পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ

মা বললেন, এত দেখাদেখির কি আছে? বড় মাছ কি আমরা আগে দেখিনি?’ 

লােকটি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, অবশ্যই দেখেছেন আম্মা, অবশ্যই দেখেছেনএই মাছটার ওজন হল এক মণএক সের কম এক মণ

পাখি আমার একলা পাখিঊনচল্লিশ সেরআপাকে ডাকেনআপা দেখুক, স্যার বলে দিয়েছেনআপাকে না দেখিয়ে মাছ যেন কাটা না হয়। 

রূপাকে ডাকা হলসে মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ, কি অদ্ভুত সুন্দর! রূপার পাতের মতাে ঝিকমিক করছে। 

আমি দোতলায় উঠে এলামঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, মানুষের সৌন্দর্যবােধের নানা দিক আছেমাছের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে কেটেকুটে আমরা খেয়ে ফেলছিএর কোনো মানে হয়

রাতে খেতে বসে রূপা বলল এ কি, বড় মাছটা রান্না হয়নি?” 

মুনিয়া বলল, নানা কেন?ডীপ ফ্রীজে রেখে দেয়া হয়েছেপরে রান্না হবেআমাদের নিজেদের বাজার রান্না করা হয়েছে। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ

রূপা আর কিছু বলল না, কিন্তু তার মুখ থেকে বিস্ময়ের ভাবটা দূর হল নাবড় মাছটা রান্না হয়নি, এটা সে যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে নাআমি বললাম, পাংগাশ মাছ কি তােমার খুব প্রিয়

রূপা বলল, পাংগাশ মাছ প্রিয় হবে কেন? কোনাে মাছই আমার প্রিয় নাইলিশ মাছের ডিম খানিকটা প্রিয়। 

তােমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মাছটা রান্না না হওয়ায় আপসেট হয়ে পড়েছ” 

আপসেট হবার কারণ আছে বলেই আপসেট হচ্ছিতুমি যদি শােন, তুমিও আপসেট হবেএই জন্যেই তােমাকে শােনাব নাকেন আপসেট হচ্ছি, পরশু বলব” 

এখনি বলে। 

রূপা খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লতার মন খারাপ ভাব স্থায়ী হল নাঘরে ঢুকেই গান চালিয়ে দিলআমার দিকে তাকিয়ে বলল, সাজগােজ করলে কেমন হয়? আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, রাত এগারােটায়

রাত এগারােটায় সাজা যাবে না, এমন তাে কোনাে আইন নেইআর রকম আইন থাকলেও আমি মানতাম নাআচ্ছা শােন, তুমি কি মানবেন্দ্রের গানটা শুনেছ, ওগাে সুন্দরী আজ অপরূপ সাজে, সাজো সাজো সাজো, .

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি যখন ছােট ছিলাম অর্থাৎ কলেজে যখন পড়তাম, তখন এই গানটা বাজাতে বাজাতে সাঙ্খতামআমার তখন মনে হতাে কি জানাে? মনে হতাে আমার জন্যেই যেন গানটা লেখা হয়েছেঅবশ্যি এই ব্যাপারটা এখনাে আমার মধ্যে আছে

কোনাে কোনাে গান শুনলেই মনে হয় এই গান আমার জন্যে লেখা, অন্য কারাে জন্যে নয়তােমার কি এরকম মনে হয়

না” 

তুমি ক্যামেরাটা নিয়ে এসাে তাে, আমার সাজগােজ শেষ হলে একটা ছবি তুলবে। 

ক্যামেরায় ফিল ছিল না বলে ছবি তােলা গেল নারূপা করুণ গলায় বলল, দোকানপাট নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে, এত রাতে কি আর ফিল্ম পাওয়া যাবে

পাওয়া না যাবারই কথাএসাে তাহলে শুয়ে পড়ি, কি আর করা। 

আমরা ঘুমুতে গেলাম বারােটার দিকেবাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করামাত্র রূপা বলল, মাছের ব্যাপারে কেন আপসেট হয়েছিলাম তােমাকে বলেই ফেলি। 

তােমার বলতে ইচ্ছা না হলে বলার দরকার নেই। 

ইচ্ছা হচ্ছেআজ থেকে বাইশ বছর আগে বাবা বিশাল একটা পাংগাশ মাছ এনেছিলেনমাছ নিয়ে ঘরে ঢােকামাত্র বাবা আমার জন্মসংবাদ পেলেনমাছটা রূপার মতাে চকচক করছিলমাছের রূপালি রঙ থেকে রূপা নাম নিয়ে বাবা আমার নাম রাখলেনসেই থেকে অলিখিত নিয়মের মতাে হয়ে গেল, আমার জন্মদিনে বাজারের সবচেবড় মাছটা আসবেগতবার এসেছিল চিতল মাছলম্বায় প্রায় 

আমার সমান। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ

আজ কি তােমার জন্মদিন?ইয়েস স্যারতুমি ইচ্ছে করলে শুভ জন্মদিন বলতে পারশুভ জন্মদিন রূপাথ্যাংক ইউতােমার জন্ম কি দেশে হয়েছিল? মিটফোর্ড হাসপাতালেআমার ধারণা, তােমার জন্য বিদেশেযতই দিন যাবে, দেখবে, আমার সম্পর্কে তােমার বেশির ভাগ ধারণাই ভুল। 

আজ যে তােমার জন্মদিন আগে বললে না কেন? আগে বলব কি করে? আমার নিজেরই মনে ছিল নাকি? মাছ দেখে মনে পড়ল। 

রূপা তরল গলায় হাসল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লআমার মন আসলেই খারাপ হয়ে গেলবেশ বুঝতে পারছি আজ রাতে আর ঘুম হবে না। 

এপাশওপাশ করে কাটাতে হবেজন্মদিনের খবরটা কাল ভােরে দিলেও অনিদ্রার হাত থেকে বাঁচতাম। 

রূপার বাবা ভদ্রলােককে যতটা খারাপ শুরুতে ভাবছিলাম এখন মনে হচ্ছে ভদ্রলােক হয়তাে ততটা খারাপ ননজন্মদিন মনে রাখছেন, বিশাল মাছ পাঠাচ্ছেনতবে আমার ধারণা, ভদ্রলােকের সীমা মাছ পর্যন্তইকন্যার প্রতি ভালবাসার আর কোনাে কোনাে লক্ষণ এখনাে তিনি দেখাননিবেশির ভাগ সময়ই তার কাটে দেশের বাইরেকিছু দিনের জন্যে দেশে আসেনটেলিফোন করেনমেয়ের সঙ্গে খুবই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা হয়এই পর্যন্তই। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ

আমাদের বাড়িতে রূপাকে কেউ পছন্দ করে নাশুধু লাবণ্য পছন্দ করেরূপার মতাে লাবণ্যেরও ঘুমরােগ আছেঘুম পেলেই সে রূপার পাশে গিয়ে শুয়ে 

পড়বে। 

আমাদের বাড়িতে রূপাকে সবচে বেশি অপছন্দ করে মতির মাসে সবসময়ই গলা নিচু করে মাকে কিংবা মুনিয়াকে রূপ সম্পর্কে গুজগুজ করে কি সব যেন বলেএকদিন আমি খানিকটা শুনলাম আম্মা, গরীব মানুষ, আপনেরে একটা কথা কই কিছু মনে নিয়েন নাদোষ হইলে ক্ষ্যামা দিয়েনকথাটা হইল নয়া বৌরে নিয়া। 

মা গম্ভীর গলায় বললেন, কি কথা

নয় বৌএর সাথে জ্বীন থাকে আম্মাদুনিয়ায় যারা খুব সুন্দর মাইয়া তারার সাথে দুইটা তিনটা কইরা পুরুষ জ্বীন থাকে। 

চুপ কর তাে” 

জানি আম্মা, আমার কথা শুনলে রাগ হইবেনকিন্তু কথা সত্যজ্বীনের সব লক্ষণ নয়া বৌএর আছেএই যে রাইত দিন ঘুমায়, এর কারণ কি? কারণ একটাইকইন্যা ঘুমের মইধ্যে থাকলে জ্বীন ভূতের জন্যে খুব সুবিধা। 

এই জাতীয় কথা দাঁড়িয়ে শােনা অসম্ভবআমি বাকিটা শুনিনিতবে মা নিশ্চয়ই শুনেছেনকিছুটা বিশ্বাসও করেছেনমানুষ সত্যের চেয়ে অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করেমুনিয়ার কথাই ধরা যাক, সে একটি চমৎকার মেয়েতার স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেছেলােকজনকে বলেছে স্ত্রীর চরিত্রহানি ঘটেছিল, সম্পর্ক ছিল অন্য একজনের সঙ্গেলােকজন এই অসত্যটাই বিশ্বাস করেছেশুধু লােকজন কেন, আমাদের নিকট আত্মীয়স্বজনদেরও সেরকম ধারণাঅসত্য বৃক্ষের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়অসত্য বৃক্ষকে সে কারণেই সহজে উপড়ে ফেলা যায় না

রূপা বলল, তুমি কি আমাকে সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে পারবে? কিছু জিজ্ঞেস করার সময় রূপা কখনাে চোখের দিকে তাকায় নাপ্রশ্নটা করছে আমাকে, অথচ সে তাকিয়ে আছে জানালার দিকেশুরুতে খুব বিরক্তি লাগতএখন লাগে নাবরং মনে হয় এটাই স্বাভাবিক। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *