মতির মা কান্নাকটি করল। আপনার হুকুমে মতির মার ট্রাংঙ্ক খােলা হল। পঞ্চাশ টাকার একটা নােট সেখানে পাওয়া গেল।
এত ফেনাচ্ছ কেন মা? যা বলতে চাও সহজ কথায় বল। ‘বেশ, সহজভাবেই বলছি। মতির মা সেই অপমানের প্রতিশােধ নিয়েছে, আর কিছুই না। বাহান্ন বছরের এক বুড়ির শরীর দেখার জন্যে কেউ বাথরুমের ফুটোয় চোখ রাখে না।”
কেউ রূপার কথা বিশ্বাস করল কি না জানি না, আমি করলাম। এবং মুনিয়ার ঠোটের কোণে হাসি দেখে মনে হল সেও করল।
বাবা গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, বৌমা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস মতির মা সত্যি কথা বলছে। কে সত্যি বলছে, কে বলছে না সেটা আমি বুঝতে পারি । তিরিশ বছর জজিয়তি করেছি। তােমাকে আরেকটা কথাও বলি মা, পৃথিবীতে অনেক বিকারগ্রস্ত মানুষ আছে। তারা বাথরুমে ফুটো দেখলেই চোখ রাখবে। রইসুদ্দিন এরকম একজন বিকারগ্রস্ত লােক। তাকে আজ সকাল এগারেটার মধ্যে বাসা ছাড়তে হবে। এই প্রসঙ্গে আমি আর কারাের কথা শুনতে চাই না।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
রূপা বলল, জাজ সাহেব হিসেবে আপনার দু‘পক্ষের কথাই শােনা উচিত। আসামীরও তাে কিছু বলার থাকতে পারে।
“বৌমা, তুমি আমার সামনে থেকে যাও। “আচ্ছা যাচ্ছি, না বললেও যেতাম। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। রূপা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে গেল, যেন কিছুই হয় নি।
এগারােটার আগেই রুইলুদ্দিন চাচাকে তার স্যুটকেস, কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে রিকশায় উঠতে হল। মতির মাকে খুব উৎফুল্ল মনে হল। আমাকে দেখে হাসিমুখে বলল, ভাইজান, দেখছেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ধর্মের কল বাতাসে নড়বে না তো কিসে নড়বে? ‘খুবই খাঁটি কথা ভাহজান। খুব খাঁটি কথা। লােকটারে প্রথম দিন দেইখ্যাই বুঝছি বুদ লােক।
সেও তােমাকে দেখে প্রথমদিনেই বুঝে ফেলেছে, তুমি বদ মেয়েছেলে। দেখ না, এত লােক থাকতে তােমাকে চোর সাব্যস্ত করল। শুধু যে চোর সাব্যস্ত করল তা
চোর প্রমাণও করে ফেলল। টাকা পাওয়া গেল তােমার ট্রাঙ্কে।
মতির মা মুখ কালাে করে ফেলল।
আমি বললাম, রইসুদ্দিন চাচাকে তুমি চেন না মতির মা। উনি বিরাট ঘুঘু লােক। প্রতি বছর ছয়–সাতটা করে মামলা করে। সে তােমাকে এত সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। মামলা–টামলা করে বসবে বলে আমার ধারণা।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
মতির মাকে পুরােপুরি ভ্যাবাচেকা খাইয়ে ঘরে এসে দেখি রূপা চাদর জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। নাশতা খেয়ে আবার বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়া রূপার পুরনো অভ্যাস। প্রথমদিকে অবাক হতাম। এখন আর হই না।।
‘রূপা ঘুমাচ্ছ নাকি?” ‘না, চেষ্টা করছি। ‘তােমার যুক্তি কেউ বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না।
‘সবাই বিশ্বাস করেছে। লােকটাকে তােমরা কেউ সহ্য করতে পারছিলে না । একটা অজুহাত পেয়ে তাড়িয়েছ। [ তুমি কি লােকটাকে পছন্দ করতে ?
“আরে দূর দূর। আমি পছন্দ করব কেন? মামলাবাজ লােক আমার অসহ্য। এই, একটা গান দাও না। গান শুনতে শুনতে ঘুমাই।
‘এখন গান দেয়া যাবে না। বাবা গান শুনলেই রেগে যান। ‘রেগে যান কেন?”
‘জানি না কেন। ছােটবেলা থেকেই দেখছি গান শুনলে বাবার মেজাজ চড়ে যায়। মুনিয়া একদিন উঁচু ভলুমে অনুরােধের আসর শুনছিল বলে চড় খেয়েছিল।‘
‘তােমার বাবা লােকটাকে আমি খুবই অপছন্দ করি। তিনিও অবশ্যি আমাকে
অপছন্দ করেন। কাজেই কাটাকাটি।
‘মা। মাকে পছন্দ কর?” ‘মাই গড। ওনার ভেতর পছন্দ হবার মতাে কি আছে?” ‘কিছুই নেই ?”
না, কিছুই নেই। এই শােন, একটা গান দাও না। গান শুনতে শুনতে ঘুমানাের অন্য রকম মজা। ঘুমের মধ্যেও গান হতে থাকে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
‘না ঘুমিয়ে একটা কাজ করলে কেমন হয় রূপা?” ‘কি কাজ?” ‘চল না কোথাও বেড়াতে যাই। ‘পাগল হয়েছ। এই রােদে আমি ঘুরব ? গায়ের রঙ নষ্ট হয়ে যাবে না?
‘বাবাকে বলে গাড়িটা নিয়ে যাই। গাড়িতে গেলে তােমার গায়ের রঙ নিশ্চয়ই নষ্ট হবে না ?”
রূপা জবাব দিল না। আমি কয়েকবার ডাকলাম, এই রূপা, এই। কোনাে সাড়া নেই। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি কি করবাে ভেবে পেলাম না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকব, নাকি বাইরে যাব। রূপাকে বিয়ের পর থেকে মােটামুটিভাবে আমি গৃহবন্দী হয়ে পড়েছি। বাইরে যেতে ভাল লাগে না। রূপার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছা করে। বেশির ভাগ সময় সে ঘুমিয়ে থাকে। আমি তার পাশে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। রূপার গা ঘেঁষে শোয়া যায় না—তার গরম লাগে। তার গায়ে হাত রাখা যায় না—ভার লাগে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
মুনিয়া প্রায়ই আমাকে ঠাট্টা করে বলে—ভাইয়া, তােকে তাে ভাবী একেবারে মেষশাবক বানিয়ে ফেলেছে। মেরী হ্যান্ড এ লিটল ল্যাম্ব অবস্থা। মেরী যেখানে যায় মেষশাবক যায় তার পিছু পিছু।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
ও তাে যায় না কোথাও। শুয়ে থাকে, ঘুমায়। ‘পাগল হয়েছ ভাইয়া, চব্বিশ ঘণ্টা কেউ ঘুমুতে পারে। আমার ধারণা, ভাবী মােটেই ঘুমােয় না। মটকা মেরে পড়ে থাকে।
‘মটকা মেরে পড়ে থাকবে কেন?”
‘তা জানি না। আমি আমার ধারণার কথা বললাম। তুমি হা করে ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাস, এটা ভাবী জানে বলেই চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে, যাতে মনের সাধ মিটিয়ে তুমি দেবীদর্শন করতে পার। – “চুপ কর তাে।
‘চুপ করছি। আমার ধারণা ভুল নাও হতে পারে ভাইয়া। ভাবী যখন ঘুমায়, তখন তুমি ভালমতাে পরীক্ষা করে দেখাে তাে। সত্যি ঘুম কিনা।
আমি সেই পরীক্ষাও করেছি।
ও যখন ঘুমুচ্ছে তখন পাশে বসে মজার মজার কয়েকটা জোক বলেছি। জেগে থাকলে তাকে হাসতেই হবে। সে হাসেনি। তার ঘুম যে নকল ঘুম না—আসল ঘুম, তা সে না হেসে প্রমাণ করেছে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৪)-হুমায়ুন আহমেদ
মুনিয়াকে আমি আমার এই পরীক্ষার কথা বলেছি। সে পুরােপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তার ধারণা, রূপার হাসি আসেনি বলে হাসেনি। সে বলল, জেগে থাকা অবস্থায় এ রসিকতাগুলাে করে দেখাে তাে—ভাবী হাসে কিনা। আমার মনে হয় হাসবে না। যা একদিন তাও করলাম। রূপা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। এমন হাসল যে তার চোখে পানি এসে গেল। হেঁচকি উঠতে লাগল। এই ব্যাপারটাও সন্দেহজনক, এত হাসবে কেন? এত হাসির কি আছে?