আরে
ব্যাটা তুই হচ্ছিস ডাক্তার, তুই করবি ডাক্তারি। তাের বই লেখালেখি কি? বই লেখার টাকা কোত্থেকে পেয়েছে কে জানে। তোমার কাছ থেকে নিয়েছে নাকি? জী না।
‘আমার ধারণা ওর মা‘র কোনাে গয়না–টয়না নিয়ে বেচে ফেলেছে। ওর মা অবশ্য অস্বীকার করছে। ছেলে ওর চোখের মণি। সারাজীবন খালি ছেলে ছেলে করেছে। এখন বুঝবে ছেলের মজা।
সুমি চা এনে সামনে রাখল। মােজাহার চাচা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মনে হচ্ছে ইদানীং তিনি চোখেও কম দেখেন। যাবার সময় দরজায় ধাক্কা খেলেন। সুমি বই দিয়ে গেল। আমি তাকে চল্লিশটা টাকা দিলাম। সুমি বলল, পনেরােটা বই আমার বিক্রি করার কথা। একটা মাত্র বিক্রি করলাম। আপনি কি আরেকটা কিনবেন?
‘আরেকটা দিয়ে আমি কি করব? ‘ভাবীর জন্যে নিয়ে যান। আপনি একটা পড়বেন, ভাবী পড়বেন আরেকটা। ‘আরেকদিন যখন আসব আরেকটা কিনে নিয়ে যাব। আজ টাকা নেই। ‘বাকিতে নিয়ে যান। পরে টাকা দেবেন। “আচ্ছা যা, নিয়ে আয়।”
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
সুমি আরেকটা বই এনে দিল। আমাকে বিদায় দিতে গেট পর্যন্ত এল। আমি যখন বললাম, “যাই সুমি” , তখন সে নিচু গলায় বলল, আপনাকে একটা কথা বলি, রাগ করবেন না তাে?
না। কি কথা?” ‘আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে?”
কে বলল ?”
সুমি চুপ করে রইল। আমিও খানিকক্ষণ চুপ থেকে রাস্তায় পা বাড়ালাম। এই নিয়ে সুমির সঙ্গে কথাবার্তা বলার মানে হয় না।
বাসায় সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম না। অকারণে অনেকক্ষণ ঘােরাঘুরি করে রাত এগারােটা বাজিয়ে ফেললাম। বাসায় ফিরে দেখি রূপা খাওয়া–দাওয়া করে ঘুমুবার আয়ােজন করে ফেলেছে। লাবণ্যকে নিয়ে এসেছে তার ঘরে। আমার জন্যে বিন্দুমাত্র উদ্বেগও লক্ষ করলাম না। এত দেরি কোথায় করলাম তা–ও জানতে চাইল
আমি নিজ থেকে বললাম, সফিকের কাছে গিয়েছিলাম। ওর একটা বই বেরিয়েছে।
রূপা মশারি ফেলতে ফেলতে বলল, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপাল
আর আমাকে বলল না। আশ্চর্য তো !
‘তুমি টাকা দিয়েছ?” | ‘হুঁ। আচ্ছা লাবণ্যকে কি তার মার কাছে দিয়ে আসব, নাকি সে থাকবে। আমাদের সঙ্গে? খাট তাে বড়ই আছে। থাকুক, কি বল ?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
‘থাকুক। “তুমি কি খেয়ে এসেছ?”
‘খাবে না?
রূপা মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল।
আমি সফিকের বই খুলে কয়েক পাতা পড়তে চেষ্টা করলাম। চৈত্র মাসের দুপুরের কথা দিয়ে বইটার শুরু। একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ঝাঝ রােদে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ টায়ার ফেটে যাওয়ায় সে মহাবিরক্ত। এই ছেলেটিই বােধহয় নায়ক। তবে ছেলেটার নাম লােকমান। লােকমান নামের কেউ কি নায়ক হবে? মনে হয় না। ঔপন্যাসিকরা বাস্তববাদী লেখা যতই লিখুন না কেন, নায়ক নায়িকার নামের ব্যাপারে তাঁরা খুব সাবধান। নায়কের নাম তাঁরা রাখবেন—শুভ্র, নায়িকার নাম নীলাঞ্জনা।।
‘বাতি জ্বালানাে থাকবে ?”
আমি বই থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম, তােমার কি অসুবিধা হচ্ছে? ‘না। আলো–অন্ধকার কোনােটাতেই আমার অসুবিধা হয় না। তুমি কি বই শেষ করে তারপর শােবে?”
‘বুঝতে পারছি না। ঘুম পেলেই শােব।
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, আজ কেন জানি আমার ঘুম আসছে না। এরকম আমার কখনাে হয় না।
আমি বললাম, এমন কিছু কি ঘটেছে যার জন্যে তুমি ডিসটার্বড় হয়েছ? রূপা বলল, আমি কখনাে ডিসটার্বড় হই না। ‘কখনাে না ?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
‘মাঝে মাঝে হয়তাে হই। তাতে ঘুমের অসুবিধা হয় না। রূপবতী মেয়েদের ডিসটার্বেনসের প্রধান কারণ হল তার শরীর। সেই শরীরটাকে আমি তুচ্ছ করে দেখতে শিখেছি। এখন আমার অসুবিধা হয় না। তা ছাড়া ...‘
তা ছাড়া কি?
থাক, অন্য একদিন বলব।”
রূপা পাশ ফিরল। হয়তো ঘুমিয়ে পড়ল। লাবণ্য দু‘হাতে রূপার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে রেখেছে। আমি একই সঙ্গে সফিকের বই পড়ছি এবং রূপাকে দেখার চেষ্টা করছি। বই পড়ার এই হচ্ছে সমস্যা। বই এর দিকে তাকিয়ে পড়তে হয়। এমন কোনাে ব্যবস্থা যদি থাকত যে যে–কোন দিকে তাকিয়ে বই পড়া যেত, তাহলে ভাল হত। গান শুনতে হলে গানের দিকে কান পেতে রাখতে। হয় না। অথচ বই পড়তে হলে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
এ্যাই, শােন। রূপা উঠে বসেছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার? ‘খুব ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারবে। ফ্রীজ থেকে। ‘ঘুম আসছে না?‘
আসছে। ঘুমুচ্ছিলাম, তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে গেল।
আমি পানি আনতে গেলাম । সিড়ির গােড়ায় বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবার অনিদ্রা রােগ আছে। বাবার অনিদ্রা রােগটার একটা উপকারী দিকও আছে। গভীর রাতে তিনি যখন দেখেন তাঁর মতাে অন্য একজনও জেগে আছে, তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বােধ করেন। এবং খুশি মনে খানিকক্ষণ গল্প করেন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
আমার উপর বাবা অসম্ভব বিরক্ত। কারণ আমি দু‘বছর আগে পাশ করেছি, চাকরি–বাকরির কোনো চেষ্টা করছি না। বিয়ে করে ফেলেছি কাউকে কিছু না জানিয়ে। অত্যন্ত রূপবতী একজন তরুণী আমার স্ত্রী, যার হাবভাব কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। যার উপর প্রচণ্ড রকম রাগ করার কিছু পাচ্ছে না, আবার যাকে ভালবাসবার মতােও কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। | সিড়ির গোড়ায় আমাকে দেখে বাবার মুখের কঠিন ভাব একটু নরম হল। তিনি বললেন, এখনাে ঘুমুতে যাসনি ?
আমি বললাম, ঘুম আসছে না।
বাবার মুখের কঠিন ভাব আরাে নরম হয়ে গেল। তিনি আন্তরিক গলায় বললেন, ঘুম না এলে অস্থির হবার কিছু নেই। প্রতিরাতে ছঘণ্টা ঘুমুতেই হবে, এমন। কোনাে কথা নেই। নেপােলিয়ান মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমুতেন। লা মিজারেবল–এর লেখক। ভিক্টর হিউগাে যখন লেখালেখি করতেন, তখন দৈনিক গড়ে দুঘণ্টা ঘুমুতেন।
আমি বললাম, ও, তাই নাকি?
সবাইকে যখন দেখি ঘুমের জন্যে মহাব্যস্ত, তখন আমি মনে মনে হাসি—বৌমা কি ঘুমুচ্ছে নাকি?”
বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বৌমার কিছু ব্যাপার নিয়ে আমি তাের সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই। যদিও খুব ভাল করেই জানি ছেলের সঙ্গে এইসব ব্যাপার ডিককাস করা উচিত না। তবে ছেলের বয়স যখন একুশ ছাড়িয়ে যায় তখন খানিকটা হলেও বন্ধুর পর্যায়ে আসে। আমি তাের সঙ্গে ডিসকাস করতে চাচ্ছি নট এজ ফাদার বাট এজ এ ফ্রেণ্ড।
‘ডিসকাস করুন। ‘সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাে ডিসকাস করা যায় না। আয়, আমার ঘরে আয়।
রূপার জন্যে পানি নিয়ে যাওয়া হল না। আমি বাবার ঘরে ঢুকলাম। বাবার ঘরটা এই বাড়ির সবচে বড় ঘর। আগে এ ঘরে বাবা এবং মা ঘুমুতেন। এখন বাবা একাই ঘুমান। মা থাকেন একতলায় মুনিয়ার সঙ্গে। কারণ স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর মুনিয়া দু’বার ঘুমের অষুধ খাবার চেষ্টা করেছে। রাতে তাকে চোখে–চোখে রাখতে হয়।