‘পুলিশে খবর দেয়া হয়েছিল। পুলিশ ছেলের নাম শুনে পিছিয়ে গেছে। পুলিশ বলছে, এখনাে তাে কিছু ঘটেনি। ঘটলে দেখা যাবে। শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তাে আমরা এ্যাকশন নিতে পারি না। এখন আপনি ভরসা।
আপনার কি করে ধারণা হল অমি অসহায় তরুণীদের উদ্ধারের ব্রত নিয়েছি?
‘তরুণীর নাম শুনলে আপনি খুব আগ্রহ করে এই ব্রত নেবেন বলে আমার ধারণা।
‘কি নাম?
‘তার নাম রূপা।
আমি প্রথমে ভাবলাম এটা নিশ্চয়ই রূপার কঠিন কোনাে রসিকতার একটি।
তারপর মনে হল রূপা তাে কখনাে রসিকতা করে না। অন্যের রসিকতায় খিলখিল করে হাসে — নিজে তাে কখনাে করে না। রূপা তরল গলায় বলল, মনে হচ্ছে কথা
শুনে পাথর হয়ে গেছেন?
‘বুঝতে চেষ্টা করছি।‘
‘শুনুন, খুব মন দিয়ে শুনুন। আমার তালিকায় তিনটি নাম আছে। আপনি হচ্ছেন দু‘নম্বর। প্রথমজনকে টেলিফোনে পাইনি, ওদের টেলিফোন নেই। কাজেই আপনাকে টেলিফোন করলাম। আপনার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যে আপনাকে পেয়ে গেলাম। আপনি যদি রাজি না থাকেন, স্পষ্ট গলায় বলে দিন। আমি তৃতীয়জনকে টেলিফোন করবো।
ঠাট্টা করছেন ? ‘না, ঠাট্টা করছি না। ‘প্রথমজনের নাম কি ?
‘প্রথমজনকে আপনি চেনেন না। প্রথমজনের নাম জেনে কোনো লাভ নেই। তৃতীয়জনকে চেনেন, কিন্তু তার নামটা বলতে চাচ্ছি না। আপনাকে চিন্তা করার জন্য আধঘণ্টা সময় দিলাম। যদি রাজি থাকেন তাহলে আধঘণ্টা পর আমাদের বসায় চলে আসবেন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
‘বিয়ে কি আপনাদের বাসায় হবে?”
‘তা কি করে হয় ! আমাদের বাসার চারদিকে মস্তান ঘুরঘুর করছে। সন্দেহ হলেই ককটেল ফোটাবে। ব্রাস ফায়ার করবে।
‘সত্যি বলছেন?”
‘এক রত্তি বানিয়ে বলিনি। আপনি যদি রাজি থাকেন চলে আসুন। আমি ইতিমধ্যে পুলিশকে টেলিফোন করছি। পুলিশের এক এআইজি আছেন বাবার বন্ধু। তাকে বলব – চাচা, আমাদের বিয়ে দিয়ে দিন।
‘আপনার বাবা? উনি কোথায়? ‘বাবা ইংল্যাণ্ডে। তার সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে। “উনি কি রাজি ?”
রূপা হাসতে হাসতে বলল, আমি তাে তাঁর কোনাে মতামত চাইনি। ঘটনা বলেছি – এখন বলুন আপনি কি রাজি ?
‘আমি রাজি আছি।‘ ‘এতাে চট করে রাজি হবেন না। আধঘণ্টা সময় নিন। রাখি, কেমন?
পুলিশের উপস্থিতিতে বিয়ে হল রূপাদের চাচার বাসায়। বিয়ের পর পুলিশের।
জীপে করেই আমরা বেরুলাম।
রূপা বলল, এখন থেকে তােমাকে তুমি করে বলব। শােন, আমার কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে হবে, টুথব্রাশ, চিরুনি, ঘরে পরার শাড়ি । তােমার কাছে কি টাকা আছে?
‘অসুবিধা নেই। আমার কাছে আছে। নতুন স্বামীরা স্ত্রীর টাকায় কিছু কিনতে চায় না বলেই জানতে চেয়েছি।”
‘আমাকে নিয়ে তুমি সারাসরি তােমার বাসায় তুলবে?”
‘অসুবিধা হবে না তাে? চিন্তা করে দেখ। ‘অসুবিধা হবে না।‘
‘তােমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে অসুবিধা হবে। তুমি বরং টেলিফোনে আগে কথা বলে নাও। ওরা খানিকটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাক।
‘টেলিফোন করার দরকার নেই।
রূপাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলাম রাত আটটার দিকে। রূপার বাবার বন্ধু এআইজি খালেকুর রহমান পুলিশের জীপে আমাদের নামিয়ে দিলেন।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
রাত সাড়ে নটায় বাবার একটা মাইল্ড স্ট্রোক হল। আমার বাসর রাত কাটল সােহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে।
আমি একা না, বাবুও সঙ্গে হাঁটছে। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। ঘন ঘন সিগারেট ধরাচ্ছে। বড় ভাই হিসেবে সে আমাকে খানিকটা সমীহ করত, সামনে সিগারেট খেত না। আজ সে সব কিছুই বােধহয় মনে নেই। তবে আমার ধারণা, বাবাকে নিয়ে সে যতটা না চিন্তিত তার চেয়েও বেশি চিন্তিত যে আজ রাতটা নষ্ট হল। রাতটা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু সে নিশ্চয়ই পড়ে ফেলত নন নিউটোনিয়ান ফ্লো না কি যেন বলে ঐ সব।
‘দাদা।
‘ই।‘
‘বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল মনে হচ্ছে। ‘পড়াশােনার ক্ষতির কথা বলছিস?”
‘সেই ঝামেলা তাে আছেই। অসুখ–বিসুখ, হাসপাতাল–বাসা ছােটাছুটি। তার উপর তুমি আবার হুট করে বিয়ে করে ফেললে। ঐ নিয়ে বাড়িতেও নিশ্চয় টেনশন থাকবে।
‘তা কিছুটা থাকবে।
বাবু সিগারেট ধারতে ধরাতে বলল, তুমি এই ঝামেলাটা আমার পরীক্ষার পরে করলেও পারতে। মারাত্মক একটা ডিসটার্বেন্স হবে পড়াশােনায়। ভাবী নিশ্চয়ই ছাদে ঘুরঘুর করবে। মেয়েদের একটা টেনডেসিই থাকে ছাদে যাওয়া। কারণে
অকারণে ছাদে যাবে।
‘আমি নিষেধ করে দেব।
‘ইমমেডিয়েটলি কিছু বলার দরকার নেই। কয়েকটা দিন যাক। বাবার অবস্থা তােমার কি রকম মনে হচ্ছে ?
এ যাত্রা টিকে যাবেন বলে মনে হয়।
বাবু শুকনাে মুখে বলল, সব কটা ঝামেলা পরীক্ষার আগে শুরু হল। ধর ভাল মন্দ কিছু যদি হয়, তাহলে এক মাস আর বই নিয়ে বসা যাবে না। আত্মীয়স্বজন... বিশ্রী অবস্থা হবে ... আজকের পুরাে রাতটা নষ্ট হল। কাল দিনটাও নষ্ট হবে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
‘কাল দিনটা নষ্ট হবে কেন?”
‘রাত দুটা থেকে ভাের সাড়ে সাতটা – এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না ঘুমালে দিনে পড়তে পারি না। মাথা জাম হয়ে থাকে। এখন বাজে তিনটা। এক ঘণ্টা তাে চলেই গেল। বিরাট সমস্যা।
‘সমস্যা তাে বটেই।
‘আমরা এখন কি করব? বাকি রাত হাসপাতালের বারান্দাতেই হাঁটাহাঁটি করে কাটাব?”
বাবু বিরক্ত মুখে বলল, আমরা হাঁটাহাঁটি করে তাে বাবাকে কোন ভাবে হেল্প করতে পারছি না। লাভটা কি হচ্ছে?
‘তুই কি চলে যেতে চাচ্ছিস?”
‘আমি চলে গিয়েই বা করব কি? বাসায় ফিরতে ফিরতে ধর রাত সাড়ে তিনটা বেজে যাবে ... তারপর কি আর রেস্ট নেবার সময় থাকবে ?
আমি বললাম, চল চা খেয়ে আসি। হাসপাতালের আশেপাশে চায়ের দোকান সারা রাত খােলা থাকে। বাবু বিরস মুখে বলল, চল।। | চা খেতে খেতে বাবু বলল, মুনিয়া বলছিল, তুমি যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছ সে নাকি দারুণ রূপবতী।।
‘তুই এখনাে দেখিস নি ?”