‘আমার ক্ষিধে নেই পুষ্প।
আপনি কি রাগ করেছেন? ‘রাগ করি নি। কি নিয়ে রাগ করব আমি?”
‘বাবু ভাই বলছিল, আপনি নাকি তাকে খুব বকা দিয়েছেন। সে আপনার রাগ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। তার ধারণা ছিল আপনি ফেরেশতার মত মানুষ।
‘তােমার কি ধারণা ? ‘আপনি খাওয়া শুরু করুন তারপর বলব।
শওকত সাহেব খেতে বসলেন। পুষ্প ঠিক তার সামনে বসেছে। তার মুখ হাসি হাসি। যেন কোন একটা ব্যাপারে সে খুব মজা পাচ্ছে।
শওকত সাহেব বললেন, খাওয়া শুরু করেছি এখন বল আমার সম্পর্কে তােমার কি ধারণা ?
‘আজ বলবনা। আপনি যেদিন চলে যাবেন সেদিন বলব। তাছাড়া আমার
মনে হয় আপনাকে বলার দরকার নেই। আমার মনে কি আছে তা আপনি ভালই জানেন।
পুষ্প এত নিশ্চিন্ত হয়ে কথাগুলি বলল যে তিনি চমকে উঠলেন। সেই চমক পুষ্পের চোখ এড়াল না।
‘বাবু ছেলেটিকে তােমার কি খুব পছন্দ? ‘হা পছন্দ। ‘কতটুক পছন্দ? ‘আপনি যতটুক ভাবছেন তার চেয়ে অনেক কম। ‘কেন পছন্দ বলতাে?”
‘ওর মধ্যে কোন ভান নেই। লুকোছাপা নেই। যা তার মনে আসে সে তাই বলে। যা তার ভাল লাগে — করে। আমরা কেউ তা পারি না। আপনার যা ইচ্ছা করে আপনি কি তা করতে পারবেন?
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ
– ‘কেন পারবাে না?”
না আপনি পারবেন না। আপনার সেই সাহস নেই, সেই ক্ষমতা নেই। এই যে আমি আপনার এত কাছে বসে আছি – আপনার যদি ইচ্ছেও করে আপনি আমার হাত ধরতে পারবেন না।
‘পুষ্প।
‘আমি তােমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি তুমি সত্যি জবাব দেবে?”
পুষ্প বলল, আমি কখনাে, কোনদিনও আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি।
‘কখন প্রতিজ্ঞা করলে ?
যেদিন আপনাকে প্রথম দেখলাম সেই দিন। যেদিন পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।
‘ভালবাসা সম্পর্কে আমার একটি থিওরী আছে তুমি কি শুনতে চাও? ‘না আমি কিছুই শুনতে চাই না। আপনি কি প্রশ্ন করতে চাইছিলেন করুন।
‘আমার সব সময় মনে হয়েছে বাবু ছেলেটিকে তুমি খবর দিয়ে এনেছ। তুমি। আমার সঙ্গে এক ধরনের খেলা খেলতে চেয়েছ। তার জন্যে বাবুকে তােমার প্রয়ােজন ছিল। আমার কথা কি ঠিক?
‘হ্যা ঠিক। আপনি আমাকে অবহেলা করছিলেন – আমার সহ্য হচ্ছিল না।
আপনি জানতে চেয়েছেন তাই বললাম। জানতে না চাইলে কোনদিনও বলতাম
না।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। করিম সাহেব ছাতা হাতে, মেয়েকে নিতে এসেছেন। তিনি শওকত সাহেবকে বললেন, স্যার আপনিও চলুন। বৃষ্টির মধ্যে একা একা থাকবেন।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ
শওকত সাহেব শীতল গলায় বললেন, আপনারা যান। আমার অসুবিধা হবে
আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে।
রাত নটার দিকে বৃষ্টি নামল।।
তুমুল বর্ষণ। শওকত সাহেব বজরার ছাদে আরাম কেদারায় এসে গা এলিয়ে দিলেন। তার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে তীব্র ইচ্ছা। মানুষ তার জীবনের
অধিকাংশ সাধই পূর্ণ করতে পারে না, কিছু ছােট খাট সাধ পূর্ণ করতে পারে।
বর্ষণ চললাে সারা রাত। কখনাে একটু কমে আসে – কখনাে বাড়ে। বাতাসে বজরা দুলতে থাকে। তার বড় ভাল লাগে।
শেষ রাতের দিকে জ্বরের ঘােরে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে হলাে রেনু যেন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। রেনু অবাক হয়ে বলছে – কি হয়ছে তােমার, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন?
তিনি হাসি মুখে বললেন, বৃষ্টিতে ভিজলেও আমার কিচ্ছু হবে না রেনু। আমি হচ্ছি ওয়াটার প্রুফ। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন W.P. টাইটেল পেয়েছিলাম। তােমার মনে নেই?
রেনু বলল, তুমি কি কোন কারণে আমার উপর রাগ করেছ? ‘না। কারাে উপর আমার কোন রাগ নেই। তােমার উপর একেবারেই নেই।” “কেন নেই বলতাে?”
‘আমাদের ছােট মেয়েটি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেল, সেই সময়ের কথা কি তােমার মনে নেই রেনু? বেচারী দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণায় কি কষ্ট করল। আমি তাকে একদিনও দেখতে যাই নি — কারণ ওর রােগ যন্ত্রণা দেখা। এবং দেখে সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। ও তােমার কোলে মাথা রেখে। ছটফট করছে, আমি ঘরে বসে লিখছি। ও মারা যাবার সময়ও বার বার বলছিল – – বাবা কোথায় বাবা ?”
“থাক ওসব কথা।
নীল অপরাজিতা-পর্ব-(শেষ)-হুমায়ূন আহমেদ
না না থাকবে কেন তুমি শশান – মেয়ে মারা যাবার পরেও তুমি কিন্তু। আমার উপর রাগ করনি। তুমি আমাকে সান্তনা দেয়ার জন্যে ছুটে এসেছিলে – সেই তােমার উপর আমি কি করে রাগ করি?” বৃষ্টির তােড় বাড়ছে। বজরা খুব দুলছে। শওকত সাহেবের মনে হল তিনি রেনুকে আর দেখতে পারছেন না। নদীর তীরে পূষ্পকে দেখতে পাচ্ছেন। পুষ্প ব্যাকুল হয়ে বলছে– আপনি খুব ভাল করে আমাকে দেখে বলুনতাে আপনি যে ডিজাইনের অর্ধেক অংশের কথা বলছিলেন সেই অর্ধেক কি আমার কাছে? দুটি ডিজাইন একটু মিলিয়ে দেখবেন? তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের হাতে সময় বেশী নেই।
কাছেই কোথাও বজ্রপাত হল। বজ্রপাতের শব্দে সাধারণত পাখিরা চেঁচামেচি করে না। এইবার কেন জানি খুব চেঁচামেচি করছে।