‘তাহলে দয়া করে একটা গান দাও তাে। গান শুনতে ইচ্ছা করছে। এলপিটা দেখে টেবিলের ওপর — ‘চরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারে’, ঐটা দাও। ই আমি তাই করলাম।
ও রূপা হাসতে হাসতে বলল, গানটা শুনতে শুনতে তােমার পা একটু ধরতে চাই। কাছে এসো তাে। ঠাট্টা না, সত্যি। কাছে এসাে।
আমি রূপার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
রূপ৷ হাসছে। তাকে অসহ্য সুন্দর লাগছে। মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে ? চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারছি না। গান বাজছে। গানের কথাগুলো কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছে—তবু পুরােপুরি অস্পষ্ট নয়।
চরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারে, নিয়াে না, নিয়াে না সরায়ে – এ জীবন মরণ সুখ-দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিবাে জড়ায়ে।
স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কতাে আর – * নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ে হার, ফেল না আমারে ছাড়ায়ে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপার চোখ বন্ধ। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিত হবার জন্যে আমি পর পর দু‘বার ডাকলাম, রূপা রূপা। সে সাড়া দিল না। পাশ ফিরল। অথচ ট্রে হাতে
মুনিয়া ঢােকামাত্র রূপা বলল, থ্যাংকস মুনিয়া।।
রূপা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছিল না। কিংবা ঘুমের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা ছিল যেন মুনিয়া ঢােকামাত্র সে জেগে যায়। কম্পিউটারাইজড কোন সুইচিং ডিভাইস। রূপা বিছানায়
উঠতে উঠতে বলল, লাবণ্য কি করছে মুনিয়া ? ওকে একটু পাঠাবে। | মুনিয়া গম্ভীর মুখে বলল, ও বই নিয়ে বসেছে। ওকে এখন ডেকো না তাে ভাবী।
‘আচ্ছা, ডাকব না।
লাবণ্য মুনিয়ার একমাত্র মেয়ে। লাবণ্যর বয়স পাঁচ। সপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে তার বাবা দেখতে আসেন। সেই বিশেষ দিনে মুনিয়া তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। সারাদিন কিছুই খায় না।
রূপার সঙ্গে লাবণ্যের অন্য একধরনের ভাব আছে। সেই ভাবের গুরুত্ব এত বেশি, যা মা হিসেবে মুনিয়া ঠিক সহ্য করতে পারে না। মুনিয়া চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লাবণ্য ঘরে ঢুকল। গম্ভীর গলায় বলল, পিরিচে করে চা খাব।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপা তাকে পিরিচে চা ঢেলে দিল। ‘কেমন আছ লাবণ্য ?”
লাবণ্য গম্ভীর গলায় বলল, কি জানি কেমন আছি। ‘মনটা কি তােমার খারাপ?
“কি করলে মন ভাল হবে ? ‘জানি না। ‘পিরিচে করে আরাে চা খেলে কি ভাল হবে?”
রূপা আরাে খানিকটা চা ঢেলে দিল। মুনিয়া আবার ঘরে ঢুকল। এই পর্যায়ে মুখ কালাে করে বলল, ভাবী, তুমি ওকে আবার চা দিয়েছ? আমি তােমাকে বলিনি চা খাওয়ানাের অভ্যাস করবে না। এই দেখ, নতুন জামায় চায়ের দাগ লাগিয়েছে।
মুনিয়া মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে জামায় চায়ের দাগ লাগার শােকে সে কেঁদে ফেলবে। আসলেই কাঁদবে। কারণে এবং
অকারণে কাঁদা তার শৈশবের অভ্যাস। এখন তার কাদার অনেক বিষয় আছে।
আজ শুক্রবার।
মা‘র হুকুমে শুক্রবার সকালে নাশতা সবাইকে একসঙ্গে খেতে হয়। মা অজিমপুর গার্লস স্কুলে মাস্টারি করেন। মর্নিং শিফটের ক্লাস আটটায় আরম্ভ হয়।
তাঁকে সাতটার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতে হয়। বাবার গাড়ি আছে। তিনি সেই গাড়িতে যাবেন না। বাবার টাকায় নিজের জন্যে কিছু কিনবেন না। সম্ভবত বছর পাঁচেক আগে তাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনাে ঝগড়া হয়েছে। সে ঝগড়ার জের এখনাে চলছে। কে জানে হয়তাে আরাে বছর পাঁচেক চলবে। ঐ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। তা ছাড়া ঝগড়ার কারণে তাদের কথাবার্তা পুরােপুরি বন্ধ
কাজ চালাবার মতাে কথা তারা বলেন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
নাশতার টেবিলে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললেন– রইসুদ্দিনের ব্যাপারটা কি বল তাে?
মা জবাব দিলেন না। জবাব দেবার অবশ্যি কথাও না। বাবা রুটিতে মাখন। লাগাতে লাগাতে বললেন, মতির মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, রহসুদ্দিন নাকি বাথরুমের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ছিল। কি অসম্ভব কাণ্ড!
মুনিয়া বিরক্ত গলায় বলল, ও কি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে নাকি ? এটা কি জনে জনে বলে বেড়াবার মতাে কথা?
বাবা বললেন, না বলারই–বা কি আছে ? তার ওপর একটা অন্যায় করা হয়েছে, সে বিচার দাবি করবে না? সেই অধিকার কি তার নেই?
মুনিয়া কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রূপা উঁচু গলায় বলল, বাথরুমের ফুটো দিয়ে মতির মাকে দেখেছে, তাতে হয়েছেটা কি? মতির মার শরীর তাে পচে যায়নি।।
বাবা রূপার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর ছেলের বৌ তার মুখের ওপর এরকম কথা বলবে, তা তিনি হয়তাে কল্পনাও করেননি। রূপার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বলছে, এই রকম একটা মেয়েকে তুই বিয়ে করলি? রূপা যেন আরাে বেফাস কিছু বলে না ফেলে, সে জন্যে টেবিলের নিচে তার পায়ের পাতায় আমি ডান পা নিয়ে চাপ দিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে “উফ কি করছ?” বলে ধমক দিল। আমি হয়ে গেলাম অপ্রস্তুত। রূপ কোনাে ব্যথা পায়নি। পুরাে ব্যাপারটা সে করল আমাকে অপ্রস্তুত করার জন্যে।‘ বা
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
বাবা বললেন, বাথরুমের ফুটো দিয়ে কোনাে মহিলার দিকে তাকানাে জঘন্য অপরাধগুলাের একটি। রইসুদ্দিনকে বলতে হবে, সে যেন সকাল এগারােটার আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আর কোনাে দিন যেন না আসে। এইসব নইসেন্সদের বাড়িতে জায়গা দেয়াই ঠিক না। ৮–০০ রূপী বলল, আমার কিছু কথা আছে।
বাবা বিস্মিত হয়ে তাকালেন। আমি খুব দ্রুত চিন্তা করলাম, আরেকবাবু পায়ে
চাপ দিয়ে রূপাকে থামানাের চেষ্টা করাটা কি ঠিক হবে? সে অবশ্য আবার “উফ! কি করছ?’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারে।
মা বললেন, বৌমা, এই বিষয়ে তােমার কিছু বলার দরকার নেই। “কেন মা?”
‘তুমি সব ব্যাপারে কথা বল, এটা ভাল না। তুমি বৌ মানুষ। সংসারের সব কিছুতে তুমি থাকবে কেন?”
‘বৌরা কি সংসারের অংশ নয় ?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
‘অংশ তাে বটেই, তবে তারা হচ্ছে সংসারের সৌন্দর্য, সংসারের শােভা। তারা নোংরা ঘাটাঘাটি করবে, এটা ঠিক না।
‘নােংরা ঘাটাঘাটি তাে না মা। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, আমার ধারণা মতির মা মিথ্যা কথা বলছে।
‘মিথ্যা কথা বলছে?” ‘হ্যা। ‘এ রকম ধারণা হবার কারণ কি?
‘রইসুদ্দিন চাচা কিছুদিন আগে বলছিলেন না—তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে মতির মা পঞ্চাশ টাকার একটা নােট সরিয়েছে।