পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

আরে 

ব্যাটা তুই হচ্ছিস ডাক্তার, তুই করবি ডাক্তারিতাের বই লেখালেখি কি? বই লেখার টাকা কোত্থেকে পেয়েছে কে জানেতোমার কাছ থেকে নিয়েছে নাকি? পাখি আমার একলা পাখিজী না। 

আমার ধারণা ওর মাকোনাে গয়নাটয়না নিয়ে বেচে ফেলেছেওর মা অবশ্য অস্বীকার করছেছেলে ওর চোখের মণিসারাজীবন খালি ছেলে ছেলে করেছেএখন বুঝবে ছেলের মজা। 

সুমি চা এনে সামনে রাখলমােজাহার চাচা ঘর ছেড়ে চলে গেলেনমনে হচ্ছে ইদানীং তিনি চোখেও কম দেখেনযাবার সময় দরজায় ধাক্কা খেলেন।  সুমি বই দিয়ে গেলআমি তাকে চল্লিশটা টাকা দিলামসুমি বলল, পনেরােটা বই আমার বিক্রি করার কথাএকটা মাত্র বিক্রি করলামআপনি কি আরেকটা কিনবেন

আরেকটা দিয়ে আমি কি করব? ভাবীর জন্যে নিয়ে যানআপনি একটা পড়বেন, ভাবী পড়বেন আরেকটাআরেকদিন যখন আসব আরেকটা কিনে নিয়ে যাবআজ টাকা নেইবাকিতে নিয়ে যানপরে টাকা দেবেনআচ্ছা যা, নিয়ে আয়” 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

সুমি আরেকটা বই এনে দিলআমাকে বিদায় দিতে গেট পর্যন্ত এলআমি যখন বললাম, যাই সুমি, তখন সে নিচু গলায় বলল, আপনাকে একটা কথা বলি, রাগ করবেন না তাে

নাকি কথা?আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে?” 

কে বলল ?” 

সুমি চুপ করে রইলআমিও খানিকক্ষণ চুপ থেকে রাস্তায় পা বাড়ালামএই নিয়ে সুমির সঙ্গে কথাবার্তা বলার মানে হয় না। 

বাসায় সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম নাঅকারণে অনেকক্ষণ ঘােরাঘুরি করে রাত এগারােটা বাজিয়ে ফেললামবাসায় ফিরে দেখি রূপা খাওয়াদাওয়া করে ঘুমুবার আয়ােজন করে ফেলেছেলাবণ্যকে নিয়ে এসেছে তার ঘরেআমার জন্যে বিন্দুমাত্র উদ্বেগও লক্ষ করলাম নাএত দেরি কোথায় করলাম তাজানতে চাইল 

আমি নিজ থেকে বললাম, সফিকের কাছে গিয়েছিলামওর একটা বই বেরিয়েছে। 

রূপা মশারি ফেলতে ফেলতে বলল, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপাল 

আর আমাকে বলল নাআশ্চর্য তো

তুমি টাকা দিয়েছ?| হুঁআচ্ছা লাবণ্যকে কি তার মার কাছে দিয়ে আসব, নাকি সে থাকবেআমাদের সঙ্গে? খাট তাে বড়ই আছেথাকুক, কি বল

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

থাকুকতুমি কি খেয়ে এসেছ?” 

খাবে না

রূপা মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল। 

আমি সফিকের বই খুলে কয়েক পাতা পড়তে চেষ্টা করলামচৈত্র মাসের দুপুরের কথা দিয়ে বইটার শুরুএকটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ঝাঝ রােদে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেহঠাৎ টায়ার ফেটে যাওয়ায় সে মহাবিরক্তএই ছেলেটিই বােধহয় নায়কতবে ছেলেটার নাম লােকমানলােকমান নামের কেউ কি নায়ক হবে? মনে হয় নাঔপন্যাসিকরা বাস্তববাদী লেখা যতই লিখুন না কেন, নায়ক নায়িকার নামের ব্যাপারে তাঁরা খুব সাবধাননায়কের নাম তাঁরা রাখবেনশুভ্র, নায়িকার নাম নীলাঞ্জনা। 

বাতি জ্বালানাে থাকবে ?” 

আমি বই থেকে চোখ না সরিয়ে বললাম, তােমার কি অসুবিধা হচ্ছে? নাআলোঅন্ধকার কোনােটাতেই আমার অসুবিধা হয় নাতুমি কি বই শেষ করে তারপর শােবে?” 

বুঝতে পারছি নাঘুম পেলেই শােব। 

রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, আজ কেন জানি আমার ঘুম আসছে নাএরকম আমার কখনাে হয় না। 

আমি বললাম, এমন কিছু কি ঘটেছে যার জন্যে তুমি ডিসটার্বড় হয়েছ? রূপা বলল, আমি কখনাে ডিসটার্বড় হই নাকখনাে না

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

‘মাঝে মাঝে হয়তাে হইতাতে ঘুমের অসুবিধা হয় নারূপবতী মেয়েদের ডিসটার্বেনসের প্রধান কারণ হল তার শরীরসেই শরীরটাকে আমি তুচ্ছ করে দেখতে শিখেছিএখন আমার অসুবিধা হয় নাতা ছাড়া ...‘ 

তা ছাড়া কি

থাক, অন্য একদিন বলব” 

রূপা পাশ ফিরলহয়তো ঘুমিয়ে পড়ললাবণ্য দুহাতে রূপার গলা জড়িয়ে ধরে আছেমুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে রেখেছেআমি একই সঙ্গে সফিকের বই পড়ছি এবং রূপাকে দেখার চেষ্টা করছিবই পড়ার এই হচ্ছে সমস্যাবই এর দিকে তাকিয়ে পড়তে হয়এমন কোনাে ব্যবস্থা যদি থাকত যে যেকোন দিকে তাকিয়ে বই পড়া যেত, তাহলে ভাল হতগান শুনতে হলে গানের দিকে কান পেতে রাখতেহয় নাঅথচ বই পড়তে হলে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। 

এ্যাই, শােনরূপা উঠে বসেছেআমি বললাম, কি ব্যাপার? খুব ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারবেফ্রীজ থেকেঘুম আসছে না?‘ 

আসছেঘুমুচ্ছিলাম, তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে গেল। 

আমি পানি আনতে গেলাম সিড়ির গােড়ায় বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলবাবার অনিদ্রা রােগ আছেবাবার অনিদ্রা রােগটার একটা উপকারী দিকও আছেগভীর রাতে তিনি যখন দেখেন তাঁর মতাে অন্য একজনও জেগে আছে, তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বােধ করেনএবং খুশি মনে খানিকক্ষণ গল্প করেন। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ

আমার উপর বাবা অসম্ভব বিরক্তকারণ আমি দুবছর আগে পাশ করেছি, চাকরিবাকরির কোনো চেষ্টা করছি নাবিয়ে করে ফেলেছি কাউকে কিছু না জানিয়েঅত্যন্ত রূপবতী একজন তরুণী আমার স্ত্রী, যার হাবভাব কেউ কিছু বুঝতে পারছে নাযার উপর প্রচণ্ড রকম রাগ করার কিছু পাচ্ছে না, আবার যাকে ভালবাসবার মতােও কিছু পাওয়া যাচ্ছে না| সিড়ির গোড়ায় আমাকে দেখে বাবার মুখের কঠিন ভাব একটু নরম হলতিনি বললেন, এখনাে ঘুমুতে যাসনি

আমি বললাম, ঘুম আসছে না। 

বাবার মুখের কঠিন ভাব আরাে নরম হয়ে গেলতিনি আন্তরিক গলায় বললেন, ঘুম না এলে অস্থির হবার কিছু নেইপ্রতিরাতে ছঘণ্টা ঘুমুতেই হবে, এমনকোনাে কথা নেইনেপােলিয়ান মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমুতেনলা মিজারেবলএর লেখকভিক্টর হিউগাে যখন লেখালেখি করতেন, তখন দৈনিক গড়ে দুঘণ্টা ঘুমুতেন। 

আমি বললাম, , তাই নাকি

সবাইকে যখন দেখি ঘুমের জন্যে মহাব্যস্ত, তখন আমি মনে মনে হাসিবৌমা কি ঘুমুচ্ছে নাকি?” 

বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বৌমার কিছু ব্যাপার নিয়ে আমি তাের সঙ্গে ডিসকাস করতে চাইযদিও খুব ভাল করেই জানি ছেলের সঙ্গে এইসব ব্যাপার ডিককাস করা উচিত নাতবে ছেলের বয়স যখন একুশ ছাড়িয়ে যায় তখন খানিকটা হলেও বন্ধুর পর্যায়ে আসেআমি তাের সঙ্গে ডিসকাস করতে চাচ্ছি নট এজ ফাদার বাট এজ ফ্রেণ্ড। 

ডিসকাস করুনসিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাে ডিসকাস করা যায় নাআয়, আমার ঘরে আয়। 

রূপার জন্যে পানি নিয়ে যাওয়া হল নাআমি বাবার ঘরে ঢুকলামবাবার ঘরটা এই বাড়ির সবচে বড় ঘরআগে ঘরে বাবা এবং মা ঘুমুতেনএখন বাবা একাই ঘুমানমা থাকেন একতলায় মুনিয়ার সঙ্গেকারণ স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর মুনিয়া দু’বার ঘুমের অষুধ খাবার চেষ্টা করেছেরাতে তাকে চোখেচোখে রাখতে হয়। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *