পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

রূপা ঘুমুচ্ছেআমি তার খাটের পাশে রাখা টুলে বসে তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকেএই ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সাধ্যও আমার নেইআট মাস আমাদের বিয়ে হয়েছেএই আট মাসে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ খানিকটা হলেও ফিকে হবার কথা

আমার তা হচ্ছে না কারণ এই মেয়েটাকে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি নাপ্রথম দিনে সে আমার কাছে যতটা অচেনা ছিল, আজও ঠিক ততটাই অচেনা আছেকিংবা হয়তো আরাে বেশি অচেনা হয়েছে। 

আমি একটা সিগারেট ধরালামরূপা বলল, আহ, সিগারেট ফেল তােগন্ধে বমি আসছেআমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি কি জেগে ছিলে নাকি

রূপা বিরক্ত গলায় বলল, জেগে থাকব কেন? সিগারেটের ধােয়ায় ঘুম ভেঙেছেদয়া করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করে এসাে। 

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট হাতে বারান্দায় চলে এলামসজনে গাছটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেলগাছটা মরে যাচ্ছেখুব ধীরে ধীরে মরছেএত ধীরে মরছে যে অন্য কেউ তা বুঝতে পারছে নাগাছদেরও কি মৃত্যুযন্ত্রণা আছে? জগদীশচন্দ্র বসু গাছের মৃত্যুযন্ত্রণা নিয়ে কি বলে গেছেন?

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

আমার সিগারেট শেষ হবার আগেই বাবা বারান্দায় এসে পড়লেনআমি নিতান্ত অনিচ্ছায় হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলামবাবা রাগী চোখে আমরা দিকে তাকাচ্ছেনআমি বললাম, কিছু বলবেন? সচরাচর বাবাকে তুমি করে বলিমাঝে মাঝে বিশেষ অবস্থায় আপনি বলি। 

বাবা তুইতুমির মিশ্রণ ব্যবহার করেন, এই তুই এই তুমি। 

বাবা বললেন, তাের সঙ্গে আমার অনেক কথাই আছে। 

এখন বলবেন ?” এ 

বলতে চাইলে বলতে পারেন, আমার হাতে সময় আছে। 

বাবা ইংরেজিতে একটি দীর্ঘ বাক্য বললেন যার বাংলাটা হল, মানুষ হিসেবে তুমি দ্রুত বদলে যাচ্ছতুমি নিজে তা বুঝতে পারছ কিনা তা আমি জানি নাতবে তােমাকে যতই দেখি ততই শঙ্কিত বােধ করিতোমার কি রাতে ঘুম হয়

আমি বললাম, হুঁকোনাে জবাব নাঘুম হয় কি হয় না?” 

শুনে সুখী হলামতাের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তাের ইদানীং ঘুম হচ্ছে নালজিক এলােমেলো হয়ে যাচ্ছেতাের মধ্যে আত্মসম্মান বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেইতাের স্ত্রী এমন অদ্ভুত আচরণ করল, আর তুই তাকিয়ে রইলি, কিছুই বললি না? তাের কি মনে হয় না কিছু বলা উচিত ছিল?

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

রূপার কথা আমার কাছে বেশ লজিকেল মনে হয়েছেলজিকেল মনে হয়েছে

আমার কথাগুলি কেমন মনে হয়েছে? আমার কথাগুলি কি পাগলের চেঁচামেচি বলে মনে হয়েছে

আমি জবাব দেবার আগেই রূপা বারান্দায় এসে বলল, তােমরা এত হৈচৈ শুরু করেছ ! ঘুমুচ্ছিলাম তােবলেই আবার ভেতরে ঢুকে গেলশব্দ করে দরজা বন্ধ করলবাবা হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেনতিনি বােধহয় অনেকদিন এত বিস্মিত হননিবাবার বিস্মিত চোখ দেখে মজা লাগছেমানুষ খুব বেশি বিস্মিত হলে খানিকটা টিকটিকির মতাে হয়ে যায়কারণ তার চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবং কোটর থেকে খানিকটা বের হয়ে আসেআমি কি বাবাকে বলব যে তাঁকে এখন কালাে টিকটিকির মতাে দেখাচ্ছে? বলে আরাে রাগিয়ে দেব? চূড়ান্ত রকম রেগে গেলে বাবা কি করেন তা কেন জানি দেখতে ইচ্ছা করছে। 

মাকে একবার চূড়ান্ত রকম রাগিয়ে দিয়েছিলামএক সময় লক্ষ করলাম, তিনি থরথর করে কাঁপছেন ঠোটের দুই কোণায় ফেনা জমছেতিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, রঞ্জু, তুই যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে, এটা কি তুই জানিস

আমি মাপ্রতি একটু করুণাই বােধ করছিলামতবু বললাম, আমি যে খুব খারাপ ধরনের ছেলে তা আমি জানি, কিন্তু তুমি যে খুব খারাপ ধরনের একজন মা, তাকি তুমি জান ?

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

কি বললি? তুই কি বললি?‘সত্যি কথা বললাম মাআমি খারাপ ধরনের মা?” 

তুমি খারাপ ধরনের মা এবং খারাপ ধরনের স্ত্রীমা হিসেবে তুমি যেমন ব্যর্থ, স্ত্রী হিসেবেও ব্যর্থআমার ধারণা, শিক্ষক হিসেবেও তুমি ব্যর্থস্কুলেরমেয়েরা তােমাকে ডাইনী ডাকেতুমিই এই কথা বলেছিলেতােমার কাছ থেকেই 

এই পর্যায়ে মা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেনআমি সহজস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাকে দেখছিখুব যে খারাপ লাগছে তা না। 

মা বললেন, তাের মাথা ঠিক নেই রঞ্জুতাের মাথা ঠিক নেইআমার ধারণা, কোনাে একদিন তুই খুটুন করবি| আমি মার কথায় হেসে ফেললামমায়ের এক অর্থে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, তিনি ঠিকই 

বলেছেন। 

আজ ছুটির দিনছুটির দিনে সব্যর নানান ধরনের পরিকল্পনা থাকেআমার কোনাে পরিকল্পনা নেইকারণ আমার ছুটি বলে কিছু নেইগত দুবছর ধরেই আমার ছুটিচাকরিবাকরি নেইতার জন্যে চেষ্টাও নেইঢাকা শহরে আমাদের যে দুটি বাড়ি আছে, তার ভাড়াতে আমরা একটা জীবন মােটামুটি সুখে পার করে দিতে পারিএখন যে বাড়িতে আছি, এটা ভাড়া বাড়িবাবার বন্ধুর বাড়িশুনতে পাচ্ছি এটিও নাকি কেনা হবেবাবা মৃত্যুর সময় তিন বাড়ি তাঁর তিন পুত্রকন্যাকে দিয়ে যাবেন

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

সবচে বড় বাড়ি ধানমণ্ডি তের নম্বরের গ্রীণ কটেজপাবে বাবুসব পরিবারে একজন আদর্শ সন্তান থাকে, বাবু হচ্ছে সেই আদর্শ সন্তানএম. এসসি, দিচ্ছে ফিজিক্সেনির্ঘাৎ ফাস্ট সেকেণ্ড হবেবাবু হচ্ছে সেই ধরনের ছেলে, যারা ফাস্ট সেকেণ্ড ছাড়াও যে কিছু হওয়া যায় তা জানে নাএরা ছুটির দিনেও দরজাজানালা বন্ধ করে পড়েবাথরুমে যাবার সময়ও বগলে করে পড়ার একটা বই নিয়ে যায়ঈদের দিন ভােরবেলা বিস্মিত হয়ে বলেআজ ঈদ ? জানতাম না তাে? কি আশ্চর্য

বাবু চিলেকোঠার একটা ঘরে থাকে, এবং তাকে বিরক্ত করা নিষেধঘরে বসেপড়তে পড়তে তার যখন মাথা ধরে যায়, তখন সে বই হাতে ছাদে ঘুরে ঘুরে পড়েতখন ছাদে কেউ থাকলে সে বিরক্ত গলায় বলে, এইখানে কি

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *