আনিস বলল, বড়ােচাচা, আপনার সানাই শুনে আজ জেগেছি।
সানাইয়ের কথায় বড়ােচাচার মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি যেমন হবে ভেবেছিলেন, তেমনি হয় নি। তিনি চেয়েছিলেন বিয়ের এই আনন্দ–উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে একটি সকরুণ সুর কাঁদতে থাকুক। সবাইকে মনে করিয়ে দিক এ–বাড়ির সবচেয়ে আদরের একটি মেয়ে আজ চলে যাচ্ছে। আর কখনাে সে জ্যেৎরাতে ছাদে দাপাদাপি করে ভুল সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে না।
কিন্তু তিনি যেমন চেয়েছিলেন, তেমনি হল না। অল্প বেলা বাড়তেই তুমুল হৈচৈ–এ সানাইয়ের সুর ডুবে গেল। তিনি মনমরা হয়ে রেডিওগ্রাম বন্ধ করে দিলেন।
বড়চাচা হাত ধুয়ে এসে বসলেন আনিসের বিছানায়। আচমকা প্রশ্ন করলেন, ‘তাের কি খুব খরাপ লাগছে আনিস?
‘কই? না তাে!’
আমেরিকা থেকে ফিরে এসে একটা সাদাসিধা ভালাে মেয়ে বিয়ে করিস
তুই।
আনিস হেসে ফেলল। বড়ােচাচা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘হাসির কী হল? হাসছিস কেন?
‘আমি আর বাঁচব না। দিস ইজ এ লস্ট গেম।
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
বড়চাচা কথা বললেন না। আনিসের সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু বড়ােচাচা না যাওয়া পর্যন্ত সেটি সম্ভব নয়। সে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন তিনি ওঠেন, কিন্তু তিনি উঠলেন না। আনিসের সিগারেট–পিপাসা আরাে বাড়িয়ে দিয়ে একটি চুরুট লেন। আনিসের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, কোনাে কারণে আমার ওপর তাের কি কোনাে রাগ আছে?”
‘কী যে বলেন চাচা! রাগ থাকবে কেন? | ‘না, সত্যি করে বল।
কী মুশকিল, আমি রাগ করব কেন? কী হয়েছে আপনার বলুন তাে। ‘আমার কিছু হয় নি।
বড়ােচাচা হঠাৎ ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। কাল রাত থেকে তার মনে হচ্ছিল, আনিসের মনে তাঁর প্রতি কিছু অভিমান জমা আছে। আনিস যদিও এখন হাসছে, তবু সেই হাসিমুখ দেখে তাঁর কষ্ট হতে থাকল। তিনি নিজের মনে খানিকক্ষণ বিড়বিড় করলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যাই আনিস’ বলে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
বড়ােচাচা হচ্ছেন সেই ধরনের মানুষ, যাঁরা সামান্য ব্যাপারে অভিভুত হন না। আজ আনিসকে দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি চাইছিলেন কিছু একটা করেন, কিন্তু কী করবেন তা তার জানা নেই। আনিসের জন্যে তাঁর একটি গাঢ় দূর্বলতা আছে। নিজের দুর্বলতাকে তিনি কোনাে কালেই প্রকাশ করতে পারেন না। প্রকাশ করবার খুব একটা ইচ্ছা তাঁর কোনাে কালে ছিল না। কিন্তু আজ তাঁর মন কাঁদতে লাগল। ইচ্ছে হল এমন কিছু করেন যাতে আনিস বুঝতে পারে এই গৃহে তার জন্যে একটি কোমল স্থান আছে। কিন্তু আনিস বড় অভিমানী হয়ে জনেছে। তার জনাে কিছু করা সেই কারণেই হয়ে ওঠে না।
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
খুব ছােটবেলায় আনিসের যখন এগার–বার বৎসর বয়স, তখনই বড়ােচাচা আনিসের তীব্র অভিমানের খোঁজ পান। বড়াে হয়েছে বলে আনিস তখন আলাদা ঘরে ঘুমায়। তার ঘরটি একতলায়। পাশের ঘরে আনিস, জৱী ও পরীদের মাষ্টার সাহেব থাকেন। এক রাত্রিতে খুব ঝড়–বৃষ্টি হচ্ছে। বড়ােচাচা আনিসের ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনলেন আনিস কাঁদছে। তিনি ঢাকলেন, ‘আনিস, কী হয়েছে রে?
আনিস ফুপিয়ে বলল, ‘ভয় পাচ্ছি। ‘আয় আমার ঘরে। আমার এঙ্গে থাকবি?’ ‘মা।
তাহলে আমি সঙ্গে শুই?
দরজা খােল তুই। আনিস দরজা খুলল না। তিনি অনেকক্ষণ বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।
বড়ােচাচার মনে হল জরীর বিয়ের এই দিনটি আনিসের জন্যে খুব একটা দুঃখের দিন। কিন্তু তাঁর কিছুই করবার নেই। | যে–ছেলেটির সঙ্গে জরীর বিয়ে হচ্ছে, তার খোঁজ বড়চাচাই এনেছিলেন। ত’র আবাল্যের বন্ধু আশরাফ আহমেদের বড়াে ছেলে। নম্র ও বিনয়ী। লাজক ও হৃদয়বান। দেখতে আনিসের মতাে সুপুরুষ নয়। রােগা ও কালাে। জরীর বাবা আপত্তি করেছিলেন। বারবার বলেছেন, ‘ছেলের ধরনধারণ যেন কেমন। জরীর মার ঠিক মত নেই। মিনমিন করে বলেছেন, ‘ইউনিভার্সিটির মাষ্টার, কয় পয়সা আর বেতন পায়? কিন্তু বড়ােচাচার প্রবল মতের বিরুদ্ধে কোনাে আপত্তিই টিকল না।