ভদ্রলােকের নাম রইসুদ্দিন। আমাদের অতি দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু কথাবার্তা শুনে মনে হয় আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁকে যে আমরা বারান্দায় ফেলে রেখে অপমান করার চেষ্টা করছি, এটা তিনি বুঝেও না বােঝার ভান করেন।
রইসুদ্দিন চাচা আমাকে দেখেই উঠে বসলেন। ছােট–খাটো মানুষ। মামলা মােকদ্দমা করে যেন আরাে ছােট হয়ে গেছেন। গালভর্তি কাঁচা–পাকা দাড়ি না থাকলে তাঁকে বাচ্চা ছেলের মতােই লাগত। তিনি হাসিমুখে বললেন, আব্বাজীর ঘুম ভাঙল?
তিনি আমাকে ডাকেন আব্বাজী, আমার বােন মুনিয়াকে আম্মা এবং রূপাকে ডাকেন আম্মাজী। আমার সবচে’ ছােট ভাই বাবুকে শুধু নাম ধরে ডাকেন। তার বেলায় এই ব্যতিক্রম কেন কে জানে। কারণ একটা নিশ্চয়ই আছে। রইসুদ্দিন চাচার মতাে ধুরন্ধর লােক বিনা কারণে কিছু করবেন না। এঁরা প্রতিটি কাজকর্ম। ভেবে–চিন্তে করেন।
তিনি আগের প্রশ্নই আবার করলেন। এবারে মুখের হাসি আগের চেয়েও বিস্তৃত হল।
‘আব্বাজীর ঘুম ভাঙল ?”
‘ঘুম হইছে কেমন?” “ভাল।।
‘আমারাে ঘুম ভাল হইছে। ফুরফুরা বাতাস। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। কম্বল গায়ে দিয়ে লম্বা ঘুম দিলাম । শেষরাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন দেখার পর মনটা আরাে ভাল হয়ে গেছে। বড়ই মধুর স্বপ্ন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ
কেউ স্বপ্নের কথা বললে কি স্বপ্ন দেখা হয়েছে জানতে চাওয়াটা সাধারণ ভদতা। এই মানুষটার সঙ্গে ভদ্রতা করতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না। তবু অভ্যাসের বসে বললাম, কি স্বপ্ন দেখলেন? কি দেখলাম শাদা একটা সাপ। গ্রামদেশে এই সাপরে বলে দুধরাজ। এই সাপ
আমার হাঁটুতে একটা ছােবল দিল। বিষ যা ছিল সব ঢেলে দিল। ও মানুষের কথা শুনে আমি কখনাে বিস্মিত হই না। বিশেষ করে এইসব ধুরন্ধর মানুষ কথাবার্তায় সবসময় অন্যদের চমৎকৃত করতে চেষ্টা করে। আমি বুঝতে পারছি রইসুদ্দিন চাচা কথাবার্তায় আমাকে কিছুক্ষণ আটকে রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি হয়তাে ভাবছেন আমি অবাক হয়ে বলব এরকম ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখে আপনার মনটা খুশি হয়ে গেল কেন? তার উত্তরে তিনি আরাে চমকপ্রদ কিছু বলবেন। আমি তাঁকে সেই সুযােগ দিলাম না। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে গেলাম। সাপ কামড় দিয়েছে এই স্বপ্ন দেখে কেউ যদি আনন্দে আত্মহারা হয়—হােক। মুখে আবার থুথু জমেছে। এ তাে বড় যন্ত্রণা হল!
রান্নাঘরে মুনিয়া ছাঁকনি দিয়ে অর্জুন গাছের রস ছাঁকছে। বাবার কবিরাজী ওষুধ। তাঁর হার্টের কি সব সমস্যা। কবিরাজ বলেছে অর্জুন গাছের ছাল সেদ্ধ করে সেই রস খেতে। অর্জুন গাছের সব ছাল নয়। গাছের পুবদিকের ছাল, যেখানে সূর্যের প্রথম রশ্মি পড়ে। মাখন বলে আমাদের যে কাজের ছেলেটি আছে, তার কাজই হচ্ছে সাইকেলে করে দূর–দূরান্ত থেকে অর্জুন গাছের ছাল নিয়ে আসা। মাখনের কোনাে কাজে উৎসাহ নেই। এই কাজটিতে খুব উৎসাহ। সে ঢাকা শহরের আশেপাশের সব অর্জুন গাছের ছাল ছাড়িয়ে ফেলেছে বলে আমার ধারণা। ছাল ছাড়ানাে অর্জুন গাছ দেখতে কেমন হয়? মাখনার সঙ্গে একদিন দেখে আসতে হবে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ
মুনিয়াকে কেমন যেন অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে। মুখ শুকনাে। চোখের নিচে কালি। মন হয়তাে খারাপ। এটা কোনাে অস্বাভাবিক ব্যাপার না। মুনিয়ার মন বেশির ভাগ সময়ই খারাপ থাকে। বছর দুই হল স্বামীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ভদ্রলােক আবার বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা শহরেই থাকেন। তাদের সঙ্গে
দেখা হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে মুনিয়া ঘর থেকে বের হয় না। ঘরে থেকে থেকে বেচারি ফর্সা হয়ে গেছে।
মুনিয়া অর্জুন গাছের রস ছাঁকতে ছাঁকতে রােবটদের মতাে গলায় বলল, ভাবীর ঘুম এখনাে ভাঙেনি? না। তােকে কফি আর একটা মাখন লাগানাে ক্র্যাকার পাঠাতে বলেছে। কফিতে তিন চামচ চিনি। দু চামচ উচু করে আর এক চামচ সমান সমান।
‘আর কিছু?” ‘ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি। আইস কোল্ড।
মুনিয়া মুখ টিপে হাসল। আমিও হাসলাম। মুনিয়া আমার পিঠাপিঠি। ওর সংঙ্গে আমার সহজ সম্পর্কের একটা ব্যাপার আছে। আমি ওর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, মন খারাপ না কি রে?
মুনিয়া হালকা গলায় বলল, বাসিমুখে আমার সামনে বসিস না। দেখেই বমি বমি লাগছে।
আমি নড়লাম না। গলার স্বর অনেকটা নামিয়ে বললাম, আজ একটা দারুণ ডিসিশান নিলাম।
‘কি ডিসিশান?”
একটা খুন করব। “তাই নাকি?” ‘হ্যা, এটা হবে একটা পারফেক্ট মার্ডার। কেউ বুঝতেও পারবে না খুন হয়েছে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ
মুনিয়া মােটেও বিস্মিত হল না। সে যে বিস্মিত হবে না আমি জানতাম। সে ভাবছে আমি রসিকতা করছি। এটা ভাবাই যুক্তিযুক্ত। যে খুন করবে সে সবাইকে বলে বেড়াবে না।
‘কাকে খুন করবি কিছু ঠিক করেছিস?” “হঁ্যা, সব ঠিক করা আছে। ‘আমার কাছে সাজেশান চাইলে দিতে পারি। ‘কি সাজেশান ?” ‘রইসুদ্দিন চাচাকে খুন করে ফেল।
মুনিয়া কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সে আশা করছে আমি বলব, রইসুদ্দিন চাচা কি করেছে ?
আমার কাছ থেকে কেউ যা আশা করে, আমি তা করি না। কাজেই কিছুই বললাম না। উদাস চোখে বারান্দায় লাগােয়া সজনে গাছের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সজনে গাছটা মরতে বসেছে। গাছের মৃত্যুও একটা দেখার মতাে ব্যাপার। কিছু কিছু
গছি হঠাৎ করে মরে যায়। ওদেরও মনে হয় হার্ট এ্যাটাকের মতাে অসুখ আছে। আবার কিছু কিছু গাছ দীর্ঘদিন রােগ ভােগ করে মরে। এই গাছটা অল্প অল্প করে মরছে। গাছের কোনো ডাক্তার থাকলে তাকে এনে চিকিৎসা করাতাম।
‘রইসুদ্দিন চাচা কি করেছেন জানিস?
‘মতির মা আমাকে বলল, ওদের যে বাথরুম রহসুদ্দিন চাচাকেও সেই বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। বাথরুমের দরােজায় একটা ফুটো। মতির মা গােসল করছে, হঠাৎ দেখে সেই ফুটো দিয়ে রইসুদ্দিন চাচা তাকিয়ে আছেন। কি রকম ঘেন্নার কথা বল তাে!
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ
‘মতির মা কি ওনাকে কিছু বলেছে? ‘না। ভাবছি আমি বলব। অবশ্যি সবচে’ ভাল হয় তুই বললে। ‘পাগল, আমি এইসব বলাবলির মধ্যে নেই। খুন করার কথা হলে ভিন্ন কথা।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। রুপা এখনাে শুয়ে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই বলল, কফির কথা বলেছ ? ১ বলেছি।
‘পানি আননি, ঠাণ্ডা পানি ? ? ‘কফির সঙ্গে আসবে।