আভা জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগছে জরী? | জরী হাসল। কনক বলল, আমার এখনাে বিশেস হচ্ছে না, তাের বিয়ে হয়ে গেছে।
জরীর মা ক্লান্ত ও অশ ভঙ্গিতে পাশেই বসে। বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকেই তিনি অবিশ্রান্ত কাঁদছেন। জরী অনেকটা সহজ হয়েছে, হালকা দু’–একটা কথাও বলছে।
বরের ছােট বােন জুরীকে নিয়ে কী–একটা রসিকতা করায় সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে জরীও হেসেছে। একসময় সে বলল, “মা, বড়ােচাচা কোথায়?
‘আনিসের ঘরে, আনিসের অসুখটা খুব বেড়েছে। ডাকব তাের চাচাকে?
না। আনিস ভাইয়ের মার সঙ্গে একটু আলাপ করব।’
আতর বৌ ছেলের কাছে ছিলেন না। বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। জরী ডাকছে শুনে ঘরে এলেন। জরী বলল, ‘ভালাে আছেন চাচী?
‘হা মা।
জরী হঠাৎ তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করল। আতর বৌ বললেন, ‘স্বামী ভাগ্যে ভাগ্যবতী হও, লক্ষ্মী মা।
বরের ছােট বােনটি আবার কী—একটা হাসির কথা বলে সবাইকে হাসিয়ে দিল। আতর বৌ বললেন, ‘এই ছােট্টটি দেখেছি জরীকে। কি দুষ্টুই না ছিল। এখন
কেমন ৰী সেজে বসে আছে। অবাক লাগে!
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
অনেকেই এসে জড়াে হয়েছে আনিসের ঘরে। বড়ােচাচা, হােসেন সাহেব, আনিসে মা, ইলা–নীলার বাবা, আনিসকে যে ডাক্তারটি চিকিৎসা করেন তিনি, এবং শী। সবাই চুপ করে আছে। ব্যথায় আনিসের ঠোট নীল হয়ে উঠেছে, তার চোখ টকটকে লাল। সে একসময় বিকৃত স্বরে বলল, ‘দুলাভাই, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। পেথিড্রিন দেন।
হােসেন সাহেব আরাে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। বুড়ােচাচা বললেন, ‘হােসেন তুমি পেথিড্রিন দাও।’
হােসেন সাহেব সিরিঞ্জ পরিষ্কার করতে লাগলেন। আনিসের মা থরথর করে কাঁপছিলেন। এক ফাঁকে হােসেন সাহেব তাঁকে বললেন, ‘আপনি ভয় পাবেন না, এক্ষুণি ঘুমিয়ে যাবে।’
আনিসের মা বিড়বিড় করে কী বললেন, ভালাে শােনা গেল না। ইনজেকশনের পরপরই আনিস পানি খেতে চাইল। রাত কত হয়েছে জানতে চাইল। হােসেন সাহেব বললেন, ‘ঘুম পাচ্ছে আনিস?
‘হ্যা।
আনিসের মা বললেন, ‘এখন আরাম লাগছে বাবা? ‘লাগছে।‘
আনিসের মা দোওয়া পড়ে ফু দিলেন ছেলের মাথায়। আনিস জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘বাতি নিভিয়ে দাও, চোখে লাগে।’
বাতি নিভিয়ে তারা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ
নিচে জরীর বিদায়ের আয়ােজন চলছে। রাত হয়েছে দশটা। বরযাত্রীরা আর এক মিনিটও দেরি করতে চায় না। কিন্তু ক্রমাগতই দেরি হচ্ছে। কনে–বিদায় উপলক্ষে খুব কান্নাকাটি হচ্ছে। জরীর মা দু বার ফিট হয়েছেন। জরীকে ধরে রেখেছেন।
বর–কনেকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে ছবি তােলা হবে। জরী শেষ বারের মতাে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে—তার ছবি। ভাড়া–করা ফটোগ্রাফার ক্যামেরা স্ট্যাণ্ডে লাগিয়ে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে। বর এসে দাঁড়িয়ে আছে কখন থেকে।
কনের
দখা নেই। জরীকে বার বার ডাকা হচ্ছে। | ঘৱেৱ সব ঝামেলা চুকিয়ে জুরী যখন বারান্দায় ছবি তােলবার জন্যে রওয়ানা হয়েছে, তখনি হােসেন সাহেব বললেন, ‘জরী, আনিসের সঙ্গে দেখা করে যাও। তার সঙ্গে আর দেখা নাও হতে পারে।’ | জরী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। হােসেন সাহেব বরকে বললেন, ‘তুমি আর দু’ মিনিট অপেক্ষা কর। এ বাড়ির একটি ছেলে খুবই অসুস্থ, জরী তার সাথে দেখা
করে যাক!
‘যদি বলেন, তবে আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে। ‘না, তােমার কষ্ট করতে হবে না। তুমি একটু অপেক্ষা কর। এস জরী।
জরীর সঙ্গে অনেকেই উঠে আসতে চাইছিল। কিন্তু হােসেন সাহেব বারণ করলেন, ‘দলবল নিয়ে রােগীর ঘরে গিয়ে কাজ নেই।
আনিসের ঘর অন্ধকার বাইরে বিয়েবাড়ির ঝলমলে আলাে। সে–আলােয় আনিসের ঘরের ভেতরটা আবছা আলােকিত জরী ভেতরে এসে দাঁড়াল। হালকা একটি সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। জুরী কী সেন্ট মেখেছে কে জানে! সে খানিকক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থেকে মৃদু স্বরে ডাকল, ‘আনিস ভাই, আলিস ভাই।