মা বললেন, এত দেখাদেখির কি আছে? বড় মাছ কি আমরা আগে দেখিনি?’
লােকটি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, অবশ্যই দেখেছেন আম্মা, অবশ্যই দেখেছেন। এই মাছটার ওজন হল এক মণ। এক সের কম এক মণ।
ঊনচল্লিশ সের। আপাকে ডাকেন। আপা দেখুক, স্যার বলে দিয়েছেন। আপাকে না দেখিয়ে মাছ যেন কাটা না হয়।
রূপাকে ডাকা হল। সে মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ, কি অদ্ভুত সুন্দর! রূপার পাতের মতাে ঝিকমিক করছে।
আমি দোতলায় উঠে এলাম। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, মানুষের সৌন্দর্যবােধের নানা দিক আছে। মাছের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে কেটেকুটে আমরা খেয়ে ফেলছি। এর কোনো মানে হয়!
রাতে খেতে বসে রূপা বলল এ কি, বড় মাছটা রান্না হয়নি?”
মুনিয়া বলল, “না।” না কেন?” ‘ডীপ ফ্রীজে রেখে দেয়া হয়েছে। পরে রান্না হবে। আমাদের নিজেদের বাজার রান্না করা হয়েছে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপা আর কিছু বলল না, কিন্তু তার মুখ থেকে বিস্ময়ের ভাবটা দূর হল না। বড় মাছটা রান্না হয়নি, এটা সে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আমি বললাম, পাংগাশ মাছ কি তােমার খুব প্রিয়?
রূপা বলল, পাংগাশ মাছ প্রিয় হবে কেন? কোনাে মাছই আমার প্রিয় না। ইলিশ মাছের ডিম খানিকটা প্রিয়।
তােমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মাছটা রান্না না হওয়ায় আপসেট হয়ে পড়েছ।”
‘আপসেট হবার কারণ আছে বলেই আপসেট হচ্ছি। তুমি যদি শােন, তুমিও আপসেট হবে। এই জন্যেই তােমাকে শােনাব না। কেন আপসেট হচ্ছি, পরশু বলব।”
‘এখনি বলে।
রূপা খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। তার মন খারাপ ভাব স্থায়ী হল না। ঘরে ঢুকেই গান চালিয়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সাজগােজ করলে কেমন হয়? আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, রাত এগারােটায় !
রাত এগারােটায় সাজা যাবে না, এমন তাে কোনাে আইন নেই। আর এ রকম আইন থাকলেও আমি মানতাম না। আচ্ছা শােন, তুমি কি মানবেন্দ্রের ঐ গানটা শুনেছ, ওগাে সুন্দরী আজ অপরূপ সাজে, সাজো সাজো সাজো, ..
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আমি যখন ছােট ছিলাম অর্থাৎ কলেজে যখন পড়তাম, তখন এই গানটা বাজাতে বাজাতে সাঙ্খতাম। আমার তখন মনে হতাে কি জানাে? মনে হতাে আমার জন্যেই যেন গানটা লেখা হয়েছে। অবশ্যি এই ব্যাপারটা এখনাে আমার মধ্যে আছে,
কোনাে কোনাে গান শুনলেই মনে হয় এই গান আমার জন্যে লেখা, অন্য কারাে জন্যে নয়। তােমার কি এরকম মনে হয়?
‘না।”
‘তুমি ক্যামেরাটা নিয়ে এসাে তাে, আমার সাজগােজ শেষ হলে একটা ছবি তুলবে।
ক্যামেরায় ফিল ছিল না বলে ছবি তােলা গেল না। রূপা করুণ গলায় বলল, “দোকানপাট নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে, এত রাতে কি আর ফিল্ম পাওয়া যাবে?
‘পাওয়া না যাবারই কথা। ‘এসাে তাহলে শুয়ে পড়ি, কি আর করা।
আমরা ঘুমুতে গেলাম বারােটার দিকে। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করামাত্র রূপা বলল, মাছের ব্যাপারে কেন আপসেট হয়েছিলাম তােমাকে বলেই ফেলি।
“তােমার বলতে ইচ্ছা না হলে বলার দরকার নেই।
‘ইচ্ছা হচ্ছে। আজ থেকে বাইশ বছর আগে বাবা বিশাল একটা পাংগাশ মাছ এনেছিলেন। মাছ নিয়ে ঘরে ঢােকামাত্র বাবা আমার জন্মসংবাদ পেলেন। মাছটা রূপার মতাে চকচক করছিল। মাছের রূপালি রঙ থেকে রূপা নাম নিয়ে বাবা আমার নাম রাখলেন। সেই থেকে অলিখিত নিয়মের মতাে হয়ে গেল, আমার জন্মদিনে বাজারের সবচে‘ বড় মাছটা আসবে। গতবার এসেছিল চিতল মাছ। লম্বায় প্রায়
আমার সমান।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
আজ কি তােমার জন্মদিন?” ‘ইয়েস স্যার। তুমি ইচ্ছে করলে শুভ জন্মদিন বলতে পার।” ‘শুভ জন্মদিন রূপা। “থ্যাংক ইউ। ‘তােমার জন্ম কি দেশে হয়েছিল? মিটফোর্ড হাসপাতালে। ‘আমার ধারণা, তােমার জন্য বিদেশে।। ‘যতই দিন যাবে, দেখবে, আমার সম্পর্কে তােমার বেশির ভাগ ধারণাই ভুল।
আজ যে তােমার জন্মদিন আগে বললে না কেন? ‘আগে বলব কি করে? আমার নিজেরই মনে ছিল নাকি? মাছ দেখে মনে পড়ল।
রূপা তরল গলায় হাসল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার মন আসলেই খারাপ হয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছি আজ রাতে আর ঘুম হবে না।
এপাশ–ওপাশ করে কাটাতে হবে। জন্মদিনের খবরটা কাল ভােরে দিলেও অনিদ্রার হাত থেকে বাঁচতাম।
রূপার বাবা ভদ্রলােককে যতটা খারাপ শুরুতে ভাবছিলাম এখন মনে হচ্ছে ভদ্রলােক হয়তাে ততটা খারাপ নন। জন্মদিন মনে রাখছেন, বিশাল মাছ পাঠাচ্ছেন। তবে আমার ধারণা, ভদ্রলােকের সীমা ঐ মাছ পর্যন্তই। কন্যার প্রতি ভালবাসার আর কোনাে কোনাে লক্ষণ এখনাে তিনি দেখাননি। বেশির ভাগ সময়ই তার কাটে দেশের বাইরে। কিছু দিনের জন্যে দেশে আসেন। টেলিফোন করেন। মেয়ের সঙ্গে খুবই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা হয়। এই পর্যন্তই।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
আমাদের বাড়িতে রূপাকে কেউ পছন্দ করে না। শুধু লাবণ্য পছন্দ করে। রূপার মতাে লাবণ্যেরও ঘুম–রােগ আছে। ঘুম পেলেই সে রূপার পাশে গিয়ে শুয়ে
পড়বে।
আমাদের বাড়িতে রূপাকে সবচে বেশি অপছন্দ করে মতির মা। সে সবসময়ই গলা নিচু করে মা’কে কিংবা মুনিয়াকে রূপ সম্পর্কে গুজগুজ করে কি সব যেন বলে। একদিন আমি খানিকটা শুনলাম ‘আম্মা, গরীব মানুষ, আপনেরে একটা কথা কই কিছু মনে নিয়েন না। দোষ হইলে ক্ষ্যামা দিয়েন। কথাটা হইল নয়া বৌরে নিয়া।
মা গম্ভীর গলায় বললেন, কি কথা?
নয় বৌ–এর সাথে জ্বীন থাকে আম্মা। দুনিয়ায় যারা খুব সুন্দর মাইয়া তারার সাথে দুইটা তিনটা কইরা পুরুষ জ্বীন থাকে।
‘চুপ কর তাে।”
‘জানি আম্মা, আমার কথা শুনলে রাগ হইবেন। কিন্তু কথা সত্য। জ্বীনের সব লক্ষণ নয়া বৌ–এর আছে—এই যে রাইত দিন ঘুমায়, এর কারণ কি? কারণ একটাই। কইন্যা ঘুমের মইধ্যে থাকলে জ্বীন ভূতের জন্যে খুব সুবিধা।
এই জাতীয় কথা দাঁড়িয়ে শােনা অসম্ভব। আমি বাকিটা শুনিনি। তবে মা নিশ্চয়ই শুনেছেন। কিছুটা বিশ্বাসও করেছেন। মানুষ সত্যের চেয়ে অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। মুনিয়ার কথাই ধরা যাক, সে একটি চমৎকার মেয়ে। তার স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। লােকজনকে বলেছে স্ত্রীর চরিত্রহানি ঘটেছিল, সম্পর্ক ছিল অন্য একজনের সঙ্গে। লােকজন এই অসত্যটাই বিশ্বাস করেছে। শুধু লােকজন কেন, আমাদের নিকট আত্মীয়স্বজনদেরও সে–রকম ধারণা। অসত্য বৃক্ষের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। অসত্য বৃক্ষকে সে কারণেই সহজে উপড়ে ফেলা যায় না।
রূপা বলল, তুমি কি আমাকে সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে পারবে? কিছু জিজ্ঞেস করার সময় রূপা কখনাে চোখের দিকে তাকায় না। প্রশ্নটা করছে আমাকে, অথচ সে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। শুরুতে খুব বিরক্তি লাগত। এখন লাগে না। বরং মনে হয় এটাই স্বাভাবিক।