পথ-নির্দেশ-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

একাদশী বৈরাগী-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

এক

মাঝারি গৃহস্থ-ঘরে বাড়ির কর্তা যখন যক্ষ্মারোগে মারা যান, তখন তিনি পরিবারটিকেও আধমরা করিয়া যান। সুলোচনার স্বামী পতিতপাবন ঠিক তাহাই করিয়া গেলেন। বর্ষাধিককাল রোগে ভুগিয়া একদিন বর্ষার দুর্দিনে গভীর রাত্রে তিনি দেহত্যাগ করিলেন। সুলোচনা কাল স্বামীর শেষ প্রায়শ্চিত্ত করাইয়া দিয়া পার্শ্বে আসিয়া বসিয়াছিলেন, আর উঠেন নাই। স্বামী নিঃশব্দে প্রাণত্যাগ করিলেন, সুলোচনা তেমনি নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন, চিৎকার করিয়া পাড়া মাথায় করিলেন না। ত্রয়োদশবর্ষীয়া অনূঢ়া কন্যা হেমনলিনী কিছুক্ষণ পূর্বে অদূরে মাদুরের উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, তাহাকেও জাগাইলেন না। সে ঘুমাইতে লাগিল, পিতার মৃত্যুর কথা জানিতেও পারিল না। বাড়িতে একটি ভৃত্য নাই, দাসী নাই, দূর সম্পর্কীয় কোন আত্মীয় পর্যন্ত নাই। পাড়ার লোকেও ক্রমশ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, বিশেষ অপরাহ্ণ হইতেই বৃষ্টি চাপিয়া আসিয়াছিল বলিয়া, দয়া করিয়া আজ আর কেহ রাত্রি জাগিবার নাম করিয়া ঘুমাইতে আসে নাই।

বাহিরে অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। ভিতরে মৃত স্বামীকে চোখের সামনে লইয়া সুলোচনা কাঠ হইয়া বসিয়া রহিলেন। পরদিন সংবাদ পাইয়া সকলেই আসিলেন, পুরুষেরা মড়া বাহির করিয়া শ্মশানে লইয়া গেল। স্ত্রীলোকেরা গোবর-জল ছড়া দিয়া কাঁদিতে বসিয়া গেলেন।

সুলোচনার থাকিবার মধ্যে শুধু একখানি ছোট আম-কাঁঠালের বাগান অবশিষ্ট ছিল। পাড়ার লোকের সাহায্যে সেইটি একশত টাকায় বিক্রয় করিয়া যথাসময়ে স্বামীর শেষ কাজ সমাধা করিয়া চুপ করিয়া ঘরে বসিলেন। মেয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কি হবে মা এবার?

মা জবাব দিলেন, ভয় কি মা? ভগবান আছেন।

শ্রাদ্ধ-শেষে যাহা বাঁচিয়াছিল, তাহাতে একমাস কোনমতে কাটিয়া গেল। তার পর একদিন আকাশ মেঘমুক্ত দেখিয়া, প্রভাত না হইতেই তিনি ঘরে-দোরে চাবি দিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

মেয়ে প্রশ্ন করিল, কোথায় যাবে মা?

মা বলিলেন, কলকাতায়, তোর দাদার বাড়িতে।

আমার আবার দাদা কে? কোনদিন ত তাঁর কথা বলনি?

মা একটু চুপ করিয়া বলিলেন, এতদিন আমার মনে পড়েনি মা।

হেম অতিশয় বুদ্ধিমতী, সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কাজ নেই মা কারু বাড়ি গিয়ে। দেশে থেকে দুঃখ করলে আমাদের দুটো পেটের ভাত জুটবে—আমি ঘর ছেড়ে কোথাও যাব না।

সুলোচনা উদ্বিগ্ন-কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, দাঁড়াস নে হেম, সকাল হয়ে যাবে।

চলিতে চলিতে বলিলেন, তিনি তোকে অনেক লেখাপড়া শিখিয়েছেন—সে-সমস্ত জলে ফেলিস নে। তুই আমাকে কি বলবি হেম! আমি জানি, ঘরে বসে মায়ে-ঝিয়ে দুঃখ করলে পেটের ভাতটা জুটবে, কিন্তু তোর বিয়ে দেব কি করে বল্‌ দেখি মা?

হেম বলিল, বিয়ে নাই দিলে?

জাত যাবে যে রে।

হেম বলিল, গেলই বা মা। আমরা দুটি মায়ে-ঝিয়ে থাকব—দুঃখ করে খাব, আমাদের জাত থাকলেই বা কি, গেলেই বা কি! পৃথিবীতে আরো অনেক জাত আছে, মেয়ের বিয়ে না দিলে তাদের জাত যায় না। আমরা না হয় তাদের মত হয়ে থাকব।

মেয়ের কথা শুনিয়া সুলোচনা এত দুঃখের মাঝেও একটুখানি হাসিলেন, বলিলেন, তা হলেও গাঁ ছাড়তে হবে। জাত গেলে কেউ উঠান ঝাঁট দিতেও ডাকবে না।

হেম আর জবাব দিল না। বিস্তর অপ্রীতিকর স্মৃতি ইহার পশ্চাতে উদ্যত হইয়াছিল, সেগুলা দমন করিয়া লইয়া সে সে চুপ করিয়া পথ চলিতে লাগিল।

যে পথটা গঙ্গার পাশ দিয়া, গ্রামের ভিতর দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া শ্রীরামপুর স্টেশনে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল, তাঁহারা সেই পথ ধরিয়া প্রায় ক্রোশ-খানেক আসিয়া পথিপার্শ্বে সিদ্ধেশ্বরীর ঘরের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া উঠিয়া হেম বলিল, মা, সকাল হয়ে গেছে, আমার পথ চলতে লজ্জা হচ্ছে।

সুলোচনার নিজেরও লজ্জা করিতেছিল। নীচে এক বৃদ্ধা প্রাতঃস্নানে আসিতেছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা, শ্রীরামপুর ইস্টিশানের এই পথ না?

বৃদ্ধা ক্ষণকাল তাঁহার মুখপানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, তোমরা কোথা থেকে আসচ মা?

সুলোচনা সে কথার জবাব না দিয়া বলিলেন, ইস্টিশানে যাবার আর কোন পথ নেই মা?

দেবালয়ের বিপরীত দিকে একটি ছোট গলি বরাবর রেলওয়ে লাইনের উপর আসিয়া পড়িয়াছিল। বৃদ্ধা সেই পথটি দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, এই গলিটা বামুনদের বাড়ির পাশ দিয়ে বরাবর রেলের রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। এই পথ দিয়ে যাও। রেলের রাস্তা ধরে সোজা বাঁ-দিকে গেলে ছিরামপুর ইস্টিশানে পৌঁছুবে—যাও মা, ভয় নেই, কেউ কিছু বলবে না।

সুলোচনা কোনরূপ দ্বিধা না করিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া গলির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলেন।

.

দুই

আমহার্স্ট স্ট্রীটের উপর গুণেন্দ্রের প্রকাণ্ড বাড়ি প্রায় খালি পড়িয়া ছিল। তেতলার একটা ঘরে সে শয়ন করিত, আর একটায় লেখাপড়া করিত। বাকি ঘরগুলা এবং সমস্ত দ্বিতলটা শূন্য পড়িয়া ছিল। নীচের তলায় এক পাচক, দুই ভৃত্য ও এক দারোয়ান এক-একটা ঘর দখল করিয়া থাকিত, তদ্ভিন্ন সমস্ত ঘরই তালাবন্ধ।

গুণেন্দ্রের পিতা লোহার ব্যবসা করিয়া মৃত্যুকালে এত টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন যে, তাঁহার এক সন্তান না থাকিয়া দশ সন্তান থাকিলেও কাহারো উপার্জন করিবার প্রয়োজন হইত না; সেই টাকা এবং পিতার লোহার কারবার বিক্রয় করিয়া ফেলিয়া সমস্ত টাকা গুণেন্দ্র ব্যাঙ্কে জমা দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া আদালতে ওকালতি করিতে বাহির হইয়াছিল।

বেলা দশটা বাজে, তখনো সে কি-একখানা বই পড়িতেছিল, ভৃত্য আসিয়া বলিল, বাবু আপনার চানের সময় হয়েছে।

যাচ্ছি, বলিয়া গুণেন্দ্র পড়িতেই লাগিল।

ভৃত্যটা খানিক পরেই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, দুটি মেয়েমানুষ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

গুণেন্দ্র বিস্মিত হইয়া বই হইতে মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার সঙ্গে?

হাঁ বাবু, আপনার সঙ্গে। আপনার—

তাহার কথা শেষ না হইতেই সুলোচনা ঘরে প্রবেশ করিলেন। গুণেন্দ্র বই বন্ধ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

সুলোচনা চাকরটার দিকে চাহিয়া বলিলেন, তুই নিজের কাজে যা।

ভৃত্য চলিয়া গেলে বলিলেন, গুণী, তোমার বাবা কোথায়, বাবা?

গুণেন্দ্র অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল, জবাব দিতে পারিল না।

সুলোচনা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, আমার মুখের দিকে চেয়ে চিনতে পারবে না বাবা! প্রায় বারো বছর আগে তোমাদেরই ওই পাশের বাড়িতে আমরা ছিলাম। সেই বছরে তোমার পৈতে হয়, আমরাও বাড়ি চলে যাই। তোমার বাবা কি দোকানে গেছেন?

গুণেন্দ্র বলিল, না, বছর-তিনেক হ’ল তিনি মারা গেছেন!

মারা গেছেন! তোমার পিসিমা?

তিনিও নেই। তিনি বাবার পূর্বেই গেছেন।

সুলোচনা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, দেখছি শুধু আমিই আছি। তোমার মা যখন মারা যান, তখন তুমি সাত বছরেরটি। তার পর পৈতে না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছেই তুমি মানুষ হয়েছিলে। হাঁ, গুণী, তোর সইমাকে মনে পড়ে না রে?

গুণেন্দ্র তৎক্ষণাৎ মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলি মাথায় তুলিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিয়া উঠিল,—হাঁ, মা! তুমি?

সুলোচনা হাত বাড়াইয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া নিজের অঙ্গুলির প্রান্তভাগ চুম্বন করিয়া বলিলেন, হাঁ বাবা, আমিই।

গুণেন্দ্র একখানা চৌকি কাছে টানিয়া আনিয়া বলিল, ব’সো মা।

সুলোচনা হাসিয়া বলিলেন, যখন তোর আশ্রয়ে এসেছি তখন বসব বৈ কি! হাঁ রে, তুই এখনো বিয়ে করিস নি?

এবার গুণেন্দ্র হাসিয়া বলিল, এখনো ত সময় হয়ে ওঠেনি।

সুলোচনা বলিলেন, এইবারে হবে। বাড়িতে কি কেউ মেয়েমানুষ নেই?

না।

রাঁধে কে?

একজন বামুন আছে।

সুলোচনা বলিলেন, বামুনের আর দরকার নেই, এখন থেকে আমি রাঁধব। আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। আমার আরো দু-চারটে কথা আছে, সেইগুলো বলে নি। আমার স্বামীর এখানকার কাজ যাবার পরে আমরা বাড়ি চলে যাই। হাতে কিছু টাকা তখন ছিল, দেশেও কিছু জমিজমা ছিল। এতেই একরকম স্বচ্ছন্দে দিন কাটছিল। তার পর গত বৎসর তাঁকে যক্ষ্মারোগে ধরে। চিকিৎসার খরচে, হাওয়া বদলানর খরচে, একেবারে সর্বস্বান্ত করে তিনি মাস-খানেক পূর্বে স্বর্গে গেছেন। এখন অনাথাকে দুটি খেতে দিবি, এই প্রার্থনা।

তাঁর চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। গুণেন্দ্রের চোখও ছলছল করিয়া উঠিল। সে কাতর হইয়া বলিল, মাকে মানুষে খেতে দেয় না, তুমি কি এই কথা মনে ভেবে এখানে এসেছ মা?

সুলোচনা আঁচল দিয়া চোখের জল মুছিয়া বলিলেন, না বাবা, সে কথা মনে ভেবে আসিনি। তা হলে এত দুঃখেও বোধ করি আসতাম না। তোকে ছোটটি দেখে গেছি, আজ বারো বছর পরে দুঃখের দিনে যখনি মনে পড়েছে, কোন শঙ্কা না করেই চলে এসেছি। তা ছাড়া আরো একটি কথা আছে। আমার মেয়ে হেমনলিনী—সে তোরই বোন—সে আবার আমার চেয়েও অনাথা। বিয়ের বয়েস হয়েছে, কিন্তু বিয়ে দিতে পারিনি। তার উপায় তোকেই করে দিতে হবে।

গুণেন্দ্র বলিল, তাকে কেন সঙ্গে আননি মা?

সুলোচনা বলিলেন, এনেছি। কিন্তু সে বড় অভিমানিনী। পাছে এ-সব কথা শুনতে পায়, তাই তাকে নীচে বসিয়ে রেখে আমি একলাই ওপরে এসেছি।

গুণেন্দ্র ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া চাকরটাকে চিৎকার করিয়া ডাক দিয়া বলিল, ও নন্দা, নীচে হেম বসে আছে, যা শিগগির ডেকে নিয়ে আয়।

সুলোচনা বলিলেন, তাকে উদ্ধার করতে তোর খরচ হবে—সে ঋণ আমি কোনদিন—

গুণেন্দ্র বাধা দিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, তবে মা, আমি বাইরে যাই, তোমার যা মুখে আসে বল। কিন্তু আমার মা মরে যাবার পর তুমি যা করেছিলে, সে-সব ঋণের কথা যদি আমি তুলি, তা হলে বলে রাখছি মা, তোমাকেও লজ্জায় বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তার চেয়ে কাজ নেই—তুমিও চুপ কর, আমিও করি।

সুলোচনা হাসিয়া বলিলেন, তাই ভাল। তবে মেয়েটা আসচে, তার সামনে আর বলা হবে না—তাই এইবেলা আর একটা কথা বলে রাখি। মনে করিস নি গুণী, আমি মায়ের চোখ নিয়ে এ কথা বলচি, কিন্তু হেম এলে দেখতে পাবি, তোর বোন রূপে গুণে কোন মানুষেরই অযোগ্যা হবে না। তার বাপ তাকে অনেক লেখাপড়া শিখিয়েচেন—শেষ কয়েক বছর এইটিই তাঁর একমাত্র কাজ ছিল। আমি বলচি, ও মেয়ে যার ঘরে যাবে, তার ঘরই আলো হবে। ও হেম, এই দিকে আয় মা, ইনি তোর গুণীদাদা—প্রণাম কর্‌।

হেম ঘরে ঢুকিয়া গুণেন্দ্রকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া নতমুখে দাঁড়াইল। তাহার পথশ্রমে ক্লান্ত মুখের দিকে চাহিয়া গুণেন্দ্র বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুলোচনা বোধ করি সে ভাব লক্ষ্য করিয়াই বলিলেন, গুণী, হেমকে তোর হাতেই দিতাম, যদি না দেশাচারে নিষেধ থাকত। আমি ম’লে হেমের দশ দিন অশৌচ হবে, তোকেও তিন দিন অশৌচ মানতে হবে, তাই ধর্মতঃ ও তোর বোন হয়।

গুণেন্দ্র এবার নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া হেমকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, হেম, শুনলে ত—আমাদের একই মা। মায়ের বাড়িতে আমিও যেমন, তুমিও তেমন। চল, তোমাদের খাবার যোগাড় করে দি।
৯৬৮

সুলোচনা হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, গুণী, তোর গলায় পৈতে দেখচি না যে!

গুণেন্দ্র খালিগায়ে ছিল, সে নিজের গলার দিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া হাসিয়া বলিল, আমরা ব্রাহ্ম।

ব্রাহ্ম! ছি বাবা, কাজটা ভাল করনি। যাই হোক, প্রায়শ্চিত্ত করে পৈতে নাও।

গুণেন্দ্র বলিল, কাজটা যদিও ঠিক আমার করা নয়, বাবা নিজেই করে গেছেন, কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করারও কোন আবশ্যক দেখিনে মা। ব্রাহ্ম-মতটা মন্দ বলে মনে করি না।

সুলোচনা মনে মনে যেন শক্ত আঘাত পাইয়া বসিয়া পড়িলেন। খানিক পরে নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, জানিনে কেন মানুষের এ-সব দুর্বুদ্ধি হয়।

গুণেন্দ্র হাসিয়া বলিল, দুর্বুদ্ধির কথা অন্য সময়েও হতে পারবে মা, এখন রান্নাঘরের দিকে চল।

.

তিন

পথিক যেমন গাছতলায় রাঁধিয়া খাইয়া হাঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যায় এবং তখন যেমন চাহিয়া দেখে না হাঁড়িটা ভাঙ্গিল কি বাঁচিল, সংসারে শতকরা নব্বই জন লোক ঠিক এমনি করিয়াই সরস্বতীর কাছ হইতে কাজ আদায় করিয়া মা-লক্ষীর রাজপথের ধারে নির্মমভাবে তাঁহাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেয়—একবার ফিরিয়াও দেখে না, তিনি ভাঙ্গিলেন কি বাঁচিলেন। গুণেন্দ্র সেইরূপ করে নাই। সে চিরদিন যেভাবে শ্রদ্ধা করিয়া সেবা করিয়া আসিয়াছিল, উকিল হইয়াও ঠিক তেমনি করিয়াই সরস্বতীর সেবা করিতে লাগিল। তাহার পড়িবার ঘর পুস্তকে ভরিয়া উঠিয়াছিল; সেই ঘরের মধ্যে হেমনলিনী ভারী আশ্রয় পাইল। গুণেন্দ্র গুছান প্রকৃতির লোক ছিল না বলিয়া তাহার যে পুস্তক একবার আলমারির বাহিরে আসিত, তাহা শীঘ্র আর ভিতরে প্রবেশ করিতে পাইত না। টেবিল, চেয়ার, অবশেষে নীচের গালিচার উপর পড়িয়া সুদীর্ঘকাল পরে যদি কোনগতিকে নন্দার সাহায্যে ভিতরে প্রবেশ করিত, আবশ্যক হইলে আর বাহির হইত না—এমনি মিশিয়া যাইত। একটা পুস্তকের তালিকাও তাহার ছিল বটে, কিন্তু সেটাকে কাজে লাগাইবার কিছুমাত্র উপায় ছিল না।

হেম এই বিশৃঙ্খলা দুই-চারদিনের মধ্যেই ঠিক করিয়া ফেলিল। একদিন একটা আলমারি খালি করিয়া সমস্ত বই নীচে নামাইয়াছে, এমন সময়ে গুণেন্দ্র ঘরে ঢুকিল। তাহাকে দেখিয়া হেম বলিল, গুণীদাদা, এই বইগুলো ওই আলমারিতে, আর ওই বইগুলো এই আলমারিতে রাখলে ভারি সুবিধে হয়।

গুণেন্দ্র চাহিয়া দেখিয়া বলিল, কি সুবিধে হয়?

হেম বলিল, বাঃ, সুবিধে হবে না? দেখচ না, এই বইগুলো এইটাতে রাখলে কেমন—

গুণেন্দ্র গম্ভীর হইয়া বলিল, দেখতে পাচ্চি বটে, খুব সুবিধে হবে।

হেম একটা চৌকির উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, যাও—করব না, তোমার ভাল করতে নেই।

গুণেন্দ্র একখানা বই তুলিয়া হাসিয়া বাহিরে চলিয়া গেল।

এই ঘরটিতে হেমনলিনী দিবারাত্র থাকিত বলিয়া, গুণেন্দ্র আজকাল তাহার শোবার ঘরে বসিয়াই পড়াশুনা করিত। একদিন রবিবারের দুপুরবেলা হেম বাহির হইতে ডাকিয়া বলিল, গুণীদা, আসব?

গুণী ভিতর হইতে বলিল, এস।

হেম ঘরে ঢুকিয়াই বলিল, তুমি সব সময়ে এই শোবার ঘরে বসেই বই পড় কেন?

দোষ কি? এ ঘরে কি বিদ্যে কম হয়?

তোমার পড়বার ঘরেই কি এতদিন কম হয়েছিল?

গুণেন্দ্র বলিল, কম হয়নি বটে, কিন্তু কাঁচা হয়েছিল—এই ঘরে সেগুলো পাকছে।

হেম প্রথমে হাসিয়া উঠিল, কিন্তু কথাটা বুঝিতে না পারিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, তোমার কেবল তামাশা। একটা কথাও কি তুমি সোজা করে বলতে জান না?

গুণী নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল, জবাব দিল না।

হেম বলিল, আমি কিন্তু জানি। ও ঘরে আমি থাকি বলেই তুমি যাও না। আমাকে তুমি লজ্জা কর। আমি কিন্তু তোমাকে একটুকুও লজ্জা করিনে।

গুণী জিজ্ঞাসা করিল, কেন কর না, করা ত উচিত।

হেম হাত দিয়া একগোছা চুল কপালের উপর হইতে পিঠের দিকে সরাইয়া দিয়া বলিল, তোমাকে আবার লজ্জা করতে যাব কি, তুমি কি পর? সে হবে না গুণীদা, চল সে ঘরে। বলিয়া সে বইগুলো তুলিয়া লইয়া বাহির হইয়া গেল।

হেমের সর্বদা ব্যবহারের জন্য হার, চুড়ি, বালা প্রভৃতি কতকগুলা অলঙ্কার গুণী কিনিয়া আনিয়াছিল। সুলোচনা দেখিয়া বলিলেন, কেন বাবা এ-সব?

গুণী বলিল, এই কটিতে কি হবে মা, আরো ত ঢের চাই। শুধু-হাতে ত মেয়ে পার হবে না।

সুলোচনা আর কথা কহিতে পারিলেন না। কিন্তু তিনি মনে মনে উদ্দ্বিগ্ন হইয়া পড়িতেছিলেন। এই দুটিতে কেমন করিয়া যে এত সত্বর এত আপনার হইয়া গেল, এই কথা তিনি যখন তখন ভাবিতে লাগিলেন। একদিন তিনি গুণীকে ডাকিয়া বলিলেন, এই সামনের অঘ্রাণ যেন বয়ে না যায় বাবা। যেমন করে হোক, ওর বিয়ে দিতেই হবে। মেয়ে বড় হয়ে উঠেছে।

গুণী বলিল, সেজন্য তুমি নিশ্চিন্ত থাক মা। কিন্তু হাত-পা বেঁধে জলে ফেলেও ত দিতে পারব না। একটি সুপাত্র ত চাই।

সুলোচনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, সুপাত্র অপাত্র ওর অদৃষ্ট, গুণী! আমাদের কাজ আমরা করব, তার পরে ভগবানের হাত।

সে ঠিক কথা মা, বলিয়া গুণী চলিয়া গেল। তাহার মুখের উপর দিয়া একটা কালোছায়া ভাসিয়া গেল, সুলোচনা তাহা লক্ষ্য করিয়া আর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নিজের কাজে চলিয়া গেলেন।মনে মনে বলিলেন, না, ভাল হচ্ছে না—যত শীঘ্র পারা যায় পাত্রস্থ করা চাই।

কয়েকদিন পরে হেম হঠাৎ ঘরে ঢুকিয়াই বলিল, এখনো শুয়ে আছ—কাপড় পরনি? শিগগির ওঠ।

গুণী বিছানার উপর শুইয়া চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল। হেম আলমারির কাছে গিয়া খট্‌ করিয়া আলমারি খুলিয়া একমুঠা নোট ও টাকা লইয়া আঁচলে বাঁধিল। চাবি বন্ধ করিয়া কাছে আসিয়া বলিল, তোমার পায়ে পড়ি গুণীদা, আর দেরি ক’রো না, ওঠ। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

গুণী তাহার সাজগোজ দেখিয়া কতকটা অনুমান করিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যেতে হবে?

হেম ব্যস্ত হইয়া বলিল, বেশ! গাড়ি তৈরি করতে বলে দিয়েছি এক ঘণ্টা আগে। এখন তুমি বলচ কোথায় যেতে হবে!

গুণী বলিল, কোচম্যান না হয় জানতে পারে কোথায় যেতে হবে; আমি ত কোচম্যান নই, আমি জানব কি করে?

হেম হাসিয়া উঠিল, বলিল, তুমি কোচম্যান কেন হবে গুণীদা? চল, দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

কোন্‌ দোকান?

বইয়ের দোকান গো! তোমাকে মানদা বলে যায়নি? আমি তাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলাম যে! অনেক ভাল ভাল নূতন বাংলা বই বেরিয়েছে—আমি একটা লিস্ট করেচি।

তাহার হাতে একটা কাগজের টুকরো দেখিয়া গুণী হাত বাড়াইয়া বলিল, লিস্ট দেখি।

না, তা হলে তুমি কিনতে দেবে না।

তা হলে চুরি করে কিনলেও পড়তে দেবো না।

হেম ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, চল, গাড়িতে দেখাব।

সন্ধ্যার সময় তাহারা একগাড়ি বই কিনিয়া ফিরিয়া আসিল। সুলোচনা দেখিয়া বলিলেন, ইস্‌! এত বই কি হবে রে!

গুণী বলিল, কি জানি মা, ও-সব হেমের বই। কেবল কতকগুলা বাজে বই কিনে টাকা নষ্ট করে এল।

সুলোচনা বলিলেন, তুই দিলি কেন?

গুণী বলিল, আমি কেন দেব? চাবি ওর হাতে, ও নিজে টাকা নিলে, গাড়ি তৈরি করতে বলে দিলে, তার পর নিজে গিয়ে কিনে আনলে—আমি শুধু সঙ্গে ছিলাম বৈ ত নয়।

হেম পুস্তকের রাশি নন্দাকে দিয়া, মানদাকে দিয়া এবং কতক নিজে বহিয়া লইয়া তেতলার ঘরে চলিয়া গেল।

সুলোচনা বলিলেন, গুণী, অত প্রশ্রয় দিস্‌নে বাবা! কোথায় কার হাতে পড়বে, তখন দুঃখে মারা যাবে।

গুণী উপরে পড়িবার ঘরে গিয়া দেখিল, হেম গ্যাসের আলোর নীচে বসিয়া নূতন পুস্তকের পিছনে আঠা দিয়া নম্বর আঁটিতেছে এবং বলিল, মা বলেচেন, তোমাকে আর প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কোথায় কার হাতে পড়ে দুঃখে-কষ্টে মারা যাবে।

হেম মুখ ফিরাইয়া ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, কেন মারা যাব? আমাকে গরীব-দুঃখীর ঘরে দিলে, আমি তার পরের দিনই পালিয়ে আসব।

গুণী হাসিয়া বলিল, তবে সেই ভাল।

হেম আর জবাব দিল না, কাজ করিতে লাগিল। গুণেন্দ্র কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া অতি ক্ষুদ্র একটি নিঃশ্বাস দমন করিয়া লইয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল।

দুর্গাপূজা শেষ হইয়া গেল। বিজয়ার দিনে গাড়ি করিয়া ঠাকুর-ভাসান দেখিয়া ফিরিয়া মাকে প্রণাম করিয়া হেম উপরে উঠিয়া গেল। তেতলার খোলা ছাদের উপর জ্যোৎস্নার আলোকে গুণেন্দ্র একাকী পায়চারি করিতেছিল, হেম সুমুখে আসিয়া তাহার পায়ের উপর মাথা রাখিয়া প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। গুণেন্দ্র নিঃশব্দে তাহার মুখের পানে চাহিয়া আছে দেখিয়া, একবার একটুখানি যেন লজ্জা করিয়া উঠিল। কিন্তু তখনই বলিল, আমাকে আশীর্বাদ করলে না গুণীদা?

গুণেন্দ্রের চমক ভাঙ্গিয়া গেল। তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, করেছি বৈ কি।

কৈ করলে?

মনে মনে করেছি।

হেম হাসি চাপিয়া বলিল, কি আশীর্বাদ করলে আমাকে বল।

গুণেন্দ্র বিপদগ্রস্ত হইয়া অবশেষে গম্ভীর হইয়া বলিল, আশীর্বাদ করে বলতে নেই। তা হলে ফলে না।

হেম বলিল, আচ্ছা সে হবে, তুমি মাকে প্রণাম করেচ?

সে তো রোজ করি।

হেম ব্যস্ত হইয়া বলিল, না না, সে হবে না। আজ বিজয়া, আজ বিশেষ করে প্রণাম করতে হয়। শিগগির যাও—না হলে তিনি দুঃখ করবেন।

গুণেন্দ্র নীচে নামিয়া গেল।

কার্তিক মাসের মাঝামাঝি একদিন হেম ঝড়ের মত ঘরে ঢুকিয়াই বলিল, তোমাদের কি আর কথা নেই, আর কাজ নেই? কেন, তোমাদের কি করেছি আমি! বলিয়াই সে কাঁদিয়া ফেলিল।

গুণেন্দ্র হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, কি হয়েছে হেম?

হেম কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, যেন কিছু জানে না! কি হয়েছে হেম! মা বলছিলেন, শান্তিপুরে, না কোথায়, সমস্ত ঠিক হয়ে গেছে! আমি যদি বিয়ে না করি, তোমার কি জোর করে আমার হাত-পা বেঁধে বিয়ে দিতে পার?

গুণেন্দ্র এবার বুঝিতে পারিয়ে হাসিয়া বলিল, ওঃ—এই কথা! বড় হয়েছ, তোমার বিয়ে দিতে হবে না?

না।

না কি? বিয়ে না দিলে জাত যাবে যে।

বিয়ে না দিলে তোমাদের জাত যায় কি?

গুণেন্দ্র কহিল, আমাদের যায় না—আমরা ব্রাহ্ম। কিন্তু তোমাদের যখন সময়ে না বিয়ে দিলে জাত যায়, তখন দিতেই হবে।

হেম চোখ মুছিয়া বলিল, তোমরাই ঠিক। তোমরাই মানুষ, তাই মানুষকে এমন ধরে-বেঁধে বধ কর না। আমি কিছুতেই এ বাড়ি ছেড়ে যাব না—তা তোমরা কেন যত মতলবই কর না!

গুণেন্দ্র তাহাকে শান্ত করিবার অভিপ্রায়ে স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, সেও খুব বড় বাড়ি। তিনি দেখতে শুনতে ভাল, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, বড়লোক, সেখানে তোমার কোন কষ্ট হবে না।

হেম কিছুমাত্র শান্ত না হইয়া সবেগে মুখের উপর হইতে চুল সরাইয়া দিয়া কহিল, সে হবে না—কিছুতেই হবে না, তোমাকে আমি বলচি। আমি তোমাদের ভার-বোঝা হয়ে থাকি, আমাকে খেতে দিতে হবে না। আমি উপোস করে আমার পড়বার ঘরে পড়ে থাকব—আমি কিছু চাইব না।

গুণেন্দ্র হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, সেখানেও তোমার পড়বার ঘর পাবে। না পাও, তোমার এই ঘর আমি সেখানে তুলে দিয়ে আসব।

হেম সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া কাঁদিয়া বলিল, তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না গুণীদা, কিচ্ছু না। এই অঘ্রাণ মাসে? এই এক মাস পরে? তোমার দুটি পায়ে পড়ি গুণীদা, তুমি সম্বন্ধ ভেঙ্গে দাও।

তাহার কান্না দেখিয়া গুণেন্দ্রের নিজের চোখও ভিজিয়া উঠিয়াছিল। সে কোন মতে আত্মসংবরণ করিয়া লইয়া বলিল, সে কি হয় ভাই? সে হয় না। কথাবার্তা সব পাকা হয়ে গেছে।

ছাই কথাবার্তা! ছাই পাকা কথা! তুমি সম্বন্ধ করেছ, তুমি ইচ্ছে করলেই ভেঙ্গে দিতে পার। আমি হাতজোড় করে বলছি গুণীদা, আমার এই কথাটি রাখো।

সুলোচনা সন্দিগ্ধ-চিত্তে পিছনে পিছনে উপরে উঠিয়া আসিয়াছিলেন, ঘরে ঢুকিয়া ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, এ-সমস্ত তোর কি হচ্ছে হেম? এ-সব কি পাগলের মত বকচিস? সম্বন্ধ কি কখনো ভাঙ্গা যায়, না, পাকাকথার নড়চড় করা যায়? আর ভাঙ্গবই বা কেন? তোর ভাগ্যি ভাল যে, এমন ভাই পেয়েছিস। এমন সম্বন্ধ জুটেছে—তুই বলিস কিনা, ভেঙ্গে দিতে? বাঙালীর মেয়ে খ্রীষ্টানীর মত আইবুড় থুবড়ো হয়ে থাকবি? যা নীচে যা।

হেম চলিয়া গেল, সুলোচনা গুণেন্দ্রের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এইসব দিনরাত বই পড়ার ফল। চব্বিশ ঘণ্টা নভেল, নাটক নিয়ে থাকলেই এই সমস্ত দুর্মতি হয়। অঘ্রাণ মাসে যেমন করে হোক, ওকে বিদেয় করতেই হবে।

গুণেন্দ্র চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সুলোচনা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া গেলেন।

দিন-দুই পরে আদালত হইতে ফিরিয়া কি-একটা বইয়ের জন্য গুণেন্দ্র পড়িবার ঘরে ঢুকিতে যাইতেছিল, ভিতর হইতে হেম বলিয়া উঠিল, এসো না গুণীদা, আমি খাচ্চি।

গুণী থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, খেলেই বা। আমি ঘরে ঢুকলেই কি খাওয়া নষ্ট হবে?

হেম কহিল, সমস্ত ঘরময় কার্পেট পাতা রয়েছে যে।

গুণী বলিল, তোমার দাসী মানদা ঢুকলে জাত যায় না, আমি কি তার চেয়ে ছোট?

হেম অপ্রতিভ হইয়া হাসিয়া বলিল, আচ্ছা এসো, আমার খাওয়া হয়েচে। বলিয়া খাবার থালাটা ঠেলিয়া টেবিলের ওধারে সরাইয়া দিল।

না না, তুমি খাও, তুমি খাও, আমি কাপড় ছেড়ে আসচি। বলিয়া গুণী তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল। তাহার বুকের ভিতরটা যেন জ্বালা করিতে লাগিল।

পরদিন বেলা দশটার সময় গুণী ভাত খাইয়া উঠিবামাত্রই হেম কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া সেই পাতা আসনে বসিয়া পড়িয়া বলিল, বামুনঠাকুর, আমাকে এই পাতে ভাত দাও।

বামুনঠাকুর আশ্চর্য হইয়া বলিল, ওতে যে বাবু খেয়ে গেলেন!

হেম বলিল, হাঁ, হাঁ, জানি, তুমি দাও না।

পাশের ঘর হইতে শুনিতে পাইয়া সুলোচনা নিকটে আসিয়া বলিলেন, ও কি করছিস হেম! ও যে গুণীর এঁটো পাত; যা, কাপড় ছেড়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে আয়।

হেম উচ্ছিষ্টাবশেষ হইতে একগ্রাস মুখে পুরিয়া দিয়া বলিল, ঠাকুর ভাত দাও। গুণীদার এঁটো পাতে বসে খাবার যোগ্যতা সংসারের ক’জনের ভাগ্যে আছে? এ পাতে খেতে পাওয়া ভাগ্য।

সুলোচনা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন, বামুনঠাকুর আরো ভাত তরকারি আনিয়া থালের উপর দিয়া গেল।

গুণী বারান্দার ওধারে বসিয়া মুখ ধুইতেছিল, সমস্ত শুনিতে পাইল। সন্ধ্যার পর সে হেমকে বলিল, আজ হেমের যে জাত গেল!

হেম নূতন বই লইয়া মগ্ন হইয়া পড়িতেছিল, মুখ না তুলিয়াই বলিল, তোমাকে কে বললে?

যেই বলুক, জাত গেছে ত?

হেম মুখ তুলিয়া বলিল, না। তোমার পাতে বসে খেলে কারু জাত যায় না—যারা জাত তৈরি করেছে—তাদেরও না।

গুণী অদূরে আর একটা চেয়ারের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, তা হোক, কিন্তু কাজটা ভাল হয়নি। যার যা জাত, তাই তার মেনে চলা উচিত। তা ছাড়া, মাকে দুঃখ দেওয়া হয় যে!

হেম ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া, হঠাৎ যেন রাগ করিয়া বলিল, এ যেন তোমার বাড়ি নয়, তোমার জায়গা নয়, তুমি যেন সকলের নীচে, সকলের ছোট। এ যদি-বা তোমার সহ্য হয়, আমার হয় না। তোমার পাতে বসে খেলে মা দুঃখ পান, না খেলে মার চেয়ে যিনি বড়, তাঁকে দুঃখ দেওয়া হয়। আচ্ছা, তুমি এখন যাও—আমি বকতে পারিনে, পড়ি। বলিয়া সে খোলা বইয়ের পাতার উপর তৎক্ষণাৎ ঝুঁকিয়া পড়িল।

গুণেন্দ্র খানিকক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া নিঃশব্দে উঠিয়া গেল। তাহার দুই চোখের উপর হইতে একটা কালো পর্দা আজ যেন অকস্মাৎ কোথায় অন্তর্ধান হইয়া গেল।

.

চার

অগ্রহায়ণ মাসের শেষে নবদ্বীপে এক বড়লোকের ঘরে হেমের বিবাহ হইয়া গেল। সে দূর হইতে গুণীদাকে প্রণাম করিয়া স্বামীর ঘর করিতে চলিয়া গেল। সেখানে শ্বশুর, শ্বশ্রু, জা, ননদ, কেহই ছিল না। স্বামীর বৃদ্ধা পিতামহী এবং স্বামীর অবিবাহিত ছোট ভাই—সে কলিকাতায় কলেজে পড়ে।

কিশোরীবাবুর বয়স ছত্রিশের কাছাকাছি। তিনি বিপত্নীক হইয়া অবধি একটি ডাগর মেয়ে খুঁজিতেছিলেন, তাই হেমকে না দেখিয়াই তাঁহার পছন্দ হইয়া গেল। বিবাহের পর তিনি সুলোচনাকেও এ বাড়িতে আনিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। সুলোচনা সম্মত হইয়া মেয়ের কাছে পত্র লিখাইলেন। তিনি নবদ্বীপে থাকিয়া পুণ্য সঞ্চয় করেন, এই ইচ্ছা।

হেম জবাবে লিখিল, তুমি যে বাড়িতে আছ মা, সে বাড়ির হাওয়া লাগলেও সমস্ত নবদ্বীপ উদ্ধার হয়ে যেতে পারে। ওখানে থেকেও যদি তোমার পুণ্যসঞ্চয় না হয়, বৈকুন্ঠে গেলেও হবে না। ওঁকে ছেড়ে যদি তুমি এস, আমি নিজে গিয়ে তাঁর কাছে থাকব।

মেয়েকে তিনি চিনিতেন, তাই যাইতে পারিলেন না বটে, কিন্তু মন তাঁহার কোথাকার অজানা নবদ্বীপের আশেপাশে দিবারাত্র ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

এমনি করিয়া আরো ছয় মাস কাটিয়া গেল। একদিন তিনি আর থাকিতে না পারিয়া কি একটা উৎসবের উপলক্ষ করিয়া, নন্দাকে সঙ্গে করিয়া, স্টিমারে চড়িয়া বসিলেন। সেখানে গিয়া তিনি মেয়েকে রোগা দেখিয়া দুঃখিত হইয়া বলিলেন, কেউ নাই মা এখানে, বোধ করি, তোর যত্ন হয় না।

মেয়ে হাঁ-না একটা জবাবও দিল না।

উৎসব শেষ হইয়া গেল, তবু তাঁহার ফিরিবার গা নাই দেখিয়া একদিন হেম বলিল, আর কতদিন জামাইয়ের বাড়ি থাকবে মা? লোকে নিন্দে করবে যে!

সুলোচনা রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, তুই আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচিস! এ তবু ত আপনার মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি, সেইখানেই কোন্‌ নিজের বাড়িতে ফিরে যাব, শুনি?

হেম কিছুক্ষণ অবাক হইয়া বসিয়া থাকিয়া বলিল, তোমার দোষ নেই মা, এ আমাদের মেয়েমানুষের স্বধর্ম। আমরা আপনার-পর একদিনেই ভুলে যাই।

দিন কাটিতে লাগিল, আবার দুর্গাপূজা ঘুরিয়া আসিল। গুণী বড় ঘটা করিয়া পূজার তত্ত্ব পাঠাইয়াছিল। সুলোচনা হেমকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন, গুণী আমার ব্রাহ্ম বটে, কিন্তু এ-সব জানে।

মিষ্টান্ন প্রভৃতি পাড়ায় বিতরণ করিয়া, কাপড়-চোপড় সকলকে দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন, আমি ঘরে নেই, তাই ছেলে আমার, বোনকে তত্ত্ব পাঠিয়েচে; এবং পূজা দেখিয়াই তিনি ঘরে ফিরিবেন, এ-কথাও সকলের কাছে প্রচার করিয়া দিলেন। তাঁহার যাওয়া সম্বন্ধে হেম সেদিন হইতে আর কোন কথা বলিত না, আজও চুপ করিয়া রহিল। সুলোচনা বুঝিতে পারিয়া মনে মনে বলিলেন, যদি কখন ভগবান দিন দেন তখন বুঝবি মা, সন্তানকে ছেড়ে যেতে মায়ের প্রাণ কি করে!

কিন্তু পূজা শেষ না হইতেই সুলোচনাকে শক্ত করিয়া ম্যালেরিয়ায় ধরিল। মাস-খানেক জ্বরভোগের পরে, একদিন হেম বলিল, আর কেন মা, বিপদে মধুসূদনকে স্মরণ করতে হয়, যদি বাঁচতে চাও গুণীদাকে ডাক দাও। বলিতে বলিতে তাহার দুই চোখ জলে ভরিয়া গেল, তার পর সেই জল ঝরঝর করিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, সে ঊর্ধ্বমুখে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

মা বলিলেন, তাই কর হেম, তাকে চিঠি লিখে দে।

হেম বাড়ির সরকারকে দিয়া মাকে লইয়া যাইবার জন্য গুণেন্দ্রকে চিঠি লিখাইয়া দিল।

দুইদিন পরে মানদা ও দরোয়ান আসিয়া উপস্থিত হইল। হেম মানদাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, গুণীদা এলো না কেন রে?

মানদা বলিল, তাঁরও অসুখ। প্রায় দু হপ্তা হয়ে গেল, সর্দি-কাশি, কোনদিন বা একটু জ্বর, না হলে তিনিই আসতেন। হেম আশা করিয়াছিল, গুণীদাদা আসিবে।

সুলোচনা চলিয়া গেলেন। গুণী ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা করিয়া দাস-দাসী সঙ্গে দিয়া তাঁহাকে বায়ু-পরিবর্তনের জন্য পশ্চিমে পাঠাইয়া দিল। যাইবার সময় সুলোচনা বলিলেন, গুণী, তুইও আমার সঙ্গে আয় বাবা, তোর দেহটাও ভাল নেই—চল্ দু’জনেই যাই। গুণী স্বীকার করিতে পারিল না। তাহার কলিকাতায় কাজ ছিল, সে রহিয়া গেল।

পশ্চিমে গিয়া সুলোচনা সারিতে লাগিলেন। তিনি নবদ্বীপে ও কলিকাতায় চিঠি লিখিয়া সংবাদ জানাইলেন যে, শরীর ভাল থাকিলে মাঘের শেষে দেশে ফিরিবেন।

গত বৎসর ছাব্বিশে অগ্রহায়ণে হেমের বিবাহ হইয়াছিল, আজ আবার ছাব্বিশে অগ্রহায়ণ ফিরিয়া আসিয়াছে। হঠাৎ এই কথাটা স্মরণ করিয়া গুণী ক্ষণকালের জন্য বই হইতে মুখ তুলিয়া শূন্যদৃষ্টিতে জানালার বাহিরে চাহিয়াছিল, এমন সময়ে পিছনে দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া নূতন দরোয়ান ডাকিল, মহারাজ, একঠো জরুরী তার আয়া।

গুণী মুখ ফিরাইয়া দেখিল, দরোয়ান বুদ্ধি করিয়া পিওনকে সঙ্গে আনিয়াছে। সে খামখানা হাতে দিয়া দস্তখত লইয়া সেলাম করিয়া চলিয়া গেল।

গুণী তার পড়িয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। হেম খবর দিতেছে, সে রওনা হইয়া পড়িয়াছে, হুগলীতে নামিয়া ট্রেনে করিয়া আসিবে, সুতরাং বেলা তিন-চারটার সময় হাওড়া স্টেশনে যেন গাড়ি পাঠান হয়। সে কি জন্য আসিতেছে, সঙ্গে কে কে আছে, কিশোরীবাবু আছেন কিংবা সে একলাই আসিতেছে, কিছুই বোঝা গেল না। বাড়িতে স্ত্রীলোক কেহ ছিল না; মানদা সুলোচনার সহিত পশ্চিমে গিয়াছিল, তাই গুণী কিছু বিব্রত হইয়া পড়িল। পুরাতন কোচম্যান গাড়ি লইয়া গেল এবং সন্ধ্যার কিছু পূর্বে হেমকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। সঙ্গে দাসী চাকর এবং কিছু জিনিসপত্র ছিল। গুণী হেমকে দেখিয়া শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, এ কি-রকম পাগলের মত বেশ করে আসা হ’ল শুনি?

হেম ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল, ওপরে চল, বলচি। উপরে বসিবার ঘরে গিয়া স্থির হইয়া বসিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, মা ত মাঘ মাসের আগে ফিরবেন না?

গুণী বলিল, না, সেই রকমই ত লিখেছেন।

তা হলে তাঁকে এর মধ্যে আর জানিয়ে কাজ নেই। কিন্তু, আশ্চর্য দেখ গুণীদা, আজকের দিনেই বিদেয় হয়েছিলাম, আজকের দিনেই ফিরে এলাম।

গুণী বুঝিতে না পারিয়া বলিল, ফিরে এলাম কি?

হেম সহজভাবে বলিল, ফিরে এলাম বৈ কি! আর সেখানে কি করে থাকব? কেন, তুমি কি আমার থানকাপড় দেখেও কিছু বুঝতে পাচ্ছ না? পরশু কাজকর্ম শেষ হয়ে গেল, আজ চলে এলাম।

গুণী স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে বলিল, একটা খবরও ত দাওনি—কি হয়েছিল কিশোরীবাবুর?

হেম বলিল, ও-বুধবারের সন্ধ্যাবেলাতেই কলেরার লক্ষণ টের পাওয়া যায়। ওদেশে যতদূর সাধ্য চিকিৎসা করা গেল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হ’ল না। পরদিন বেলা দশটার সময় মারা গেলেন।

গুণী কিছুক্ষণ পরে অলক্ষ্যে আর্দ্রচক্ষু মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, কিন্তু মা শুনলে একেবারে মারা যাবেন। যতদিন তিনি জানতে না পারেন, ততদিনই ভাল।

হেম কহিল, কি করবে গুণীদা? তোমরা ভগবানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলে, সে কথা কেবল আমিই মনে মনে টের পেয়েছিলাম। তখন আমার কথা তোমরা গ্রাহ্য করলে না—এখন কান্না, আর হায় হায়!—খিদে পেয়েছে, কি খাই বল ত? কিন্তু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আর রাঁধতে পারব না—কিছু ফলমূল খেয়েই আজকের দিন কাটাই।

গুণী জিজ্ঞাসা করিল, ও বেলাতেও খাওয়া হয়নি?

না। সকালে স্টিমার ধরতে হয়েছিল।

মাঘের শেষে সুলোচনা ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু রোগমুক্ত হইয়া আসিতে পারিলেন না। তার পর ঘরে আসিয়া এই দৃশ্য দেখিয়া সেইদিনই আবার শয্যা গ্রহণ করিলেন। এ শোক তাঁহার বুকে শেলের মত বাজিল। চিকিৎসা ও শুশ্রূষার অন্ত রহিল না, কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হইতে চাহিল না। একদিন তাঁহার হাত-পা ফুলিয়া উঠিল দেখিয়া গুণী অতিশয় চিন্তিত হইল। সেদিন তিনিও গুণীকে নিভৃতে পাইয়া বলিলেন, আর কি হবে বাবা, চেষ্টা করে? আমাকে একটু শান্তিতে যেতে দে।

গুণী চোখের জল চাপিয়া বলিল, এমন কি হয়েছে মা, যে, একেবারেই তুমি নিরাশ হয়ে পড়েচ?

সুলোচনা বলিলেন, আচ্ছা, তুই বলে দে, আমার আশা করবার আর কি বাকি আছে?

গুণী মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল।

সুলোচনা বলিলেন, গুণী, আমি অত নির্বোধ নই বাবা। আমি জেনেশুনে যে পাপ করেচি, সেই পাপ আমাকে যেন ভিতর থেকে পলে পলে ভস্ম করে আনচে। ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া আবার বলিলেন, একটি কথা আমাকে সত্য করে বল্‌ গুণী। আমি বেশ জানি একদিন তুই আমার হেমকে স্নেহ করতিস, আর একবার চেষ্টা করলে কি তাকে আবার স্নেহ করতে পারিস নে?

গুণী মুখ নিচু করিয়া বলিল, তাকে ত চিরকালই স্নেহ করি মা! সেদিনও করেছি, আজও করি। তার জন্য তোমার কোন ভাবনা নেই, আমি বেঁচে থাকতে সে কোন দুঃখ পাবে না।

সুলোচনা বলিলেন, তা জানি। আচ্ছা, এই আমার শেষ আশীর্বাদ তোদের উপর রইল, যদি কোনদিন আবশ্যক হয়, এ-কথা তাকে বলিস। আর একটা কথা বাবা—এখানে থাকতে হেম আমাকে চিঠি লিখেছিল,—মা, যেখানে তুমি আছ, সে বাড়ির হাওয়া লাগলে সমস্ত নবদ্বীপ উদ্ধার হয়ে যেতে পারে। ও-বাড়িতে থেকেও যদি তোমাদের পুণ্যসঞ্চয় না হয়, বৈকুণ্ঠেও হবে না। আর বাবা, আমার মরণ-কালে আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ কর, যেন পাপমুক্ত হই। আমার অপরাধ যে কত বড় গুণী, সে আমি ছাড়া আর ত কেউ জানে না।

গুণী নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল। সে যথার্থই সুলোচনাকে মায়ের মত ভালবাসিত।

সুলোচনা বলিলেন, হেমকে আমি কোন কথাই বলে যেতে পারব না। তার মুখের দিকে তাকালেই আমার বুকের ভিতর হুহু করে জ্বলতে থাকে। লোকে সৎমার গল্প করে, আমি সৎমার চেয়েও তার শত্রু।

পরদিন অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হইল। তাঁহার বাঁচিবার আশা সকলেই ত্যাগ করিল। তাঁহার শ্বাসকষ্টের সূত্রপাতেই তিনি হেমকে কাছে ডাকাইয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিয়াই কাঁদিয়া ফেলিলেন।

হেম, তবে বিদায় হ’লাম মা!

হেম মায়ের বুকের উপর পড়িয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। কতক্ষণ পরে তিনি ইশারায় উঠিতে বলিয়া বলিলেন, কাঁদিস নে মা। সুখে-দুঃখে পনেরো বছর তোকে বুকে করে কাটিয়েছি; আজ সময় হয়েচে, তাই তোর বাপের কাছেই যাচ্ছি। আজ আমার সুখের দিন, আজ আমি কাঁদতাম না হেম, আজ হেসে আমোদ করে যেতাম, যদি না তোকে এমন করে নষ্ট করতাম। আমি লজ্জায়, দুঃখে তোর মুখের পানে যে চাইতেই পারচি না মা!

হেম কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, কেন অমন করে তুমি বলছ মা? আমার কপালে যা ছিল তাই হয়েচে, এতে তোমার হাত কি?

সুলোচনা বাধা দিয়া বলিলেন, আমার হাত ছিল, সে হাত আমি নিজের হাতেই কেটেচি। তুই বলচিস মন্দ কপাল, কিন্তু তোর কপালের মত ভাল কপাল এ রাজ্যে একটি মেয়েরও ছিল না মা, আমি যদি না মাঝে পড়ে সমস্ত নষ্ট করে দিতাম। আমি যে সমস্তই জানি; তাতেই ত এ দুঃখ রাখবার আর জায়গা খুঁজে পেলাম না। অজানা পাপের উপায় আছে, কিন্তু জেনেশুনে পাপ করার কোথায় মোচন পাব মা?

তাঁহার চোখ দিয়া টপটপ করিয়া বড় বড় অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। হেম আঁচল দিয়া তাহা মুছাইয়া দিলে, কিছুক্ষণ পরে সুলোচনা পুনরায় বলিলেন, মায়ের উপর রাগ রাখিস নে মা! পাছে এ কথা বললে তোর অকল্যাণ করা হয়, তাই বলতে পারলাম না; না হলে আজ মরণকালে হাতজোড় করে বলতাম—

হেম তাড়াতাড়ি তাঁহার মুখে হাত চাপা দিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল, কি করলে তুমি সুখী হও—আমাকে বল, আমি তাই করব। আমি ত কোনদিন তোমার অবাধ্য হইনি মা।

সুলোচনা অনেক কষ্টে তাঁহার অবশ হাতখানি হেমের মাথায় রাখিয়া বলিলেন, সেই জন্যই ত পুড়ে মরচি হেম। আমার যা বলবার, তা আমি গুণীকে বলেছি, দরকার হলে সে-ই তোকে বলবে। তুই কিন্তু আজ এই কাপড়খানা তোর ছেড়ে আয়। যে কাপড় পরে এক বছর আগে এই ঘরে এই খাটের উপর এসে বসতিস, যে-সব গয়না পরে আমাকে প্রণাম করতে এসেছিলি, আমার গুণীর দেওয়া সেই কাপড়, সেই গয়না পরে আমার সামনে আয়। একদণ্ডের জন্যেও আমার নিজের পাপ থেকে আমায় মুক্তি দে।

হেম নিঃশব্দে উঠিয়া গিয়া তাঁহার আদেশ পালন করিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিলে, তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্তে যেন ঈষৎ হর্ষের আভাস খেলা করিয়া গেল। তিনি অপেক্ষাকৃত সুস্থভাবে বলিলেন, মা, চৌত্রিশ বছর বয়সে আমার যে জ্ঞান কোনদিন হয়নি, সে জ্ঞান, সে বুদ্ধি এক নিমিষে হয়েছিল, যেদিন পশ্চিম থেকে ফিরে এসে তোকে প্রথমে দেখি। লোকে বলে, মাথায় বাজ পড়া; কি জানি মা, কি-রকম সে, কিন্তু সেদিন আমার যে ব্যথা বেজেছিল, তার অর্ধেক ব্যাথাও যদি বজ্রাঘাতে বাজে, ত, সে ব্যথা আমার পরম শত্রুর জন্যেও কামনা করিনে। আমার দিব্যি রইল হেম, এ বেশ আর খুলে ফেলিস নে। কি জানি, কোন্‌ পাষাণ বিধবার সাজ তৈরি করে গিয়েছিল, আজ আমি অভিসম্পাত করি, তাকে যেন আমার মত আঘাত বুক পেতে সইতে হয়। না না হেম, বাধা দিসনে, মা, কাল আমি আর বলতে আসব না। আজ তোকে বলি, যেন তোর বাপের কাছে গিয়ে তোকে দেখে সুখী হতে পারি।

তাঁহার আবার স্বর বদ্ধ হইয়া আসিল। হেম আঁচল দিয়া ধীরে ধীরে চোখ মুছাইয়া দিতে লাগিল। বাহিরে জুতার শব্দ শুনিয়া হেম মাথার উপরে কাপড় তুলিয়া দিতেই গুণী সাহেব-ডাক্তার লইয়া ঘরের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইল। সুলোচনা দেখিতে পাইয়া অধীরভাবে বলিয়া উঠিলেন, আবার ডাক্তার কেন গুণী? ঐখান থেকে ভিজিট দিয়ে ওকে বিদায় করে দিয়ে তুই আমার কাছে এসে একবার বোস।

গুণী বলিল, মা, অন্ততঃ একবার তোমার হাতটা—

না গুণী, না। আর আমাকে দগ্ধ করিস নে, যেতে দে ওকে।

সাহেব-ডাক্তার অত বুঝিল না। সে ঘরে ঢুকিয়া নিকটে চৌকি টানিয়া লইয়া থার্মোমিটার বাহির করিতে লাগিল।
সুলোচনা বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ওর বুদ্ধি দেখ! ও ঐটে দিয়ে আজ আমার জ্বর দেখবে! যা গুণী, নন্দাকে পাঠিয়ে দে, ভাল কবিরাজ ডেকে আনুক, কখন শেষ হবে আমাকে শুনিয়ে যাক। বলে দে যেন ওষুধপত্র না আনে।

সুলোচনা গ্যাসের আলো সহ্য করিতে পারিতেন না; তাই এ-ঘরে বরাবর মোমবাতি জ্বলিত। সন্ধ্যা হইলে দাসী সেজ জ্বালিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া গেলে, সুলোচনা বলিলেন, আজকের রাত্রিই বোধ করি শেষরাত্রি। তাই আজ যদি না সত্যি কথা স্পষ্ট করে বলতে পারি, আজ যদি না লজ্জা সঙ্কোচ ত্যাগ করে মুখের সঙ্গে বুকের সঙ্গে এক করে দেখতে পারি, তবে ভগবান যেন আমাকে আরও শাস্তি দেন। কিন্তু তিনি নির্দোষীকে যেন আর দুঃখ না দেন! আমার পাপের ফল যেন আমার ওপর দিয়েই শেষ হয়।

তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া থাকিয়া হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ‘উঃ’ করিয়া উঠিলেন, হেম ব্যস্ত হইয়া মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল, কি মা?

সুলোচনা আস্তে আস্তে বলিলেন, কিছুই নয় মা। শুধু কি তুই একা হেম, আমার গুণীর যে মুখ আমি চোখে দেখেচি—পাষাণেরও বোধ করি তাতে দয়া হত, কিন্তু আমার হয়নি, অথচ সে আমাদের কি না করেচে! থাক্‌, ও-সব কথা আর তুলব না। কোনদিন তার অবাধ্য হ’স্‌নে মা, কোনদিন তাকে দুঃখ দিসনে। এ কথাটা কোনদিন ভুলিস নে মা, ও-সব মানুষের বুকের ব্যথা স্বয়ং ভগবানের বুকে গিয়ে বাজে। তার যা ধর্ম, তোর ধর্মও তাই। এ আমার আদেশ নয় হেম, এ তাঁর আদেশ, যাঁর আদেশে তোরা একদিনের দেখাতেই চিরকালের মত এক হয়ে গিয়েছিলি। ছি মা, লজ্জা কি! যিনি অন্তর্যামী, যিনি বুকের ভিতর লুকিয়ে বসে কথা কন, তাঁকে অস্বীকার ক’রো না—তাঁকে অমান্য ক’রো না। তাঁর হুকুম আমার ভিতরেও কথা কয়েছিল, কিন্তু দর্প করে তা শুনিনি, অগ্রাহ্য করে অপমান করেছিলাম, তাই তার ফল পাচ্চি। কিন্তু তোদের ওপর আমার এই শেষ অনুরোধ রইল মা, আমার অন্যায়, আবার পাপকে চিরকাল স্বীকার করে আমার দুষ্কৃতিকে যেন অক্ষয় করে রাখিস নে।

মানদা আসিয়া বলিল, মা, কবিরাজ এসেছেন।

সুলোচনা আস্তে আস্তে বলিলেন, তাঁকে আসতে বল। হেম, তুই একবার বাইরে যা মা।

.

পাঁচ

মায়ের মৃত্যুর পর হইতেই হেমের আচার-ব্যবহারের আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা দিল। কাছে থাকিয়াও সে যেন প্রতিদিন নিজেকে কোন্‌ সুদূর অন্তরালের দিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। গুণেন্দ্র চিরদিন সহিষ্ণু ও নিস্তব্ধ প্রকৃতির লোক। এ পরিবর্তন সে প্রথমেই টের পাইল, কিন্তু নিঃশব্দে সহ্য করিয়া রহিল। অকস্মাৎ ধর্মের মধ্যে হেম কি রস পাইল, সে-ই জানে, সে নাটক, নভেল, কবিতার বই তুলিয়া রাখিয়া রামায়ণ, মহাভারত, গীতা ও উপনিষদের বাংলা অনুবাদের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করিয়া ফেলিল। মায়ের শপথ মনে করিয়া সে থান-কাপড় আর পরিল না বটে এবং কানের দুটি হীরার দুল, চুড়ি এবং হারও খুলিয়া রাখিল না সত্য, কিন্তু বৈধব্যের সমস্ত কঠোরতা অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত সে পালন করিয়া চলিতে লাগিল। সমস্ত রকমের বাহুল্য বর্জন করিয়া সে একবেলা রাঁধিয়া খাইত। এইটুকু সময় এবং গৃহিণীর প্রয়োজনীয় কর্ম সমাধা করিতে যেটুকু সময় লাগে, সেইটুকু ছাড়া সমস্ত সময়টা সে ধর্মচর্চায় অতিবাহিত করিতে লাগিল। যদি বা কোন সময়ে সে গুণীর কাছে আসিয়া বসিত, কিন্তু পরক্ষণেই কোন একটা কাজের নাম করিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইত। সে যে তাহার সঙ্গকে ভয় করিতে শুরু করিয়াছে, এই আকস্মিক ত্রস্ত পলায়নের দ্বারা তাহা এতই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিত যে, বহুক্ষণের নিমিত্ত গুণী শূন্যদৃষ্টিতে জানালার বাহিরে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া থাকিত। যত দিন কাটিতে লাগিল, তাহার আচার-বিচারের ছোটখাট কাজগুলা পর্যন্ত সুদৃঢ় আকার ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতে লাগিল। যেমন জেলের কর্তৃপক্ষ জেলের মধ্যে বেষ্টনের পরে বেষ্টন তুলিয়া তাহার বড় কয়েদীগুলির পরিসর ছোট করিয়া আনিতে থাকে, হেম যেন ঠিক তেমনি সতর্ক হইয়া তাহার হৃদয়বাসী কোন এক গভীর দুষ্কৃতকারীর চলাফেরার পথ অহরহ সঙ্কীর্ণ করিয়া আনিতে লাগিল।

একদিন সে হঠাৎ আসিয়া বলিল, গুণীদা, মন্তর নেব?

গুণী মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, কি মন্ত্র, গুরুমন্ত্র?

হাঁ।

গুণী হাসিয়া বলিল, ভয় নেই ভাই, তোমাকে আত্মরক্ষার জন্যে নিত্য নূতন কবচ আঁটতে হবে না।

হেম বোধ করি এ কথা বুঝিতে পারিল না; কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, গুরুমন্ত্রের দরকার নেই?

গুণী বলিল, আছে, কিন্তু সে বয়স এখনো তোমার হয়নি। তা ছাড়া, কে তোমাদের গুরু, সে ত আমি জানিনে।

হেম বলিল, সে গুরুতে আমার কাজ নেই, আমি তোমার কাছ থেকে দীক্ষা নেব।

গুণী আশ্চর্য হইয়া বলিল, আমার কাছ থেকে দীক্ষা নেবে? আমি দীক্ষার কি জানি হেম? তা ছাড়া তোমরা হিন্দু, আমি ব্রাহ্ম।

হেম বলিল, আমি সে জানিনে। মা বলেছিলেন, তোমার যা ধর্ম আমারও তাই ধর্ম। আচ্ছা গুণীদা, এ কথার অর্থ কি?

এ কথার কি অর্থ গুণী তাহা জানিত। কিন্তু তাহা না বলিয়া সহজভাবে সে বলিল, বোধ করি, তিনি বলছিলেন, সব ধর্মই এক।

হেম বলিল, কিন্তু সে ধর্ম ত এক নয়!

গুণী ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিল, হেম, এ-সব আলোচনা আমি কখনো পরের সঙ্গে করিনে।

হেম বলিল, কিন্তু আমি ত তোমার পর নই।

গুণী প্রত্যুত্তরে বলিয়া উঠিল, না, তুমি আমার পরমাত্মীয়, কিন্তু তোমার সঙ্গেও আমি এ-সমস্ত চর্চা করব না।

হেম হতাশভাবে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, যদি বলবে না, তবে আর কি করে শুনব?

গুণী তাহার মুখ দেখিয়া অনুতপ্ত হইয়া বলিল, তুমি কি শুনতে চাও?

হেম বলিল, গুণীদা, যেদিন আমি জোর করে তোমার পাতে বসে খেয়েছিলাম, তুমি সেদিন নিষেধ করে বলেছিলে, কাজটা ভাল করনি, যার যা জাত, তার তাই মেনে চলা উচিত, আজ বলচ, সব ধর্মই এক—কোন্‌টা সত্যি?

গুণী কহিল, সেদিন আমি সাধারণভাবেই বলেছিলাম। তবুও দুটো কথাই সত্য। জাত আর ধর্ম এক জিনিস নয়। একটা দেশাচার, লোকাচার, শুদ্ধমাত্র কালের বস্তু। কিন্তু অপরটা ইহকাল, পরকাল, দুই কালেরই বস্তু। কিন্তু তাই বলে ধর্ম মেনে চললেই যে জাত মেনে চলা হয়, তাও না, আবার জাত মেনে চললেই যে ধর্ম মানা হয়, তাও নয়। জাত না মেনে চলার দুঃখ আছে, সবাই সে দুঃখ সইতে পারে না, পারার প্রয়োজনও সব সময়ে হয় না—তাই তোমাকে আমি সেদিন ও-কথা বলেছিলাম। কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া বলিল, হেম, এ দুটো আলাদা, অথচ মিশে আছে। মিশে আছে বলেই দেশভেদের সঙ্গে ধর্মেরও নানা ভেদ হয়ে গেছে। ধর্মের যেটা গোড়ার কথা, সেটা পরকালের কথা, মরণই শেষ নয়, এই কথা। এই বনিয়াদের ওপর তুমি হিন্দু, তুমিও দাঁড়িয়ে আছ, আমি ব্রাহ্ম, আমিও দাঁড়িয়ে আছি। ঈশ্বরকেও সকল ধর্মে হয়ত মানে না, কিন্তু মরণ হলেই যে নিষ্কৃতি পাবার জো নেই, এ কথাটা নিগ্রোদের দেশ থেকে ল্যাপ্‌ল্যান্ডের দেশ পর্যন্ত সকল দেশের ধর্মই স্বীকার করে। মৃত্যুর পরের ভাবনা তাই তুমিও ভাব, আমিও ভাবি। হতে পারে, আলাদা রকম করে ভাবি, কিন্তু ভাবনার আসল বস্তুটা যে এক, এই কথাটা মা হয়ত মরণকালে তোমাকে উপদেশ দিয়ে গেছেন।

হেম অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, শুধু ভাবলেই ত হয় না, তার উপায় করাও ত চাই।

গুণী বলিল, চাই বৈ কি ভাই! এই উপায় বার করা নিয়েই এত দ্বন্দ্ব, এত গণ্ডগোল। তোমার উপায়টা আমি পছন্দ করিনে, আমারটা তুমি পছন্দ কর না। এটা অনুমানের জিনিস, প্রমাণের জিনিস নয় বলেই তর্ক শেষ হয় না, ঝগড়া থামে না। কিন্তু তোমার রাঁধবার সময় হ’ল যে, হেম?

হেম নিঃশব্দে ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল। গুণী শূন্যদৃষ্টিতে শূন্যের দিকেই চাহিয়া বসিয়া রহিল।

গুণীদা!

গুণী চমকিয়া মুখ ফিরিয়া বলিল, কি হেম?

হেম বলিল, আচ্ছা, আমি যে-পথে চলচি, সে কি ঠিক পথ?

কি করে বলব ভাই? সে কথা তুমিই জান। যদি আনন্দ পাও, শান্তি পাও, নিশ্চয়ই তা হ’ল ঠিক পথ!

কিন্তু আমি ত কিছুই পাইনে।

তাহার ব্যথিত কণ্ঠস্বরে গুণীর চোখ ফাটিয়া জল আসিতে চাহিল। সে বহুক্লেশে তাহা রোধ করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, তবে কর কেন?

হেম বলিল, কি জানি গুণীদা, কিসে যেন আমাকে টেনে নিয়ে যায়, যেন জোর করে করায়, আমি থামতে পারিনে।

গুণী কি বলিবে, হঠাৎ ভাবিয়া পাইল না, তার পর বলিল, হয়ত নূতন বলেই প্রথমে সুখ পাচ্ছ না, শেষে নিশ্চয় পাবে।

হেম উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, পাব?

নিশ্চয় পাবে। ধর্মে যদি সুখ-শান্তি না পাও, তবে আর কিসে পাবে? আমি আশীর্বাদ করি, একদিন নিশ্চয় তুমি সুখী হবে।

দিন-দুই পরে জ্যোৎস্নার আলোয় খোলা ছাদের উপর পাটি পাতিয়া গুণী চুপ করিয়া শুইয়া ছিল। হেম আসিয়া পায়ের কাছে বসিয়া পড়িল,—তোমার পায়ে হাত বুলিয়ে দেব গুণীদা?

গুণী ‘দাও’, বলিয়া চোখ বুজিয়া রহিল। চন্দ্রালোকে দীপ্ত হেমের মুখের দিকে সে চাহিতে সাহস করিল না। হেম নিঃশব্দে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে হঠাৎ বলিল, গুণীদা, বিধবার বিয়ে হওয়া কি ভাল?

গুণী চোখ বুজিয়াই বলিল, তুমি কি বল?

হেম বলিল, আমি ত বলতে আসিনি, শুনতে এসেছি।

গুণী বলিল, পায়ে হাত বুলোনটা বুঝি তার ভূমিকা?

হেম সহজভাবে বলিল, না তা নয়। তোমার পায়ের কাছে বসলেই আমার হাত দেবার লোভ হয়।

গুণী চুপ করিয়া রহিল। নিজের জিভকে সে বিশ্বাস করিতে পারিল না।

হেম বলিল, কৈ, বললে না?

গুণী তথাপি চুপ করিয়া রহিল।

হেম পায়ের তলায় একটি ক্ষুদ্র চিমটি কাটিয়া বলিল, বল শিগগিরি।

গুণী বলিল, বলব, কিন্তু আগে আমার কথার জবাব দাও।

কি?

তোমার স্বামীকে তুমি ভালবাসতে কি?

একটুও না। সে কথা আমার কোনদিন মনেও হয়নি। সেখানকার একটি পয়সার জিনিস সঙ্গে আনিনি, তাদের দেওয়া একখানি কাপড় পর্যন্ত পরে আসিনি। পেটে যা খেয়েছি, তার চতুর্গুণ দিয়ে এসেছি—এমনি তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক।

গুণী বলিল, কিন্তু যারা সতী-লক্ষ্মী তারা নিজেদের স্বামীকে ভালবাসে। বিধবা হলে তাঁর মুখ মনে করে আর বিয়ে করে না। তোমার মার মত তাঁরা মরণকালে ‘স্বামীর কাছে যাচ্ছি’ মনে করেন।

হেম বলিল, আমাকে তোমরা জোর করে ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়েছিলে। আমিও সতীলক্ষ্মী, তাই মরণ-কালে আমি তোমার কাছে যাচ্ছি, এই কথাই মনে করব। আচ্ছা গুণীদা, মরে কি তোমার কাছে যেতে পারব?

তাহার কথার মধ্যে জড়তা নাই, দ্বিধা নাই, লজ্জার লেশমাত্র নাই, এ যেন কাহার কথা কে বলিয়া যাইতেছে। তখনকার হেমের সহিত আজিকার হেমের যেন সংস্রব পর্যন্ত নাই। গুণী স্তম্ভিত হইয়া রহিল। হেম বলিল, বল, তোমার কাছে যেতে পারব কি না?

গুণী বলিল, না।

না—কেন?

গুণী কহিল, আমার কর্মের ফল আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, সে আমি জানি না, তোমার কর্মফল তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, সে তুমিও জান না। আমার কর্মদোষে হয়ত পশু হয়ে জন্মাব, তুমি হয়ত আবার বামুনের মেয়ে হয়ে জন্মাবে, তখন আমাকে কি করে পাবে ভাই? কর্মফল যদি সত্য হয়, স্বামী-স্ত্রীর চিরসম্বন্ধ কোনমতেই সত্য হতে পারে না। আমাদের এই কাল্পনিক সম্বন্ধ ত অতি তুচ্ছ! কত ভেদ, কত পার্থক্য, কত উঁচু-নিচু চোখের উপরেই দেখতে পাচ্ছ, এগুলো হয়ত কর্মেরই ফল। একে কোন ভালবাসার টানই নিরাকরণ করে দিতে পারে না। এ সংসারে কত পাষণ্ড স্বামীর সতী-সাধ্বী স্ত্রী থাকে, স্বামীটা হয়ত মরে গরু হয়ে জন্মায়—এ তোমাদেরই শাস্ত্রের কথা,—তুমি কি কামনা কর হেম, সতী-সাধ্বী স্ত্রী, তারা সারা-জীবনের সুকর্মের অন্তে এই গরুর সঙ্গে গোয়ালে গিয়ে বাস করে? সে হয় না।

তা হলে ভাল কাজ, মন্দ কাজের অর্থ থাকে না। স্ত্রী নিজের কর্মে স্বর্গে যায়, স্বামী হয়ত জন্ম জন্ম নরক ভোগ করে—হাজার কামনা করলেও আর এক হবার উপায় থাকে না।

হেম বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, তবে কি সত্যিই আর মেলবার পথ থাকে না?

গুণী বলিল, না। তার আবশ্যকও থাকে না। তার চেয়ে হেম, যে মেলা সবচেয়ে বড় মেলা, যার কাছে যেতে পারলে আর কারো কাছে যেতে ইচ্ছে হবে না, অথচ সমস্ত রকমের মিলনের ইচ্ছাই আপনা -আপনি পরিপূর্ণ, সার্থক হয়ে যাবে, তুমি সেই মিলনের কামনা কর। তোমার পথ থেকে তোমাকে কেউ যেন টেনে নিয়ে না যায়; আমি কায়মনে আশীর্বাদ করি, আমাদের দেওয়া সমস্ত দুঃখ একদিন যেন তোমার সার্থক হয়।

চাঁদের আলোয় হেম দেখিতে পাইল, গুণীর চোখ দিয়া ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িতেছে। সে পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া গেল। সে উঠিয়া গেল, এমন অনেক দিনই এমনি করিয়া নিঃশব্দে উঠিয়া গিয়াছে, কিন্তু আজ যেন কেমন করিয়া গুণীর সমস্ত সংযম, সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ সে সমূলে উৎপাটিত করিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে। আজ তাহার ধিক্কারের সহিত কেবলি মনে হইতে লাগিল, যেন চিরদিনের সুযোগ অকস্মাৎ চোখের সামনে দিয়া বহিয়া গেল, হাত বাড়াইয়া ধরা হইল না। হেম তাহাকে যে কত ভালবাসে, এ কথা সে নিঃসংশয়ে জানিত। আজ তাহার মুখ হইতে স্পষ্ট করিয়া শুনিয়াও, সে কোনমতেই নিজের কথাটা বলিতে পারিল না। সুলোচনার মৃত্যু হইতেই বলি-বলি করিয়াছে, বলিতে পারে নাই। কেবলি মনে হইয়াছে, এ যেন কোন বিষধর সর্প ঘুমাইয়া আছে, হাত বাড়াইয়া স্পর্শ করিলেই বুঝি ফণা তুলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবে। তাই বরাবর যে ভয় তাহার হাত চাপিয়া রাখিয়াছে, আজিকার এমন রাত্রেও সেই ভয় তাহেকে হাত বাড়াইতে দিল না।

প্রত্যহ প্রাতঃস্নান করিয়া হেম প্রণাম করিতে আসিত, পরদিন আসিবামাত্রই গুণী সমস্ত সঙ্কোচ প্রাণপণে অতিক্রম করিয়া প্রশ্ন করিল, হেম, কাল তুমি বিধবা-বিবাহের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে কেন?

হেম বলিল, একটা খবরের কাগজে পড়ছিলাম, তাই।

গুণী বলিল, তুমি কি ওটা ভাল মনে কর?

হেম সংক্ষেপে বলিল, ছিঃ! ও কি আবার একটা বিয়ে?

গুণী প্রশ্ন করিল, কেন নয়? এক হিন্দু ছাড়া পৃথিবীর সব জাতের মধ্যেই ত বিধবা-বিবাহ আছে।

থাক গে, বলিয়া হেম বাহির হইয়া যাইতেছিল, গুণী ডাকিয়া বলিল, আর একটা কথা আছে, হেম!

হেম ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কি?

তোমার বয়স কত?

ষোল।

এই বয়স থেকে চিরকাল সন্ন্যাসিনী হয়ে থাকবে?

হেম মৃদু হাসিয়া বলিল, আর কি করব? যেমন কপাল! যেমন তোমাদের বুদ্ধি!

গুণী ক্ষণকাল মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আর কি কোন পথ নেই, কোন উপায় নেই?

কিছু না গুণীদা, কিচ্ছু না, বলিয়া হেম বাহির হইয়া গেল।

দিন দিন পরিপূর্ণ যৌবন যেমন হেমের সর্বদেহে কানায় কানায় ভরিয়া উঠিতে লাগিল, তাহার ধর্ম-কর্মও যেন সে-সমস্ত ছাপাইয়া চলিতে লাগিল। গুণী সমস্তই দেখিতে পাইত, কিন্তু সাহস করিয়া কিছুই বলিতে পারিত না। হেমের মধ্যে এমন একটা বস্তু ছিল, যাহাতে সকলেই তাহাকে মনে মনে ভয় করিয়া চলিত। তাহার মাও তাহাকে ভয় করিতেন, গুণীও ভয় করিত। উহার কয়েকদিন পরে একদিন গুণী আদালতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল, এমন সময় হেম আসিয়া আলমারি খুলিয়া চেক বই বাহির করিয়া হাতে দিয়া বলিল, ফিরবার সময় ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ শ টাকা সঙ্গে করে এনো।

গুণী, ‘আচ্ছা’ বলিয়া বইখানা পকেটে রাখিয়া দিল।

হেম কহিল, রোসো, সংসার-খরচের টাকাও কমে গেছে, আর দু’শ অমনি ঐ সঙ্গে এনো।

গুণী কিছু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ পাঁচ শ টাকা তবে কিসের জন্যে?

হেম বলিল, ও টাকা? আমি কাল কাশী যাব যে!

গুণী চৌকির উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, কাল কাশী যাবে? এ বিষয়ে কারো মত নেওয়াও আবশ্যক মনে কর না?

হেম অপ্রতিভ হইয়া বলিল, তোমার হুকুম নিয়ে তবে ত যাব।

গুণী বলিল, ঠিক করেচ, কাল যাবে, আবার কবে হুকুম নেবে শুনি? সঙ্গে কে যাবে?

হেম বলিল, মানদা, নন্দা আর দরোয়ান যাবে। আজ রাত্তিরে তোমাকে বলব মনে করেছিলাম। গুণীদা, যাব কাল?

আচ্ছা, যেয়ো, বলিয়া গুণী আদালতে চলিয়া গেল।

সন্ধ্যার পরে হেম নোট টাকা চাবিবন্ধ করিয়া রাখিয়া গুণীর কাছে আসিয়া বলিল, কাল যাওয়া হ’ল না।

কেন?

আজ দুপুরবেলা বামুনঠাকুরের ঘর থেকে টেলিগ্রাফ এসেছিল, তার মায়ের ব্যামো। আমি তিন মাসের মাইনে দিয়ে তাকে ছুটি দিয়েচি, সে চলে গেছে।

রাঁধবে কে?

যতদিন লোক না পাওয়া যায়, ততদিন আমিই রাঁধব। গুণীদা, তুমি একটি বিয়ে কর।

কেন?

কেন আবার কি? বিয়ে করবে না—সংসার চালাবে কে? তোমাকে দেখবে শুনবে কে?

তুমি।

হেম হাসিয়া বলিল, আমি বুঝি চিরকাল এই সংসার ঘাড়ে করে থাকব? আমাকে কাজ করতে হবে না?

আমাকে দেখাশোনা বুঝি কাজ নয়?

হেম হাসিমুখে বলিল, তোমার সঙ্গে তর্ক করে আমি পারিনে। না, না, সে হবে না। তোমাদের বেশ বড় মেয়ে পাওয়া যায়। দেখেশুনে একটি বিয়ে কর, আমি তার হাতে সংসার দিয়ে কাশী যাই।

গুণী বলিল, আচ্ছা তুমিও একটি বিয়ে কর, আমিও করি।

এইমাত্র হেম হাসিতেছিল, একমুহূর্তে তাহার সমস্ত হাসি যেন উড়িয়া গেল। সে গম্ভীর হইয়া বলিল, ছিঃ, ও কি তামাশা গুণীদা? কোনদিন ও-কথা মুখেও এনো না।

গুণী আর কথা কহিতে পারিল না, মুখপানে চাহিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। হেম উঠিয়া গেল।

.

ছয়

মাস-দুই কাশী থাকিয়া, গুণীর অসুখের সংবাদ পাইয়া হেম বাড়ি আসিল। সে আসিয়া না পড়িলে অসুখ হয়ত কঠিন হইয়া দাঁড়াইত। আসিয়া শুশ্রূষা করিয়া কিছুদিনের মধ্যেই তাহাকে সুস্থ করিয়া তুলিল।

বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছিল। গুণী শয্যার উপর বসিয়া সার্সীর ভিতর দিয়া তাহাই দেখিতেছিল। আর ভাবিতেছিল, হেমের কথা। একটা পরিবর্তন তাহার চোখে পড়িয়াছিল। হেম পূর্বে প্রত্যহ নিয়মিত প্রণাম করিয়া যাইত, এবারে সেটা আর দেখা গেল না। মানদাকে দিয়া হেমকে সে ডাকিতে পাঠাইয়াছিল; মানদা আসিয়া বলিল, দিদিঠাকরুন জপ কচ্ছেন।

ঘণ্টা-দুই পরে হেম ঘরে ঢুকিয়া বলিল, আমাকে ডাকছিলে?

গুণী বলিল, হাঁ, একটু ব’সো।

হেম কহিল, কিন্তু এখনো যে আমার জপ সারা হয়নি।

দু’ ঘণ্টাতেও জপ সারা হয়নি?

দু’ ঘণ্টাতে কি হবে? গুরু বলেছেন, অন্ততঃ দু’হাজার জপ করা চাই।

গুরু বলেচেন? গুরু কে?

হেম বলিল, আমি যে এবার কাশীতে মন্ত্র নিয়েছি। আমার গুরু, কাশীবাসী সন্ন্যাসী। আহা, তাঁকে দেখলে আর সংসারে ফিরতে ইচ্ছে করে না। আবার কতদিনে তাঁর চরণ-দর্শন পাব তাই ভাবি। মনে করচি, কাল-পরশুর মধ্যেই ফিরব।

গুণী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কাল-পরশুর মধ্যে কি করে ফিরবে? আমি ত এখনো বেশ সারিনি হেম, আমাকে দেখবে কে?

হেম একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, ও কিছু নয়,—ওটুকু দু’দিনেই সেরে যাবে।

গুণী বলিল, অন্ততঃ সে দুটো দিন ত তোমাকে থাকতে হবে।

আচ্ছা, না হয় থাকব। বলিয়া হেম চলিয়া যাইতেছিল, গুণী ডাকিয়া বলিল, শোন, কাল-পরশুই যেয়ো, কিন্তু আবার কতদিনে ফিরবে?

এখন বোধ হয় শীঘ্র ফিরতে পারব না। আমাকে তুমি মাসে এক শ টাকা করে পাঠিয়ো তাতেই চলে যাবে, তার কমে হবে না।

গুণী বলিল, টাকার কথা ত হচ্চে না, হেম! তোমার এক শ টাকার জায়গায় দু’শ টাকা লাগলেও আমি পাঠাব। কিন্তু সত্যিই কি তুমি আর ফিরবে না?

কি করতে আর ফিরব?

যদি আমার মৃত্যুসংবাদ পাও, তা হলে ফিরবে?

হেম ব্যথিত হইয়া বলিল, ও কি কথা গুণীদা?

গুণী বলিল, বলা যায় না ভাই, তাই সময় থাকতে বলে রাখা ভাল। আমার উইলের মধ্যে তোমাকে টাকা দেবার ব্যবস্থা থাকবে। আর থাকবে এই বাড়িটা। যদি কখন এদেশে এস, এই বাড়িতে এই ঘরে শুয়ো, এই আমার অনুরোধ।

হেম কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু তাহা চাপিয়া গিয়া বলিল, আমি বলচি গুণীদা, তোমার কোন ভয় নেই। এখন শরীরটা দুর্বল বলেই ও-সব মনে হচ্ছে।

বোধ হয়, তাই হবে, বলিয়া গুণী বাহিরের বৃষ্টির দিকে চাহিয়া রহিল। হেম বিষণ্ণমুখে বাহির হইয়া গেল।

সন্ধ্যার কিছু পরে দ্বারের বাহির হইতে ঘরের মধ্যে অন্ধকার দেখিয়া হেম রাগিয়া উঠিয়া ডাকিল, নন্দা, বাবুর ঘরে আলো জ্বেলে দিসনি?

গুণী ভিতর হইতে কহিল, আমি মানা করেছিলাম।

নন্দা ছুটিয়া আসিলে হেম তাহাকে একটা সেজ জ্বালিয়া আনিতে বলিয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে ঠাহর করিয়া গুণীর পায়ের কাছে খাটের উপর গিয়া বসিল। নন্দা ঘরে আলো জ্বালিয়া দিয়া গেলে হেম গুণীর পায়ের উপর হাত রাখিতেই, সে পা সরাইয়া লইল। হেম ব্যথা পাইয়া বলিল, তুমি কি আর আমাকে পায়ে হাত দিতে দেবে না?

গুণী বলিল, কাজ কি ভাই, তোমার গুরুর হয়ত নিষেধ থাকতে পারে।

হেম বুঝিল যে, সে আসিয়া অবধি পায়ের ধূলা লয় নাই, গুণী তাহার লক্ষ্য করিয়াছে। কিন্তু উত্তর দিতেও পারিল না, চুপ করিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, গুণীদা, আমার ওপর রাগ করেছ?

আমি কি কোনদিন তোমার উপর রাগ করেছি হেম?

হেম তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হইয়া বলিল, কোনদিন না—কিন্তু আজ ও-সব কথা বলছিলে কেন?

কি কথা ভাই?

উইল করার কথা, আরো কত কি কথা,—আমি বলচি গুণীদা, তুমি ভাল হয়ে যাবে। তুমি কিছু ভয় করো না।

গুণী একটুখানি হাসিয়া বলিল, ভাল না হওয়ায় আমার কি খুব ভয় বলে তোমার মনে হয়?

হেম কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি ও-সব কথা বলো না। তুমি ভাল না হলে আমি বাঁচব কি করে?

তুমি চলে গেলেই বা আমি বাঁচব কি করে? তাই, যদি ধরে রাখি, যদি যেতে না দি।

হেম ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিল, আমাকে ধরে রেখে তোমার লাভ কি?

লাভ! গুণী আর বলিতে পারিল না, নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। বাহিরের বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পটপট শব্দে সার্সীর গায়ে আঘাত করিতে লাগিল। এক-একবার দমকা হাওয়া খোলা দরজার ভিতর দিয়া আসিয়া সেজের বাতির আলো নিবাইবার উপক্রম করিতে লাগিল। নীচে চাকরদের অস্পষ্ট কোলাহল শুনা যাইতে লাগিল। তবুও দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রসিল। গুণী শিশুকাল হইতে অত্যন্ত অভিমানী, অত্যন্ত সংযমী। তাহার ধৈর্যের বাঁধ সে সুদৃঢ় করিয়াই গড়িয়া তুলিয়াছিল, কিন্তু সুলোচনার শেষ আশীর্বচন সেই বাঁধের ভিত্তিমূলে সেইদিন হইতে মুষিকের মত নিরন্তর বিবর খুঁড়িয়া নদীর জল ভিতরে প্রবেশ করাইয়া বহুদূরব্যাপী ভাঙ্গন সৃষ্টি করিতেছিল, কবে কখন যে সমস্তটা ধসিয়া যাইবে তাহার স্থিরতা ছিল না।

উন্মত্ত বাহ্য প্রকৃতির দিকে চাহিয়া একবার, সে গোড়া হইতে শেষ পর্যন্ত কথাগুলো আলোচনা করিয়া দেখিতে চাহিল, কিন্তু তাহার রুগ্ন দেহ, দুর্বল মস্তিষ্ক কোন কথাই যেন পরিষ্কার করিয়া বুঝিতে দিল না।

হেম হঠাৎ বলিল, গুণীদা, চুপ করে রইলে যে, কি ভাবছ?

কিছু না, কিছু না, আমার কথা তোমাকে বলবার নয়—তুমি বুঝবে না। কিন্তু যদি কোনদিন তোমার মতি ফেরে, আর তখনও যদি আমি বেঁচে থাকি—এসো।

হেম একটু সরিয়া বসিয়া বলিল, আমি সমস্ত বুঝেচি। হা অদৃষ্ট! যে রক্ষক, সে-ই ভক্ষক! শেষকালে তুমিই আমাকে দুর্গতির পথে টেনে আনতে চাও!

গুণী এতক্ষণ একটা মোটা বালিশে হেলান দিয়াছিল, তাহার চোখ জ্বলিয়া উঠিল; উঠিয়া বসিয়া বলিল, ছিঃ হেম, বুঝে কথা কও! ও কি বলচ?

হেম তড়িৎবেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বুঝেই বলচি। তুমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যা বলচ, আমি স্পষ্ট করে তোমার মুখের সামনেই তা বলি। তুমি আমাকে নষ্ট করতে চাও! বিধবার আবার বিয়ে কি গুণীদা? আমি এত শিশু নই যে, ধর্মের ভান করলেই অধর্মের পথে পা বাড়িয়ে দেব। আমি তোমার টাকা চাইনে, আশ্রয় চাইনে, কিছু চাইনে, আমার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে উঠান ঝাঁট দিয়ে খাই, সেও ভাল, কিন্তু এ ঐশ্বর্যে আমার কাজ নেই। এ কুমতি আমার যেন না হয়! সেদিন বুদ্ধি তোমার ছিল কোথায়? সেদিন এমনি করে বলতে পারনি?

গুণী স্থির হইয়া বসিয়া বলিল, হেম, দোষ হয়েছে, আমাকে মাপ কর। আমি পীড়িত—সে-কথাটা একবার ভাব।

ভেবেচি। মাপ তোমাকে আজ না হয়, দু’দিন পরে করবই, কিন্তু তোমার সংস্রব আর রাখব না। কাল আমি সেইখানেই ফিরে যাব, যেখানে থেকে দর্প করে চলে এসেছিলাম। যেমন করে পারি, সেখানেই পড়ে থাকব। মনে করব, সেই আমার কাশী, সেই আমার বৈকুণ্ঠ। তুমিও আমাকে মাপ কর গুণীদা, আমি চললাম।

হেম চলিয়া গেল, গুণী উঁচু হইয়া বসিয়া রহিল—বজ্রাহত তালবৃক্ষ যেমন করিয়া থাকে, তেমনি করিয়া! সমস্ত অভ্যন্তরে দগ্ধ রন্ধ্র লইয়া কবন্ধের মত যেভাবে খাড়া হইয়া থাকে, সেইভাবে! তাহার শুইয়া পড়িবার শক্তিটুকু পর্যন্ত যেন আর নাই।

.

সাত

আবার দুর্গাপূজা ফিরিয়া আসিয়াছে। অতি প্রত্যূষে জানলা খুলিয়া দিয়া হেম পূর্বদিকের অরুণ রক্তচ্ছটার দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। এ পাড়ার কোথায় রোশনচৌকির সানাইয়ের বিভাস শরতের সমস্ত করুণার সহিত মিলিয়া তাহার সর্বদেহে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হইতেছিল। অজ্ঞাতসারে তাহার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। কতদিন হইয়া গিয়াছে, সে গুণীর কোন সংবাদ পায় নাই—সে মনে মনে ভাবিল, কে জানে গুণীদা আমার কোথায়, কেমন আছে। চলিয়া আসিবার সময় গুণী কাঁদিয়া বলিয়াছিল, হেম, আর দুটো দিন থাক—রাগ করে যেয়ো না। অভিমানীর চোখের জলের হেম সেদিন কোন মূল্য দেয় নাই। সেদিন পীড়িত রুগ্নদেহ সত্ত্বেও গুণী পথের ধার পর্যন্ত নামিয়া আসিয়া বলিয়াছিল, হেম, তোমার মন কখনই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই, যে কারণে হোক বিকৃত হয়ে উঠেছে—তাই অনুরোধ করচি, ফিরে এসে আর একটা দিনও থাক। হেম শোনে নাই, গাড়িতে উঠিয়া বসিয়াছিল। গুণী গাড়ির জানালার ধারে আসিয়া শেষ মিনতি জানাইয়া বলিয়াছিল, হেম, হয়ত এই কাজটা তোমার চিরকাল শেলের মত বিঁধে থাকবে—আমার জন্য বলছি নে ভাই, তোমার নিজের জন্যেই বলছি, আজকের মত গাড়ি থেকে নেমে এস। তাহার উত্তরে হেম কোচম্যানকে গাড়ি হাঁকাইয়া দিতে বলিয়াছিল, হেম ফিরিয়া আসিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল এবং অনেকক্ষণ ধরিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া মাথার সমস্ত চুল ভিজাইয়া শেষে ঘুমাইয়া পড়িল। এত দুঃখের একটা কারণও ঘটিয়াছিল। তীর্থে যাইবার সঙ্কল্প করিয়া সে কাল দাসীকে দিয়া বাটীর সরকারের নিকট পঞ্চাশটি টাকা চাহিয়া পাঠাইয়াছিল। সরকার ফিরাইয়া দিয়া বলিয়া পাঠাইয়াছিল, ছোটবাবুর হুকুম ব্যতীত দিতে পারিবে না। হেম দেবরের সহিত কথা কহিত না, আড়ালে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিল, আমি চেয়ে পাঠালে কি পঞ্চাশটা টাকা সরকার দিতে পারে না?

দেবর উত্তর করিয়াছিল, না; আপনি শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের অধিকারিণী—টাকা পেতে পারেন না।

হেম বলিয়াছিল, কি পেতে পারি, না পারি, সে আমি জানি ঠাকুরপো! তোমার সঙ্গে টাকার জন্যে বিবাদ করতে, মামলা-মকদ্দমা করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। কিন্তু আমাকে অত নিরুপায় তুমি মনে ক’রো না। এনে দিতে ইচ্ছে হয় দাও, না হলে বলচি তোমাকে, টাকার যদি কোন জোর থাকে, শত্রুতা করে আমি তোমার বাড়ির এক-একটা ইট তুলে নিয়ে গিয়ে ঐ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসব।

তাহার কিছুক্ষণ পরেই টাকা আসিয়া পৌঁছিল, কিন্তু হেম গ্রহণ করিল না, রাগ করিয়া উঠানের মাঝখানে ছড়াইয়া ফেলিয়া দিয়া ঘরে দোর দিয়া শুইল; সমস্তদিন খাইল না, উঠিল না, মনে মনে কাহাকে স্মরণ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। বেলা তখন সাতটা বাজিয়া গিয়াছে, তখন ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া স্নান সারিয়া আসিয়া হেম আহ্নিক করিতে বসিতেছিল, দাসী আসিয়া সংবাদ দিল, বৌমা, তোমার ভাইয়ের বাড়ি থেকে চার-পাঁচ জন তত্ত্ব নিয়ে এসেচে। বলিতে বলিতেই মানদা আসিয়া প্রণাম করিল।

হেম একবারমাত্র তাহার মুখপানে চাহিয়া সব ভুলিয়া ছুটিয়া গিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া উঠিল। কাল হইতেই তাহার চোখের জল শুকায় নাই, আজ অকস্মাৎ মানদাকে পাইয়া তাহার প্রায় এক বৎসরের রুদ্ধ-অশ্রু বন্যার মত সব ভাসাইয়া দিল। মানদাকে নিজের ঘরের মধ্যে টানিয়া লইয়া গিয়া বলিল, গুণীদা কি চিঠি লিখে দিয়েছে, আমাকে দে।

মানদা কহিল, তিনি ত চিঠি দেননি!

হেম যেন বিশ্বাস করিতে পারিল না, বলিল, দেননি?

মানদা বলিল, না দিদিমণি! তিনি কি উঠতে পারেন যে, চিঠি লিখবেন!

হেম পাংশু হইয়া গিয়া বলিল, উঠতে পারেন না, কি হয়েছে তাঁর?

তুমি কিচ্ছু জান না?

না, বল।

মানদা বলিল, আর কি বলব? বলিয়াই কাঁদিতে লাগিল।

হেম রূক্ষভাবে বলিল, কাঁদিস পরে—এখন বল্‌।

সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, বলবার কিছুই নেই দিদি। তুমি চলে আসার পরের দিনই আবার জ্বরে পড়েন, ভাল হন, আবার জ্বরে পড়েন, আবার ভাল হন,আবার জ্বরে পড়েন—ফিরে গিয়ে যে দেখতে পাব, এমন ভরসাও করিনে।

হেম বলিল, তার পরে বল্‌।

মানদা বলিল,তার পরে কোথায় বর্ধমান না কোথা থেকে খবর পেয়ে,কোথাকার মাসী আসে,তার পরে মেসো, তার পরে মাসতুতো ভাই,বৌ,বোন,ভগিনীপতি,এখন আর কেউ বাকী নেই। বাড়িতে আর জায়গা নেই।

আমি সব বিদেয় করব—তার পর?

খাচ্ছে, দাচ্ছে, বসে আছে। বাবু ওপরে পড়ে আছেন, না ডাক্তার, না বদ্যি, না ওষুধ, না পথ্যি! শুনি, হাওয়া বদলালে ভাল হয়, তা নিয়ে যায় কে?

হেম বলিল, তোরা কি কচ্ছিস? নন্দা নিয়ে যায়নি কেন?

মানদা কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, সে-ই বাবুর অনেকদিনের চাকর, তাকে মেসোবাবুর ছেলে অভয় মেরে তাড়িয়ে দিয়েচে—ছোঁড়া আবার মদ খায়—এক-একদিন বাড়িতে এসে এমন হাঙ্গামা করে যে, ভয়ে কেউ বেরুতে পারে না—তাকে আমাদের বাবু পর্যন্ত ভয় করেন।

হেম ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, মানু, একটা কথা সত্যি বল দিদি, আমার গুণীদা কি তাহলে বাঁচবে না?

মানদা বলিল, কেন বাঁচবেন না দিদি, দেখালে শোনালে, চেষ্টা করলে নিশ্চয় ভাল হবেন—কিন্তু অমন করে ফেলে রাখলে আর ক’দিন?

হেম মিনিট-খানেক চোখ বুজিয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, মানদা, তোদের ফিরে যাবার টাকা আছে?

আছে বৈ কি দিদি! জানোই ত, বাবু এক টাকার দরকার থাকলে সঙ্গে দশ টাকা দিয়ে পাঠান—আমাদের ভাড়া আমার কাছেই আছে। বলিয়া সে আঁচলে বাঁধা নোট দেখাইল।

হেম জিজ্ঞাসা করিল, কবে যাবি? কাল?

মানদা বলিল, হাঁ দিদি, কালই যেতে হবে—আমি যা একটা লোক আছি, না হলে সবাই নতুন—কেউ টিকতে পারে না। যেমন মাসী, তেমনি মেসো, তেমনি ছেলে, তেমনি ঝি-বৌ—বিধাতা-পুরুষ যেন ফরমাশ দিয়ে এঁদের এক ছাঁচে ঢেলেছিলেন। আমার নাকি বড় শক্ত প্রাণ, তাই এখনও টিঁকে আছি—অভয় ছোঁড়া আমাকেই একদিন তেড়ে মারতে এসেছিল—বাবুকে বলে, ও মলেই বাঁচা যায়!

হেমের চোখের মধ্যে আগুন জ্বলিতে লাগিল,—বলিল, আগে যাই। আজ স্টিমার কখন ফিরে যাবে জানিস?

মানদা বলিল, আর ঘণ্টা-খানেক পরেই ফিরবে, আমি ঘাট থেকে জেনে এসেছি।

তবে এতেই যাব। তুই গাড়ি ডেকে আন গে।

তুমি যাবে দিদি? আজ ত সুদিন নয়।

বেশ দিন। দেরি করিস নে—গাড়ি ডেকে আন।

সেইদিন অপরাহ্নবেলায় ছেলে অভয়কে খাবার দিয়া মা কাছে বসিয়া আর দুইখানা লুচি খাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছিলেন। তাহার পাশ দিয়াই তেতলায় উঠিবার সিঁড়ি। অপরিচিতা হেমকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া মাসী প্রশ্ন করিলেন, তুমি কে গা বাছা?

আমি বিদেশী, বলিয়া হেম উপরে উঠিয়া গেল। অভয় তাহার আশ্চর্য রূপের দিকে নেকড়ে বাঘের মত চাহিয়া রহিল।

হেম গুণীর ঘরে গিয়া দেখিল, সে দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া শুইয়া আছে। জাগিয়া আছে কি ঘুমাইতেছে, বোঝা গেল না। শিয়রের কাছে চাবির গোছাটা পড়িয়া ছিল, হেম সর্বাগ্রে সেটা নিজের আঁচলে বাঁধিয়া ফেলিল। একটা টেবিলের উপর গোটা-দুই খালি ঔষধের শিশি ছিল, তুলিয়া লইয়া দেখিল, লেবেলের গায়ে পনের দিন পূর্বের তারিখ দেওয়া আছে। সমস্ত ব্যাপারটা সে স্পষ্ট বুঝিল। তার পর লোহার সিন্দুক খুলিয়া চেক-বই বাহির করিয়া যখন ব্যবহৃত অংশগুলি পরীক্ষা করিয়া গুণীর দস্তখত মিলাইয়া দেখিতেছিল, এমন সময় মাসী ঘরে ঢুকিয়া একেবারে অবাক হইয়া গেলেন। চেঁচাইয়া বলিলেন, কে গা তুমি সিন্দুক খুলেচ?

হেম কহিল, চেঁচাও কেন, উনি উঠে পড়বেন যে!

মাসী আরও চেঁচাইয়া উঠিয়া বলিলেন, চেঁচাই কেন?

গুণী জাগিয়াছিল, পাশ ফিরিল। হেম বলিল, আমি খুলব না ত কে খুলবে? তুমি?

গুণী চাহিয়া দেখিতেছিল, দুইজনের কেহই তাহা লক্ষ্য করে নাই; মাসী ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। গুণী আস্তে আস্তে কহিল, হেম, কখন এলে ভাই?

এই আসছি। ওঁকে বুঝিয়ে দাও—তোমার জিনিস খুললে বাইরের লোকের ঘরে ঢুকে চেঁচামেচি করতে নেই। এ সমস্তই আমার, এই কথাটা ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে ওঁকে যেতে বল।

গুণী সমস্ত বুঝিল। তার পর হাসিয়া বলিল, সেই সম্পর্কে এতদিন পরে বুঝি সিন্দুক খুলতে এসেচ?

হেম চেকের পাতা গুণিতে গুণিতে বলল, হুঁ।

মাসী বলিলেন, ও কে গুণী?

আমার বোন। উত্তর শুনিয়া হেম শিহরিয়া উঠিল। তাহার পর চোখ তুলিয়া একটিবার মাত্র তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মাথা হেঁট করিয়া রহিল।

মাসী বলিলেন, কৈ, এতদিন ত এ-সব কথা শুনিনি? কিরকম বোন হয়?

গুণী সে-কথার উত্তর এড়াইয়া সংক্ষেপে কহিল, ঝগড়া করে চলে গিয়েছিল—ওরই সর্বস্ব মাসী।

মাসী বিশ্বাসও করিলেন না—বুঝিতে পারিলেন না, ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। তিনি চলিয়া গেলে, গুণী হেমের দিকে ভাল করিয়া না চাহিয়াই বলিল, মরণকালে হঠাৎ এ খেয়াল কেন? কিন্তু বলিয়া ফেলিয়াই তাহার মুখ দেখিয়া ভীত হইয়া উঠিল। হেমের মুখ সাদা হইয়া গিয়াছে—সে যেন অকস্মাৎ কোন ক্রুদ্ধ তপস্বীর অভিসম্পাতে একনিমেষে পাষাণ হইয়া গিয়াছে। গুণী সভয়ে ডাকিল, হেম!

হেম সাড়া দিল না, নড়িলও না—নির্নিমেষ-নেত্রে মেঝের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল।

গুণী অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া ডাকিল, হেম, কথা শোন।

হেম তদুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া স্থির হইয়া রহিল। গুণী শয্যার উপর কোনমতে উঠিয়া বসিল, তাহার পর খাট হইতে নামিয়া ধীরে ধীরে অতি ক্লেশে হেমের সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইতেই সে একেবারে উপুড় হইয়া পড়িয়া তাহার দুই পায়ের মধ্যে মুখ লুকাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, বিনা অপরাধে আমাকে সবাই শাস্তি দেয়—তুমিও দেবে, এ যে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি!

গুণী নির্বাক হইয়া রহিল। শ্রাবণের আকাশভরা মেঘের মত বিপর্যস্ত কালো চুলে তাহার দুই পা ঢাকিয়া গিয়াছে—তাহার প্রতি চাহিয়া সে কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রহিল। তার পর ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িয়া হেমের মাথার উপর ডান হাত রাখিয়া শান্তকণ্ঠে কহিল, তোমাকে শাস্তি দেব কি হেম, আমাকে ভালবেসেছিলে বলে আমি আমাকেও শাস্তি দিইনি। এ শাস্তি নয় বোন, চার বৎসরের বড় দুঃখের পর মরণের আগে যে শান্তি পেয়েছি, শেষদিনে আমি সে দুর্লভ বস্তুটিই তোমাকে দিয়ে যাব—চল, আমরা কাশী যাই।

হেম মুখ লুকাইয়া কাঁদিয়া বলিল, চল, কিন্তু এই কি তোমার শেষ আদেশ। এ কি আমি সহ্য করতে পারব?

গুণী বলিল, পারবে। যখন বুঝবে, সংসারে, ভালবাসাকে মহামহিমান্বিত করবার জন্য বিচ্ছেদ শুধু তোমার মত অতুল ঐশ্বর্যশালিনীর দ্বারে এসেই চিরদিন হাত পেতেছে, সে অল্পপ্রাণ ক্ষুদ্র প্রেমের কুটীরে অবজ্ঞায় যায়নি—তখনই সহ্য করতে পারবে। যখন জানবে, অতৃপ্ত বাসনাই মহৎ প্রেমের প্রাণ, এর দ্বারাই সে অমরত্ব লাভ করে যুগে যুগে কত কাব্য, কত মধু, কত অমূল্য অশ্রু সঞ্চিত করে রেখে যায়, যখন নিঃসংশয়ে উপলব্ধি হবে, কেন রাধার শতবর্ষব্যাপী বিরহ বৈষ্ণবের প্রাণ, কেন সে প্রেম মিলনের অভাবেই সুসম্পূর্ণ, ব্যথাতেই মধুর, তখন সইতে পারবে হেম। উঠে বস—চল, আজই আমরা কাশী যাই। যে ক’টা দিন আরো আছি, সে ক’টা দিনের শেষ সেবা তোমার, ভগবানের আশীর্বাদে অক্ষয় হয়ে তোমাকে সারা-জীবন সুপথে শান্তিতে রাখবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *