পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

ফর্সা রঙ দেখে মাথা আউলা হয়ে গেছেসারা পৃথিবীকে এখন কালো লাগছেসারা পৃথিবীকে লাগছে না, তােকে লাগছে। 

মুনিয়া দরজা ধরে কাঁদতে লাগলআমি যা করেছি তা ঘােরতর অন্যায়

পাখি আমার একলা পাখিআমার কথায় মুনিয়া যে কাঁদছে, তাতে তাকে দোষ দেয়া যায় নাযে কেউই কাঁদবেমজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার সামান্য হলেও অনুশোচনা এবং গ্লানি বােধ করা উচিত তা করছি নাবরং ইচ্ছা করছে বাড়ির প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীকে কাঁদিয়ে দিতে। 

মাকে খুঁজে বের করে তাঁর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঝগড়া করলে কেমন হয়না, ঝগড়া না, এই জিনিস আমি পারি নামাকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে আসা যায়কিংবা দোতলায় উঠে বাবুকে বলে আসা যায় বাবু শােন, তুই আসলে মহামূখকিছু জটিল ইকোয়েশন মুখস্থ করার বিদ্যা ছাড়া পরম কুরুণাময় ঈশ্বর তােকে আর কিছু দেননিতােকে পৃথিবীতে পাঠানাে হয়েছে ফিজিক্সের একটা শুকনাে বই 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

বানিয়ে। 

আমি ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠলামযার সঙ্গেই প্রথম দেখা হবে, তাকে কিছু কথাবার্তা বলববাবার সঙ্গে দেখা হলে বাবাকে

দেখা হল সঙ্গেএই মহিলা বারান্দায় বসে আছেনমতির মা চিরুনি দিয়ে তাঁর মাথার উকুন এনে দিচ্ছেমনে হচ্ছে কাজটিতে দুজনই খুব আনন্দ পাচ্ছেপ্রাণীহত্যা আনন্দজনক কাজ তাে বটেইপ্রাণী যত ক্ষুদ্রই হােক না কেন তাকেহত্যায় আনন্দ আছেউকুন এবং মশা প্রাণী হিসেবে কাছাকাছি দুজনই রক্ত 

খায়তারপরেও উকুন মারার আনন্দ বেশি, কারণ এরা শব্দ করে মারা যায়নখ দিয়ে এদের ফুটানাে হয়। 

মা বললেন, রঞ্জু, বৌমা কার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলছে? আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সফিকের সঙ্গেযার তার সঙ্গে তার এত কি কথা

আমি আবার হাই তুললাম, কোন লাইনে শাকে আক্রমন করা যায় ঠিক বুঝতে পারছি নামাধারণা, মানুষ হিসেবে তিনি প্রথম শ্রেণীরদয়ামায়ায় তাঁর অন্তর পূর্ণনামাজ রােজা করছেনপ্রয়ােজনের বেশি করছেনশুক্রবারে ফকির এলে ভিক্ষা না নিয়ে বিদেয় হয় নামানির্দেশ, শুক্রবারে ভিক্ষা চাইলে ভিক্ষা দিতে হবেতাঁর সঙ্গে একবার গাড়ি করে পল্লবীর দিকে যাচ্ছিসােনারগা হােটেলের কাছে লাল লাইটে গাড়ি থামলদুটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এল ফুল বিক্রি করতেআমি গলার স্বর যথাসম্ভব কর্কশ করে বললাম, ভাগে

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

মা অবাক হয়ে বললেন, ভাগে ভাগাে বলছিস কেন? গরিব মানুষ না ? শীতের সময় খালিগায়ে ফুল বিক্রি করছে ‘আহা রে!তিনি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে দুজনকে দুটা টাকা দিলেনগরিবের দুঃখে কাতর এই মাঅন্য একটি ছবিও আছে, সেই ছবিও সবার চেনা, কিন্তু সেই ছবি কারাে চোখে পড়ে নাজাহেদা নামে আমাদের একটা কাজের মেয়ে ছিল

কোলের একটা বাচ্চা নিয়ে সে কাজ করতে এসেছিলবাচ্চাটা বেশির ভাগ সময় কাঁদতখিদের যন্ত্রণাতেই কাঁদতজাহেদা মাঝে মাঝে চুরি করে দুধ নিয়ে বাচ্চাটাকে খাওয়াতএকদিন ধরা পড়ে গেলমা রেগে আগুনবিদায় হওএক্ষুণি বিদায় হওঘরে চোর পুষছি। কি সর্বনাশের কথা! জাহেদা মাপা জড়িয়ে ধরলদুগ্ধপােষ্য একটি শিশু নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ পাওয়া তার সহজ হবে না

মামন গলল নাতাঁর এক কথা বাড়িতে আমি চোর রাখব নাআমাদের পরম করুণাময়ী মাতা চোর বিদায় করে দিলেন। 

চোর বিদায়ের কথা তুলব, না অন্য কোনাে প্রসঙ্গ তুলব বুঝতে পারছি নাচোর বিদায়ের প্রসঙ্গ তােলা ঠিক হবে না, কারণ এতদিন আগের কথা মামনে নেইতাঁর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণনামতা পৰ্য্যন্ত মনে থাকে নাদিন কি একটা জিনিসের দাম ঠিক করতে গিয়ে নামতা গণ্ডগােল হয়ে গেলআমাকে বললেন, সাত আট কত রে রঞ্জু ? আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম বাহান্নমা বাহান্ন স্বীকার করেই চলে গেলেনকাজেই চুরির প্রসঙ্গ থাকঅন্য কোনাে প্রসঙ্গে আক্রমণ শুরু করা যাক। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

মা বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মােড়টায় বােস না। 

আমি বসলামমা বললেন, তাের বাবা দিন বলছিলেন, রঞ্জুর যা স্বভাব, কোনাে চাকরিবাকরি করবে বলে তাে মনে হয় নাওকে একটা ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়কি রে, করবি ব্যবসা? বিয়েটয়ে করেছিল, এখন রােজগারের কথা চিন্তা করবি না ? তাের শ্বশুর তাে বিরাট পয়সাওয়ালা লােক, ওঁকে বল তােকে কোন একটা ব্যবসা শুরু করিয়ে দিতে। 

আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললাম, শিগগিরই বলব। 

কোনো একটা ব্যবসাটবসা শুরু করলে মন ভাল থাকবেদিনরাত ইজিচেয়ার শুয়ে থাকা তাে কাজের কথা না। 

তা তো ঠিকই। 

তাের বাবা বলছিলেনবিনা কারণে একটা মানুষ দিন রাত শুয়ে থাকে কি ভাবে

আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, বিনা কারণে শুয়ে থাকিনা তােশুয়ে শুয়ে ভাবিকি ভাবিস?” 

একটা খুন করার কথা ভাবছিকি বলছিস তুই

আমি হাসতে হাসতে বললাম, সত্যি কথা বলছি মাকাকে খুণ করবি ? সেটা এখনো ফাইনাল করিনি

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

রূপাদের বাড়ি থেকে একটা মাছ এসেছেতার আকৃতি হুলস্থূল ধরনেরমাছ বললে এই জলজ প্রাণীটির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানাে হয় নামৎস্য বললে কিছুটা হয়সেই মৎস্য দুজন ধরাধরি করে বারান্দায় এনে রাখলআমাদের বাসার সবারই হতভম্ব হয়ে যাওয়া উচিত ছিলকেউ হতভম্ব হলাম নাবরং সবাই এমন ভাব করতে লাগলাম, যেন খুব বিরক্ত হয়েছিআমাদের বাসার অলিখিত নিয়ম হচ্ছে রূপাদের প্রতিটি কার্যকলাপে আমরা বিরক্ত হবােরূপাদের কোনাে আত্মীয় টেলিফোন করলে আমরা শুকনো গলায় বলব, এখন কথা বলতে পারছি না, খুব ব্যস্ত, পরে করুনএরপর আর টেলিফোন করা উচিত নয়তবু যদি লজ্জার মাথা খেয়ে কেউ করে, তখন বলা হয়, বাসায় নেইকখন ফিরবে বলা যাচ্ছে না। 

রূপার চাচা কিছুদিন আগে এসেছিলেনতাঁকে বসার ঘরে একা একা ঘণ্টখানিক বসিয়ে রাখা হলআমাদের কাজের ছেলের হাতে চা পাঠিয়ে দেয়া হলশেষ পর্যন্ত বাবা অবশ্যি দেখা করতে গেলেনকয়েকবার হাই তুলে বললেন, শরীরটা ভাল যাচ্ছে নাপ্রেসার বেড়েছে আজ আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি নাআরেকদিন আসুনটা খেয়েছেন তাে?

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ

প্রকাণ্ড পাংগাশ মাছ বারান্দায় পড়ে আছেসবাই বিরক্ত মুখে দেখছেশুধু আমাদের বেড়ালটা মনের আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না, লাফঝাঁপ দিচ্ছেবেড়ালটাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি যে বাড়ির কোনাে কিছুতেই এত আনন্দিত হতে নেই আমার মা ক্রু কুঁচকে বললেন, এই মাছ এখন কে কাটবে

যে লােক মাছের সঙ্গে এসেছে, সে হাসিমুখে বলল, আম্মা, মাছ কাটার লােক সঙ্গে নিয়ে এসেছি, বটিও এনেছিআগে সবাই দেখুন, তারপরে কাটার ব্যবস্থা হবে। 

মাছ কাটার লােক কোথায় ? গাড়িতে বসে আছে আম্মা, সবাইকে ডাকুন, সবাই দেখুক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *