আমি হাঁটছি আর ভাবছি – কোনাে কিছু নিয়ে চিন্তা করবে না। পৃথিবী রসাতলে যাক কিছুই যায় আসে না। বাস্তবে তা হচ্ছে না, মাথার ভেতরে রূপা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে ফেরেনি।
কোথায় গিয়েছে তাও জানি না। মাথায় বেশ কয়েকটা সম্ভাবনা খেলা করছে। কোনােটাই খুব স্পষ্ট নয়। স্বপ্ন দৃশ্যের মতাে অস্পষ্ট এবং দুর্বল যুক্তির সম্ভাবনা। মাথার ভেতর এক সংগে অনেকগুলাে ভাবনা। একটা অন্যটার ভেতর জড়িয়ে জট লেগে গেছে। খণ্ড খণ্ড দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে, ভেসেই মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি দৃশ্যের উল্লেখ করা যাক।
সময় ঃ রাত ৩টা
পুলিশের গাড়ি এসে থামল। দরজায় নক। বুটের লাথি। পুলিশ কখনাে কলিং বেল বাজায় না। কলিং বেল খুঁজে বের করার মতাে ধৈর্য এদের নেই। আমি দরজা খুলে দিলাম। পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি কি রূপার স্বামী? (এইখানে লজিক খুব দুর্বল। আমাকে দেখেই পুলিশ অফিসার কি করে বুঝবেন আমি রূপার স্বামী? শার্লক হােমসেরও এটা বােঝার জন্যে সময় লাগার কথা। তবে অলস চিন্তায় দূর্বল লজিকও চলে যায়। আমি পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বললাম, হ্যা। আপনারা কি চান?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আপনাকে একটু আমাদের সংগে থানায় যেতে হচ্ছে। ‘কেন বলুন তো?” ‘থানায় গিয়েই বলব।
আমি তাদের সংগে জীপে উঠে বসলাম, জীপ উড়ে চলল। পথ ফুরাচ্ছেই না। আমি ঝিম ধরে বসে আছি।
সময় ঃ ভাের ৯টা
আমি চা খাচ্ছি। মুনিয়া খবরের কাগজটা আমার কোলে ফেলে দিয়ে বলল, এই নে কাগজ। আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ বুলাচ্ছি। হেডিং পড়বার পর কোনাে খবরই বিস্তারিত পড়তে ইচ্ছা করছে না। একটা খবরে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। ‘অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতীর লাশ উদ্ধার। যুবতীর বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে – এ রূপা। রূপা ছাড়া আর কেউ নয় ...
সময় : দুপুর আমি ঘুমুচ্ছি। টেলিফোন এল। টেলিফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে রূপা বলল,
কে? তুমি ?
‘ভালো আছ ?” ‘আছি। ‘তােমাকে একটা জরুরী বিষয় বলার জন্যে টেলিফোন করেছি।
বল।
‘তােমার সংগে আর জীবন–যাপন করতে পরাছি না। আমি দূরে সরে গেলাম। কিছু মনে করাে না।
“আচ্ছা। ‘টেলিফোন রাখি, কেমন?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখার শব্দ | দৃশ্যের সমাপ্তি। আমি আবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাঙা ঘুম জোড়া লাগাবার চেষ্টা করছি।
যে তিনটি খণ্ড দৃশ্যের কথা উল্লেখ করলাম তা থেকে কি আমার মানসিক অবস্থা বােঝা যাচ্ছে? আমাকে কি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে? আমি জানি, তা
মনে হচ্ছে না। আমি প্রচণ্ড রকম দুশ্চিন্তা ভােগ করছি না। এক ধরনের শূন্যতা বােধ করছি।
পাখি আমার একলা পাখি
আমাদের বাসার অন্য সবাইও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে। যে বাড়ির বৌ কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে – রাত একটা বেজে গেছে এখনাে ফিরছে না, তাদের এতাে নিশ্চিন্তে ঘুমানাের প্রশ্ন উঠে না। তারা তা করতে পারছে, কারণ আমি তাদের দুশ্চিন্তা দূর করেছি। খুব ভালােভাবেই দূর করেছি।
লাবণ্যর সমস্যা মিটে যাবার পর মা যখন অত্যন্ত চিন্তিত গলায় বললেন, কি রে বউমা আসছে না কেন? তখন আমি বিস্মিত গলায় বললাম, আসবে কেন? বান্ধবীর জন্মদিনে গেছে, সেখান থেকে বাপের বাড়িতে চলে যাবে। তার কোনাে এক মামাতাে বােন এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে। তার সংগে সারারাত গল্প বলার প্ল্যান।।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
“তােকে নিয়ে গেল না কেন? ‘দু’বােন গল্প করবে, সেখানে শুধু শুধু আমাকে নিয়ে যাবে কেন?”
মা পুরােপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন। মানুষের দুশ্চিন্তা কতাে সহজেই না দূর করা যায় ! এখন যদি কেউ টেলিফোন করে আমাকে শুধু বলে, রূপা বিয়েবাড়িতে গিয়ে আটকা পড়েছে, ভােরবেলা ফিরবে। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে যাবাে। আমার সুনিদ্রা হবে। সুন্দর কিছু স্বপ্নও দেখে ফেলতে পারি রাত দুইটার দিকে ঘুমুতে গেলাম। ভালাে ঘুম হল। আশ্চর্যের ব্যাপার, স্বপ্নও দেখলাম। স্বপ্নে দাড়িওয়ালা এক লােকের সংগে খুব গল্প হচ্ছে – কিছুক্ষণ পরপর সে বলছে, ভাইজান, ভাইজান।
পাখি আমার একলা পাখি
বলেই আবার খানিকক্ষণ পর পর হাসছে – সেই হাসি মেয়েলী গলার হাসি। গলাটও চেনা চেনা, রূপার গলার সংগে মিল আছে। ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখি হাসছে রূপা। রূপ লাবণ্যকে কাতুকুতু দিচ্ছে, লাবণ্য হাসছে, রূপাও হাসছে। দু‘জনই আমার বিছানায়। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবুর ঘুম ভাঙল ?
আমি কিছু বললাম না। রূপা বলল, আমরা দুজন আধ ঘণ্টা ধরে তােমার বিছানার পাশে হাসাহাসি করছি তারপরেও তােমার ঘুম ভাঙছে না, আশ্চর্য ঘুম তাে তােমার! আমি হাই তুলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। প্রায় জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, কখন এসেছাে? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলাম। থাক। ছাড়া ছাড়া ভাবটাই ভালাে। রূপা আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললাে, এই শুনছাে ?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ
‘শুনছি। ‘কাল যা বিপদে পড়েছিলাম – মাই গড! “তাই নাকি?
ডেমরার কাছে আমাদের জীপ একটা ভিখিরীকে হিট করল। বেচারার মাথা ফেটে রক্তারক্তি। পাবলিক ফিউরিয়াস। কেলেংকারি হয়ে যাবার অবস্থা। আমাদের সঙ্গে আকবর ছিল। আকবর যে কোনো সিচুয়েশন ম্যানেজ করতে পারে। সে সিচুয়েশন ম্যানেজ করে ফেলল। আমরা ভিখিরীকে হাসপাতালে নিয়ে এলাম। থানা পুলিশ। ভিখিরী এই মরে, সেই মরে।
পাখি আমার একলা পাখি
আমরা চলে আসতে পারতাম। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব ইনহিউম্যান মনে হল। আমি আর আকবর দু’জন রয়ে গেলাম। তিনবার টেলিফোন করলাম, কেউ টেলিফোন ধরে না।
‘ভিখিরীর অবস্থা কেমন ?” ‘এখন একটু স্টেবল। ডাক্তাররা বলছেন আউট অব ডেনজার। চা খাবে?” ‘খেতে পারি। ‘মুখ ধুয়ে এসাে। চা আসছে। মুনিয়াকে চা দিতে বলে এসেছি। সে এক্ষুণি আনবে। | রূপা আবার লাবণ্যকে হাসাতে লাগল।