‘না। ভাবীকে নিয়ে তুমি যখন এলে তখন আমি ফ্রী পার্টিকেল প্রবলেম সলভ করছিলাম – নিচে নামতে ইচ্ছা করল না।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার
উপকারিতাটা কি তুই আমাকে বল তাে দেখি। . বাবু বিস্মিত মুখে বলল, তােমার কথা কিছুই বুঝলাম না। ঠিক কি জানতে চাচ্ছ বুঝিয়ে বল তাে।
‘বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। কথার কথা। চল খোজ নিয়ে দেখি। বাবার কি অবস্থা ?”
মা বাবার অবস্থা ভালই। বাবা সামলে উঠেছেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, হার্টের কিছু না। হঠাৎ ব্লাড প্রেসার সুট করেছে, তাই এ অবস্থা।
বাবার কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ, তবু তিনি ক্ষীণ গলায় আমাকে বললেন, এই কাজটা তুই কি করে করলি ? শাদা চামড়া দেখে সব ভুলে গেলি? কি আছে শাদা চামড়ায়? বল তুই, কি আছে?
“কিছু নেই। ‘সুন্দর চেহারা? কি হয় সুন্দর চেহারায় তুই বল। ‘কিছুই হয় না।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
‘তাহলে কি মনে করে তুই এই কাজটা করলি ? কি জানিস তুই এই মেয়ে সম্পর্কে ?
‘বিশেষ কিছু জানি না। ‘মেয়ের বাবা – উনি করেন কি ?
বলতে পারছি না। ব্যবসা–ট্যাবসা করেন বােধহয়। ‘উনার নাম কি?
‘নাম জানি না। কখনাে জিজ্ঞেস করিনি। রূপাকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে বলব।
বাবা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমাদের বারান্দায় দু‘টি ইজিচেয়ার ছিল। দু’টি ইজিচেয়ারের একটি আমি আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। বিয়ের পর আমার শােবার ঘরের পরিবর্তনের মধ্যে এই পরিবর্তনটা হয়েছে। ও আচ্ছা, আরেকটা পরিবর্তন হয়েছে ইজিচেয়ারের পাশে বড় একটা টেবিল ল্যাম্প। এই টেবিল ল্যাম্প রূপাদের বাড়ি থেকে এসেছে। রূপার বাবা দেশে ফিরেই তাঁর কন্যার ব্যবহারী শাড়ি, গয়না, কিছু ফার্নিচার একটা পিক
আপ ভর্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে আধ পৃষ্ঠার একটা চিঠি। ব্যক্তিগত চিঠি—তাঁর কন্যাকে লেখা। আমার পড়ার কথা না, পড়া উচিতও না। যেহেতু চিঠি দু দিন ধরে আমার টেবিলে পড়ে আছে কাজেই আমি পড়েছি। মা রূপা, তােমার শাড়ি, গয়না, পাস বই, চেক বই পাঠালাম। ছােট স্যুটকেসটায় কসমেটিকস। তােমার ড্রেসিং টেবিলে যা পেয়েছি সবই দিয়ে দিয়েছি।
কাজগুলি দ্রুত করতে হয়েছে, কারণ আমি আবার মাস তিনেকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। বাড়ি তালাবন্ধ থাকবে। চাবি তােমার রহমান চাচার কাছে থাকবে। প্রয়ােজনে তার কাছ থেকে নিতে পার। তবে তাকে পাওয়া এক সমস্যা। তােমার ব্যবহারী জিনিসপত্র তােমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি, তার মানে এই নয় যে হুট করে তুমি যে কাণ্ডটি করেছ তা ক্ষমা করা হয়েছে। তােমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল, তার থেকে বাঁচার জন্য ‘বিয়ে’ নামক ব্যপারটি ব্যবহার করেছ।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
বিয়ে সমস্যা থেকে বাঁচার কোনাে ব্যবস্থা নয়। তােমার মাও সমস্যা এড়াবার জন্যে আমাকে বিয়ে করে অনেক বড় সমস্যা তৈরি করেছিলেন। আমি দুঃখিত হয়ে লক্ষ করছি, তােমার মা যেসব ভুল তার। জীবনে করেছিল, তুমিও একে একে তাই করতে যাচ্ছ। তােমার মা এক একটা ভুল করত, আর সেই ভূলকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার হাস্যকর চেষ্টা করত। তুমিও হয়তাে তাই করবে। যে ছেলেটিকে তুমি কেঁকের মাথায় বিয়ে করলে সে কেমন ছেলে আমরা পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তুমিই ভাল বলতে পারবে। তার সঙ্গে দু‘দিন। আমার দেখা হয়েছে। সামান্য কথা হয়েছে। আমার কাছে তাকে নির্বোধ বলে মনে হয়েছে। কে জানে, হয়তাে নিবোধ ছেলেই তােমার কাম্য।
ভাল থাক, এই শুভ কামনা। সব বাবার মতাে আমিও তােমার মঙ্গল কামনাই করছি। তােমার বাইশ বছরের জীবনে আমি তােমার প্রতি ভালবাসার কোনো অভাব দেখাইনি। আমাকে তােমার অসহ্য বােধ হয়েছে জানার পর আমি তােমাকে অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তােমার মা‘র মৃত্যুর পর আমি অনায়াসে। আরেকটি বিয়ে করতে পারতাম। তা করিনি। তােমার অযত্ন হবে, অবহেলা হবে, এই ভেবেই করিনি। তুমি আমার সেই ভালবাসা তুচ্ছ করেছ। এই স্বভাবও তুমি পেয়েছ তােমার মা’র কাছ থেকে। তােমার মা বেঁচে থাকলে হয়ত সে বলত—রূপা, তুমি যা করেছ ভালই করেছ। আমি তা বলতে পারছি না। যাই হােক, শেষ কথাটি বলছি—আমার বাড়ির দরজা তােমার জন্যে সব সময় খােলা থাকবে তােমার সব আশ্রয় নষ্ট হবার পর যদি ফিরতে ইচ্ছা করে ফিরতে পারবে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
তােমার বাবা। প্রথমে ভেবেছিলাম, রূপা ইচ্ছা করেই এই চিঠি টেবিলে ফেলে রেখেছে যাতে আমি পড়তে পারি। সেই ধারণা ঠিক না। রূপার স্বভাবই হচ্ছে এলােমেলাে অগােছালো। গােসলখানায় গােসল করতে গিয়ে সে গলার হার খুলে রেখে এসেছিল। মুনিয়া তাতে খুব হৈচৈ করছিল। রূপা অবাক হয়ে বলেছে – সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত হৈচৈ কেন? মুনিয়া বলল, ঘরে তিনটা কাজের লােক, যদি চুরি হত? রূপা বলল, চুরি হলে কি আর করা। এম্নিতেও তাে অনেক সময় হারায়। হঠাৎ গলা থেকে খুলে পড়ে।
‘দামী একটা হার হঠাৎ গলা থেকে খুলে পড়বে?
‘দামী হার গলা থেকে খুলে পড়তে পারবে না এমন কোনাে আইন তাে নেই মুনিয়া। মানুষ পর্যন্ত হারিয়ে যায়, আর সামান্য গলার হার। | মুনিয়ার ধারণা, এসব হচ্ছে রূপার চালবাজি কথা। আমি জানি চালবাজি কথা।
সে যা ভাবছে তাই বলছে। মন রেখে কথা বলার বিদ্যা এখনাে বােধহয় শিখে উঠতে পারেনি।
আমি ইজিচেয়ারে বসে আছি। হাতে গতকালকের পত্রিকা। পত্রিকা রেখেছি। পড়ার জন্যে না। মুখ আড়াল করে রাখার জন্যে। মুখ আড়াল করে আমি রূপার কথা শুনছি।
রূপা লাবণ্যের সঙ্গে লুডু খেলতে খেলতে কথা বলছে। ভাঙা ভাঙা কথা, যা একমাত্র ছােটদের সঙ্গেই বলা যায়। | ‘লাবণ্য সােনা, এই নাও চার চাললাম। ওয়ান টু থ্রী ফোর। তােমার দুই হয়েছে, তুমি দুই চালবে। উহু, তুমি উল্টোদিকে চলেছ। সব খেলার নিয়ম আছে। যে খেলার
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
যে নিয়ম সেই খেলা সেই ভাবে খেলতে হয়। উল্টো খেলা যায় না। আমি কি বলছি তুমি কি বুঝতে পারছ লাবণ্য?”
‘পারছি।”
‘ভেরি গুড়। ছােটরা খুব সহজে জটিল জিনিস বােঝে। বড়রা বুঝতে চায় না। বুঝিয়ে দিলেও ভাব করে যে বােঝেনি। ছােট থাকাই ভাল। তাই না ?”
“তুমি কি ছােট থাকতে চাও? ‘চাই।”