কিন্তু ছােট থাকার সমস্যাও আছে। ছােটরা নিজেদের পছন্দমতো জিনিস কখনাে পায় না। তাদের চলতে হয় বড়দের পছন্দে। যেমন ধর, আমি এখন চা খাব। তুমি খাবে না।
‘আমিও পিরিচে ঢেলে চা খাব।” ‘আচ্ছা, দেয়া হবে। যাও, চায়ের কথা বলে আস।‘
লাবণ্য চায়ের কথা বলতে উঠে গেল। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, গতকাল সন্ধ্যায় তােমার ছােট ভাইয়ের সঙ্গে কথা হল। ছাদে গিয়েছিলাম, সে রীতিমতাে ধমক দিল—গাল ফুলিয়ে বলল, এখানে কি করছেন?
আমি বললাম, হাঁটছি। সে বলল, সন্ধ্যাবেলা হাঁটছেন কেন? আমি বললাম, সন্ধ্যাবেলা হাঁটা কি নিষিদ্ধ? ‘ছাদে হাঁটা নিষেধ। আমার ডিসটার্ব হয়। পড়াশােনা করছি—এক মাসও নেই। পরীক্ষার। ছাদে কেউ এলেই আমি ডিসটার্বড় ফিল করি।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি বললাম, আমি ছাদে হাঁটতে এসেছি, আপনি পড়ছেন—এতে আমিও ডিসটার্বড ফিল করছি। ঠিকমতাে হাঁটতে পারছি না। আপনি বরং এক কাজ করুন, বই নিয়ে নিচে চলে যান, আমার হাঁটা শেষ হলে আবার আসবেন।
‘আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি মুনিয়ারও ছােট।
“ও আচ্ছা। বুড়ােদের মত দেখাচ্ছে বলে আপনি বলছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি সবার বড়।
‘আমার গত ডিসেম্বরে ২৫ হয়েছে। ডিসেম্বরের কত তারিখ? ২৩শে ডিসেম্বর। “ঠিক আছে, পড়াশােনা করতে থাক, আমি নিচে যাই।” এই বলে আমি নিচে
চলে এলাম। তােমরা ছিটগ্রস্ত পরিবার। তােমার ভাইয়েরও তােমার মতাে ব্রেইন এলােমেলো।
আমি বললাম, আমার ব্রেইন কি এলােমেলাে?
এক ঘণ্টা ধরে বাসি একটা খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে আছ। সারাক্ষণ দেখি ইজিচেয়ারটায় বসে আছে। কি আছে এই চেয়ারটায়?”
“কিছু নেই। ‘তাহলে বসে থাক কেন?”
বসে থাকতে ভাল লাগে, তাই বসে থাকি। “তােমার এই উত্তর আমার পছন্দ হয়েছে। যা করতে তােমার ভাল লাগে তা। অবশ্যই করবে। কে কি বলছে বা বলছে, না তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কারণ। একটা জিনিস মনে রাখবে—তুমি আছ বলেই এই পৃথিবী টিকে আছে। তুমি নেই পৃথিবীও নেই।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আমার কাছে নেই। অন্যের কাছে তাে আছে।
‘অন্যের কাছে থাকলে তােমার কি ? তােমার কিছু যাচ্ছে আসছে না। শােন, তােমার যা ভাল লাগে তুমি করবে। আমি কখনাে বাধা দেব না। ঠিক একইভাবে আমি আশা করব আমি যা করব তা আমাকে করতে দেবে। বাধা দেবে না। এই একটা ব্যাপার ঠিক করে নিলে আমাদের কখনাে কোনাে সমস্যা হবে না।
‘এইসব কথা তুমি কি তােমার মার কাছে শিখেছ?” । “তিনি কি সব সময় তােমাকে উপদেশ দিতেন ?
“মােটেও উপদেশ দিতেন না। তিনি তাঁর সব উপদেশ একদিন দিলেন। তাঁর উপদেশ দেয়ার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। শুনতে চাও?
‘চাই।‘
‘আমার তখন বয়স বার। ঘুমুচ্ছি। রাত দু‘টার মতাে বাজে। মা এসে আমাকে ডেকে তুললেন। আমি বললাম, কি ব্যাপার? মা বললেন – কফি খাবার জন্য ডাকলাম। আমি বললাম, রাত–দুপুরে কফি খাব কেন? মা বললেন, রাত–দুপুরে কফি খাওয়া যাবে না, এমন তাে কোনাে কথা নেই লিটল ডার্লিং।
আমি মা‘র সঙ্গে কফি খেলাম। দু’জন খানিকক্ষণ বারান্দায় হাঁটলাম। মা আমাকে উপদেশ দিতে শুরু করলেন। ঘণ্টাখানিক উপদেশ দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন মা‘র স্বাস্থ্য খুব খারাপ ছিল। কোনাে পরিশ্রম করতে পারেন না। সিড়ি ভাঙতে পারেন না। তাঁকে ধরে ধরে দোতলায় তুলতে হয়।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
পরদিন ভােরবেলা শুনলাম ঘুমের মধ্যে মা মারা গেছেন। হার্ট ছিল দুর্বল, অতিরিক্ত ঘুমের অষুধ খেয়েছিলেন। শরীর সহ্য করতে পারেনি।
যদিও আমার ধারণা এটা আত্মহত্যা, নয়তাে আমাকে রাত দুটায় ঘুম থেকে তুলে উপদেশ দিতেন না। তােমার কি মনে হয় আমার অনুমান ঠিক আছে? খবরের কাগজ হাতে আমি রূপার দিকে তাকিয়ে আছি। কোনাে রকম দ্বিধা ছাড়া সে এই গল্প কি করে করল! লাবণ্যও পাশে বসে হাঁ করে কথা শুনছে।
আমি কিছু বলার আগেই মুনিয়া চা নিয়ে ঢুকল এবং গম্ভীর গলায় বলল, ভাবী, লাবণ্যকে তুমি কিন্তু চা দেবে না। ও আজেবাজে সব অভ্যেস করছে। আর শােন দাদা তুই একটু নিচে যা।।
আমি বললাম, কেন? ‘সফিক ভাই এসেছে। তােকে চাচ্ছে। ‘বলে দে বাসায় নেই।
একটু আগে বলেছি, তুই বাসায় আছিস। এখন বলে দে—আমি বাসায় নেই।
‘মিথ্যা আমি বলতে পারব না দাদ তুই নিজে গিয়ে বলে আয় যে তুই বাসায় নেই।
মুনিয়া শুকনাে মুখে চলে গেল। রূপা বলল, আমি বলে আসি। উনি আসলে আমাকে দেখতেই এসেছেন। প্রতি দশ থেকে বারাে দিন পরপর উনি আমাকে দেখতে আসেন। এই চক্রটা আমি হিসেব করে বের করেছি। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে এগারাে দিন আগে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপা নিচে নেমে গেল। আমি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বসে রইলাম। লাবণ্য বলল, মামী লুডু খেলবে?
আমি বললাম, না। ‘একটু খেল মামা। তুমি কালাে আমি লাল।
‘খেল মামা, খেল। খেলতেই হবে। আমি ইজিচেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বেশ জোরেই তার গালে একটা চড় বসালাম। মেয়েটা মুহূর্তৈ বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। মুনিয়া ছুটে এসে বলল, কি হয়েছে ?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, তেমন কিছু হয়নি। চড় মেরেছি। বড় বিরক্ত করছিল।
মুনিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, এইভাবে তাকিয়ে থাকিস মুনিয়া। তােকে কালো টিকটিকির মতাে দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তাের চোখ ঠিকরে বের হয়ে আসবে।
‘ঠিক করে আমাকে বল তাে দাদা, কেন মারলি ?”
‘আমাকে লুডু খেলতে বলছিল। খেলব না বলছি, তারপরেও জোর করছে। চড় মারার ফলে ভবিষ্যতে আর কখনাে জোর খাটাতে আসবে না। একই সঙ্গে বুঝতে পারবে পৃথিবী জোর খাটানাের জায়গা নয়।”
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
‘তাের মাথা খারাপ। তাের চিকিৎসা হওয়া দরকার।
আমি আবার খবরের কাগজ চোখের সামনে মেলে ধরলাম। মুনিয়া হিসহিস করতে করতে বলল, আমাকে কালাে টিকটিকি কেন বললে, গায়ের রঙ কালো বলে ?