বােস রঞ্জু।
আমি বসলাম। আমার একটু গা ছমছম করতে লাগল। বাবার এই ঘরে শৈশবে অনেকবার আসতে হয়েছে। প্রতিবারই শাস্তি ভােগ করার জন্যে। সেই শাস্তিও বিচিত্র—খাটের নিচে মাথা দিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তুই তাের শ্বশুরবাড়ির হিস্ট্রি কিছু জানিস?”
‘খোঁজ নেয়ার ইচ্ছা হয়নি?”
‘তাের শ্বশুর যে এক বিদেশী মহিলা বিয়ে করেছিলেন, সেটা জানিস?” ‘জানি। ‘ঐ বিদেশী মহিলার হিস্ট্রী জানিস?”
সে ছিল নর্তকী। নাইট ক্লাবে নচিত। খুব অথেনটিক সাের্স থেকে খবর পেয়েছি। আমার ছেলেবেলার বন্ধু রহমান ঐদিন কথায় কথায় বললাে। বলতে চায়নি—আমিই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করেছি। রহমান এবং তাের শ্বশুর একসঙ্গে বাইরে ছিল। সে রূপার মা সম্পর্কে যা বলল ... ভয়াবহ! সে সব বলতে চাচ্ছি না।
নাইট ক্লাবের নর্তকী – এই একটা বাক্যই যথেষ্ট।
‘তাতে কিছু যায় আসে না বাবা। ‘কিছু যায় আসে না? ‘না। বাইশ তেইশ বছর আগের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানাের কি আছে?”
ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানাের কিছু না থাকলে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়ানাে হয় কেন? বর্তমানের ভিত থাকে অতীতে। এই যে তাের স্ত্রীর কথাই ধর — তার স্বভাব, তার মানসিকতা সে নিয়ে আসবে তার মা–বাবার কাছ থেকে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, এটাও ঠিক না বাবা। আমাকে দিয়ে দেখ – আমি কি তােমার মানসিকতা পেয়েছি? তুমি যে রকম আমি মােটেও সে রকম না। কাজ ছাড়া তুমি এক সেকেণ্ড থাকতে পার না, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে থাকতে পারি। তুমি মুহূর্তের মধ্যে রেগে আগুন হও। আমি কখনাে রাগি না।
তুই হচ্ছিস একটা মেষ। মেরি হেড এ লিটল ল্যাম্বের এক ল্যাম্ব।
এই কথাও তুমি আমাকে অসংখ্যবার বলেছ। আমি কখনাে কথা শুনে রেগে যাইনি। এখনাে যাচ্ছি না। যাই বাবা, ঘুম পাচ্ছে।
বাবা হঠাৎ গলার স্বর বেশ কঠিন করে বললেন, আমি চাই না তুই তাের বৌ নিয়ে এই বাড়িতে বাস করিস। তুই অন্য কোথাও উঠে যা।
আমি বললাম, আচ্ছা। ‘কথার কথা আমি বলছি না। আমি সত্যি সত্যি তাই চাচ্ছি। ‘শিগগিরই সব সমস্যার সমধান করে ফেলব বাবা। এখন যাই।‘
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি উঠে চলে এলাম। ফ্রীজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে এসেছি। কিন্তু রূপা ঘুমুচ্ছে ... আহ, কি সুন্দর তাকে লাগছে! বাবার ঘরে ডাক পড়েছে।
জজীয়তীয়ের অভ্যাস তিনি এখনাে ছাড়তে পারেননি। কিছু দিন পর পর তিনি জাজ সাহেবের ভূমিকায় নামেন। অভিযােগ আমার বিরুদ্ধে হলেও পুরাে বিষয়টির নেপথ্যে যে রূপা আছে তা বুঝতে পারছি। তবে কোন্ কোন্ বিষয় আলােচনা হবে তা বুঝতে পারছি না। এ জাতীয় বিচার সভা এর আগেও হয়েছে। শুরুটা হয় আন্তরিক ভঙ্গিতে। টি পটে চা থাকে, চা খাওয়া হয়। টুক টাক কথা হয়। শীতকালে বলা হয় – বেশ শীত পড়েছে। গরমকালে অত্যধিক গরম নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ হয়। চা শেষ হবার পর বাবা তাঁর ইজিচেয়ারে আধশােয়া হয়ে বসেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বারান্দার ইজিচেয়ার এই উপলক্ষ্যে বাবার ঘরে নেয়া হয়। খানিকক্ষণ তাঁর পা নাচে। এক সময় পা নাচা বন্ধ হয়। তিনি চোখ বন্ধ করে বলেন – রঞ্জু, তােমাকে আমার দু‘একটা কথা বলার আছে। দেখা যায় দু‘একটা না, তাঁর অসংখ্য কথাই বলার আছে। বাবার স্মৃতিশক্তি খুব একটা ভাল বলে আমার কখনো মনে হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার বিষয়ে তাঁর স্মৃতিশক্তি অসম্ভব তীক্ষ্ণ। চার বছর বয়স থেকে আমি কি কি অপরাধ করেছি তা এক এক করে বলা হয়। মােটামুটি চরিত্র বিশ্লেষণ যাকে বলে। সব অপরাধ নিয়ে কথা বলা শেষ হবার পর সেদিনের আলােচ্যসূচি আসে। ঘণ্টা দুই সময় তাতে লাগে। এই দু ঘণ্টা সময় বাবা খুব উপভোগ করেন বলেই আমার ধারণা।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
আজ বাবার বিখ্যাত বিচার সভা বসল রাত দশটায়। এই জাতীয় সভায় পরিবারের সকল সদস্যের উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাবু সভা শুরুর আগেই বলল, আমি থাকতে পারব না। পড়া ফেলে এসেছি। বাবা বললেন, দশ পনেরাে মিনিটে তোমার পড়া মাথায় উঠবে না। বােস।
বাবু গম্ভীর গলায় বলল, আমার পড়াশােনার ব্যাপারটা আমি দেখব। এই বিষয়ে কেউ কিছু বললে আমার ভাল লাগে না। আমি ঠিক ঘড়ি দেখে কুড়ি মিনিট থাকব। এর মধ্যে যার যা বলার বলে শেষ করতে হবে।
বলেই বাবু হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল। বাবুর এই সব কাণ্ডকারখানা সভার চরিত্র খানিকটা বদলে দিল। সভা পুরানাে রুটিন মত অগ্রসর হল না। আমি অতীতে কি করেছি না করেছি তা আলােচনা করার সুযােগ বাবা পেলেন না। সরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলেন –“আমি সবাইকে এখানে ডেকেছি বৌমা সম্পর্কে দু‘একটা কথা বলার জন্য।”
বাবু বলল, ভাবীর প্রসঙ্গে কথা বলবেন – ভাবী কোথায়?
মা বললেন, তার এখানে থাকার প্রয়ােজন নেই। ‘যার প্রসঙ্গে কথা সে এখানে থাকবে না, তা কি করে হয়?”
বাবা বললেন, তুই খুব বিরক্ত করছিস – তার এখানে থাকার প্রয়ােজন কেন নেই তা কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবি। একটা সিনেমা পত্রিকায় তার একটা ছবি ছাপা হয়েছে। সেটা নিয়েই দু‘একটা কথা বলতে চাই।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ
বাবু বিস্মিত গলায় বলল, ভাবী ছবি করছে, কাজেই সিনেমা পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হবেই। খেলাধুলা করলে স্পাের্টস পত্রিকায় ছবি ছাপা হত।
বাবা বললেন, তুই বেশি বকবক করছিস। যা তুই, তাের ঘরে গিয়ে পড়াশােনা কর। চলে যা। | বাবু ঘড়ি দেখে বলল, কুড়ি মিনিট এখনাে হয় নি। কুড়ি মিনিট হােক, তারপর যাব।
মা বললেন, যে রকম ছবি ছাপা হয়েছে কোন ভদ্রঘরের মেয়ের সে রকম ছবি ছাপা হয় না। পুকুর থেকে উঠে আসছে সারা শরীর ভেজা। শাড়ি গায়ে লেপ্টে আছে। ব্লাউজ নেই – আমার বলতেও ঘেন্না লাগছে। এই পরিবারের একটা সম্মান আছে। দশজনের সঙ্গে মিলে মিশে আমাদের থাকতে হয়। আমার বা তাের বাবার বংশে এ জাতীয় ঘটনা ঘটে নি।
বাবু বলল, তােমাদের বংশে কোন অভিনেত্রী ছিল না বলে এজাতীয় ঘটনা ঘটে নি। অভিনেত্রী থাকলে ঘটত।
বাবু, তুই উঠে যা। তাের মাথা গরম হয়ে আছে।
বাবু ঘড়ি দেখে বলল, এখনাে দশ মিনিট আছে। দশ মিনিট পার হােক, তারপর যাব।
দশ মিনিট কেউ কোন কথা বলল না। চারদিক নিস্তব্ধ। দশ মিনিটকে মনে হল অনন্ত কাল। বাবু উঠে যাবার পর মা বললেন, আমি এই বিষয় নিয়ে বোমার সঙ্গে কথা বলেছি। বৌমা বলল, সে নাকি ছবি ছাপানােয় সম্মানহানির কিছু দেখতে পায় নি। আমি তাকে বললাম, এ বাড়িতে থেকে এসব জিনিস করা যাবে না। সে বলল, এ বাড়িতে আমি বেশিদিন থাকব না। অল্প ক‘টা দিন। এই কথার মানে কি তাই আমি জানতে চাই। রঞ্জু, সে এই কথা কেন বলল ?