গেছে। আমাদের খাবার দেয়া হচ্ছে না, কারণ এতিম দু‘জন অতিথি। এরা খাওয়া শেষ করলে আমরা খার। | এতিম দু’জনের মধ্যে একজন উসখুস করছে। চলে যেতে চাচ্ছে। মনে হয় এ তেমন ক্ষুধার্ত না, কিংবা নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করার মত সাহস তার আছে। শূন্য থালা সামনে নিয়ে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায় ? তাদের দুজনের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছে সাংকেতিক ভাষায় যার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝলাম না। কথা–বার্তা এ রকম,
রূপা ও কিটেমন ইটাছ? লাবণ্য ও ভিটাল ইটাছি। রূপা ও তিটুমি ইটামাকিটে ভিটাল বিটাস? লাবণ্য ঃ বিটাসি।
আমি ওদের অদ্ভুত ভাষার কথাবার্তা শুনছি। মজাই লাগছে। এই ভাষার ওপর মনে হয় এদের দুজনেরই বেশ দখল। দ্রুত কথা বলে যাচ্ছে। এমন মজার কথাবার্তর মাঝখানে হাসপাতাল থেকে খবর এল ভিখিরী মারা গেছে। রূপা কঁদিতে শুরু করল। হৈচৈ ধরনের কান্না। মা বিস্মিত হয়ে বললেন, বৌমা কাঁদছে কেন?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি বললাম, একজন ভিখিরী মারা গেছে তাই কাঁদছে। ‘তামাশা করছিস নাকি ? ‘না, তামাশা করছি না। শুধু শুধু তামাশা করব কেন?”
মা কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আজ মাসের প্রথম শুক্রবার।
মাসের প্রথম শুক্রবারে মা কিছু এতিম খাওয়ান। বেজোড় সংখ্যক এতিম — তিন, পাঁচ, কিংবা সাত। কোন হাদিসে তিনি পড়েছেন আল্লাহ নিজে যেহেতু বেজোড় তিনি বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন। বেজোড় সংখ্যার উপর আল্লাহর খাস রহমত।
কাজের ছেলে মাখন গিযেছে এতিমের সন্ধানে। বাসায় তেহারী রান্না হচ্ছে। মা নিজেই রাঁধছেন। বাজারও তিনি নিজেই তাঁর রােজগারের টাকায় করে নিয়ে এসেছেন। কুটা বাছা সব নিজে করবেন। এতিমদের পরিবেশনার দায়িত্বও তাঁর নিজের। সােয়াবের ভাগ অন্য কাউকে দেবেন না। সবটাই তাঁর।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ুন আহমেদ
এতিম খাওয়ানাের দিনে আমরা একটু ভয়ে ভয়ে থাকি কারণ মার মেজাজ থাকে খুব খারাপ। তিনি খিদে সহ্য করতে পারেন না, এই দিনে তিনি রােজা রাখেন। বলে মাথা ঠিক থাকে না।
আজ তাঁর মাথা অন্যদিনের চেয়েও খারাপ কারণ কাজের ছেলে খুঁজে পেতে মাত্র দু‘জন এতিম ধরে এনেছে। বেজোড় আনার কথা, জোড় এনেছে। তাদের খেতে দেয়া হয়নি, বসিয়ে রাখা হয়েছে। মাখন আবারাে গেছে। তার ফেরার নাম নেই। আড়াইটা বেজে
পৌনে তিনটায় সাইকেলের পছনে বসিয়ে মাখন তৃতীয় এতিম নিয়ে উপস্থিত হল। মাখনের মুখ ভর্তি হাসি। মা বললেন, একটা এতিম জোগাড় করতে এতক্ষণ লাগল ?
মাখন দাঁত বের করে বলল, আসল নকল বিচার কইরা আনা লাগে না? নকল এতিমে ঢাকা ভর্তি।।
যেটা এনেছিস সেটা আসল?”
বাজাইয়া আনছি আম্মা। আর মা তিনজনকেই বসে বসে খাওয়ালেন। আরেকটু নাও’, ‘আরেকটু নাও‘ বলে খাদিমদারি করলেন। খাওয়ার শেষে পান সুপারি এবং তিনটা করে টাকা দেয়া হল। মা আনন্দিত মনে ঘরে ঢুকলেন। আর তখনি রূপার সঙ্গে তাঁর বড় ধরনের ঝামেলা বেঁধে গেল।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ুন আহমেদ
ঝামেলার শুরুটা আমি জানি না। বাথরুমে ছিলাম, শুনতে পাইনি। যা শুনলাম তা হল – মা রাগী গলায় বলছেন, | ‘তােমার ধারণা আমার এই এতিম খাওয়ানো ব্যাপারটা হাস্যকর?”
‘দ্ধি মা, আমার তাই ধারণা। খুব হাস্যকর। | ‘দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষকে ভরপেট খাওয়ানাে তােমার কাছে হাস্যকর ?”
“যে ভঙ্গিমায় খাওয়াচ্ছেন তা হাস্যকর। আয়ােজনটা হাস্যকর।
‘ক্ষুধার্ত মানুষ, ভিখিরী এদের জন্যে আপনার আসলে তেমন কোন মমতা নেই। এতিম খাওয়ানাে উপলক্ষে হৈ চৈ করতে পারছেন – এটাই আসল। | ‘এই বয়সে আসল নকল জেনে বসে আছ? দু‘দিনের মেয়ে, আমার ভুল ধরতে আস? নিজের ভুলগুলি চোখে পড়ে না?”
রূপা শান্তগলায় বলল, আমার কি ভুল মা? কি এর উত্তরে মা কিছু ভয়ংকর কথা বলে ফেললেন। তাঁকে ঠিক দোষ দেয়া যায় । সারাদিনের পরিশ্রমে এবং উপবাসে তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। তাছাড়া এই কঠিন কথাগুলি তাঁর মনে ছিল। বলার মত পরিস্থিতি হয় নি। কে জানে মা হয়ত এই পরিস্থিতিকেই কাজে লাগালেন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ুন আহমেদ
প্রতিটি মেয়েই নিষ্ঠুর হবার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। মা বললেন, তােমার ভুল আমাকে বলে দিতে হবে? তুমি নিজে তা জান না? সিনেমা করার নামে রাজ্যের পুরুষদের সঙ্গে যে মাখামাখিটা কর তা তুমি নিজে জান না? নাকি নিজের অজান্তে কর? আর করবে নাই বা কেন? রক্তের টান আছে না
মা‘র কাছ থেকেই তাে শিখেছ? তােমার মাও তাে ক্লাবে ক্লাবে নেচে বেড়াতে। কোন ধরনের মেয়ে ক্লাবে ক্লাবে নেচে বেড়ায় তা কি আমি জানি না? না কি তুমি ভেবেছ আমিও রঞ্জুর মত গাধা?
রূপ৷ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আমি বিস্মিত হয়ে ঘরে উপস্থিত অন্য মানুষগুলির দিকে তাকালাম। কেউ কিছু বলছে না। কেউ মা’কে থামাবার চেষ্টা করছে না। বাবা এমন ভাব করছেন যেন তিনি কিছুই শুনতে পান নি। মুনিয়া তার মেয়ের মুখে তেহারী তুলে দেয়ায় অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত। আদর্শ মানব বাবু একমনে খেয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা মায়ের কোন কথাই তার কানে ঢুকে নি। তার প্লেটের কাছে একটা বই খােলা। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় বই—এ নিবদ্ধ। আগামীকাল থেকে তার পরীক্ষা শুরু।
রূপা বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, কিছু কিছু জিনিস আমি আমার মায়ের
কাছ থেকে পেয়েছি। আপনাকে রাগিয়ে দেবার জন্যে দুঃখিত। আসুন, খেতে আসুন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মা চেঁচিয়ে বললেন, খেতে আসব মানে? তুমি কি জান না আমি রােজা? “না, আমি জানতাম না। ‘এখন বল – রােজা রাখাও একটা হাস্যকর ব্যাপার।
রূপা তার জবাব না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খেতে বস। তুমি না বললে তােমার ক্ষিধে পেয়েছে ?
আমি খেতে বসলাম। লক্ষ করলাম রূপা খেতে পারছে না। ভাত মাখাচ্ছে, মুখে তুলতে পারছে না। তার চোখ ভেজা। আমি রূপাকে কখনাে কাঁদতে দেখিনি। আজ কি সে কাঁদবে? রূপা কিছু কিছু জিনিস তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। কঠিন আঘাতে না কাঁদার স্বভাবও কি তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া?
বাবা খুব সম্ভব প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বললেন, বিরিয়ানী এবং তেহারী এই দু‘টা জিনিসের মধ্যে ডিফারেন্সটা কি ?
আদর্শ মানব বাবু অবাক হয়ে বলল, আমাকে কিছু বলছেন? ‘বিরিয়ানী এবং তেহারী এই দুয়ের মধ্যে ডিফারেন্সটা কি?”
‘আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি কি বাবুর্চি? আমাকে এমন জিনিস জিজ্ঞেস করবেন যার উত্তর আমি জানি। যেমন ধরুন, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন – ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ কি তাহলে আমি বলতে পারব। সেটা কি জানতে চান ?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২৩)-হুমায়ুন আহমেদ
বাবা অসম্ভব বিরক্ত হলেন। বাবু তাকাল রূপার দিকে। ‘ভাবী, তুমি জানতে চাও ?” ‘চাই। ‘সত্যি চাও না কথার কথা ? ‘সত্যি চাই। ‘ঠিক আছে বলছি। নিউটনের নাম শুনেছ তো ভাবী? নিউটনের গতিসূত্র দিয়ে শুরু করা যাক ...‘
বাবু বক বক করে যাচ্ছে। রূপা মনােযােগী ছাত্রীর মত তাকিয়ে আছে বাবুর দিকে। আমি তাকিয়ে আছি রূপার চোখের দিকে। দেখতে চাচ্ছি তার ভেজা চোখ কি শুকিয়ে যাবে? না কি শেষ পর্যন্ত সে নিজেকে সামলাতে পারবে না? কতটুক শক্ত এই মেয়ে!
খাওয়া শেষ করে ঘরে এসেছি। রূপা পান চিবুতে চিবুতে ঘরে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, মা মিষ্টি পান আনিয়েছেন। পান খাবে?