পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি বাবুর ঘরে চলে গেলামবাবু বই হাতে বিছানায় শুয়ে ছিলসে বিরক্তগলায় বলল, কি চাও দাদা

আমি হাই তুলে বললাম, তাের কাছে একটা পরামর্শের জন্যে এসেছিসে বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে কি পরামর্শ তাের কাছে কি পরামর্শের জন্যে আসা যায় না? সারা জীবন ফাস্ট সেকেণ্ডপাখি আমার একলা পাখিহয়েছিসতােদের ব্রেইন হচ্ছে কম্পিউটারইজডসমস্যার খটাখট সমাধান করে ফেলবি। 

বাবু আগের চেয়েও বিরক্ত গলায় বলল, দাদা, মানুষের ব্রেইন কম্পিউটারের চেয়ে কোটিগুণ পাওয়ারফুলকম্পিউটার মানুষের তৈরি এটা ভুলে যাও কেন

সবার ব্রেইন তাে আর পাওয়ারফুল নাকিছু কিছু ব্ৰহন আছে ইটের টুকরার মতােসলিড রক। 

তােমার সমস্যাটা কি দাদা অল্প কথায় বলে চলে যাওআমি জটিল একটা বিষয় পড়ছি নন নিউটোনিয়ান ফ্লো প্যাটার্ন ...। 

আমি বসতে বসতে বললাম, একটা খুন করতে চাচ্ছি, বুঝলি পারফেক্ট না মর্ভিারকিভাবে করব বুঝতে পারছি না। 

ঠাট্টা করছ নাকি?নাঠাট্টা করব কেনতুই ভেবেটেবে একটা কায়দা বের কর তােকাকে খুন করবে?আন্দাজ করতােরূপা ভাবীকে? ঠিক ধরেছিসরূপা ভাবীকে খুন করবে কেন?” 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, এত মানুষ থাকতে তােরই বা রূপার কথা মনে হল কেন?” 

বাবু থতমত খেয়ে গেলআমি উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভালমতাে চিন্তা ভাবনা করে তারপর আমাকে বলবিহুট করে কিছু বলবি নাখুনটা হবে টেক্সট বুক মার্ডারকোনাে রকম ভুলচুক থাকবে না। 

বাবু বিড়বিড় করে বলল, তােমার মাথা আগেও খারাপ ছিল এখন আরাে বেশি 

খারাপ হয়েছেতােমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। দাদা, তুমি কি ড্রাগট্রাগ কিছু খাও

 আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, খাই না, তবে খেয়ে দেখব বলে ভাবছিইন্টারেস্টিং ড্রাগ কি আছে বল তাে। 

আমাদের পরিবারের আদর্শ মানববাবু বিরক্ত মুখে বই পড়তে শুরু করেছে নন নিউটোনিয়ান ফ্লো মেকানিক্সঅতি জটিল বিষয়, সে নিশ্চয়ই জলের মতাে বুঝতে পারছেতবে সহজ জিনিস সে কিছু বােঝে না বলেই আমার বিশ্বাসবাবু ভুরু কুঁচকে বলল, দাদা, এখন যাও তোমূর্তির মতাে বসে আছি, আমার খুব বিরক্ত লাগছে। 

আমি উঠে পড়লামআদর্শ মানবকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করা ঠিক নাসিড়ি দিয়ে নামার সময় দেখি, লাবণ্যও নামছেচুল বেঁধে, মুখে পাউডার দিয়ে একেবারে পরীদের ছানাপায়ে লাল ভেলভেটের জুতাআমি বললাম, এমন সেজেছিস কেন রে লাবণ্য

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

লাবণ্য হাসিমুখে বলল, বাবা আমাকে দেখতে এসেছেআচ্ছাখুব আনন্দ হচ্ছে ? হচ্ছে। 

একা একা বাবার কাছে যেতে পারবি, নাকি আমাকে সঙ্গে যেতে হবে? একা যেতে পারব। 

লাবণ্য রেলিং ধরে খুব সাবধানে নামছেএই সাবধানতা তার নতুন জুতার জন্যে। 

আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছিলাবণ্যর বাবার গাড়ি এখান থেকে দেখা যাচ্ছেগাড়িতে রােগামতাে একটি মেয়ে বসে আছেএই বোধহয় ভদ্রলােকের নতুন স্ত্রীমেয়েটা মাথায় ঘােমটা দিয়ে বৌ বৌ ভাব নিয়ে এসেছে। 

আমি আবার আমার ঘরে ঢুকলামআমাদের বিছানায় মুনিয়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছেফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেমুনিয়ার পিঠে হাত দিয়ে বসে আছে রূপাআমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রূপা তীব্র স্বরে বলল, প্লীজ লিভ আস এলােন। 

এই ইংরেজি বাক্যটির সুন্দর বাংলা কি হবে দয়া করে আমাদের একা থাকতে দাওনাকি পায়ে পড়ি আমাদের একা থাকতে দাও

রূপার সঙ্গে কি করে পরিচয় হল সেটা বলিআমার ছেলেবেলার বন্ধু সফিকভুল বললাম, বন্ধু বলে আমার কেউ নেইযাদের আমি খানিকটা সহ্য করতে পারি তাদেরই বন্ধু বলার চেষ্টা করিস্কুলে এবং কলেজে যাদের সঙ্গে আমি পড়েছি তাদের মধ্যে একমাত্র সফিককেই খানিকটা সহ্য করতে পারিতাও সব সময় নয়, মাঝে মাঝেসে গত বছর ডাক্তারি পাশ করেছেএখনাে বেকার

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

ডাক্তারও যে বেকার থাকে তা সফিকের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে কোনােদিনও জানতাম নাতাকে ইদানীং দেখায় একজন লেখকের মতোতার চুল লম্বাগায়ে ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে টায়ারের সােল লাগানাে স্যাণ্ডেলতাকেসারাক্ষণই খুব উত্তেজিত দেখা যায়এক জায়গায় বসে একটা দীর্ঘ বাক্য সে বলতে পারে না, লাফ দিয়ে উঠে পড়েআবার বসে। 

একদিন সফিক এসে বলল, চট করে শার্টটা গায়ে দে তাে কুইকআমি বললাম, কেন? পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটিকে দেখবিহেলেন অব ট্রয় এই মেয়ের কাছে মাতারি শ্ৰেণীর। 

আমি চুপ করে রইলামহেলেন অব ট্রয় যে মেয়ের তুলনায় মাতরি তাকে দেখার ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিককিন্তু কেন জানি ইচ্ছা করছে না। 

দেরি করিস নাচট করে কাপড় পরনা। 

না মানে? আমি মেয়েকে দেখার জন্য সপ্তাহে একবার করে যেতে পারি, আর তুই একদিন যেতে পারবি না?” 

তুই প্রতি সপ্তাহে যাস

অফকোর্স যাইইন্সপাইরেশনের জন্যে যাইআমি লেখালেখির লাইন ধরব বলে ঠিক করেছি উপন্যাসের ওয়ান ফোর্থ লিখেও ফেলেছিরূপাকে পড়ে শােনালামরূপা বলল, ব্রিলিয়ান্ট

 রূপাটা কে? রূপবতী?” 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

 চল যাইআজও খানিকটা পড়বতুই শুনতে পারবি* আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, উপন্যাস পড়তে বা শুনতে আমার ভাল লাগে না। 

না লাগলেও চলএকটা রিকোয়েস্ট রাখএকা যেতে ইচ্ছা করছে না। 

পুরানাে ঢাকার যে বাড়ির সামনে নিয়ে সফিক আমাকে দাড়া করালাে তার নিতান্তই ভগ্নদশারাজকন্যারা এ জাতীয় বাড়িতে থাকে নাদোতলা বাড়িএকতলার সব কটা দরজাজানালা বন্ধুএকতলাটা মনে হয় বসতবাড়ি না, দোকানপাটএকটা সাইনবাের্ড ঝুলছে নিউ হেকিমী দাওয়াখানারেলিংঘেরা উঠানে পিয়াজুর দোকানপিয়াজু ভাজা হচ্ছেদোতলায় উঠার সিঁড়ি লােহার

সেই সিড়ি যে এতদিনেও ভেঙ্গে পড়ে যায়নি কেন কে জানেশুধু সিড়ি না, পুরো বাড়িটাই ছােটখাট ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষা করছেসিড়ির গোড়ায় কলিং বেল আছেসফিক অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল টেপাটিপি করতে লাগলবেল বাজছে কিনা বােঝা যাচ্ছে নাআমি কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি নাসফিক হাসিমুখে বলল, অনেকক্ষণ ধরে বেল টেপাটিপি করতে হয়। 

বেল বাজাতে বাজাতে সফিক যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন দশ বছরের একটি ছেলে নামলযাকে দেখেই মনে হল অসুস্থচোখমুখ ফোলা। 

কারে চান ?রূপা আছে? আমরা রূপার বন্ধু। 

নাম কি ? আমার নাম বললেই হবেগিয়ে বল সফিক। 

আমরা দোতলায় উঠলাম নাএকতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলামসফিক বলল, একতলায় রূপার নিজের একটা ড্রয়িং রুম আছেখুব সুন্দর করে সাজানো

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *