পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি হাঁটছি আর ভাবছি কোনাে কিছু নিয়ে চিন্তা করবে নাপৃথিবী রসাতলে যাক কিছুই যায় আসে নাবাস্তবে তা হচ্ছে না, মাথার ভেতরে রূপা ঘুরপাক খাচ্ছেসে ফেরেনি

পাখি আমার একলা পাখিকোথায় গিয়েছে তাও জানি নামাথায় বেশ কয়েকটা সম্ভাবনা খেলা করছেকোনােটাই খুব স্পষ্ট নয়স্বপ্ন দৃশ্যের মতাে অস্পষ্ট এবং দুর্বল যুক্তির সম্ভাবনামাথার ভেতর এক সংগে অনেকগুলাে ভাবনাএকটা অন্যটার ভেতর জড়িয়ে জট লেগে গেছেখণ্ড খণ্ড দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে, ভেসেই মিলিয়ে যাচ্ছেকয়েকটি দৃশ্যের উল্লেখ করা যাক। 

সময়রাত ৩টা 

পুলিশের গাড়ি এসে থামলদরজায় নকবুটের লাথিপুলিশ কখনাে কলিং বেল বাজায় নাকলিং বেল খুঁজে বের করার মতাে ধৈর্য এদের নেইআমি দরজা খুলে দিলামপুলিশ অফিসার বললেন, আপনি কি রূপার স্বামী? (এইখানে লজিক খুব দুর্বলআমাকে দেখেই পুলিশ অফিসার কি করে বুঝবেন আমি রূপার স্বামী? শার্লক হােমসেরও এটা বােঝার জন্যে সময় লাগার কথাতবে অলস চিন্তায় দূর্বল লজিকও চলে যায়আমি পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বললাম, হ্যাআপনারা কি চান?

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ 

আপনাকে একটু আমাদের সংগে থানায় যেতে হচ্ছেকেন বলুন তো?থানায় গিয়েই বলব। 

আমি তাদের সংগে জীপে উঠে বসলাম, জীপ উড়ে চললপথ ফুরাচ্ছেই নাআমি ঝিম ধরে বসে আছি। 

সময়ভাের ৯টা 

আমি চা খাচ্ছিমুনিয়া খবরের কাগজটা আমার কোলে ফেলে দিয়ে বলল, এই নে কাগজআমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ বুলাচ্ছিহেডিং পড়বার পর কোনাে খবরই বিস্তারিত পড়তে ইচ্ছা করছে নাএকটা খবরে হঠাৎ চোখ আটকে গেলঅনিন্দ্য সুন্দরী যুবতীর লাশ উদ্ধারযুবতীর বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে রূপারূপা ছাড়া আর কেউ নয় ..

সময় : দুপুর আমি ঘুমুচ্ছিটেলিফোন এলটেলিফোন ধরলামওপাশ থেকে রূপা বলল

কে? তুমি

ভালো আছ ?” আছিতােমাকে একটা জরুরী বিষয় বলার জন্যে টেলিফোন করেছি। 

বল। 

তােমার সংগে আর জীবনযাপন করতে পরাছি নাআমি দূরে সরে গেলামকিছু মনে করাে না। 

আচ্ছাটেলিফোন রাখি, কেমন

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ 

খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখার শব্দ | দৃশ্যের সমাপ্তিআমি আবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাঙা ঘুম জোড়া লাগাবার চেষ্টা করছি। 

যে তিনটি খণ্ড দৃশ্যের কথা উল্লেখ করলাম তা থেকে কি আমার মানসিক অবস্থা বােঝা যাচ্ছে? আমাকে কি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে? আমি জানি, তা 

মনে হচ্ছে নাআমি প্রচণ্ড রকম দুশ্চিন্তা ভােগ করছি নাএক ধরনের শূন্যতা বােধ করছি। 

পাখি আমার একলা পাখি

আমাদের বাসার অন্য সবাইও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছেযে বাড়ির বৌ কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে রাত একটা বেজে গেছে এখনাে ফিরছে না, তাদের এতাে নিশ্চিন্তে ঘুমানাের প্রশ্ন উঠে নাতারা তা করতে পারছে, কারণ আমি তাদের দুশ্চিন্তা দূর করেছিখুব ভালােভাবেই দূর করেছি। 

