‘ফর্সা রঙ দেখে মাথা আউলা হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীকে এখন কালো লাগছে। ‘সারা পৃথিবীকে লাগছে না, তােকে লাগছে।
মুনিয়া দরজা ধরে কাঁদতে লাগল। আমি যা করেছি তা ঘােরতর অন্যায়।
আমার কথায় মুনিয়া যে কাঁদছে, তাতে তাকে দোষ দেয়া যায় না। যে কেউই কাঁদবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার সামান্য হলেও অনুশোচনা এবং গ্লানি বােধ করা উচিত – তা করছি না। বরং ইচ্ছা করছে এ বাড়ির প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীকে কাঁদিয়ে দিতে।
মাকে খুঁজে বের করে তাঁর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঝগড়া করলে কেমন হয়। না, ঝগড়া না, এই জিনিস আমি পারি না। মা’কে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে আসা যায়। কিংবা দোতলায় উঠে বাবুকে বলে আসা যায় – বাবু শােন, তুই আসলে মহামূখ। কিছু জটিল ইকোয়েশন মুখস্থ করার বিদ্যা ছাড়া পরম কুরুণাময় ঈশ্বর তােকে আর কিছু দেননি। তােকে পৃথিবীতে পাঠানাে হয়েছে ফিজিক্সের একটা শুকনাে বই
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
বানিয়ে।।
আমি ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠলাম। যার সঙ্গেই প্রথম দেখা হবে, তাকে কিছু কথা। বার্তা বলব। বাবার সঙ্গে দেখা হলে বাবাকে।
দেখা হল ‘র সঙ্গে। এই মহিলা বারান্দায় বসে আছেন। মতির মা চিরুনি দিয়ে তাঁর মাথার উকুন এনে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কাজটিতে দুজনই খুব আনন্দ পাচ্ছে। প্রাণীহত্যা আনন্দজনক কাজ তাে বটেই। প্রাণী যত ক্ষুদ্রই হােক না কেন তাকে। হত্যায় আনন্দ আছে। উকুন এবং মশা প্রাণী হিসেবে কাছাকাছি – দুজনই রক্ত
খায়। তারপরেও উকুন মারার আনন্দ বেশি, কারণ এরা শব্দ করে মারা যায়। নখ দিয়ে এদের ফুটানাে হয়।
মা বললেন, রঞ্জু, বৌমা কার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলছে? আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সফিকের সঙ্গে। ‘যার তার সঙ্গে তার এত কি কথা?
আমি আবার হাই তুললাম, কোন লাইনে শাকে আক্রমন করা যায় ঠিক বুঝতে পারছি না। মা’র ধারণা, মানুষ হিসেবে তিনি প্রথম শ্রেণীর। দয়ামায়ায় তাঁর অন্তর পূর্ণ। নামাজ রােজা করছেন। প্রয়ােজনের বেশি করছেন। শুক্রবারে ফকির এলে ভিক্ষা না নিয়ে বিদেয় হয় না। মা‘র নির্দেশ, শুক্রবারে ভিক্ষা চাইলে ভিক্ষা দিতে হবে। তাঁর সঙ্গে একবার গাড়ি করে পল্লবীর দিকে যাচ্ছি। সােনারগা হােটেলের কাছে লাল লাইটে গাড়ি থামল। দুটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এল ফুল বিক্রি করতে। আমি গলার স্বর যথাসম্ভব কর্কশ করে বললাম, ভাগে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
মা অবাক হয়ে বললেন, ভাগে ভাগাে বলছিস কেন? গরিব মানুষ না ? শীতের সময় খালিগায়ে ফুল বিক্রি করছে ‘আহা রে!‘ তিনি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে দুজনকে দুটা টাকা দিলেন। গরিবের দুঃখে কাতর এই মা‘র অন্য একটি ছবিও আছে, সেই ছবিও সবার চেনা, কিন্তু সেই ছবি কারাে চোখে পড়ে না। জাহেদা নামে আমাদের একটা কাজের মেয়ে ছিল।
কোলের একটা বাচ্চা নিয়ে সে কাজ করতে এসেছিল। বাচ্চাটা বেশির ভাগ সময় কাঁদত। খিদের যন্ত্রণাতেই কাঁদত। জাহেদা মাঝে মাঝে চুরি করে দুধ নিয়ে বাচ্চাটাকে খাওয়াত। একদিন ধরা পড়ে গেল। মা রেগে আগুন। বিদায় হও। এক্ষুণি বিদায় হও। ঘরে চোর পুষছি। কি সর্বনাশের কথা! জাহেদা মা‘র পা জড়িয়ে ধরল। দুগ্ধপােষ্য একটি শিশু নিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ পাওয়া তার সহজ হবে না।
মা’র মন গলল না। তাঁর এক কথা – বাড়িতে আমি চোর রাখব না। আমাদের পরম করুণাময়ী মাতা চোর বিদায় করে দিলেন।
চোর বিদায়ের কথা তুলব, না অন্য কোনাে প্রসঙ্গ তুলব বুঝতে পারছি না। চোর বিদায়ের প্রসঙ্গ তােলা ঠিক হবে না, কারণ এতদিন আগের কথা মা’র মনে নেই। তাঁর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ। নামতা পৰ্য্যন্ত মনে থাকে না। ঐ দিন কি একটা জিনিসের দাম ঠিক করতে গিয়ে নামতা গণ্ডগােল হয়ে গেল। আমাকে বললেন, সাত আট কত রে রঞ্জু ? আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম বাহান্ন। মা বাহান্ন স্বীকার করেই চলে গেলেন। কাজেই চুরির প্রসঙ্গ থাক। অন্য কোনাে প্রসঙ্গে আক্রমণ শুরু করা যাক।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
মা বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঐ মােড়টায় বােস না।
আমি বসলাম। মা বললেন, তাের বাবা ঐ দিন বলছিলেন, রঞ্জুর যা স্বভাব, ও কোনাে চাকরি–বাকরি করবে বলে তাে মনে হয় না। ওকে একটা ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়। কি রে, করবি ব্যবসা? বিয়েটয়ে করেছিল, এখন রােজগারের কথা চিন্তা করবি না ? তাের শ্বশুর তাে বিরাট পয়সাওয়ালা লােক, ওঁকে বল তােকে কোন একটা ব্যবসা শুরু করিয়ে দিতে।
আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললাম, শিগগিরই বলব।।
কোনো একটা ব্যবসা–টবসা শুরু করলে মন ভাল থাকবে। দিন–রাত ইজিচেয়ার শুয়ে থাকা তাে কাজের কথা না।
‘তা তো ঠিকই।
‘তাের বাবা বলছিলেন—বিনা কারণে একটা মানুষ দিন রাত শুয়ে থাকে কি ভাবে?
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, বিনা কারণে শুয়ে থাকিনা তাে। শুয়ে শুয়ে ভাবি। ‘কি ভাবিস?”
একটা খুন করার কথা ভাবছি। “কি বলছিস তুই?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সত্যি কথা বলছি মা। “কাকে খুণ করবি ? ‘সেটা এখনো ফাইনাল করিনি।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপাদের বাড়ি থেকে একটা মাছ এসেছে। তার আকৃতি হুলস্থূল ধরনের। মাছ বললে এই জলজ প্রাণীটির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানাে হয় না। মৎস্য বললে কিছুটা হয়। সেই ‘মৎস্য দু’জন ধরাধরি করে বারান্দায় এনে রাখল। আমাদের বাসার সবারই হতভম্ব হয়ে যাওয়া উচিত ছিল—কেউ হতভম্ব হলাম না। বরং সবাই এমন ভাব করতে লাগলাম, যেন খুব বিরক্ত হয়েছি। আমাদের বাসার অলিখিত নিয়ম হচ্ছে – রূপাদের প্রতিটি কার্যকলাপে আমরা বিরক্ত হবাে। রূপাদের কোনাে আত্মীয় টেলিফোন করলে আমরা শুকনো গলায় বলব, এখন কথা বলতে পারছি না, খুব ব্যস্ত, পরে করুন। এরপর আর টেলিফোন করা উচিত নয়। তবু যদি লজ্জার মাথা খেয়ে কেউ করে, তখন বলা হয়, বাসায় নেই। কখন ফিরবে বলা যাচ্ছে না।
রূপার চাচা কিছুদিন আগে এসেছিলেন। তাঁকে বসার ঘরে একা একা ঘণ্টখানিক বসিয়ে রাখা হল। আমাদের কাজের ছেলের হাতে চা পাঠিয়ে দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত বাবা অবশ্যি দেখা করতে গেলেন। কয়েকবার হাই তুলে বললেন, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রেসার বেড়েছে । আজ আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। আরেকদিন আসুন। চ–টা খেয়েছেন তাে?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
প্রকাণ্ড পাংগাশ মাছ বারান্দায় পড়ে আছে। সবাই বিরক্ত মুখে দেখছে। শুধু আমাদের বেড়ালটা মনের আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না, লাফঝাঁপ দিচ্ছে। বেড়ালটাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি যে ও বাড়ির কোনাে কিছুতেই এত আনন্দিত হতে নেই । আমার মা ক্রু কুঁচকে বললেন, এই মাছ এখন কে কাটবে?
যে লােক মাছের সঙ্গে এসেছে, সে হাসিমুখে বলল, আম্মা, মাছ কাটার লােক সঙ্গে নিয়ে এসেছি, বটিও এনেছি। আগে সবাই দেখুন, তারপরে কাটার ব্যবস্থা হবে।
‘মাছ কাটার লােক কোথায় ? ‘গাড়িতে বসে আছে আম্মা, সবাইকে ডাকুন, সবাই দেখুক।