আর বৌ হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ে চলে গেলেন। কী পরিষ্কার পানি, আয়নার মতাে ঝকঝক করছে। পুকুরপাড়ের ঘাটটি বাঁধান। তাঁর সময় বাঁধান ছিল না। সে–সময় কাঠের তক্তা দিয়ে ঘাট বাঁধা ছিল। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে থাকত সে–ঘাট। পা টিপে টিপে পানিতে নামতে হত। এক বার তাে পিছলে পড়ে হাত কেটে গেল অনেকখানি।
রত্ত বন্ধ হয় না কিছুতেই, শাড়ি দিয়ে হাত চেপে ধরে ঘরে উঠে এসেছেন। সারা শাড়ি রক্তে লাল। দেখতে পেয়ে আনিসের বাবা সঙ্গে সঙ্গে ফিট।
এমন জোয়ান মানুষ, অথচ একটু-আধটু রক্ত দেখলেই হয়েছে ? শো ছােট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন।
তাঁর ক্ষণিকের জন্য মনে হল এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তিনি ভুল করেছে। এখানে থাকলে জীবন এমন কিছু মন্দ কাটত না। পরমুহূর্তেই এ–চিন্তা ছোট ফেললেন। পুরনাে জায়গায় ফিরে আসবার জন্যই এ–রকম লাগছে হয়তাে। তিনি আসলে মােটেই অসুখী নন। তাঁর স্বামী ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে কোনাে গােপন দুঃখ নেই। নিজের চারদিকে নতুন জীবনের সৃষ্টি করেছেন। সেখানে দুঃখ, হতাশা ও গ্রার্নির সঙ্গে সঙ্গে ভালােবাসাও আছে। শুধু যদি আনিস তাঁর সঙ্গে থাকত। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হেসেখেলে বড়াে হত।
কিন্তু এ–বাড়ির সবাই অহংকারী ও নিষ্ঠুর। আনিসকে তারা কিছুতেই ছাড়ল না। অবিমিশ্র সুখী কখনাে বােধহয় হতে নেই।
‘আতর বৌ এসেছ?
আতর বৌ চমকে দেখলেন-–বড়াে ভাসুর, নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘তুমি বড়াে রােগা হয়ে গেছ আতর বৌ।
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
তাঁর মুখে পুরনাে দিনের ডাক শুনে আতর বৌ–এর চোখে পানি এল। বড়াে ভাসুর বললেন, ‘তােমার ছেলেমেয়েরা সবাই ভালাে?
‘জি, ভালাে।
তাদের নিয়ে আসলে না কেন, দেখত তাদের আনিস ভাইকে। ‘আপনি তাে চিঠিতে তাদের আনবার কথা লেখেন নি। আতর বৌ আঁচলে চোখ মুছলেন। বড়াে ভাসুর বললেন, ‘কাঁদছ কেন? ‘না, কাদছি না।’ ‘আনিসের সঙ্গে দেখা হয়েছে তােমার?
না।
‘তাহলে তার পাশে গিয়ে একটু বস। তার গায়ে–মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। আজ আনিসের বড়াে দুঃখের দিন।
আর বৌ বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? আজ দুঃখের দিন কেন?’
বড়াে ভাসুর চুপ করে রইলেন। অনেক দিন পর আতর বৌকে দেখে তাঁর বড়াে ভালাে লাগছে। তিনি হঠাৎ কী মনে করে বললেন, ‘আতর বৌ, আনিসের বাবাকে কননা স্বপ্নে দেখ?
আতর বৌ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, দেখি। ‘তুমি কিছু মনে করলে না তাে? ‘না, কিছু মনে করি নি। স্বপ্নের কথা কেন জিজ্ঞেস করলেন? ‘এমি করেছি। কোনাে কারণ নেই।
আনিস লােকটিকে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। আগে আরাে দু–এক বার দেখা হয়েছে। আজ যদিও অনেক দিন পরে দেখা, তবু চিনতে একটুও দেরি হল না। লােকটি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। আনিসকে তাকাতে দেখে মৃদু গলায় বলল, ‘ভেতরে আসব?
‘আসুন।
লােকটি ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল। মাথার চুল পেকে গেছে। কপালের চামড়া কোঁচকান। চোখ দু’টি ভাসা–ভাসা। সমস্ত মুখাবয়বে একটা ভালােমানুষী আত্মভোলা ভঙ্গি আছে।
আমি একটু বসলে তােমার অসুবিধে হবে? বসুন বসুন। অসুবিধে হবে কেন?” ‘আমাকে চিনতে পেরেছ তাে বাবা? । ‘আমি তােমার মাকে নিয়ে এসেছি।’
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
আনিস চুপ করে রইল। লােকটির বসবার ধরন কেমন অদ্ভুত। পা তুলে পদ্মাসন হয়ে চেয়ারে বসেছেন। সারাক্ষণই হাসছেন আপন মনে। আনিস কী কথা বলবে ভেবে পেল না। দু জল লােক চুপচাপ কতক্ষণ বসে থাকতে পারে? একসময় আনিস বলল, আপনার ছেলেমেয়ে কয়টি?
‘দুই মেয়ে এক ছেলে। বড়াে মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, কেমিস্ট্রিতে অনার্স, এইবার সেকেন্ড ইয়ার।
ছেলেমেয়েদের কথা বলতে পেরে ভদ্রলােকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বুকে এলেন আনিসের দিকে। গাঢ় স্বরে বলতে লাগলেন, বড়াে মেয়ের নাম নীলা, তােমার মা রেখেছেন। ছােট মেয়ের নাম আমি রেখেছি ইলা। ছেলেটির নাম শাহীন। | ভদ্রলােক মহা উৎসাহে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন। তেমনি অন্তরঙ্গ সুরে বলতে লাগলেন, গত ঈদের সময় নীলা তােমাকে একটা ঈদকার্ড পাঠিয়েছিল। নিজেই এঁকেছে, নদীতে সূর্যাস্ত হচ্ছে। দুটি বক উড়ে যাচ্ছে। তুমি পাও নি বাবা?
পেয়েছিলাম।