লাবণ্যর সমস্যা মিটে যাবার পর মা যখন অত্যন্ত চিন্তিত গলায় বললেন, কি রে বউমা আসছে না কেন? তখন আমি বিস্মিত গলায় বললাম, আসবে কেন? বান্ধবীর জন্মদিনে গেছে, সেখান থেকে বাপের বাড়িতে চলে যাবেতার কোনাে এক মামাতাে বােন এসেছে সিঙ্গাপুর থেকেতার সংগে সারারাত গল্প বলার প্ল্যান। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ 

তােকে নিয়ে গেল না কেন? দুবােন গল্প করবে, সেখানে শুধু শুধু আমাকে নিয়ে যাবে কেন?” 

মা পুরােপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেনমানুষের দুশ্চিন্তা কতাে সহজেই না দূর করা যায় ! এখন যদি কেউ টেলিফোন করে আমাকে শুধু বলে, রূপা বিয়েবাড়িতে গিয়ে আটকা পড়েছে, ভােরবেলা ফিরবেআমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে যাবােআমার সুনিদ্রা হবেসুন্দর কিছু স্বপ্নও দেখে ফেলতে পারি রাত দুইটার দিকে ঘুমুতে গেলামভালাে ঘুম হল। আশ্চর্যের ব্যাপার, স্বপ্নও দেখলামস্বপ্নে দাড়িওয়ালা এক লােকের সংগে খুব গল্প হচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর সে বলছে, ভাইজান, ভাইজান

পাখি আমার একলা পাখি

বলেই আবার খানিকক্ষণ পর পর হাসছে সেই হাসি মেয়েলী গলার হাসিগলাটও চেনা চেনা, রূপার গলার সংগে মিল আছেঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখি হাসছে রূপারূপ লাবণ্যকে কাতুকুতু দিচ্ছে, লাবণ্য হাসছে, রূপাও হাসছেদুজনই আমার বিছানায়রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবুর ঘুম ভাঙল

আমি কিছু বললাম নারূপা বলল, আমরা দুজন আধ ঘণ্টা ধরে তােমার বিছানার পাশে হাসাহাসি করছি তারপরেও তােমার ঘুম ভাঙছে না, আশ্চর্য ঘুম তাে তােমার! আমি হাই তুলে চোখ বন্ধ করে ফেললামপ্রায় জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, কখন এসেছাে? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলামথাকছাড়া ছাড়া ভাবটাই ভালাে। রূপা আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললাে, এই শুনছাে

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২২)-হুমায়ুন আহমেদ 

শুনছিকাল যা বিপদে পড়েছিলাম মাই গড! তাই নাকি

ডেমরার কাছে আমাদের জীপ একটা ভিখিরীকে হিট করলবেচারার মাথা ফেটে রক্তারক্তিপাবলিক ফিউরিয়াসকেলেংকারি হয়ে যাবার অবস্থাআমাদের সঙ্গে আকবর ছিলআকবর যে কোনো সিচুয়েশন ম্যানেজ করতে পারেসে সিচুয়েশন ম্যানেজ করে ফেললআমরা ভিখিরীকে হাসপাতালে নিয়ে এলামথানা পুলিশভিখিরী এই মরে, সেই মরে

পাখি আমার একলা পাখি

আমরা চলে আসতে পারতামআমার কাছে ব্যাপারটা খুব ইনহিউম্যান মনে হলআমি আর আকবর দুজন রয়ে গেলামতিনবার টেলিফোন করলাম, কেউ টেলিফোন ধরে না। 

ভিখিরীর অবস্থা কেমন ?এখন একটু স্টেবল। ডাক্তাররা বলছেন আউট অব ডেনজারচা খাবে?” খেতে পারিমুখ ধুয়ে এসােচা আসছেমুনিয়াকে চা দিতে বলে এসেছিসে এক্ষুণি আনবে| রূপা আবার লাবণ্যকে হাসাতে লাগল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *