পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

তাহলে দয়া করে একটা গান দাও তােগান শুনতে ইচ্ছা করছেএলপিটা দেখে টেবিলের ওপর চরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারে’, ঐটা দাওআমি তাই করলাম। 

রূপা হাসতে হাসতে বলল, গানটা শুনতে শুনতে তােমার পা একটু ধরতে চাইকাছে এসো তােঠাট্টা না, সত্যিকাছে এসাে। 

আমি রূপার দিকে তাকিয়ে রইলাম। 

রূপ৷ হাসছেতাকে অসহ্য সুন্দর লাগছেমানুষ এত সুন্দর হয় কি করে ? চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারছি নাগান বাজছেগানের কথাগুলো কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছেতবু পুরােপুরি অস্পষ্ট নয়। 

চরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারে, নিয়াে না, নিয়াে না সরায়ে জীবন মরণ সুখ-দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিবাে জড়ায়ে। 

স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কতাে আর * নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ে হার, ফেল না আমারে ছাড়ায়ে। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

রূপার চোখ বন্ধমনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেনিশ্চিত হবার জন্যে আমি পর পর দুবার ডাকলাম, রূপা রূপাসে সাড়া দিল না। পাশ ফিরলঅথচ ট্রে হাতে 

মুনিয়া ঢােকামাত্র রূপা বলল, থ্যাংকস মুনিয়া। 

রূপা নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছিল নাকিংবা ঘুমের মধ্যেই এমন ব্যবস্থা ছিল যেন মুনিয়া ঢােকামাত্র সে জেগে যায়কম্পিউটারাইজড কোন সুইচিং ডিভাইসরূপা বিছানায় 

উঠতে উঠতে বলল, লাবণ্য কি করছে মুনিয়া ? ওকে একটু পাঠাবে| মুনিয়া গম্ভীর মুখে বলল, বই নিয়ে বসেছেওকে এখন ডেকো না তাে ভাবী। 

আচ্ছা, ডাকব না। 

লাবণ্য মুনিয়ার একমাত্র মেয়েলাবণ্যর বয়স পাঁচসপ্তাহে অন্তত একদিন তাকে তার বাবা দেখতে আসেনসেই বিশেষ দিনে মুনিয়া তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকেসারাদিন কিছুই খায় না। 

রূপার সঙ্গে লাবণ্যের অন্য একধরনের ভাব আছেসেই ভাবের গুরুত্ব এত বেশি, যা মা হিসেবে মুনিয়া ঠিক সহ্য করতে পারে নামুনিয়া চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লাবণ্য ঘরে ঢুকলগম্ভীর গলায় বলল, পিরিচে করে চা খাব

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

রূপা তাকে পিরিচে চা ঢেলে দিলকেমন আছ লাবণ্য ?” 

লাবণ্য গম্ভীর গলায় বলল, কি জানি কেমন আছিমনটা কি তােমার খারাপ

কি করলে মন ভাল হবে ? জানি নাপিরিচে করে আরাে চা খেলে কি ভাল হবে?” 

রূপা আরাে খানিকটা চা ঢেলে দিলমুনিয়া আবার ঘরে ঢুকলএই পর্যায়ে মুখ কালাে করে বলল, ভাবী, তুমি ওকে আবার চা দিয়েছ? আমি তােমাকে বলিনি চা খাওয়ানাের অভ্যাস করবে নাএই দেখ, নতুন জামায় চায়ের দাগ লাগিয়েছে। 

মুনিয়া মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেলতার মুখ দেখে মনে হচ্ছে জামায় চায়ের দাগ লাগার শােকে সে কেঁদে ফেলবেআসলেই কাঁদবেকারণে এবং 

অকারণে কাঁদা তার শৈশবের অভ্যাসএখন তার কাদার অনেক বিষয় আছে। 

আজ শুক্রবার। 

মাহুকুমে শুক্রবার সকালে নাশতা সবাইকে একসঙ্গে খেতে হয়মা অজিমপুর গার্লস স্কুলে মাস্টারি করেনমর্নিং শিফটের ক্লাস আটটায় আরম্ভ হয়। 

তাঁকে সাতটার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতে হয়বাবার গাড়ি আছেতিনি সেই গাড়িতে যাবেন নাবাবার টাকায় নিজের জন্যে কিছু কিনবেন নাসম্ভবত বছর পাঁচেক আগে তাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনাে ঝগড়া হয়েছেসে ঝগড়ার জের এখনাে চলছেকে জানে হয়তাে আরাে বছর পাঁচেক চলবেনিয়ে আমরা মাথা ঘামাই নাতা ছাড়া ঝগড়ার কারণে তাদের কথাবার্তা পুরােপুরি বন্ধ 

কাজ চালাবার মতাে কথা তারা বলেন। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

নাশতার টেবিলে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললেনরইসুদ্দিনের ব্যাপারটা কি বল তাে

মা জবাব দিলেন নাজবাব দেবার অবশ্যি কথাও নাবাবা রুটিতে মাখনলাগাতে লাগাতে বললেন, মতির মা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, রহসুদ্দিন নাকি বাথরুমের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ছিলকি অসম্ভব কাণ্ড

মুনিয়া বিরক্ত গলায় বলল, কি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে নাকি ? এটা কি জনে জনে বলে বেড়াবার মতাে কথা

বাবা বললেন, না বলারইবা কি আছে ? তার ওপর একটা অন্যায় করা হয়েছে, সে বিচার দাবি করবে না? সেই অধিকার কি তার নেই

মুনিয়া কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে রূপা উঁচু গলায় বলল, বাথরুমের ফুটো দিয়ে মতির মাকে দেখেছে, তাতে হয়েছেটা কি? মতির মার শরীর তাে পচে যায়নি। 

বাবা রূপার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেনতাঁর ছেলের বৌ তার মুখের ওপর এরকম কথা বলবে, তা তিনি হয়তাে কল্পনাও করেননিরূপার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেনতাঁর চোখের দৃষ্টি বলছে, এই রকম একটা মেয়েকে তুই বিয়ে করলি? রূপা যেন আরাে বেফাস কিছু বলে না ফেলে, সে জন্যে টেবিলের নিচে তার পায়ের পাতায় আমি ডান পা নিয়ে চাপ দিলামসে আমার দিকে তাকিয়ে উফ কি করছ?বলে ধমক দিলআমি হয়ে গেলাম অপ্রস্তুতরূপ কোনাে ব্যথা পায়নিপুরাে ব্যাপারটা সে করল আমাকে অপ্রস্তুত করার জন্যেবা 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

বাবা বললেন, বাথরুমের ফুটো দিয়ে কোনাে মহিলার দিকে তাকানাে জঘন্য অপরাধগুলাের একটিরইসুদ্দিনকে বলতে হবে, সে যেন সকাল এগারােটার আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়আর কোনাে দিন যেন না আসেএইসব নইসেন্সদের বাড়িতে জায়গা দেয়াই ঠিক না০০ রূপী বলল, আমার কিছু কথা আছে। 

বাবা বিস্মিত হয়ে তাকালেনআমি খুব দ্রুত চিন্তা করলাম, আরেকবাবু পায়ে 

চাপ দিয়ে রূপাকে থামানাের চেষ্টা করাটা কি ঠিক হবে? সে অবশ্য আবার উফ! কি করছ?বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারে। 

মা বললেন, বৌমা, এই বিষয়ে তােমার কিছু বলার দরকার নেইকেন মা?” 

তুমি সব ব্যাপারে কথা বল, এটা ভাল নাতুমি বৌ মানুষসংসারের সব কিছুতে তুমি থাকবে কেন?” 

বৌরা কি সংসারের অংশ নয়

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

অংশ তাে বটেই, তবে তারা হচ্ছে সংসারের সৌন্দর্য, সংসারের শােভাতারা নোংরা ঘাটাঘাটি করবে, এটা ঠিক না। 

নােংরা ঘাটাঘাটি তাে না মাআমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, আমার ধারণা মতির মা মিথ্যা কথা বলছে। 

মিথ্যা কথা বলছে?হ্যারকম ধারণা হবার কারণ কি

রইসুদ্দিন চাচা কিছুদিন আগে বলছিলেন নাতার পাঞ্জাবির পকেট থেকে মতির মা পঞ্চাশ টাকার একটা নােট সরিয়েছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *