পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

মতির মা কান্নাকটি করলআপনার হুকুমে মতির মার ট্রাংঙ্ক খােলা হলপঞ্চাশ টাকার একটা নােট সেখানে পাওয়া গেল। 

এত ফেনাচ্ছ কেন মা? যা বলতে চাও সহজ কথায় বলবেশ, সহজভাবেই বলছিমতির মা সেই অপমানের প্রতিশােধ নিয়েছে, আর কিছুই নাবাহান্ন বছরের এক বুড়ির শরীর দেখার জন্যে কেউ বাথরুমের ফুটোয় চোখ রাখে না” 

কেউ রূপার কথা বিশ্বাস করল কি না জানি না, আমি করলামএবং মুনিয়ার ঠোটের কোণে হাসি দেখে মনে হল সেও করল। 

বাবা গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, বৌমা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস মতির মা সত্যি কথা বলছেকে সত্যি বলছে, কে বলছে না সেটা আমি বুঝতে পারি তিরিশ বছর জজিয়তি করেছিতােমাকে আরেকটা কথাও বলি মা, পৃথিবীতে অনেক বিকারগ্রস্ত মানুষ আছেতারা বাথরুমে ফুটো দেখলেই চোখ রাখবেরইসুদ্দিন এরকম একজন বিকারগ্রস্ত লােকতাকে আজ সকাল এগারেটার মধ্যে বাসা ছাড়তে হবেএই প্রসঙ্গে আমি আর কারাের কথা শুনতে চাই না। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

রূপা বলল, জাজ সাহেব হিসেবে আপনার দুপক্ষের কথাই শােনা উচিতআসামীরও তাে কিছু বলার থাকতে পারে। 

বৌমা, তুমি আমার সামনে থেকে যাওআচ্ছা যাচ্ছি, না বললেও যেতামআমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছেরূপা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে গেল, যেন কিছুই হয় নি। 

এগারােটার আগেই রুইলুদ্দিন চাচাকে তার স্যুটকেস, কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে রিকশায় উঠতে হলমতির মাকে খুব উৎফুল্ল মনে হলআমাকে দেখে হাসিমুখে বলল, ভাইজান, দেখছেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। 

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ধর্মের কল বাতাসে নড়বে না তো কিসে নড়বে? খুবই খাঁটি কথা ভাহজানখুব খাঁটি কথালােকটারে প্রথম দিন দেইখ্যাই বুঝছি বুদ লােক। 

সেও তােমাকে দেখে প্রথমদিনেই বুঝে ফেলেছে, তুমি বদ মেয়েছেলেদেখ না, এত লােক থাকতে তােমাকে চোর সাব্যস্ত করলশুধু যে চোর সাব্যস্ত করল তা 

চোর প্রমাণও করে ফেললটাকা পাওয়া গেল তােমার ট্রাঙ্কে। 

মতির মা মুখ কালাে করে ফেলল। 

আমি বললাম, রইসুদ্দিন চাচাকে তুমি চেন না মতির মাউনি বিরাট ঘুঘু লােকপ্রতি বছর ছয়সাতটা করে মামলা করেসে তােমাকে এত সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় নামামলাটামলা করে বসবে বলে আমার ধারণা

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ 

মতির মাকে পুরােপুরি ভ্যাবাচেকা খাইয়ে ঘরে এসে দেখি রূপা চাদর জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছেনির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়েছেনাশতা খেয়ে আবার বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়া রূপার পুরনো অভ্যাসপ্রথমদিকে অবাক হতামএখন আর হই না। 

রূপা ঘুমাচ্ছ নাকি?না, চেষ্টা করছিতােমার যুক্তি কেউ বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না। 

সবাই বিশ্বাস করেছেলােকটাকে তােমরা কেউ সহ্য করতে পারছিলে না একটা অজুহাত পেয়ে তাড়িয়েছ[ তুমি কি লােকটাকে পছন্দ করতে

আরে দূর দূরআমি পছন্দ করব কেন? মামলাবাজ লােক আমার অসহ্যএই, একটা গান দাও নাগান শুনতে শুনতে ঘুমাই। 

এখন গান দেয়া যাবে নাবাবা গান শুনলেই রেগে যানরেগে যান কেন?” 

জানি না কেনছােটবেলা থেকেই দেখছি গান শুনলে বাবার মেজাজ চড়ে যায়মুনিয়া একদিন উঁচু ভলুমে অনুরােধের আসর শুনছিল বলে চড় খেয়েছিল‘ 

তােমার বাবা লােকটাকে আমি খুবই অপছন্দ করিতিনিও অবশ্যি আমাকে 

অপছন্দ করেনকাজেই কাটাকাটি। 

মামাকে পছন্দ কর?‘মাই গডওনার ভেতর পছন্দ হবার মতাে কি আছে?কিছুই নেই ?” 

না, কিছুই নেইএই শােন, একটা গান দাও নাগান শুনতে শুনতে ঘুমানাের অন্য রকম মজাঘুমের মধ্যেও গান হতে থাকে

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ 

না ঘুমিয়ে একটা কাজ করলে কেমন হয় রূপা?কি কাজ?চল না কোথাও বেড়াতে যাইপাগল হয়েছএই রােদে আমি ঘুরব ? গায়ের রঙ নষ্ট হয়ে যাবে না

বাবাকে বলে গাড়িটা নিয়ে যাইগাড়িতে গেলে তােমার গায়ের রঙ নিশ্চয়ই নষ্ট হবে না ?” 

রূপা জবাব দিল নাআমি কয়েকবার ডাকলাম, এই রূপা, এইকোনাে সাড়া নেইসে ঘুমিয়ে পড়েছেআমি কি করবাে ভেবে পেলাম নাচুপচাপ ঘরে বসে থাকব, নাকি বাইরে যাবরূপাকে বিয়ের পর থেকে মােটামুটিভাবে আমি গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিবাইরে যেতে ভাল লাগে নারূপার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছা করেবেশির ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকেআমি তার পাশে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকিরূপার গা ঘেঁষে শোয়া যায় নাতার গরম লাগেতার গায়ে হাত রাখা যায় নাভার লাগে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। 

মুনিয়া প্রায়ই আমাকে ঠাট্টা করে বলেভাইয়া, তােকে তাে ভাবী একেবারে মেষশাবক বানিয়ে ফেলেছেমেরী হ্যান্ড লিটল ল্যাম্ব অবস্থামেরী যেখানে যায় মেষশাবক যায় তার পিছু পিছু। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

তাে যায় না কোথাওশুয়ে থাকে, ঘুমায়পাগল হয়েছ ভাইয়া, চব্বিশ ঘণ্টা কেউ ঘুমুতে পারেআমার ধারণা, ভাবী মােটেই ঘুমােয় নামটকা মেরে পড়ে থাকে। 

মটকা মেরে পড়ে থাকবে কেন?” 

তা জানি নাআমি আমার ধারণার কথা বললামতুমি হা করে ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাস, এটা ভাবী জানে বলেই চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে, যাতে মনের সাধ মিটিয়ে তুমি দেবীদর্শন করতে পারচুপ কর তাে। 

চুপ করছিআমার ধারণা ভুল নাও হতে পারে ভাইয়াভাবী যখন ঘুমায়, তখন তুমি ভালমতাে পরীক্ষা করে দেখাে তােসত্যি ঘুম কিনা। 

আমি সেই পরীক্ষাও করেছি। 

যখন ঘুমুচ্ছে তখন পাশে বসে মজার মজার কয়েকটা জোক বলেছিজেগে থাকলে তাকে হাসতেই হবেসে হাসেনিতার ঘুম যে নকল ঘুম নাআসল ঘুম, তা সে না হেসে প্রমাণ করেছে

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ

মুনিয়াকে আমি আমার এই পরীক্ষার কথা বলেছিসে পুরােপুরি নিশ্চিত হতে পারেনিতার ধারণা, রূপার হাসি আসেনি বলে হাসেনিসে বলল, জেগে থাকা অবস্থায় রসিকতাগুলাে করে দেখাে তােভাবী হাসে কিনাআমার মনে হয় হাসবে নাযা একদিন তাও করলামরূপা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লএমন হাসল যে তার চোখে পানি এসে গেলহেঁচকি উঠতে লাগলএই ব্যাপারটাও সন্দেহজনক, এত হাসবে কেন? এত হাসির কি আছে?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *