আমি বাবুর ঘরে চলে গেলাম। বাবু বই হাতে বিছানায় শুয়ে ছিল। সে বিরক্ত। গলায় বলল, কি চাও দাদা?
আমি হাই তুলে বললাম, তাের কাছে একটা পরামর্শের জন্যে এসেছি। সে বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে কি পরামর্শ ।।। ‘তাের কাছে কি পরামর্শের জন্যে আসা যায় না? সারা জীবন ফাস্ট সেকেণ্ড।হয়েছিস—তােদের ব্রেইন হচ্ছে কম্পিউটারইজড। সমস্যার খটাখট সমাধান করে । ফেলবি।
বাবু আগের চেয়েও বিরক্ত গলায় বলল, দাদা, মানুষের ব্রেইন কম্পিউটারের চেয়ে কোটিগুণ পাওয়ারফুল। কম্পিউটার মানুষের তৈরি এটা ভুলে যাও কেন?
‘সবার ব্রেইন তাে আর পাওয়ারফুল না। কিছু কিছু ব্ৰহন আছে ইটের টুকরার মতাে। সলিড রক।
‘তােমার সমস্যাটা কি দাদা অল্প কথায় বলে চলে যাও। আমি জটিল একটা বিষয় পড়ছি – নন নিউটোনিয়ান ফ্লো প্যাটার্ন ...।
‘আমি বসতে বসতে বললাম, একটা খুন করতে চাচ্ছি, বুঝলি — পারফেক্ট না মর্ভিার। কিভাবে করব বুঝতে পারছি না।
‘ঠাট্টা করছ নাকি?” ‘না। ঠাট্টা করব কেন। তুই ভেবেটেবে একটা কায়দা বের কর তাে। ” ‘কাকে খুন করবে?” ‘আন্দাজ করতাে। ‘রূপা ভাবীকে? ‘ঠিক ধরেছিস। ‘রূপা ভাবীকে খুন করবে কেন?”
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
‘আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, এত মানুষ থাকতে তােরই বা রূপার কথা মনে হল কেন?”
বাবু থতমত খেয়ে গেল। আমি উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভালমতাে চিন্তা ভাবনা করে তারপর আমাকে বলবি। হুট করে কিছু বলবি না। খুনটা হবে টেক্সট বুক মার্ডার। কোনাে রকম ভুলচুক থাকবে না।
বাবু বিড়বিড় করে বলল, তােমার মাথা আগেও খারাপ ছিল এখন আরাে বেশি
খারাপ হয়েছে। তােমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। দাদা, তুমি কি ড্রাগ–ট্রাগ কিছু খাও?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, খাই না, তবে খেয়ে দেখব বলে ভাবছি। ইন্টারেস্টিং ড্রাগ কি আছে বল তাে।
আমাদের পরিবারের ‘আদর্শ মানব‘ বাবু বিরক্ত মুখে বই পড়তে শুরু করেছে – নন নিউটোনিয়ান ফ্লো মেকানিক্স। অতি জটিল বিষয়, সে নিশ্চয়ই জলের মতাে বুঝতে পারছে। তবে সহজ জিনিস সে কিছু বােঝে না বলেই আমার বিশ্বাস। বাবু ভুরু কুঁচকে বলল, দাদা, এখন যাও তো। মূর্তির মতাে বসে আছি, আমার খুব বিরক্ত লাগছে।
আমি উঠে পড়লাম। আদর্শ মানবকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করা ঠিক না। সিড়ি দিয়ে নামার সময় দেখি, লাবণ্যও নামছে। চুল বেঁধে, মুখে পাউডার দিয়ে একেবারে পরীদের ছানা। পায়ে লাল ভেলভেটের জুতা। আমি বললাম, এমন সেজেছিস কেন রে লাবণ্য?
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
লাবণ্য হাসিমুখে বলল, বাবা আমাকে দেখতে এসেছে। ‘ও আচ্ছা। খুব আনন্দ হচ্ছে ? ‘হচ্ছে।
একা একা বাবার কাছে যেতে পারবি, নাকি আমাকে সঙ্গে যেতে হবে? ‘একা যেতে পারব।
লাবণ্য রেলিং ধরে খুব সাবধানে নামছে। এই সাবধানতা তার নতুন জুতার জন্যে।
আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। লাবণ্যর বাবার গাড়ি এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে রােগামতাে একটি মেয়ে বসে আছে। এই বোধহয় ভদ্রলােকের নতুন স্ত্রী। মেয়েটা মাথায় ঘােমটা দিয়ে বৌ বৌ ভাব নিয়ে এসেছে।
আমি আবার আমার ঘরে ঢুকলাম। আমাদের বিছানায় মুনিয়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুনিয়ার পিঠে হাত দিয়ে বসে আছে রূপা। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রূপা তীব্র স্বরে বলল, “প্লীজ লিভ আস এলােন।
এই ইংরেজি বাক্যটির সুন্দর বাংলা কি হবে – দয়া করে আমাদের একা থাকতে দাও’ – নাকি পায়ে পড়ি আমাদের একা থাকতে দাও?
রূপার সঙ্গে কি করে পরিচয় হল সেটা বলি। আমার ছেলেবেলার বন্ধু সফিক। ভুল বললাম, বন্ধু বলে আমার কেউ নেই। যাদের আমি খানিকটা সহ্য করতে পারি তাদেরই বন্ধু বলার চেষ্টা করি। স্কুলে এবং কলেজে যাদের সঙ্গে আমি পড়েছি তাদের মধ্যে একমাত্র সফিককেই খানিকটা সহ্য করতে পারি। তাও সব সময় নয়, মাঝে মাঝে। সে গত বছর ডাক্তারি পাশ করেছে। এখনাে বেকার।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
ডাক্তারও যে বেকার থাকে তা সফিকের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে কোনােদিনও জানতাম না। তাকে ইদানীং দেখায় একজন লেখকের মতো। তার চুল লম্বা। গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে টায়ারের সােল লাগানাে স্যাণ্ডেল। তাকে। সারাক্ষণই খুব উত্তেজিত দেখা যায়। এক জায়গায় বসে একটা দীর্ঘ বাক্য সে বলতে পারে না, লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। আবার বসে।
একদিন সফিক এসে বলল, চট করে শার্টটা গায়ে দে তাে – কুইক।। আমি বললাম, কেন? ‘পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটিকে দেখবি। হেলেন অব ট্রয় এই মেয়ের কাছে মাতারি শ্ৰেণীর।
আমি চুপ করে রইলাম। হেলেন অব ট্রয় যে মেয়ের তুলনায় মাতরি তাকে দেখার ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছা করছে না।
‘দেরি করিস না। চট করে কাপড় পর। ‘না।
“না মানে? আমি ঐ মেয়েকে দেখার জন্য সপ্তাহে একবার করে যেতে পারি, আর তুই একদিন যেতে পারবি না?”
‘তুই প্রতি সপ্তাহে যাস?
‘অফকোর্স যাই। ইন্সপাইরেশনের জন্যে যাই। আমি লেখালেখির লাইন ধরব বলে ঠিক করেছি । উপন্যাসের ওয়ান ফোর্থ লিখেও ফেলেছি। রূপাকে পড়ে শােনালাম। রূপা বলল, ব্রিলিয়ান্ট!
‘রূপাটা কে? ঐ রূপবতী?”
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
চল যাই। আজও খানিকটা পড়ব—তুই শুনতে পারবি।। * আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, উপন্যাস পড়তে বা শুনতে আমার ভাল লাগে না।
‘না লাগলেও চল। একটা রিকোয়েস্ট রাখ। একা যেতে ইচ্ছা করছে না।
পুরানাে ঢাকার যে বাড়ির সামনে নিয়ে সফিক আমাকে দাড়া করালাে তার নিতান্তই ভগ্নদশা। রাজকন্যারা এ জাতীয় বাড়িতে থাকে না। দোতলা বাড়ি। একতলার সব কটা দরজা–জানালা বন্ধু। একতলাটা মনে হয় বসতবাড়ি না, দোকানপাট। একটা সাইনবাের্ড ঝুলছে – নিউ হেকিমী দাওয়াখানা। রেলিংঘেরা উঠানে পিয়াজুর দোকান। পিয়াজু ভাজা হচ্ছে। দোতলায় উঠার সিঁড়ি লােহার।
সেই সিড়ি যে এতদিনেও ভেঙ্গে পড়ে যায়নি কেন কে জানে। শুধু সিড়ি না, পুরো বাড়িটাই ছােটখাট ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষা করছে। সিড়ির গোড়ায় কলিং বেল আছে। সফিক অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল টেপাটিপি করতে লাগল। বেল বাজছে কি–না বােঝা যাচ্ছে না। আমি কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। সফিক হাসিমুখে বলল, অনেকক্ষণ ধরে বেল টেপাটিপি করতে হয়।
বেল বাজাতে বাজাতে সফিক যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল তখন ন‘দশ বছরের একটি ছেলে নামল। যাকে দেখেই মনে হল অসুস্থ। চোখ–মুখ ফোলা।
কারে চান ?” ‘রূপা আছে? আমরা রূপার বন্ধু।
নাম কি ? ‘আমার নাম বললেই হবে। গিয়ে বল সফিক।
আমরা দোতলায় উঠলাম না। একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সফিক বলল, একতলায় রূপার নিজের একটা ড্রয়িং রুম আছে। খুব সুন্দর করে সাজানো।