নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব-১৮)

‘নীলা ভেবেছিল, তুমিও তাকে একটা পাঠাবে। সে রােজ জিজ্ঞেস করতবাবা, তােমার ঠিকানায় আমার কোনাে ঈদকার্ড এসেছে? 

আনিস লজ্জা পেল খুব। লজ্জা ঢাকবার জন্য জিজ্ঞেস করল, “ইলা কত বড়াে হয়েছে?’ 

ক্লাস নাইনে পড়ে। বৃত্তি পেয়েছে ননরেসিডেনশিয়াল।

নির্বাসনদেখতে কেমন হয়েছে? ‘আমার কাছে খুব ভালাে লাগে। তবে শ্যামলা রং। নাকটা একটু চাপা। স্কুলের মেয়েরা তাকে চায়না ডেকে ক্ষেপায়। 

আনিস হােহাে করে হেসে ফেলল। নীলা ও ইলার সঙ্গে দেখা হলে খু• ভালাে হত। আনিস মনে মনে ভাবল, ইলার সঙ্গে যদি কখনাে দেখা হয় তাহলে সে বলবে— 

ইলা হল চায়না 

ব্যাঙ ছাড়া খায় না। ভদ্রলােক বললেন, তােমার ভাইবােনগুলির খুব শখ ছিল তুমি কিছুদিন তাদের সঙ্গে থাক। এক বার তােমার মা খুব করে লিখেছিল, ঠিক না?’ 

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ

আনিস লজ্জিত হয়ে মাথা নাড়ল। তার মা সেবার শুধু চিঠিই লেখেন নি, এক শ’টি টাকাও পাঠিয়েছিলেন। সে টাকা ফেরত পাঠান হয়েছিল । 

ভদ্রলােক উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ইলা আবার কবিতা লেখে। স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে তার কবিতা“রুগণ হওয়ার রহস্য” কবিতার নাম। ভীষণ হাসির কবিতা। দাঁড়াও তােমাকে শােনাই। আমার মনে আছে কবিতাটি | 

ভদ্রলা চেয়ার থেকে পা নামিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলেন— 

‘কয়েক হাঁড়ি পাটালী গুড় সঙ্গে কিছু মিষ্টি দই, সেৱেক খানি চিড়ে ছাড়াও 

লাগবে তাতে ভাল খইকি, সবটা বলব? আনিস সেকথার জবাব দিল না, ঘােলাটে চোখে তাকাল। তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে। ভদ্রলােক উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘কী হয়েছে বাবা? তুমি খুব ঘামছ| সেকথাটি আবার শুরু হয়েছে। পা দুটো কেউ যেন জ্বলন্ত আগুনে ঠেসে ধরল। আনিস গােঙাতে শুরু করল। ভদ্রলােক ব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মৃদু স্বরে ডাকলেন, ‘ও বাবা শােন, ও আনিস।‘ 

আনিস বিকৃত স্বরে বলল, আপনি এখন যান। একা থাকতে দিন আমাকে। 

ভদ্রলােক নড়লেন না। একটা হাতপাখা নিয়ে সজোরে বাতাস করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে বলতে লাগলেন, ‘পানি খাবে বাবা? মাথায় হাত বুলিয়ে 

দেব? 

আনিস কথা বলতে পারছিল না। ভদ্রলােক অসহায় গলা বললেন, কেউ কি এক জন ডাক্তার ডেকে আনবে, আহা বড় মায়া লাগে।’ 

আনিসের মা ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি সেখান থেকে দেখলেন, আনিস চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছে আর ইলানীলার বাবা প্রবল বেগে হাওয়া করছেন। আনিসের মা ঘরের ভেতর ঢুকলেন না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বাইরে। শুনলেন ইলার বাবা মৃদুস্বরে বলছেন, ইয়া রহমান, ইয়া রহিমু, ইয়া মালিক 

তখন নিচে তুমুল হৈচৈএর সঙ্গে বর এসেছে বর এসেছে শােনা গেল, আর বৌ নিচে নামলেন। তাঁকে এক জন ডাক্তার খুজতে হবে। আনিসের জন্য একজন ডাক্তার প্রয়ােজন।

একটি লাজুক, ভদ্র ও বিনয়ী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল জরীর। মুসলমানদের বিয়ে বড় বেশি সাদাসিধা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই উৎসবের সমাপ্তি। যেছেলেটির সঙ্গে কোনাে জন্মেও জরীর পরিচয় ছিল না, তার সঙ্গে পরম পরিচয়ের অনুষ্ঠানটি এত ক্ষুদ্র হতে দেখে ভালাে লাগে না। মন খারাপ হয়ে যায়মনে হয় কীযেন একটা বাকি থেকে গেল। | জরীর দিকে চোখ তুলে তাকান যায় না। শ্যামলা রংয়ের এই মেয়েটি এত রূপ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল! দেখে দেখে বুকের ভেতরে আশ্চর্য এক ব্যাথার অনুভূতি হয়। ভয় হয়, সেই লাজুক, ভদ্র ও বিনয়ী ছেলেটি কি এই রূপের ঠিক মূল্য দেবে? হয়তাে দেবে, কারণ ছেলেটি কবি, মাঝে মাঝে গল্পও লেখে। হয়তাে দেবে না, না চাইতে যা পাওয়া যায় তার তাে কোনাে কালেই কোনাে মূল্য নেই। 

জৱী বসে আছে সম্রাজ্ঞীর মতাে। তার যেবন্ধুরা এতক্ষণ ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিল, তারা এখন খানিকটা দুরে সরে বসেছে। বিয়ের পরপরই অবিবাহিত মেয়েদের থেকে বিবাহিতরা আলাদা হয়ে পড়ে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *