পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

বােস রঞ্জু। 

আমি বসলামআমার একটু গা ছমছম করতে লাগলবাবার এই ঘরে শৈশবে অনেকবার আসতে হয়েছেপ্রতিবারই শাস্তি ভােগ করার জন্যেসেই শাস্তিও বিচিত্রখাটের নিচে মাথা দিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাপাখি আমার একলা পাখিতুই তাের শ্বশুরবাড়ির হিস্ট্রি কিছু জানিস?” 

‘খোঁজ নেয়ার ইচ্ছা হয়নি?” 

তাের শ্বশুর যে এক বিদেশী মহিলা বিয়ে করেছিলেন, সেটা জানিস?জানিবিদেশী মহিলার হিস্ট্রী জানিস?” 

সে ছিল নর্তকীনাইট ক্লাবে নচিতখুব অথেনটিক সাের্স থেকে খবর পেয়েছিআমার ছেলেবেলার বন্ধু রহমান ঐদিন কথায় কথায় বললােবলতে চায়নিআমিই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করেছিরহমান এবং তাের শ্বশুর একসঙ্গে বাইরে ছিলসে রূপার মা সম্পর্কে যা বলল ... ভয়াবহ! সে সব বলতে চাচ্ছি না। 

নাইট ক্লাবের নর্তকী এই একটা বাক্যই যথেষ্ট। 

তাতে কিছু যায় আসে না বাবাকিছু যায় আসে না? নাবাইশ তেইশ বছর আগের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানাের কি আছে?” 

ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানাের কিছু না থাকলে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়ানাে হয় কেন? বর্তমানের ভিত থাকে অতীতেএই যে তাের স্ত্রীর কথাই ধর তার স্বভাব, তার মানসিকতা সে নিয়ে আসবে তার মাবাবার কাছ থেকে। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, এটাও ঠিক না বাবাআমাকে দিয়ে দেখ আমি কি তােমার মানসিকতা পেয়েছি? তুমি যে রকম আমি মােটেও সে রকম নাকাজ ছাড়া তুমি এক সেকেণ্ড থাকতে পার না, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ বসে থাকতে পারিতুমি মুহূর্তের মধ্যে রেগে আগুন হওআমি কখনাে রাগি না। 

তুই হচ্ছিস একটা মেষমেরি হেড লিটল ল্যাম্বের এক ল্যাম্ব। 

এই কথাও তুমি আমাকে অসংখ্যবার বলেছআমি কখনাে কথা শুনে রেগে যাইনিএখনাে যাচ্ছি নাযাই বাবা, ঘুম পাচ্ছে। 

বাবা হঠাৎ গলার স্বর বেশ কঠিন করে বললেন, আমি চাই না তুই তাের বৌ নিয়ে এই বাড়িতে বাস করিসতুই অন্য কোথাও উঠে যা। 

আমি বললাম, আচ্ছাকথার কথা আমি বলছি নাআমি সত্যি সত্যি তাই চাচ্ছিশিগগিরই সব সমস্যার সমধান করে ফেলব বাবাএখন যাই‘ 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি উঠে চলে এলামফ্রীজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে এসেছিকিন্তু রূপা ঘুমুচ্ছে ... আহ, কি সুন্দর তাকে লাগছেবাবার ঘরে ডাক পড়েছে। 

জজীয়তীয়ের অভ্যাস তিনি এখনাে ছাড়তে পারেননিকিছু দিন পর পর তিনি জাজ সাহেবের ভূমিকায় নামেনঅভিযােগ আমার বিরুদ্ধে হলেও পুরাে বিষয়টির নেপথ্যে যে রূপা আছে তা বুঝতে পারছিতবে কোন্ কোন্ বিষয় আলােচনা হবে তা বুঝতে পারছি নাজাতীয় বিচার সভা এর আগেও হয়েছেশুরুটা হয় আন্তরিক ভঙ্গিতেটি পটে চা থাকে, চা খাওয়া হয়টুক টাক কথা হয়শীতকালে বলা হয় বেশ শীত পড়েছেগরমকালে অত্যধিক গরম নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ হয়চা শেষ হবার পর বাবা তাঁর ইজিচেয়ারে আধশােয়া হয়ে বসেন

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বারান্দার ইজিচেয়ার এই উপলক্ষ্যে বাবার ঘরে নেয়া হয়খানিকক্ষণ তাঁর পা নাচেএক সময় পা নাচা বন্ধ হয়তিনি চোখ বন্ধ করে বলেন রঞ্জু, তােমাকে আমার দুএকটা কথা বলার আছেদেখা যায় দুএকটা না, তাঁর অসংখ্য কথাই বলার আছেবাবার স্মৃতিশক্তি খুব একটা ভাল বলে আমার কখনো মনে হয়নিকিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার বিষয়ে তাঁর স্মৃতিশক্তি অসম্ভব তীক্ষ্ণচার বছর বয়স থেকে আমি কি কি অপরাধ করেছি তা এক এক করে বলা হয়মােটামুটি চরিত্র বিশ্লেষণ যাকে বলেসব অপরাধ নিয়ে কথা বলা শেষ হবার পর সেদিনের আলােচ্যসূচি আসেঘণ্টা দুই সময় তাতে লাগেএই দু ঘণ্টা সময় বাবা খুব উপভোগ করেন বলেই আমার ধারণা। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ

আজ বাবার বিখ্যাত বিচার সভা বসল রাত দশটায়এই জাতীয় সভায় পরিবারের সকল সদস্যের উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়কিন্তু বাবু সভা শুরুর আগেই বলল, আমি থাকতে পারব নাপড়া ফেলে এসেছিবাবা বললেন, দশ পনেরাে মিনিটে তোমার পড়া মাথায় উঠবে নাবােস। 

বাবু গম্ভীর গলায় বলল, আমার পড়াশােনার ব্যাপারটা আমি দেখবএই বিষয়ে কেউ কিছু বললে আমার ভাল লাগে নাআমি ঠিক ঘড়ি দেখে কুড়ি মিনিট থাকবএর মধ্যে যার যা বলার বলে শেষ করতে হবে। 

বলেই বাবু হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলবাবুর এই সব কাণ্ডকারখানা সভার চরিত্র খানিকটা বদলে দিলসভা পুরানাে রুটিন মত অগ্রসর হল নাআমি অতীতে কি করেছি না করেছি তা আলােচনা করার সুযােগ বাবা পেলেন নাসরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলেন আমি সবাইকে এখানে ডেকেছি বৌমা সম্পর্কে দুএকটা কথা বলার জন্য” 

বাবু বলল, ভাবীর প্রসঙ্গে কথা বলবেন ভাবী কোথায়

মা বললেন, তার এখানে থাকার প্রয়ােজন নেইযার প্রসঙ্গে কথা সে এখানে থাকবে না, তা কি করে হয়?” 

বাবা বললেন, তুই খুব বিরক্ত করছিস তার এখানে থাকার প্রয়ােজন কেন নেই তা কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবিএকটা সিনেমা পত্রিকায় তার একটা ছবি ছাপা হয়েছেসেটা নিয়েই দুএকটা কথা বলতে চাই

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ুন আহমেদ 

বাবু বিস্মিত গলায় বলল, ভাবী ছবি করছে, কাজেই সিনেমা পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হবেইখেলাধুলা করলে স্পাের্টস পত্রিকায় ছবি ছাপা হত। 

বাবা বললেন, তুই বেশি বকবক করছিসযা তুই, তাের ঘরে গিয়ে পড়াশােনা করচলে যা| বাবু ঘড়ি দেখে বলল, কুড়ি মিনিট এখনাে হয় নিকুড়ি মিনিট হােক, তারপর যাব। 

মা বললেন, যে রকম ছবি ছাপা হয়েছে কোন ভদ্রঘরের মেয়ের সে রকম ছবি ছাপা হয় নাপুকুর থেকে উঠে আসছে সারা শরীর ভেজাশাড়ি গায়ে লেপ্টে আছেব্লাউজ নেই আমার বলতেও ঘেন্না লাগছেএই পরিবারের একটা সম্মান আছেদশজনের সঙ্গে মিলে মিশে আমাদের থাকতে হয়আমার বা তাের বাবার বংশে জাতীয় ঘটনা ঘটে নি 

বাবু বলল, তােমাদের বংশে কোন অভিনেত্রী ছিল না বলে এজাতীয় ঘটনা ঘটে নিঅভিনেত্রী থাকলে ঘটত। 

বাবু, তুই উঠে যাতাের মাথা গরম হয়ে আছে। 

বাবু ঘড়ি দেখে বলল, এখনাে দশ মিনিট আছেদশ মিনিট পার হােক, তারপর যাব। 

দশ মিনিট কেউ কোন কথা বলল নাচারদিক নিস্তব্ধদশ মিনিটকে মনে হল অনন্ত কালবাবু উঠে যাবার পর মা বললেন, আমি এই বিষয় নিয়ে বোমার সঙ্গে কথা বলেছিবৌমা বলল, সে নাকি ছবি ছাপানােয় সম্মানহানির কিছু দেখতে পায় নিআমি তাকে বললাম, এ বাড়িতে থেকে এসব জিনিস করা যাবে নাসে বলল, বাড়িতে আমি বেশিদিন থাকব নাঅল্প টা দিনএই কথার মানে কি তাই আমি জানতে চাইরঞ্জু, সে এই কথা কেন বলল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *