নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ শেষ পর্ব

কেউ সাড়া দিল না। হােসেন সাহেব বললেন, ‘বাতি জ্বালাব, জরী? 

না, না দুলাভাই।। 

জরী নিচু হয়ে আনিসের কপাল স্পর্শ করল। ভালােবাসার কোমল স্পর্শ, যার জন্যে একটি পুরুষ আজীবন ভূষিত হয়ে থাকে।

নির্বাসনহােসেন সাহেব বললেন, ‘ছিঃ জরী, কাঁদে না। এস আমরা যাই। 

ঘরের বাইরে বড়াচাচা দাড়িয়ে ছিলেন। জরী তাকে জড়িয়ে ধরল। তিনি বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে মা। ফি আমানুল্লাহ্, ফি আমানুল্লাহ্। 

নিচে তুমুল হৈচৈ হচ্ছিল। জরী নামতেই তাকে বরের পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। ক্যামেরাম্যান বলল, একটু হাসুন। 

সবই বলল ‘হাস জরী, হাস, ছবি উঠবে। জরীর চোখে জল টলমল করছে, কিন্তু সে হাসল। 

আনিসের ঘুম যখন ভাঙল, তখন কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, ঠিক বুঝতে পারছে না। জরী কি চলে গিয়েছে নাকি? উঠোনে সারি সারি আলাে জ্বলছে। 

 গেটের বাতিগুলি জ্বলছে নিভছে। তার বিছানার খানিকটা অংশ বারালার বাতিতে আলােকিত হয়ে রয়েছে।। 

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ

আনিস ঘাড় উঁচু করে জানালা দিয়ে তাকাল। না, বরের গাড়ি এখনাে যায় নি। জরী এখনাে এই বাড়িতেই আছে! যাবার আগে দেখা করতে এখানে আসবে নিশ্চয়ই। আনিস তখন কী বলবে ভেবে পেল না। খুব গুছিয়ে কিছু একটা বলা উচিত, যাতে জরীর মনের সব গ্লানি কেটে যায়। কিন্তু আনিস কোনাে কথাই গুছিয়ে বলতে পারে না। | জরীকে বিয়ের সাজে কেমন দেখাচ্ছে কে জানে? আনিস হয়তো দেখে চিনতেই পারবে না। জরী কি হুট করে তাকে সালাম করে বসবে নাকি? এই একটি বিশ্রী অভ্যো আছে তার। ঈদের দিন কথা নেই, বার্তা নেই, সেজেগুজে এসে 

টুপ করে এক সালাম। কিছু বললে বলবেসিনিওরিটির একটা  তারপরই খিলখিল হাসি।। 

আনিস অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাখে। বরযাত্রীরা তৈরি হয়েছে বিদায় নিতে। সবাই জরীকে ধরাধরি করে উঠোনে নিয়ে এল। রাজ্যের লােক সেখানে এসে ভিড় করেছে। যাবার আগে সবাই একই কথা বলবে। দু’একটি কী আচারঅনুষ্ঠানও আছে। 

আনিস জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। বরের সাজান গাড়ি ব্যাক করে আরাে পিছনে আনা হচ্ছে। গাড়িতে উঠতে যেন কনেকে হাঁটতে না হয়। উপর থেকে জুরীর ঝলমলে লাল শাড়ির খানিকটা চোখে পড়ে। খুব আগ্রহ নিয়ে আনিস সেদিকে তাকিয়ে রইল। যাবার আগে জরী নিশ্চয়ই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাবে। 

আনিস, আনিস।’ কে? ‘আমি টিংকুমণি। আমি এসেছি। ‘এস এস। 

তােমার ব্যথা কমেছ?” ‘কমেছে।’ ‘আচ্ছা। 

সারা দিনের ক্লান্তিতে মেয়েটির মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চুল এলােমেলে। আজ কেউ তার দিকে নজর দেবার সময় পায় নি। আনিস তাকে বুকের কাছে টেনে নিল। জানালার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ঐ দেখ টিংকু। জরী চলে যাচ্ছে। 

নির্বাসন-হুমায়ূন আহমেদ

টিংকু সেকথায় কান দিল না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি ব্যথা পেয়েছি, হাত ভেঙে গেছে।’ 

‘আহা আহা! একটু হাতিহাতি খেলবে টিংকু? ‘না, আমার ঘুম পাচ্ছে। 

ছােট ছােট হাতে আনিসের গলা জড়িয়ে ধরে টিংকু কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। 

ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। বাড়ির আলােগুলি নিভে যেতে লাগল। বাগানের গােলাপ আর হাসুহেনাঝাড় থেকে ভেসে এল ফুলের সৌরভ। অনেক দূরে একটি নিশিপাওয়া কুকুর কাঁদতে লাগল। | তারও অনেক পরে আকাশে একফালি চাঁদ উঠল। তার আলাে এসে পড়ল নিদিত শিশুটির মখে। জ্যোৎস্নালােকিত একটি শিশুর কোমল মখ, তার চারপাশে  বিপুল অন্ধকার। গভীর বিষাদে আনিসের চোখে জল এল। যেজীবন দোয়েলের, ফড়িংয়েরমানুষের সাথে তার কোনাে কালেই দেখা হয় না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *