রূপা ঘুমুচ্ছে। আমি তার খাটের পাশে রাখা টুলে বসে তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। এই ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সাধ্যও আমার নেই। আট মাস আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই আট মাসে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ খানিকটা হলেও ফিকে হবার কথা।
আমার তা হচ্ছে না — কারণ এই মেয়েটাকে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না। প্রথম দিনে সে আমার কাছে যতটা অচেনা ছিল, আজও ঠিক ততটাই অচেনা আছে। কিংবা হয়তো আরাে বেশি অচেনা হয়েছে।
আমি একটা সিগারেট ধরালাম। রূপা বলল, আহ, সিগারেট ফেল তাে। গন্ধে বমি আসছে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি কি জেগে ছিলে নাকি ?
রূপা বিরক্ত গলায় বলল, জেগে থাকব কেন? সিগারেটের ধােয়ায় ঘুম ভেঙেছে। দয়া করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করে এসাে।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট হাতে বারান্দায় চলে এলাম। সজনে গাছটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। গাছটা মরে যাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে মরছে। এত ধীরে মরছে যে অন্য কেউ তা বুঝতে পারছে না। গাছদেরও কি মৃত্যু–যন্ত্রণা আছে? জগদীশচন্দ্র বসু গাছের মৃত্যু–যন্ত্রণা নিয়ে কি বলে গেছেন?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
আমার সিগারেট শেষ হবার আগেই বাবা বারান্দায় এসে পড়লেন। আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলাম। বাবা রাগী চোখে আমরা দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বললাম, কিছু বলবেন? সচরাচর বাবাকে তুমি করে বলি। মাঝে মাঝে বিশেষ অবস্থায় আপনি বলি।
বাবা তুই–তুমির মিশ্রণ ব্যবহার করেন, এই তুই এই তুমি।
বাবা বললেন, তাের সঙ্গে আমার অনেক কথাই আছে।
এখন বলবেন ?” এ
বলতে চাইলে বলতে পারেন, আমার হাতে সময় আছে।
বাবা ইংরেজিতে একটি দীর্ঘ বাক্য বললেন যার বাংলাটা হল, মানুষ হিসেবে তুমি দ্রুত বদলে যাচ্ছ। তুমি নিজে তা বুঝতে পারছ কিনা তা আমি জানি না। তবে তােমাকে যতই দেখি ততই শঙ্কিত বােধ করি। তোমার কি রাতে ঘুম হয় ?
আমি বললাম, হুঁ। “ কোনাে জবাব না। ঘুম হয় কি হয় না?”
‘শুনে সুখী হলাম। তাের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তাের ইদানীং ঘুম হচ্ছে না। লজিক এলােমেলো হয়ে যাচ্ছে। তাের মধ্যে আত্মসম্মান বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাের স্ত্রী এমন অদ্ভুত আচরণ করল, আর তুই তাকিয়ে রইলি, কিছুই বললি না? তাের কি মনে হয় না – কিছু বলা উচিত ছিল?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
‘রূপার কথা আমার কাছে বেশ লজিকেল মনে হয়েছে। ‘লজিকেল মনে হয়েছে?
‘আমার কথাগুলি কেমন মনে হয়েছে? আমার কথাগুলি কি পাগলের চেঁচামেচি বলে মনে হয়েছে ?
আমি জবাব দেবার আগেই রূপা বারান্দায় এসে বলল, তােমরা এত হৈচৈ শুরু করেছ ! ঘুমুচ্ছিলাম তাে। – বলেই আবার ভেতরে ঢুকে গেল। শব্দ করে দরজা বন্ধ করল। বাবা হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বােধহয় অনেকদিন এত বিস্মিত হননি। বাবার বিস্মিত চোখ দেখে মজা লাগছে। মানুষ খুব বেশি বিস্মিত হলে খানিকটা টিকটিকির মতাে হয়ে যায়। কারণ তার চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবং কোটর থেকে খানিকটা বের হয়ে আসে। আমি কি বাবাকে বলব যে তাঁকে এখন কালাে টিকটিকির মতাে দেখাচ্ছে? বলে আরাে রাগিয়ে দেব? চূড়ান্ত রকম রেগে গেলে বাবা কি করেন তা কেন জানি দেখতে ইচ্ছা করছে।
– মাকে একবার চূড়ান্ত রকম রাগিয়ে দিয়েছিলাম। এক সময় লক্ষ করলাম, তিনি থরথর করে কাঁপছেন । ঠোটের দুই কোণায় ফেনা জমছে। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, রঞ্জু, তুই যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে, এটা কি তুই জানিস?
আমি মা‘র প্রতি একটু করুণাই বােধ করছিলাম। তবু বললাম, আমি যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে তা আমি জানি, কিন্তু তুমি যে খুব খারাপ ধরনের একজন মা, তাকি তুমি জান ?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
‘কি বললি? তুই কি বললি?” ‘সত্যি কথা বললাম মা। ‘আমি খারাপ ধরনের মা?”
‘তুমি খারাপ ধরনের মা এবং খারাপ ধরনের স্ত্রী। মা হিসেবে তুমি যেমন ব্যর্থ, স্ত্রী হিসেবেও ব্যর্থ। আমার ধারণা, শিক্ষক হিসেবেও তুমি ব্যর্থ। স্কুলের। মেয়েরা তােমাকে ডাইনী ডাকে। তুমিই এই কথা বলেছিলে। তােমার কাছ থেকেই
এই পর্যায়ে মা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। আমি সহজ–স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাকে দেখছি। খুব যে খারাপ লাগছে তা না।
মা বললেন, তাের মাথা ঠিক নেই রঞ্জু। তাের মাথা ঠিক নেই। আমার ধারণা, কোনাে একদিন তুই খু–টুন করবি। | আমি মার কথায় হেসে ফেললাম। মায়ের এক অর্থে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, তিনি ঠিকই
বলেছেন।
আজ ছুটির দিন। এ ছুটির দিনে সব্যর নানান ধরনের পরিকল্পনা থাকে। আমার কোনাে পরিকল্পনা নেই। কারণ আমার ছুটি বলে কিছু নেই। গত দু‘বছর ধরেই আমার ছুটি। চাকরিবাকরি নেই। তার জন্যে চেষ্টাও নেই। ঢাকা শহরে আমাদের যে দুটি বাড়ি আছে, তার ভাড়াতে আমরা একটা জীবন মােটামুটি সুখে পার করে দিতে পারি। এখন যে বাড়িতে আছি, এটা ভাড়া বাড়ি। বাবার বন্ধুর বাড়ি। শুনতে পাচ্ছি এটিও নাকি কেনা হবে। বাবা মৃত্যুর সময় তিন বাড়ি তাঁর তিন পুত্র–কন্যাকে দিয়ে যাবেন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
সবচে বড় বাড়ি ধানমণ্ডি তের নম্বরের ‘গ্রীণ কটেজ’ পাবে বাবু। সব পরিবারে একজন আদর্শ সন্তান থাকে, বাবু হচ্ছে সেই আদর্শ সন্তান। এম. এসসি, দিচ্ছে ফিজিক্সে। নির্ঘাৎ ফাস্ট সেকেণ্ড হবে। বাবু হচ্ছে সেই ধরনের ছেলে, যারা ফাস্ট সেকেণ্ড ছাড়াও যে কিছু হওয়া যায় তা জানে না। এরা ছুটির দিনেও দরজা–জানালা বন্ধ করে পড়ে। বাথরুমে যাবার সময়ও বগলে করে পড়ার একটা বই নিয়ে যায়। ঈদের দিন ভােরবেলা বিস্মিত হয়ে বলে—আজ ঈদ ? জানতাম না তাে? কি আশ্চর্য !
বাবু চিলেকোঠার একটা ঘরে থাকে, এবং তাকে বিরক্ত করা নিষেধ। ঘরে বসে। পড়তে পড়তে তার যখন মাথা ধরে যায়, তখন সে বই হাতে ছাদে ঘুরে ঘুরে পড়ে। তখন ছাদে কেউ থাকলে সে বিরক্ত গলায় বলে, এইখানে কি?