের জগৎটা ছিল পরিষ্কার। মোহিনীকে নিয়ে গাছের ওপরে ওঠা। যায় না, তাই গঙ্গাচরণ অনেক দেখেশুনে যে বিরাট শালগাছের গুঁড়িটা বেছে নিয়েছিল রাত কাটাবার জন্যে সেটা তখন মনে হয়েছিল অনেক নিরাপদ। তারপর টুকুস করে রাত নামল। চোখের পাতা বন্ধ করলেও এত কালো হয় না আঁধার। এক সময় উত্তরের ভূটান পাহাড় থেকে এল হাওয়া আর বৃষ্টি।

ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছুনয়–গঙ্গাচরণ একটা হাত মোহিনীর ভেজা চুলে রেখে বলল ফিসফিসিয়ে। এখন কথা বলতে ভয় হয়। জঙ্গলের আনাচে-কানাচে কি বিচিত্র সব শব্দ বাজছে, এ জঙ্গলে কি বাঘ আছে? তেমন তো শোনা যায় না। দু-একটা বড় জন্তু অবশ্যি আসে–তা তারা আসে শীতকালে। ভয় বলতে তাকে, রাত্রে যার নাম করতে নেই। সে আসুক, কাছে তো ঘেঁষতে পাবে না। এখানে বসার আগে গঙ্গাচরণ একশো আটবার অস্তিমুনির নাম নিয়ে গণ্ডি কেটে রেখেছে গোল করে। সে গণ্ডি পেরিয়ে আসবে কারও সাধ্যি নেই। সে যত বড়ই লতা হোক। কিন্তু এভাবে বসে ভেজা, সারা শরীর দিয়ে জল গড়াচ্ছে, একটা ছাউনি দরকার। অন্তত মাথা বাঁচানোর একটা আড়াল। গায়ের মধ্যে শীত যেন যাঁদা মারছে। তবু ভরসা হয় না, এই অন্ধকারের জঙ্গলে এই বৃষ্টির বাতাসে দু-পা বাড়াতে। দিনমান হলে হত, রাতে কোথায় খুঁজবে গঙ্গাচরণ।

অথচ মোহিনী বাঁশের পাতার মতো কাঁপছে, দাঁতে-দাঁতে শব্দ হচ্ছে ওর, দশ আঙুলে কাঁকড়ার মতো ধরে রেখেছে পাঁজরার হাড়, গঙ্গাচরণের কেমন কষ্ট হল। মোহিনীর মুখ দেখা যাচ্ছে না। গলার কাছে গরম নিশ্বাসের স্পর্শ লাগছে। গঙ্গাচরণ একবার হাত বোলাল মোহিনীর মুখে। কি। নরম, মাটির চেয়ে নরম মুখের জমি। এই অন্ধকারে চোখ বুজে আঙুলের ডগার স্পর্শে গঙ্গাচরণ বলে দিতে পারে মোহিনীর কপালের কোন জায়গাটা একটু ঢালু, ধনুকের মতো দুটো জ্ব কতটা ঘন, চোখের পাতার আড়ালে যে দুটো দিঘি তা কতটা গভীর, নাকের পাটায় কাঁপা-কাঁপা ছোট্ট ফুল, টিপে থাকা দুটো ঠোঁট কতটা রক্তে গোলাপ তার চিবুকের পাশে যে ছোট্ট টোল পড়ে ঠোঁট খুললেই–গঙ্গাচরণ যেখানে ক-ফোঁটা চোখের জল স্বচ্ছন্দে রেখে দিতে পারে। এ সবকিছু বুকের মধ্যে জমা হয়ে আছে। চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়।

অথচ মোহিনীকে কোনওদিন স্পর্শ করার সুযোগ হয়নি গঙ্গাচরণের। খুঁটিমারীর কাঠকাটাদের গাঁয়ের বউ মোহিনীর গায়ে হাত দেবে গঙ্গাচরণের এত বড় বুকের পাটা ছিল না। মোহিনীদের ঘরের দাওয়ায় যে লম্বা কাটারিটা ঝোলানো থাকত, যেটা নিয়ে মোহিনীর স্বামী কামাখ্যা দু-বেলা বেরুত সেটার ওপর ভয় ছিল গাঁসুষ্ঠু সবার। তবু বাদা অঞ্চলের মানুষ গঙ্গাচরণ ঘুরতে-ঘুরতে যখন এসে পড়েছিল খুঁটিমারীতে তখনই নজর কেড়েছিল মোহিনী। বৈরাগীর ভেক নিয়ে এসেছিল গঙ্গাচরণ। এতে অন্ন পাওয়ার সুবিধে হয়। গানের গলাটাও ছিল ভালো। মানুষজন আপন করে নিতে দেরি করত না। তা খুঁটিমারীতে এসে আর পা সরে না। মোহিনী তার গানের সুরের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল আচমকা। আর সেই সুরের টানে-টানে কখন মোহিনী কাছাকাছি। এসেছে, কখন তার বুকের মধ্যে হাঁপর উঠেছে টের পায়নি কেউ। মোহিনীর বাড়ির সামনে ছোট্ট ভিড় জমিয়ে গঙ্গাচরণ একদম নিজের মনের কথা, সারাজীবনে সে যা ভেবেছে সেই কথাগুলো বলত, সুখ কেউ পায় না গো, সুখের ভান করে সবাই। সুখ কি বাজারের আলুবেগুন, পয়সা দিয়েই কেনা যায়? সুখ কি তোমার বাঁধা গরু যে মন্ত্র দিয়েই বাঁধা যায়! নাকি সুখ তোমার গায়ের জোরে কাটারির তলায় ঘাড় পেতে বসে রইবে! বলত আর আড়চোখে মোহিনীর দাওয়ার দিকে তাকাত। সেখানে কামাখ্যা পা ঝুলিয়ে কথার তালে মাথা দোলাত। তাই দেখে গা জ্বলত গঙ্গাচরণের। গলা ছেড়ে গান ধরত, আমার দুঃখ বড় ভালো, সে যে সঙ্গ ছাড়ে না…।

মাথা গোঁজার আস্তানা জুটে গিয়েছিল একটা, জুটে যায়। বিধাতার এটাই নিয়ম। বুকের মধ্যে ঘর আছে সবার, শুধু দরজা খুলে দেওয়ার মন্ত্রটা জেনে নিলেই হল। সে মন্ত্রের নাম ভালোবাসা, তাই গান হয়ে, ফুল হয়ে, আকাশ হয়ে, তাই দুঃখ হয়ে ঝুরু-ঝুরু করে। গঙ্গাচরণের মুখে হাসি, গলার সুরে দুঃখের সঙ্গে চিরকালের মিতালি। তাই যখন শুধু চোখে-চোখে চাওয়ার টানে মোহিনী ঘন। বিকেলের ছায়ায় চলে এল ওর কাছে তখন বুকের মধ্যে কেমন একটা দুঃখ চলকে উঠেছিল গঙ্গাচরণের। এত কাছে, এই নিরালা বনের ধারে মোহিনী পানের পাতার মতো মুখ তুলে যখন বলল, আমি এলাম, আমাকে নিয়ে চলো, তখন বুকটা থম ধরেছিল।

কোথায়?

তোমার দুঃখের কাছে।

কেন, সুখ চাও না? তোমার তো সুখের শরীর। গঙ্গাচরণ হেসেছিল।

হাত ধরেছিল মোহিনী, সুখের সুখ তো পেলাম, এবার দুঃখের সুখ চাই।

আর সঙ্গে-সঙ্গে গঙ্গাচরণের শরীরের শিরায়-শিরায় শরীরের সমস্ত ঘরের দরজা-জানলাগুলো হঠাৎ ওঠা ঝড়ের দমকে উথালপাথাল।

তোমার ভয় হয় না?

না।

ঠিক আছে। তাই হোক।

আমি রাত্তিরে আসব। জেগে থেকো।

জেগে থাকব। গঙ্গাচরণের মন বলল, আমি তো জীবনভর জেগেই আছি গো! জেগে-জেগেই আমার রাত গেল, দিন এলে চোখ বন্ধ হয় না। মুখে বলল, এখন নয় কেন?

বাঃ উঠোনটা নিকিয়ে দিয়ে আসি, বাসনগুলো ময়লা–ধুতে হবে না? স্মৃতিগুলো রেখে দিয়ে আসব।

অথচ কেমন করে কী হল, গ্রামসুদ্ধ লোক চড়াও হল সন্ধে পেরোতে কুপ ডাকা কন্ট্রাকটরের বারান্দায়। সেটাই গঙ্গাচরণের আস্তানা। পা ঝুলিয়ে আকাশ দেখছিল সে, একটা তারা টুক করে পড়ে গিয়ে কোথায় লুকিয়ে পড়ল। এমন সময় লোকগুলো এসে হাজির একরাশ অন্ধকারের মতো। সবার সামনে লকলকে আগুনের মতো কাটারি হাতে কামাখ্যা, মোহিনীর স্বামী। তার গলাটাই চড়া, এই শালা বাউণ্ডুলে, ওঠ!

আর দুজন এসে হাত ধরল।

ঘরের বউ-এর সঙ্গে পিরিত! শালা ফুসলে নেওয়ার মতলব!

শালাকে আমি কেটেই ফেলব। আমার বউ আমার মুখের ওপর বলে এর সঙ্গে ঘর ছাড়ব! ডুবে ডুবে জল খাওয়া!

দুঃখ-দুঃখ করে ভড়ং দেখানো।

লোকগুলো কেমন করে গোল হয়ে গেল। সব হাতগুলো মিলেমিশে একটা বর্শা হয়ে গঙ্গাচরণের পাঁজরার হাড়ে মাথার খুলিতে খোঁচা মারতে লাগল। দু-চোখ ঢেকে যায় যে, এর নাম রক্ত, আঃ!

ওরা ওকে নিয়ে এল গাঁয়ের ধারে, যেখানে জঙ্গলের শুরু। যে জঙ্গলের তিনপাশে পাহাড় আর পাহাড় আর একদিকে এই কাঠ কাটাদের গ্রাম। কে যেন হাঁকল, যা শালা জঙ্গলে। এ গ্রামে আবার যদি দেখি চামড়া খুলে ঢাক বানাব।

হইচইটা গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেল। গঙ্গাচরণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। জঙ্গল থেকে বেতের ফুলের গন্ধ আসছে। এত মারল ওরা, কই কান্না নেই কেন? কপাল থেকে রক্ত ঝরছে, তবু কান্না আসছে না। কেন? মোহিনী কোথায়? তাকেও কি ওরা মেরেছে? হঠাৎ খুব ভালো লাগল গঙ্গাচরণের, খুব ভালো মেয়ে, সোজা কথা সোজা মনে বলে দিল কামাখ্যার মুখের ওপর। গঙ্গাচরণ ঝরনার জলে মুখ ধুলো। আর তারপরেই পাতার শব্দ পায়ের চাপে কানে বাজল। চোখ তুলতেই সে।

এলাম।

তুমি!

হ্যাঁ, ওরা তোমাকে মেরেছে, আমাকে পারেনি। অন্ধকারে-অন্ধকারে এলাম। সোজা পথ নেই।

যে!

এখন কী হবে? গঙ্গাচরণ গাঁয়ের দিকে তাকাল। সেখানে হইচই বেশ জোরদার। আর হ্যারিকেন নয়, এবার মশাল জ্বলছে।

পালিয়ে চলো। যত তাড়াতাড়ি। ওরা আমাদের একসঙ্গে পেলে–।

কোথায় যাব?

জঙ্গলের ভিতরে, ওই পাহাড় পেরিয়ে কোথাও, সেখানেও তো মানুষ আছে। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকো না।

মানুষ আছে। হ্যাঁ, চেনা মানুষের চেয়ে অচেনা মানুষ ভালো। কিন্তু এই জঙ্গলে হাঁটতে পারবে?

তুমি আছ। মোহিনী হাসল।

এরপর আর কথা নয়, থাকতে পারে না। হাত ধরল ওরা। অন্ধকারে বেতগাছের পাশ কাটিয়ে, পাতা মাড়িয়ে বনের অনেকটা দূর চলে এল। এখন বন অনেকটা ঘন। হাঁটা যাচ্ছে না। গা ছড়ে যাচ্ছে। ওরা অনেক ভৌতিক শব্দ শুনল, মাথার ওপর পাখি আর বাঁদরের চিৎকার। মাঝে-মাঝে অন্ধকারে কী যেন জ্বলে। মোহিনী আর হাঁটতে পারছিল না। গঙ্গাচরণের মুঠোয় ধরা মোহিনীর নরম হাত ভিজে-ভিজে একাকার। তারপর এক সময় সকাল হল। বড়-বড় গাছের মাথা চুঁইয়ে রোদ এল, মাটিতে সেই বুনো গন্ধ আর পাখির ডানার ঝাঁপটানি শুনতে-শুনতে মোহিনী হাসল। গঙ্গাচরণ মুগ্ধ হয়ে দেখল।

ওরা আর আমাদের পাবে না। গঙ্গাচরণ বলল।

বলা যায় না। এখান থেকেও তো কাঠ কাটা হয়। দেখছ, সামনে গাছ কাটা আছে, নম্বর দেওয়া! মোহিনী দেখাল।

হ্যাঁ, এখানেও মানুষের পায়ের চিহ্ন আছে। গঙ্গাচরণ দেখল, সারারাত না ঘুমিয়ে মোহিনীর চুল রুক্ষ, মুখের ওপর ধুলোর প্রলেপ।

এখন দিনের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার। চোখ মেলতেই আকাশ। শ্যাওলা-মাখা গাছের সারি। তবু কী আশ্চর্য, ওই ঠাসবোনা পাতার লুকোচুরির ফাঁকে খেলে কিছু রোদ চুঁইয়ে পড়েছে মাটিতে। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল ওদের। সকাল হতেই গাঁ-সুদ্ধ কাঠকাটারা এদিকে চলে আসতে পারে, প্রতিটি ডাল সরিয়ে খুঁজবে ওদের। নাকি কামাখ্যা সব ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকবে? মেয়ের তো অভাব নেই আশেপাশে। রোদ উঠলে, আলোর মুখ দেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত। গায়ে হাতে একটু লাগছে এই পর্যন্ত। ফুলে-ফুলে গিয়েছে মুখ হাত। রাগলে মানুষ মানুষ থাকে না। এই যে কাল রাত্তিরে কামাখ্যা ওকে বেধড়ক মারল, কী লাভ হল? না, একটা উল্লাস পূর্ণ হল, ব্যস। তার বেশি কিছু তো নয়। তারপর বাড়ি ফিরে যখন দেখবে মোহিনী নেই, তখন ওর কেমন খারাপ লাগবে? নিজেকে খাটো লাগবে না? হেরে যেতে লজ্জা করবে না? করবে। করবে বলেই ও খুঁজবে খুঁটিমারীর ওপাশের বসতি অঞ্চলে, বিনাগুঁড়ির স্টেশনে, যেখানে মানুষ ঘর বেঁধে ভালোবাসা। কৃপণের মতো রোজ একটু-একটু খরচ করে। ওর খেয়ালই হবে না হয়তো, এই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে একটা মজা আছে। কপালটা টনটন করছে, গঙ্গাচরণ হাত দিল মুখে। মোহিনীর নজর পড়েছিল। গঙ্গাচরণ দেখল, একটা সরু নরম আঙুল হারমোনিয়ামের রিডের মতো তার মুখের ওপর সুর তুলছে। গঙ্গাচরণের চোখ বুজে এল।

ওরা তেমনি চুপচাপ বসে রইল খানিক। তারপর আলোর তেজ বাড়তে তারা হাঁটা শুরু করল। এখন চারধারে গাছ, গাছের দেওয়াল। একটা বনজ শব্দ ছাড়া কোথাও কারও অস্তিত্ব নেই। মোহিনী আগে-আগে চলছিল। জঙ্গল বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে তবু মেয়েদের চলায় চটক কত। চিবুক কাঁধের কাছে এনে টোল দেখিয়ে হাসছিল মোহিনী।

হাসছ কেন?

দেখছি তোমাকে, তুমি কেমন পুরুষমানুষ। মাথার ওপরে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর দেখতে-দেখতে বলল মোহিনী।

অবাক হল গঙ্গাচরণ, কেন?

কাল রাত থেকে তোমার সঙ্গে আছি, এই বনের মধ্যে একসঙ্গে, তবু তুমি ছুঁয়ে দেখলে না ভালো করে, পুরুষ তো গো! খিলখিল শব্দটা চমকে দিয়ে গেল কিছু পাখিকে। ওরা শব্দ তুলল।

হাসল গঙ্গাচরণ, আগে নিজের করে পাই!

চট করে সরে এল মোহিনী, আর কীভাবে পাবে বলো? তারপর একবারে গঙ্গাচরণের শরীরের সাথে মিশে যেতে-যেতে বলল, দাও না, দাও না।

মোহিনীর নরম, গরম শরীরটাকে কোনওরকমে খাড়া রেখে গঙ্গাচরণ বলল, কী?

ভালোবাসলে সব পাওয়া যায়?

যায়।

সব?

হুঁ।

ছেলে?

ছেলে!

হুঁ! সে লোকটা আমাকে দিতে পারেনি। তুমি দাও। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। আমার নাকি হবে না কোনওকালে। শোনো কথা! তুমি তো বলো ভালোবাসলে সব হয়, হয় না?

হয়।

তবে?

আমি তো আছি।

তাতে কী?

ভালোবাসলে কি কোনও ফাঁক থাকে! মানুষের বুকের মধ্যে ছোট-ছোট কয়েকটা ঘর আছে। একটা স্বামীর জন্যে, একটা সন্তানের জন্যে, একটা মা-বাবার জন্যে, এইসব–কাউকে ভালোবাসলে সব ঘর পূর্ণ হয়ে যায় না? তখন আলাদা-আলাদা কেউ নয়, সব মিলিয়ে এক আর তার জন্যেই সব, বুঝলে?

উঁহু, আমি রক্তমাংসের মানুষ চাই। আমার পেটে থাকবে, আমাকে ব্যথা দেবে যে, আমি তার জন্যে রক্ত দেব, যে আমাকে রক্ত দেবে, আমি মরে গেলে সে বেঁচে থাকবে, আমার রক্ত থাকবে। বলো দেবে?

গঙ্গাচরণ দু-চোখ মেলে দেখল মোহিনীকে। তারপর ভাবল, রোদ লেগে চোখ অন্ধ হয়, বাজ পড়লে কেউ কালা হয়ে যায় আবার ফুল ফুটলে মনে আনন্দ হয় যখন তখন ভালোবাসলে–মোহিনীর অনুর্বর শরীরের দিকে হাত বাড়িয়ে গঙ্গাচরণ ফিসফিসিয়ে বলল, দেব।

ওরা সেই পাহাড়টার দিকে চোখ রেখে হাঁটছিল। এভাবে হাঁটা যায় না যাওয়া সহজ নয়। জঙ্গলের পায়ে চলা পথগুলো ভীষণরকম প্যাঁচালো অথচ সময়গুলো কী দ্রুত লাফিয়ে-লাফিয়ে যাচ্ছে! এখন যত জলদি হোক ওই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছানো যায় ততই মঙ্গল। ওইসব পাহাড়িয়া মানুষগুলোকে বিশ্বাস করা যায়।

মোহিনীর নজর পড়েছিল, এধারটায় বাঁদরের ভিড় বেশি। পায়ের তলায় আধখাওয়া পচা ফল পড়ে রয়েছে। হঠাৎই নজরে পড়ল কয়েকটা পেয়ারা গাছের মতো গাছ গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। তার অঙ্গে-অঙ্গে ফল। এ ফল কোনওদিন দেখেনি মোহিনী। গঙ্গাচরণও না। গঙ্গাচরণ বাঁদরদের তাড়িয়ে কোনওরকমে তার কয়েকটা পেড়ে আনতে মোহিনী জিগ্যেস করল, কী ফল?

জানি না, বাঁদরগুলো তো খাচ্ছে! বিধাতার জিনিস, খাও।

তারপর এক সময় ছায়া জমা হল পাতায়-পাতায়। শেষপর্যন্ত বিরাট গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল ওরা। গঙ্গাচরণ গুনগুন করে গাইছিল, সুখ নামে সেই ফিচেল পাখি ফুড়ুৎ-ফুড়ুৎ ওড়ে–I গায়ে গা লাগিয়ে দুলে-দুলে গান শুনছিল মোহিনী। আর সেই সময় একরাশ বাতাস আরও কিছু অন্ধকার ছুঁড়ে দিল জঙ্গলের ভিতরে, বিরাট-বিরাট গাছের ঝুঁটি নেড়ে দিয়ে শোঁ-শোঁ শব্দে তেড়ে এল। আর তার কাঁধে চেপে এল বাতাসের মতো ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি। শেষপর্যন্ত কাঁপুনি ধরল গঙ্গাচরণের। কানের কাছে সুড়সুড়ি লাগছিল, হাত দিতে কী একটা পোকা উঠে এল। টান মেরে ছুঁড়ে দিল সেটাকে। একটা উঁচুমতো জায়গা পেলে হত, মাটির ওপর বসা ঠিক হয়নি। মোহিনী থরথর করে কাঁপছিল। কাঁপা গলায় বলল, আমার শীত করছে গো।

মোহিনীর শরীর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছে। স্নো মেখেছিল হয়তো, খুঁটিমারীর বাজারে পাওয়া যায় সব। হঠাৎ মেঘ ডাকল জোরসে। সমস্ত জঙ্গলটা মুহূর্তের জন্যে সাদা হয়ে আবার নিবে গেল আচমকা। মোহিনীর শরীর কেমন গরম হয়ে উঠেছে। আর হঠাৎ একদম। ছেলেমানুষের মতো গঙ্গাচরণ দু-হাতে মোহিনীর মুখটা তুলে ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল। মোহিনীর গরম নিশ্বাস লাগছে মুখে। কী নরম ঠোঁট মোহিনীর! ভেজা-ভেজা একটু টক গন্ধ। তবু। কী ভালো লাগল গঙ্গাচরণের। মনের মধ্যে একটা বলের মতো গড়িয়ে গেল ভালোলাগা।

হঠাৎ চুপচাপ চারধার। শুধু গাছের পাতায় জমে থাকা জল টুপটাপ ঝরছে। বৃষ্টিটা আচমকা থেমে গেল। গঙ্গাচরণ বুকের ওপর একটা গরম তেতে ওঠা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল। দু-হাত দিয়ে মোহিনীকে আবার স্পর্শ করতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল মন, মোহিনীর শরীর পুড়ছে, তেতে উঠছে গা। ভেজা চুল জামা-কাপড়ে যে জলের ঠান্ডা সেটা যেন আর হাতে লাগছে না। গঙ্গাচরণ ফিসফিস করে বলল, শরীর খারাপ লাগছে?

অনেক দূর থেকে যেন মোহিনী কথা বলল, হুঁ।

এখন কী করবে গঙ্গাচরণ? যদি জ্বর বাড়ে, তাহলে? শরীর তোমার সুখের, দুঃখ তোমার সইবে কেন? গঙ্গাচরণ হাসল। হাঁটাচলা হলেই ঠিক হয়ে যাবে। মনের জোর থাকলে কি না হয়।

তারপর যখন আলো ফুটল, গাছের ভেজা পাতা ছুঁইয়ে যখন আলো পড়ল মাটিতে তখন গঙ্গাচরণ চমকে উঠল। জবাফুলের মতো টকটকে চোখ, মুখখানা কেমন বিবর্ণ, গায়ে হাত-পোড়াননা তাপ। দুবার ডাকতে মোহিনী চোখ মেলল। গঙ্গাচরণের চেহারা দেখে হাসল। দু-হাতে দিয়ে মোহিনীকে ধরে দাঁড় করাল ও, হাঁটতে পারবে?

কয়েক পা হাঁটল মোহিনী, তারপর টলতে লাগল। না, এভাবে ওকে নিয়ে চলা সম্ভব নয়। প্রথমটায় কী করবে ভেবে পেল না ও। মোহিনীর জ্বর এত তাড়াতাড়ি বাড়ছে কেন? ভেজা মাটিতে বসিয়ে দিতে মোহিনী একটা কাপড়ের পুঁটলির মতো মাথা গুঁজে রইল। এ মোহিনীকে গঙ্গাচরণ কোনওদিন দ্যাখেনি। বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে।

একটা ভালো জায়গা দরকার, যেখানে মোহিনীকে শুইয়ে দেওয়া যায়। কয়েক পা হাঁটল। গঙ্গাচরণ। ভালো করে এপাশ-ওপাশ দেখল। তারপর নজরে পড়ে গেল। বিরাট একটা ঝোঁপড়া গাছের নিচটা বেশ পরিষ্কার, আর আশ্চর্য, গাছের গোড়াটা বেশ শুকনো খটখটে। কাল রাতের বৃষ্টিতেও তলার মাটি ভেজেনি। গঙ্গাচরণ মোহিনীকে দু-হাতে কোলে তুলে নিয়ে গাছটার তলায় শুইয়ে দিল। একদম পাখির মতো হালকা মোহিনী লাল চোখ মেলে শুধু একবার দেখল, কোনও কথা বলল না।

সারাটা দিন গঙ্গাচরণ আচ্ছন্নের মতো মোহিনীর মাথার কাছে বসে রইল। এর মধ্যে দুবার বমি করেছে মোহিনী। কালকের গোগ্রাসে খাওয়া ফলগুলো বেরিয়ে এসেছে। হজম হয়নি একদম। বেলা যত পড়তে শুরু করল গঙ্গাচরণের বুকের মধ্যে তত ভয় জমছিল। একবার ছুটে গিয়ে গাঁয়ে খবর দেবে নাকি? ওগো তোমরা এসো, তোমাদের গাঁয়ের বউ-এর ভারি অসুখ। আর দেখতে। হবে না, শান দেওয়া কাটারিগুলো উড়ে আসবে সঙ্গে-সঙ্গে। কী দরকার, একসঙ্গে জোট বেঁধেছি, একসঙ্গেই থাকব। দুঃখের সুখ দেখবে যে ও। মাথাটা তুলে নিল গঙ্গাচরণ। চোখ বন্ধ মোহিনীর। স্থির হয়ে শুয়ে আছে সেই থেকে। গরম কপালে হাত বোলাতে-বোলাতে গঙ্গাচরণ শুনল মোহিনীর নরম বুকে যেন একশো হাঁপড়ের শব্দ। মোহিনীর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল গঙ্গাচরণ। আহা, ঘুমোক একটু। বড় সুখের মেয়ে আমার। এত কষ্ট সইবে কেন? কত জল ঝড় গেছে শরীরের ওপর দিয়ে। চোখের ওপর আলতো আঙুল রাখল ও। চোখের পাতা খুলতেই টইটুম্বর দিঘি। যখন গাইত গঙ্গাচরণ সেই দিঘিতে সকালের রোদ পড়ত যেন। আহা একটু আড়াল থাক দিঘিটা। একটু নিজের মধ্যে ভরে থাক। আসলে সুখের মেয়েগুলোই বড়। দু:খী হয়। একটু সোহাগ পেলে একটু প্রাণের কথা শুনলে ছটফটিয়ে ওঠে। মোহিনীর শুয়ে থাকা শরীরটার দিকে তাকাল গঙ্গাচরণ। অঙ্গে-অঙ্গে এত রূপ দেখে মনে হয় মরে যাই। বুকের ভিতরটা ভরাট হয়ে যায়। পাঁচ হাতির বল আসে। গুনগুনিয়ে গান গাইল গঙ্গাচরণ–আমার দুঃখ বড় ভালো, সে যে সঙ্গ ছাড়ে না, সে যে বুকের মাঝে উথালপাতাল সঙ্গ ছাড়ে না।

গঙ্গাচরণের কেমন একটা ঘোর লাগছিল। মুখ-চোখ এত ভার কেন? এত ব্যথা কেন? হেসে ফেলল ও, কেমন দেখাচ্ছে এখন নিজেকে? সারারাত ভিজে শরীরে রস জমেছে নাকি? চোখে এত ছায়া পড়ে কেন? চোখে-মুখে হাত বোলালো নিজের। কেমন গরম-গরম। ঠিক মোহিনীর মতন। হ্যাঁগো, আমাকে ঠান্ডা থাকতে দিলে না নাকি! শরীর গরম হলে মন যে অস্থির হয়।

সারাটা দিন একভাবে বসে রইল গঙ্গাচরণ। শরীরে কী একটা অস্বস্তি। মোহিনীর মাথা তার কোলে। চুলগুলো ফুলেফেঁপে একরাজ্যি মেঘ। দুপুরের দিকে মোহিনী একবার তাকিয়েছিল। তারপর আবার চুপচাপ আছে। গঙ্গাচরণের খেয়াল নেই কী করে দিনটা কেটে গেল। মোহিনীর শরীরের তাপ কমছে। বিকেল হয়ে যাওয়ায় জঙ্গলের ওপর নজর বুলিয়ে গঙ্গাচরণ খুশি হল। তার নিজের হাত বেশ গরম। মোহিনীর ঠান্ডা হয়ে আসা শরীরটা ধরে রাখতে কি আরাম লাগছে। এই তো নিয়ম, একজনের শুরু অন্যজনের শেষ। একসঙ্গে দুজনের হলে চলবে কেন?

তারপর রাত এল। জঙ্গলের ওপর বাচ্চা মেয়ের মতো ত্রয়োদশীর চাঁদটা লাফিয়ে উঠে বসল। সমস্ত জঙ্গলে এখন অজস্র শব্দে কান পাতা দায়। আঃ! চোখ কুঁচকে তাকাল গঙ্গাচরণ। এই হতচ্ছাড়া পাখিগুলো এমন চিৎকার করছে যেন ঘর কারোর নেই। নাকি কাল রাত্রে ঝড়ে ওদের ঘর ভেঙেছে। বাহারে বাহা! অত চিল্কারের কি আছে, আবার ঘর বাঁধো। আমার ঘরও নেই, চিৎকারও নেই। তোরা যদি এত চিৎকার করিস, আমার সুখের মেয়ের ঘুম ভেঙে যাবে যে।

নিরিবিলি জ্যোৎস্নায় অন্ধকার আজ তেমন জমজমাট নয়। প্রথম রাতে কি মেঘ ছিল? দ্বিতীয় রাতে ঝড় উঠল। আর আজ দুধ টলটলে জ্যোৎস্না। এখন ভারি ইচ্ছে করে দুজনে হাত ধরাধরি করে জ্যোৎস্নার জঙ্গলে হাঁটি, আমার সুখের মেয়ে গান গাইতে পারে না? আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুনগুন করুক। থাক বাবা, অত সুখে কাজ নেই। ও আর একটু ঘুমিয়ে নিক। আচ্ছা এত শক্ত হয়ে ঘুমিয়ে কেন? এত আড়ষ্ট! কি ভীতু মেয়ে আমার।

কতক্ষণ ঝিম ধরেছিল খেয়াল নেই, কীসের একটা সর সর শব্দে লাল চোখ মেলে তাকাল গঙ্গাচরণ। একদম সামনে প্রায় মোহিনীর পায়ের তলায় যে দাঁড়িয়ে তার চোখ জ্বলছে। শেয়াল নাকি? না, শেয়ালের চেয়ে বড় এটা। চোখের দৃষ্টি কি ধারালো। একটা হাত তুলে চাপা গলায় শব্দ করল গঙ্গাচরণ। কয়েক পা সরে গেল জন্তুটা, তারপর কিছুদূরে গিয়ে মোহিনীর দিকে। তাকাল ও। আঃ পিপড়েগুলো উঠে আসছে কেন আবার? জ্বালাতন! সরিয়ে দিল আলতো করে যাতে মেয়ের ঘুম না ভাঙে। গঙ্গাচরণের বুকের মধ্যে ইচ্ছে করছে প্রাণভর জড়িয়ে ধরতে। বড় হিম ঠান্ডা মেয়ে।

হঠাৎ চমকে উঠল গঙ্গাচরণ। কে যেন হাসছে, সারা বন কাঁপিয়ে হাসিটা ছড়াচ্ছে। সেই জন্তুটা সামনে নেই, কিন্তু দূরে তার চোখ জ্বলছে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে গঙ্গাচরণ। হায়না নাকি।

ভোর হয়ে গেছে কখন, কখন বেলা গড়িয়েছে টের পায়নি, মোহিনীর মুখের ওপর মুখ রেখে ঝিম ধরে পড়েছিল। হঠাৎ ঝিম ভাঙতেই তাড়াতাড়ি উঠে বসল। পেটের ভিতরটা কেমন করছে। ক্ষিদে পেয়েছে নাকি! ওই ফলগুলো আনলে কেমন হয়। গাছটা তো বেশি দূরে নয়। সুখের মেয়ে এখনও ঘুমোচ্ছে যে। উঠলেই খেতে চাইবে তো। শীত করছে বোধহয়, তাই শরীর এত ঠান্ডা। পেটে কিছু পড়লে গরম হবে। আলতো করে মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে রাখল সে। তারপর উঠে দাঁড়াল। একবারে পারল না, শরীর টলছে, পায়ে জোর নেই, হাঁটু দুটো বড় আলগা মনে। হয়। একা রেখে যাব? মোহিনীর দিকে তাকাল গঙ্গাচরণ। যদি ঘুম ভেঙে যায় তাহলে দেখবে সে নেই। কী হবে! গঙ্গাচরণ ভাবল খুব দ্রুত ফিরে আসবে। খাবার দরকার। ও টলতে-টলতে হাঁটতে লাগল। আহা শরীরটা এমন করে কেন? এমন অবাধ্য?

বেশ কিছুটা দূরে গিয়েও গাছটাকে খুঁজে পেল না গঙ্গাচরণ। হঠাৎ ও কান খাড়া করে দাঁড়াল। মানুষজনের গলা না? হ্যাঁ, তাই তো। চেঁচাচে-চেঁচাতে আসছে। ওদের খুঁজতে নাকি? গঙ্গাচরণ হঠাৎই কোমর উঁচু বুনো ঘাসের মধ্যে বসে পড়ল। মোহিনী এখন কী করছে? ওর কি ঘুম ভেঙে গেছে? যদি ওকে লোকজন পেয়ে যায়? না পাবে না, যা ঝাঁপড়া গাছটা। কিছুতেই মোহিনীকে খুঁজে পাবে না। মানুষগুলোর গলা ক্রমশ স্পষ্ট হল। কাউকেই চিনতে পারছিল না গঙ্গাচরণ। ওরা কি খুব রেগে আছে? মানুষ এত অল্পে রাগে কেন?

অনেকক্ষণ ওই ঘাসের বনে পড়েছিল গঙ্গাচরণ। ঘোর কাটতেই উঠে দাঁড়াল হুড়মুড় করে। না, কারোর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। লোকগুলো তাহলে চলে গেছে? বাঃ! টলতে-টলতে আবার ফিরে। এল গঙ্গাচরণ। ফল আনা হয়নি। ইস! আবার যেতে ইচ্ছে করছিল না। শরীর এত টানছে কেন?

ঝাঁপড়া গাছটার তলায় এসে অবাক হল সে। মোহিনী নেই! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল চারধার, কোথাও মোহিনী নেই। যা, মেয়ের ঘুম তাহলে ভেঙে গেছে এরই মধ্যে। কোথায় গেল? নিশ্চয় খুঁজছে। এখন তাকে। মেয়ে যা ভীতু। খুব রাগ হল নিজের ওপর গঙ্গাচরণের। কেন এতক্ষণ দেরি করল সে? ও একবার চেঁচিয়ে ডাকবার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা থেকে স্বর বেরুতে চাইছে না ভালো। করে। বুকের মধ্যে একটা কান্না এসে গেল হঠাৎ। মোহিনী কোথায় গেল? টলতে-টলতে খুঁজতে বেরুল গঙ্গাচরণ। ঘন জঙ্গলের এপাশে-ওপাশে কোথাও মোহিনী নেই। তবে কি সেই ফলগাছটার কাছে গেছে? না, সেখানেও নেই। খোঁজার টানে-টানে ফিরে-ফিরে যাচ্ছিল গঙ্গাচরণ গাঁয়ের দিকে। এই তো আর একটু পেরোলেই গাঁ। মাথার ওপর শকুন ওড়ে কেন? চোখ আড়াল করে আকাশ দেখল সে। রোদ নেই এখন। বিকেলের ছায়া বেশ ঘন।

আচ্ছা, মোহিনী কি আবার গাঁয়ে ফিরে গেছে? যা, তা কি হয়? সুখের মুখ দেখেছে মেয়ে, এবার দুঃখের মুখ দেখবে যে! তাই তো বুকের ভিতরটা এত ভরাট লাগে ও মেয়েকে দেখলে। না, ও ফিরতেই পারে না।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা সরু পথ। কিন্তু সমানতালে পা পড়ছে না গঙ্গাচরণের। পা দুটো যেন নিজের নয়, দুধের শিশুর মতো হাঁটছে যেন। হাসতে গিয়ে গঙ্গাচরণ মুখে হাত দিল। খোঁচা খোঁচা দাড়ির গোড়ায় যে যজ্ঞিবাড়ির উনুন জ্বলছে। মাথার চুলে ভাতের ফ্যানের আঠা। আঃ, একটু শুলে কেমন হয়, হাত পা ছড়িয়ে? মোহিনী কোথায় গেল? ও এলে ওর কোলে মাথা রেখে শুলে শরীর শীতল হবে। গঙ্গাচরণ চোখ তুলে তাকাল। না, মোহিনী নেই কেন? আকাশ দেখল সে! আরে বাবা, আকাশটা নাগরদোলার মতো ঘোরে কেন?

জঙ্গলের কিনারে আসতে আসতে রাত ঘন হয়ে গেল। দুধের সরের মতো জ্যোৎস্না জঙ্গলের গায়ে মাখানো। সবকিছু সাফসুফ দেখছিল গঙ্গাচরণ। পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে সমানে। গঙ্গাচরণ নিজেকে উৎসাহ দিচ্ছিল, এত দুর্বল কেন হে তুমি, মোহিনীর কথা একটু ভাব দেখি যে তোমাকে খুঁজে-খুঁজে হয়রান হয়ে গেল!

জঙ্গল সরিয়ে গাঁয়ের দিকে পা বাড়াতেই থমকে দাঁড়াল গঙ্গাচরণ। আরে ওটা কী? কাঠকাটাদের গাঁ আর জঙ্গলের ওপাশে যে ঝরনা তার গায়ে বসে দলবেঁধে ওরা করে কী? আগুন জ্বলছে যেন? আগুনটাকে ঘিরে বসেছেনাকি সবাই? যাচ্চলে! এই গরমকালে কেউ আগুন পোয়ায়? লোকগুলোর মুখ ঠিক বুঝতে পারছিল না সে। আর একটু এগিয়ে গেল। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। ওই তো কামাখ্যা বসে, হাতে কাটারি আছে নাকি! অন্ধকারে লুকিয়ে দেখতে লাগল গঙ্গাচরণ। না, ওদের মধ্যে মোহিনী নেই। তাহলে গাঁয়েও নেই। গাঁয়ে থাকলে কামাখ্যা এখানে বসে থাকত না। আচ্ছা, কামাখ্যার মুখটা যেন কেমন। অত গম্ভীর কেন? বড় দু:খী-দু:খী মনে। হয়!

বেশ খানিক বাদে ওরা ফিরে গেল গাঁয়ে। গঙ্গাচরণ দেখল আগুনটা নিভে এসেছে, কিন্তু সম্পূর্ণ নেভেনি। আরে আগুন না নিভিয়ে ওরা চলে গেল কেন? কেউ নেই কাছাকাছি। গঙ্গাচরণ পায়ে পায়ে এগোল। একদম কাছাকাছি আসতেই একটা কটু গন্ধ নাকে এল ওর। প্রায় নিভে আসা। আধপোড়া কয়েকটা কাঠের চারপাশে ঘুরল ও। ধুস শালা। এই লোকগুলো করলটা কী? জড়ো হয়ে আগুন জ্বালালো, আগুনটাকে পুড়তে দেখল, তারপর ভালো করে না নিভিয়ে ফিরে গেল। মানুষ বড় তাজ্জব জীব!

তারপর হঠাৎই ওর মনে পড়ে গেল মোহিনী তো এতক্ষণে সেই গাছতলায় ফিরে আসতে পারে। এসে দু-চোখ ভরে কাঁদতে পারে। তা ছাড়া তার তো আর কোথাও যাওয়ার নেই। বুকের ভিতরে একটা ছটফটানি শুরু হল গঙ্গাচরণের। ও টলতে টলতে হাঁটতে লাগল জঙ্গলের দিকে। মোহিনীকে একটা মজার গল্প বলতে হবে। লোকগুলো এল, আগুন জ্বালালো, চলে গেল। মানুষ যে কী করে, কোনও মানে হয় না মানুষের।

গঙ্গাচরণ হোঁচট খেতে-খেতে হাঁটছিল আর ওর প্রিয় গানটা গুন-গুন করছিল মনের মধ্যে–আমার দুখ বড় ভালো…।

হঠাৎ তার খেয়াল হল মোহিনীকে বলতে হবে, কামাখ্যাকে দেখে এলাম। মনটা খুব নরম নিশ্চয়, নইলে অমন দু:খু-দুখু মুখ করে কেউ বসে থাকতে পারে?

গঙ্গাচরণ আর হাঁটতে পারছিল না। দু-চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ওর। আর আশ্চর্য কাণ্ড, গঙ্গাচরণ। দেখল ওর চোখের দুই পাতায় মোহিনীর হাসি-হাসি মুখ, ওর বুকের মধ্যে মোহিনী হেঁটে যাচ্ছে।

চোরের মতন দুঃখ ভুলে সুখের আশায় নিজের বুক জড়িয়ে ধরল গঙ্গাচরণ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *